পোস্টস

গল্প

তুমি ছাড়া শূন্য লাগে

২৮ মার্চ ২০২৪

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

“কতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিলা?”- প্রশ্নটার মধ্যে তেমন একটা আবেদন নাই। নাই প্রশ্নের উত্তর জানার তাগিদও। করতে হবে বইলা করছে, এটা আবিদও জানে, আমিও। উত্তর দেওয়ার তাগিদ আমারও নাই। দুই ঘণ্টা ১৭ মিনিট পর আবিদ গন্তব্যে পৌঁছাইছে, এটাই এখন মুখ্য বিষয়। পূরবী সিনেমা হলের উল্টা পাশে মিল্লাত ক্যাম্পের দিকে যাওয়ার রাস্তাটায় দুই ঘণ্টার বেশি দাঁড়াইয়া থাকতে দুই মিনিট আগেও আমার যেমন মেজাজ খারাপ হইতেছিল, এখন সেটা নাই হইয়া গেছে। ঠোঁটের কোনায় বেনসন নিয়া মোবাইল গুঁতাইতেছে আবিদ। আগের প্রশ্নের উত্তরের তোয়াক্কা না কইরাই দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো- “তাইলে? সুইসাইড করার প্ল্যান কি আছে এখনো, নাকি বাদ দিছো?” বেহুদা প্রশ্ন শুনতে ভাল লাগতেছে না। ওর পাশে চুপচাপ হাঁটতে যেই শান্তি, সেটা দুনিয়ার অন্যকিছুতে পাই না বইলাই তো এত যন্ত্রণা! আরে শালা! বেশ সুন্দর একটা লাইন হইছে তো! মান্না দে’র “ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে” লাইনটার কাছাকাছি হইছে ব্যাপারটা! ওই গানের লাইনটা মাথায় বাজতেই ফিক কইরা হাইসা দিলাম। এই ছেলের চোখ থেইকা কোনোকিছুই এড়ায় না। অন্যদিকে তাকাইয়াও সে আমার হাসি ঠিকই দেখছে। অতঃপর হাসির কারণ জানতে সে তৃতীয় প্রশ্ন করলো- “কী মনে কইরা হাসতেছো?” হাসির কারণ না জানাইয়া উল্টা প্রশ্ন করলাম, এইখানে সিগারেট খাওয়া যাবে না? ঠোঁটের কোনার সিগারেটটা দুই আঙ্গুলের টোকা দিয়া ছুঁইড়া ফেইলা সে জবাব দিলো- “তোমার চ্যাটের খুশি। মন চাইলে দুনিয়ার যেকোনো জায়গাতেই খাইতে পারবা।“

গাঞ্জার ডিলার আসতে দেরি করতেছে। বিকাল পাঁচটা বাজে। পুরাপুরি পাঁচটা বাজে নাই, চার মিনিট বাকি। হাঁটতে হাঁটতে হীড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের গলিতে ঢুইকা বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখতেছি। ১০-১১ বছরের ৫টা ছেলে ক্রিকেট খেলার চেয়ে ঝগড়া করতেছে বেশি। ওদের মনে হয় বল মারার সীমানা নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে গেলে ওইটারে ওরা আউট বইলা বিবেচনা করে! ক্যাচ ধরে নাই, রান আউট হয় না, স্টাম্পড হয় নাই, তবুও আউট! যে বল করতেছিল এবং যেই তিনজন ছেলে ফিল্ডিংয়ে ছিল, তারা আউট আউট বইলা চিল্লাইতেছে। ব্যাটিং করতে থাকা ছেলেটা এই আউট মানবে না। সেও আউটের সীমানা আর তার বল মারার দূরত্বের পরিমাপ কইরা ততোধিক জোরে চিল্লাইতেছে। তবে তিনজন ছেলের সামনে তার একলার দাবি টিকবে বইলা মনে হইতেছে না। মেট্রোরেলের কাজ চলতেছে মেইনরোডে। মিরপুরে আসা একটা আজাব হইয়া দাঁড়াইছে। তবুও মাঝেমধ্যে আমার এইখানে আসতে হয় গাঞ্জা নেওয়ার জন্য। গাঞ্জার গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না, খাওয়া তো দূরের কথা! একটা মানুষ, যে গাঞ্জা খায় না, সে মাসে এক-দুইবার এখানে আইসা দুই-আড়াই ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকে ডিলারের অপেক্ষায়- এইটা যে কারোর কাছেই একটা প্রশ্নবোধক ব্যাপার! আবারও মান্না দে’র গানের লাইন মাথায় ঘুরতেছে- “পথের কাঁটায় পায় রক্ত না ঝরালে/কী করে এখানে তুমি আসবে/ক'ফোটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে...।”

