পোস্টস

গল্প

ক্যান ইউ এভার ফরগিভ মি?

২৯ মার্চ ২০২৪

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

“এটা আপনার প্রথম বাচ্চা?” ইয়ং একজন ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রামের সময় প্রশ্ন করলেন। সম্ভবত আমার নার্ভাসনেস কাটানোর জন্যই এমন প্রশ্ন। এসির নিচেও দরদর করে ঘামছি। প্রেশার ফল করেছে। পালস ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তার প্রশ্ন করার অনেকক্ষণ পর আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম, “না”। উনি বেশ কিছুক্ষণ তলপেট পরীক্ষা করে জানালেন; আর্লি প্রেগন্যান্সি, কিন্তু বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে। ভ্রুণ না বলে বাচ্চা বললেন কেন? তার মানে এটা এখন শুধু ভ্রুণ নাই? কত কী চিন্তা যে মাথায় এসে ভর করেছে! ১১ বছর আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আমি এই একইভাবে শুয়ে শুনেছিলাম, “বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না।” 

সমস্ত শরীর অবশ লাগছে। স্ক্রিনের দিকে তাকানোর সাহস করতে পারলাম না। নিজেকে এত দুর্বল আমার কোনোদিনও লাগেনি। দুনিয়ার কী অদ্ভুত হিসাব! ১১ বছর আগে যার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছিল না প্রথম অবস্থায়, সে ঠিকই দুনিয়াতে এসেছে। অথচ আজকে যার হার্টবিট পাওয়া গেল, কয়েক ঘণ্টা পরই আর তার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। দুইটা সিদ্ধান্ত নেওয়াই আমার জন্য কঠিন ছিল। আমার প্রথম সন্তানের বয়স এখন দশ। তার পিতৃপরিচয় নিয়ে খোদ তারা জন্মদাতাই শঙ্কিত ছিলেন অথবা সন্দেহে। সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ওই কম বয়সে নিজের একার সিদ্ধান্তেই আমি তাকে পৃথিবীতে এনেছিলাম। এর জন্য আমাকে যা যা সহ্য করতে হয়েছে, সেসব চিন্তা করে এখন একাই হাসি। মানুষের দুঃখগুলো একসময় এত বেশি শক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে সেগুলো নিয়ে হাসতে তেমন একটা যন্ত্রণা আর হয় না। সমস্যা তখনই হয়, যখন যন্ত্রণাগুলো সহ্য করার মুহূর্তরা চলমান থাকে। সারা জীবন একটা মশাকেও আমি হাতের মুঠোতে পিষে না ফেলে, হাত নাড়িয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। অথচ আজকের এই এত বড় সিদ্ধান্ত না নিতে আর কোনো বিকল্প আমার আছে কি? 

আল্ট্রাসাউন্ড রুম থেকে বের হয়ে অনেকক্ষণ রিসিপশনের পাশের একটা চেয়ারে মাথা চেপে ধরে বসে থাকলাম। বুকের ভেতর এত জোরে ধুক ধুক শব্দ হচ্ছে, আমার পাশে বসে থাকা ইয়ং কাপল দুজনও হয়তো এই শব্দ শুনতে পারছেন। প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে এসে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, কল্পনাতেও ভাবিনি। আমি ইন্ডিপেনডেন্ট, অন্য অনেকের চেয়ে আমার সাহস কিছুটা কম না, বরং ক্ষেত্র বিশেষে বেশিই। সারা জীবন আমি নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছি। মন যা বলেছে, তা-ই করেছি। অথচ আজকের এই সিচ্যুয়েশনে এসে আমাকে দুর্বল হতে হচ্ছে। আমার ভেতর কোনো ভয় কাজ করছে না, কিন্তু তীব্র এক অপরাধ বোধে ভেতরে ভেতরে আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি। আমার সামনের সারিতে এক মায়ের সঙ্গে আসা ৫-৬ বছরের বাচ্চা তেলাপোকা দেখে ভয় পাচ্ছে। তার মাকে দেখলাম পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে তেলপোকাটা নিমিষেই পিষে ফেললেন! এই দৃশ্য দেখে হুট করেই বমি পেলো। হাসপাতালগুলোর ওয়াশরুম আমি পারতপক্ষে ব্যবহার করি না। নিজেকে ঠিক রাখার জন্যই বাধ্য হয়ে যেতে হলো, তাছাড়া এতক্ষণ যাবত আল্ট্রাসনোর জন্য কয়েক লিটার পানি খেয়েছি, সেটারও চাপ ফিল হচ্ছে। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলাম তেলাপোকার ছড়াছড়ি। একটা বড় তেলাপোকা প্রায় আমার পায়ে ওঠে যাওয়ার উপক্রম ঘটলেও আমি সেটাকে মারতে পারলাম না। হ্যান্ড ওয়াশের পানি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম। মুখে-চোখে-মাথায় পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলাম। ডাক্তার অপেক্ষা করছেন আমার সিদ্ধান্তের!