গাঞ্জা জোগাড় করার মিশন কমপ্লিট। এর পরের গন্তব্য সম্পর্কে এখনো আমি কিছু জানি না। আবিদের সঙ্গে কোনোকিছু প্ল্যান কইরা ঘটে না। এই কারণে কোনোকিছু জানতে চাওয়াও বৃথা। আমি প্রশ্ন করলে সে উত্তর না দিয়া সিগারেট ফুঁকতে থাকবে। মেজাজ খুব ভালো থাকলে কোনো একটা গান ইউটিউব থেইকা বাইর কইরা জানতে চাইবে- “এটা শুনছো? শুইনো। ভালো আছে।“ আবিদ আমার ইউনিভার্সিটির জুনিয়র। এই পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয়- যখন আমি মৃতপ্রায়, এই ছেলেটা আমারে ফিল দিছে- আই’ম স্টিল এলাইভ! আই ক্যান লিভ মাই য়ৌন লাইফ। আই ক্যান স্টার্ট এগেইন! সেপারেশনের পর জাগতিক সকল কিছু যখন আমার অসহ্য লাগা শুরু হইছিল, আমি তখন শুধু কাজ নিয়াই ব্যস্ত থাকতাম। অফিস আর বাসায় আসা-যাওয়ার বাইরে আর কোনো জগৎ ছিল না। আমিও যে একটা মানুষ, আমারও যে একটা আলাদা জগৎ আছে, এটা ভুইলাই যাইতেছিলাম। আমার ওই মহাশূন্যে আইসা আবিদ যে একটা বিরাট টোকা দেবে, এইটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। ওরে আমি অ্যাজ অ্যা জুনিয়রই আদর করতাম! ‘আদর’ শব্দটা মনে পইড়তেই আবার ফিক কইরা হাসি চলে আসছে। আবিদরে আমি জুনিয়র হিসেবে আদর করতাম শুইনা আমাদের বন্ধু কৌশিক প্রায়ই বলে, “তুই ওরে কেমনে আদর করছিলি? প্র্যাক্টিক্যালি ছিল ব্যাপারটা?” ওর এই কথা শুনলে আমার মতো ট্যাবুহীন মানুষেরও বারবার হাইসা দিতে হয়।

আবিদ একটা রিকশা ডাক দিলো। যথারীতি রিকশাওয়ালারে মুখ দিয়া কিছু না বইলা সোজা হাত দেখাইলো। রিকশাওয়ালাও কিছু জানতে চাইলো না। আমারে ওঠার জন্যও মুখে কিছু না বইলা সাইড দিয়া দাঁড়াইয়া থাকলো। বুঝলাম যে, রিকশায় ওঠতে হবে। কই যাইতেছি, এখনো জানি না। আবিদের মুড ভালো। রিকশায় লাফ দিয়া ওইঠাই গুন গুন কইরা গান শুরু করলো- “এই নিশাচর আমায় ভেবো না সুখের মোহনা/ দেখবে আমাদের ভালোবাসা, হয়ে গেছে কখন যেন/প.........দ্ম পাতার জল...”। আবিদের গানের কণ্ঠ খুবই বেসুরা। সুদর্শন যুবকদের কণ্ঠ অধিকাংশ সময়ই বিশ্রী হয়। একমাত্র ঘুমকাতুরে কণ্ঠস্বর ছাড়া, আবিদেরও তাই। আমি বহু বহু দিন আবিদরে ঘুম থেইকা জাগাইয়া দিতে ফোন দিছি শুধু একবার ওর ওই সময়ের কণ্ঠ শোনার জন্য। এত আদুরে, এত আহ্লাদী, এত মায়া থাকে কণ্ঠটায়! আবিদের গুন গুন তখনও চলতেছে- "বেদনা সিক্ত অশান্ত এই মন/খুঁজে ফেরে মেটায় প্রয়োজন/যতদূর জানে এ ব্যাকুল হৃদয়/নীল বিষের পেয়ালা মনের বাঁধন/দেখবে আমাদের ভালোবাসা, হয়ে গেছে কখন যেন...।“

রিকশা দশ নম্বর গোল চক্করের আগে আইসা থামলো। রিকশাওয়ালারে কোনো বাক্য বলা ছাড়াই পকেট থেইকা মোচড়ানো-কুঁচকানো ৫০ টাকার একটা নোট বাইর কইরা দিলো আবিদ। তারপর আবার লাফ দিয়া নামলো রিকশা থেইকা। আমিও নামলাম। লম্বা লম্বা পা দুইটা ফেইলা হেইলা দুইলা সে হাঁটতেছে। আমিও তার পাশে পাশে হাঁটতেছি। মাঝে মাঝে সে একটু আগাইয়া গেলে, আবার দাঁড়াইয়া আমার জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে। এইগুলার কিছুই সে আমার দিকে তাকাইয়া করে না। অন্যদিকে তাকাইয়াই তার এসব কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। আজকে সম্ভবত আবিদের অন্য ডিলাররা পুলিশের চাপে আছে। অন্য কিছু পাইলে সে গাঞ্জার খোঁজে আসতো না। গাঞ্জা তার মেইন প্রায়োরিটি না। সাবস্টিটিউট। কিছু না পাইলে তার গাঞ্জার সান্নিধ্যে আসতে হয়। এইগুলারে আবিদ বলে মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করা। মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি না হইলে ওর বাঁচার আগ্রহ কমতে থাকে। হয় নেশা, নয় নারী- এই দুই আলোড়নের ভেতর তারে থাকতে হয়। ভুল বললাম, নারীও তো আসলে নেশাই! আমার মাথায় মান্না দে’র গানটা হঠাৎ হঠাৎ চ্যাগাইয়া ওঠে আর আমি একলা একলাই মুচকি হাসতে থাকি। আবিদ প্রতিবারই সেটা বুঝতেছে। এইবার আমার দিকে সরাসরি তাকাইয়া ‘কী হইছে’ সূচক একটা প্রশ্ন রাইখা চোখ নাচাইলো। আমিও মাথাটা একবার ডানে, একবার বামে, তারপর আবার ডানে ঘুরাইয়া শব্দহীন উত্তর দিলাম- কিছু না! রাস্তা পার হইয়া আরেকটা রিকশা থামাইয়া আবিদ আমারে সাইড দিলো। রিকশায় ওইঠা ফোন বাজার শব্দ পাইলাম। জিন্সের পকেট থেইকা ফোন বাইর কইরা দেখি-কৌশিক! ফোনের স্ক্রিনটা আবিদের দিকে ধরতেই মাথা নাড়াইয়া ফোন না ধরার ইশারা দিলো। বুঝলাম, এই সময় সে অন্য কোনো ডিস্টার্বেন্স চাইতেছে না।

আবিদের সবকিছুই মুডের উপর নির্ভর করে। মাঝেমধ্যে সে আমার সঙ্গে থাকলে পৃথিবীর কারো ফোন ধরে না। আমি ধরি, সেটাও পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে আবার শুধু কৌশিকের ফোন ধরে। আমার কাছে কৌশিকের ফোন আসলেও ধরতে ইশারা দেয়। আমারে ফোনে না পাইয়া কৌশিক এইবার আবিদরে ফোন দিলো। ফোন পকেট থেইকা না বাইর করলেও এটা আমরা দুইজনই বুঝতেছি। আমাদের দুইজনের একজন ফোন না ধরলেই কৌশিক নিশ্চিত হয়- আবিদ আর আমি একসঙ্গেই আছি এবং ওরে এভোয়েড করতে চাইতেছি।অধিকাংশ সময়ই গাঞ্জা স্কোর করার পর আবিদ ওর বাসার সামনে গিয়া আমার কাছে জানতে চায়, এরপর আমি কই যাবো। এর অর্থ হইলো, সে আমারে বাসায় নিতে চাইতেছে না। এর কারণ আমি প্রথমদিকে বুঝতাম না। অন্য যেকোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য আমার সামনে নিতে তার কোনো সমস্যা হয় না, শুধু গাঞ্জার বেলাতেই সে এই কাজটা করে। প্রথম প্রথম এই ব্যাপারটায় বেশ অপমান ফিল হইতো। গাঞ্জা আনতে সঙ্গে গেলাম, গাঞ্জা খাইও না আমি, তাইলে এত ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকার পর বাসাতে না ডাকার কারণ কী! একদিন এই রহস্যের কারণ আবিষ্কার করলাম। এরপর থেইকা আর কিছু মনে করি না। এমনিতেও আবিদের কোনোকিছুতেই আমি কিছু মনে করি না। এইটা ওর প্রতি আমার প্রেম আছে বইলা না যতটা, তারচেয়ে একটা মাদারহুডের জায়গা থেইকা। প্রেমিকা তো আসলে মায়েরই আরেকটা রূপ, সেটা ফ্রয়েড সাহেবের শরীরী ব্যাখ্যার বাইরে গিয়াই।