আমার প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসার সময় নিজের সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য অনেকগুলো জিনিস এক্সট্রা নিয়ে এসেছিল- শ্বাসকষ্ট, রেস্টলেসনেস, এনজাইটি, রাগ, জেদ আর বাইপোলার ডিজঅর্ডার! তার আগ পর্যন্ত আমি সম্ভবত ছিলাম পৃথিবীর অন্যতম শান্ত মানুষ। বাই নেচার আমি এখনো হয়তো তাই, তবে মানুষ হয়তো সীমার বেশি সহ্য করে ফেললে নিজের স্বভাব বিরোধী আচরণ শুরু করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আমি এতটা প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ কখনোই ছিলাম না, এখন যতটা হয়েছি। রিসিপশন থেকে আমার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যেই আমি খেয়াল করলাম- আমার মাথায় বারবারই “প্রথম সন্তান” টার্মটা ঘুরছে। একমাত্র সন্তান না! আমার ভেতরে যে এখন আরেকটা সত্তা যুক্ত হয়েছে, সেটা আমি চাইলেও ভুলতে পারছি না। যখন আমার সামর্থ্য ছিল না, আমি একা ছিলাম, সেই সময় আমি কত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম খুব সহজেই। আর এখন, সমস্ত সামর্থ্য থাকার পরও সিদ্ধান্ত নিতে আমার সময় লাগছে। একজন পুরুষের সাইনবোর্ড না থাকার কারণে জীবনের সবচেয়ে জঘন্য পাপটা করার দিকে হয়তো আমি এগোচ্ছি। আমার মনুষ্যত্ব, সংবেদনশীল মন, আমার সমস্ত অস্তিত্বের দাফন আজ এখানেই হবে।

সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে ইতালিয়ান সাংবাদিক ও লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির “লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন”–এর বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, “হাত বাড়িয়ে দাও”। প্রফেসর আনু মুহাম্মদ অনুবাদ করেছিলেন। একজন অনাগত শিশুর কাছে লেখা তার মায়ের চিঠি। ডায়েরি বলাই ভালো বেশি। প্রতিদিনের কথা লেখা থাকতো সেই চিঠিতে। সেই কিশোর বয়সে ওই লেখা পড়ে আমার শরীর শিহরে ওঠেছিল। আর আজকে হাসপাতালে কিছুক্ষণ পর নিজেরই অনাগত শিশুর ভবিষ্যত নির্ধারণ করার আগে আমার শরীর কাঁপছে। অন্যমনষ্ক ভাবনার ভেতরে আমি আমার ডান হাতটা তলপেটের ওপর টের পেলাম। আমার পাশে থাকা চেয়ারগুলো খালি হয়ে গেল। পৃথিবীতে এরচেয়ে বেশি একা আমি কখনোই অনুভব করিনি। মানুষের বয়স হয়ে গেলে অনেক জটিল ভাবনা ঘিরে ধরে, সবকিছুরই কনসিক্যুয়েন্স চিন্তা করতে থাকে আনকনশাস মনে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা চিন্তা করতে গিয়েও বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। একটু নামাজ পড়তে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো। সময় নেই। রিসিপশন থেকে বারবার নাম ডেকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। মানুষের এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যও এই দুনিয়ায় সময় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, সময় পার হয়ে গেলে কেউ একটা মিনিটও এক্সট্রা দিতে চায় না!