তো ওই দিন হইছিল কী, আবিদের বাসায় যাবো, এটা আবিদ জানতো না। মানে, আমার খুব অস্থির লাগতেছিল কোনো একটা কারণে। আমি ওরে টেক্সট করলাম, ভালো লাগতেছে না। বাসায় আছো? দেখা করবো। বাসায় থাকলে ওর ফোন একদিকে থাকে, আর ও আরেকদিকে। তাছাড়া সারাক্ষণ ফোন হাতে নিয়া রাখার ছেলেও সে না। উত্তরের আশা না কইরাই আমি ওর বাসার দরজায় গিয়া কলিংবেল বাজাইলাম। কয়েকবার বাজানোর পর ও দরজা খুইলা মোবাইলের কাছে গিয়া টেক্সট চেক করলো। তারপর কোনো কথা না বইলা নিজের ঘরে গিয়া সটান শুইয়া একটা স্টিক ধরাইয়া টানা শুরু করলো। আমি ওর পায়ের কাছে চুপচাপ বইসা গান ছাড়লাম- "তুমি আমার পাশে বন্ধু হে/বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো..."। স্টিক শেষ কইরা আবিদ জানতে চাইলো, “প্যারা খাইতেছো কী নিয়া?” ওর জানতে চাওয়ার ভঙ্গীতে এত মায়া ছিল, চোখ ছলছল হইয়া ওঠলো। আমার চোখ দিয়া পানি পড়বে, এটা আবিদ একদমই এক্সপেক্ট করে নাই। শোওয়া থেইকা ওইঠা বারান্দার রকিং চেয়ারটায় গিয়া বসলো। একটু পর অনেক দরদ দিয়া গাইয়া ওঠলো- "রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই/জলের মধ্যে জল/বুকের মধ্যে বন্ধু একটা-নিঃশূন্য অঞ্চল...”। বেসুরা হওয়া সত্ত্বেও আবিদ যখন ভেতর থেইকা দরদ দিয়া গান গায়, শুনতে খারাপ লাগে না। ওর গান শুনতে শুনতে আমি হুড়মুড় কইরা কাঁইদা দিলাম। আমার কান্না আর ওর গান একসঙ্গে কোনো এক সুরে গিয়া মিশলো যেন।

মিনিট দশেক পর আবিদ বারান্দা থেইকা ঘরে ফিরলো। আমার মন তখন অনেকটাই হালকা হইয়া গেছে। অস্থিরতাও কমছে। চোখে তখনও কিছুটা পানি। আবিদ হঠাৎ আইসা আমার মাথায় হাত রাখতেই আমি ওরে জড়াইয়া ধরলাম। এরপর সম্ভবত অনেকক্ষণই আমাদের দুইজনেরই আর কোনো হুঁশ ছিল না। হুঁশ ফিরলো কৌশিকের ফোনে। একটু পর পর আমাদের দুইজনের ফোন ক্রমাগত বাইজা যাইতেছে। প্রথমে ইগনোর করলেও একটা সময় দুইজনই কিছুটা আলাদা হইয়া সিগারেট ধরাইলাম। ওই মোমেন্ট আমাদের দুইজনের কাছেই খুব অপ্রত্যাশিত ছিল। দুইজনেরই দুইজনের প্রতি ভালো লাগা ছিল। অনেকটা মায়া, কিছুটা প্রেমও আছে। সেসব কখনো শারীরিক ছিল না। বা শরীরী কিছু আমরা এর আগে ভাবিও হয়তো নাই। আবিদরে আমি চিনি বইলাই দুইজনের ব্যাপারেই এটা নিশ্চিত হইয়া বলতে পারি। আমাদের প্রেমটা ছিল পুরাটাই প্লেটোনিক! সম্ভবত ওই দিনের ঘটনার কারণেই গাঞ্জা স্কোর করলে আবিদ আমারে আর বাসায় ডাকতো না।

কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে রিকশাওয়ালার পিঠে হাত রাখলো আবিদ। আবার কুঁচকানো-মোচড়ানো-অগোছালো টাকা পকেট থেইকা বাইর কইরা দিয়া লাফ মাইরা নামলো। রিকশা থেইকা নাইমা আমি অপেক্ষা করতেছি “এখন কই যাইবা?” প্রশ্নের। কোনো প্রশ্ন করলো না। মোড়ের দোকানটায় দাঁড়াইয়া সিগারেট কিনলো। তারপর হাঁইটা বাসার দিকে যাওয়া শুরু করলো। আমিও হাঁটতেছি ওর পেছন পেছন। বাসার গেট পর্যন্ত আসলাম। ও চুপচাপ সিঁড়ি দিয়া ওঠতেই বুঝলাম আমারেও যাইতে হবে। একবার ওর বাসায় যাওয়া নিয়া দাঁড়োয়ান গ্যাঞ্জাম করছিল। ওইটা একটা বিরাট কেলেঙ্কারি ঘটনা। অন্য কারোর বাসায় এটা ঘটলে আমি আর জীবনেও ওই মুখী হইতাম না। আবিদ বইলাই দুনিয়ার সাত খুন মাফ! আবিদের আব্বার ঢাকার বাইরে পোস্টিং। আম্মাও সেইখানেই থাকেন। ১৫০০ স্কয়ার ফিটের একটা বাসায় জোয়ান একটা ছেলে একা থাকে। তার বাসায় এক নারী প্রায়ই ভোর নাই, সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই, রাত নাই- যাতায়াত করে। ব্যাপারটা যে কারোরই চোখে পড়ার কথা। যথারীতি আবিদের পাশের ফ্ল্যাটের বয়স্ক এক ভদ্রমহিলার নজরে সেটা অনেকদিনই পড়লো। প্রথমদিন আবিদের সঙ্গেই লিফটে ছিলাম আমি। ভদ্রমহিলা আবিদের কাছে আমারে দেখাইয়া জানতে চাইলেন, “এটা কে?” আবিদ খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়া বললো, “বন্ধু।“ ভদ্রমহিলার যে এই উত্তর পছন্দ হইলো না, সেটা তার ভ্রু কুঁচকানো দেইখাই টের পাইলাম আমরা। এরপর উনি প্রশ্ন করলেন, আবিদের আম্মা ঢাকায় নাকি?

তো এই ঘটনা ওইদিনই শেষ হয় নাই। এরপর যতবার একা বা আবিদের সঙ্গে আমারে উনি দেখছেন, ততবারই উনার একই প্রশ্ন। আবিদ সঙ্গে থাকলে, আমি কে? আর আমি একা থাকলে, আবিদ আমার কী হয়! ঘটনা ওইখানেই থাইমা থাকে নাই। ছোটবেলায় আমার দাদী একটা গল্প শুনাইছিল- এক বুড়ি তার নাতনী বাড়ি থেইকা বাঘের ডরে লাউয়ের ভেতর ঢুইকা নিজের বাড়ি যাওয়ার সময় বলে, “লাউ গুড় গুড় লাউ গুড় গুড়, চিড়ে খায় আর খায় গুড়, বুড়ি গেল অনেক দূর…”। তো আবিদের পাশের বাসার ওই বুড়ি অনেকদূর আগাইয়া আবিদের আব্বার কান পর্যন্ত এই ঘটনা পৌঁছাইয়া দিছেন। এর পর পুত্র রসাতলে গেছে চিন্তা কইরা আবিদের আব্বা দাঁড়োয়ানদের উপর হুকুম জারি করলেন যেন তারা আবিদরে নজরদারিতে রাখে। 