“আপনি একা? আপনার হাজবেন্ড বা অন্য কেউ আসেননি?” মাথা নাড়িয়ে “না” বললাম। “আপনাকে এক রাত থাকতেও হতে পারে, নাও পারে। আপাতত যেসব ঔষধ লাগবে, আমরা দিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু সার্জারির পর রাতে আপনাকে ঔষধ আনিয়ে নিতে হবে। এই কাগজগুলোতে সাইন করে বিলটা ক্লিয়ার করলেই আপাতত প্রসেডিউর শেষ হবে।” কাগজগুলোতে ঠিক কী লেখা আছে আমি পড়তে পারছিলাম না। ডাক্তারের রুমে বসে আছি। হাত চলছে না। উনি আমার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে নিজেই সব লিখলেন, শুধু সিগনেচার নেওয়ার সময় কাগজটা আমার সামনে বাড়িয়ে ধরলেন। হাত কাঁপছে, ডান পা এবং সম্ভবত সমস্ত শরীরও। ঝাপসা হয়ে ওঠছে সবকিছু। ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রাখলেন। কলমটা নিয়ে আঁকাবাঁকাভাবেই সিগনেচার করলাম। ওটিতে নেওয়ার আগে আমার কাপড় চেঞ্জ করানো হলো। কয়েকটা ঔষধ খাওয়ানো হলো। হাতে ক্যানোলা লাগানো হলো। অ্যালার্জি আছে কি না পরীক্ষা করতে একটা ইনজেকশন দেওয়া হলো। এরপরের অংশ হলো অ্যানেস্থেসিয়া। একজন আয়া এসে আমাকে প্রস্তুত হতে বলে চলে গেলেন। একটা রুমে আরো দুইজন শুয়ে আছেন। তাদের মনের মধ্যে কী ভাবনা চলছে জানি না, তবে দুইজনই বিষণ্ন হয়ে আছেন, সেটা স্পষ্টই তাদের চেহারায় বোঝা যাচ্ছে। এটা কোনো নারীর জন্যই আনন্দের বিষয় না, বাধ্য না হলে কেউ এমন সিদ্ধান্ত নেয় না বলেই আমার বিশ্বাস। ওটিতে শেষ পর্যন্ত আমার ডাক এসেছে। ওয়েটিং রুমের পুরোটা সময় আমার ডান হাতটা তলপেটের ওপরে ছিল। আমি হয়তো মনে-প্রাণে একটাবার ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কোনো শব্দ দিয়েই গুছিয়ে বাক্যটা উচ্চারণ করতে পারছি না। গলার কাছে দলা পাকিয়ে সব শব্দরা আটকে যাচ্ছে। আরেকটাবার আমি কোনো সম্ভাবনা আছে কি না চিন্তা করতে চাইলাম। ডিউটিতে থাকা নার্স বা ডাক্তার, কারোরই এত সময় নেই। অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার জন্য যিনি অপেক্ষা করছেন, উনার নামাজে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়া দিলেন সবাইকে। আমার একটাবার বাবার মুখ মনে পড়লো।

অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পরও মনে হচ্ছিল আমার পুরোপুরি জ্ঞান চলে যায়নি। আমার সমস্ত শরীর থেকে টেনে-হিঁচড়ে যেন কিছু একটা বের করা হচ্ছে। আমি সব বুঝতে পারছিলাম। টের পাচ্ছিলাম, আমার শরীর থেকে কিছু একটা চলে যাচ্ছে। এমন কিছু একটা, যেটা আমার শরীরের খুব গভীর কোনো অংশ। আমিও তার সঙ্গে চলে যেতে চাইছিলাম। খুব আপন একটা কিছু আমাকে বিদায় জানাচ্ছে যেন, আমার সমস্ত সত্তায় সেটা আমি অনুভব করছিলাম। সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এলো। চোখ খুলে দেখলাম হাসপাতালের কেবিনে আমি একা শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার এসে জানালেন, “আপনার সিচ্যুয়েশন কিছুটা ক্রিটিক্যাল হয়ে পড়েছিল। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার কারণে আপনাকে আজকে রিলিজ দেওয়া যাচ্ছে না। এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া লাগতে পারে। আপাতত স্যালাইনটা চলুক।” আমার এসব কোনো কথাতেই মনোযোগ নেই। একটা জীবন আমার ভেতর বেড়ে ওঠার জন্য এসেছিল, সেটা আমি রাখতে পারলাম না। আমার সবচেয়ে আপন অংশ আমার ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল, আমি তাকে হত্যা করলাম। হত্যা করার আগে, একটাবারের জন্যও আমি তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারলাম না। পৃথিবীর সমস্ত কান্না এসে আমার ভেতর ভর করলো, অথচ আমি কাঁদতে পারছি না। আমার সারা মস্তিষ্কে শুধু কয়েকটা বাক্য ঘুরপাক খাচ্ছে- আই নেভার গট টু সি ইউর ফেস, অর হ্যাড অ্যা চান্স টু চুজ ইউর নেম...ক্যান ইউ প্লিজ ফরগিভ মি, মাই চাইল্ড?