বিল্ডিংয়ের প্রেসিডেন্টের এমন হুকুম অমান্য করার সাধ্য আছে কোন দাঁড়োয়ানের? এর পর পরই একদিন অন্যান্য সময়ের মতো আমি নরমালি বিল্ডিংয়ে ঢোকার মুখে দাঁড়োয়ান আমার কাছে জানতে চাইলো- “কোথায় যাবেন?” যেন উনি আমারে এই প্রথম দেখতেছেন এবং আমি কোথায় বা কার কাছে যাই, তা উনি জানেন না! গেটে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহারের ঘটনায় আবিদের মতো শান্ত ছেলেরে আমি ভয়ংকর ক্ষেপতে দেখছি। ও এতটাই ক্ষেপে গেছিল যে ওর আব্বারে ফোন দিয়াও নানা কথা শুনাইলো। আমি ওরে হাতের ইশারায় থামতে বইলাও থামাইতে পারতেছিলাম না। বাপের সঙ্গে চিল্লাচিল্লির পর আবিদ আমার পায়ের মধ্যে মাথা রাইখা অনেকক্ষণ কাঁন্দলো। কী যে যন্ত্রণা হইতেছিল ওর ওই কান্না দেখতে! মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ওরে বলতেছিলাম, বাবা তো! তোমার ভালোই চান উনি। ও আমারে পাল্টা প্রশ্ন করলো- “তুমি আর আমি কী করি এইখানে?” আমি মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতেই হাইসা বললাম, তুমি আর আমি পাশাপাশি-মুখোমুখি বইসা থাকি। এটা শুধু আমরা জানি। দুনিয়ার আর কেউ এটা বিশ্বাস করবে না। তারা তাদের ওয়েতেই যেটা ভাবার, ভাইবা নিতেছে। এসব নিয়া রিয়্যাক্ট কইরো না।

ওই ঘটনার পর আমি অনেকদিন আবিদের বাসায় যাই নাই। একদিন ভোরে যখন ও ফোন দিয়া বললো, “একটু আসবা? আমি ৭ দিন যাবত ঘুমাইতে পারতেছি না“, আমার যাইতে হইলো। আমি ওর পাশে গিয়া বসার পর একটা বাচ্চার মতো ও অঘোরে ঘুমাইলো দীর্ঘক্ষণ। এরপর থেইকা যতবার ওর বাসায় আসি, ও সঙ্গে থাকলে সিঁড়ি দিয়াই ওঠে, আর আমি লিফটে। বাসায় ঢুইকা হাত-মুখ ধুইয়া আবিদের বিছানায় গিয়া শুইলাম। আবিদ আমার পায়ের কাছে বইসা বইসা স্টিক বানাইয়া ধরাইলো। আমি মোবাইলের নোটপ্যাডে একটা কবিতা লেখা শুরু কইরা খেয়াল করলাম, তামাক শেষ করার পর আবিদ অনেকক্ষণ যাবতই এই ঘরে নাই। প্রথমে ভাবছি ওয়াশরুমে গেছে বোধহয়। অনেকক্ষণ না আসায় দেখলাম পাশের ঘরে গিয়া শুইয়া আছে। চোখ বন্ধ। মাথায় হাত রাখতেই দেখলাম, ঘামতেছে। তোমার কি খারাপ লাগতেছে- জানতে চাইলে ও চোখ খুইলা আমার দিকে তাকাইলো। চোখ সরাইতেছে না। আমার অস্বস্তি হইলো কিছুটা। চোখে চোখ রাইখা দেওয়ার এই খেলা ও মাঝে মাঝেই খেলে। সেখানে দুষ্টুমি থাকে। আজকেরটায় দুষ্টুমি নাই। দুর্বলতা আছে। আবিদ আমার হাতটা ধরতেই ওর ফোনটা বাইজা ওঠলো। একটু পর আমারটাও। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো ফোন বাজতে বাজতে নিজেই থাইমা গেছে। এই মুহূর্তে অন্য কোনো ডিস্টার্বেন্স আমাদের ভাল লাগতেছে না...