পোস্টস

গল্প

মুস্তাকিমের ভাই

১৫ এপ্রিল ২০২৪

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

“আপনার মেরুন শাড়ি নাই?”- জানতে চাইলো মুস্তাকিমের ভাই। মুস্তাকিম আমার ক্রাশিত বন্ধু। ভার্সিটিতে সে আমার সিনিয়র ছিল। যেহেতু সমবয়সী বন্ধু আমার শৈশব থেইকাই কম, তাই মুস্তাকিমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হইয়া গেল। এটারও লম্বা ইতিহাস আছে। আমাদের মধ্যে ভালো লাগালাগির ব্যাপারটাই প্রথমদিকে বেশি ছিল। কিন্তু প্রেমের দিকে আগাইতে না পারলে যেমন কিছু সম্পর্ক বন্ধুত্বে টার্ন নেয়, মুস্তাকিমের সঙ্গেও আমার তেমন ঘটনা ঘটছে। যদিও পরে আমি আর একই ভার্সিটিতে থাকি নাই। প্রেম না হওয়া বন্ধুত্বরে হজম করতে প্যারা লাগতেছিল বইলা একদিন হুট কইরাই ওই ভার্সিটিতে যাওয়া ছেড়ে দিছিলাম।

ভার্সিটি ছাড়ার পর মুস্তাকিমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হইয়া গেছিল ফরমাল। ঈদে-চাঁন্দে আমরা খুবই আদব-লেহাজের সহিত একজন আরেকজনরে উইশ করতাম। এখনো করি। মাঝেমধ্যে এইসব উইশ টেক্সটের বাইরে কথাবার্তা আগাইলে একটা প্রেম প্রেম ভাব টের পাওয়া যায়, যদিও সেইখানে জড়তা থাকে। তো মুস্তাকিমের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর আমার শুধু একবারই দেখা হইছিল। সেটাও ভার্সিটি ছাড়ার ৭ বছর পর আর এখন থেইকা ৮-৯ বছর আগে। এরপর আমাদের দেখা সাক্ষাৎ আর হয় নাই কখনো। আমার সেই ক্রাশ মুস্তাকিমের ছোট ভাই যখন আমারে একটা কফি শপে বইসা মেরুন শাড়ি আছে কিনা জানতে চায়, অস্বস্তিতে আমার কপাল গড়াইয়া চিবুক পর্যন্ত ঘাম পড়াটারে স্বাভাবিকই মনে হইতেছে।
 
প্রশ্নটা শুনি নাই এমন একটা ভাণ কইরা জিজ্ঞেস করলাম, কী খাবা? অর্ডার করো। মেন্যু দেখতে দেখতে ছেলেটা আবার বলা শুরু করলো, “লাল টিপের চেয়ে কিন্তু মেরুন সুন্দর। আরেকটু ছোট টিপ মনে হয় আপনাকে বেশি মানাবে।” মোর জ্বালা! শাড়ি, নারী কোনোকিছুতে আগ্রহ নিয়াই আমার ঝামেলা নাই, ঝামেলা হইলো আমার সামনে বইসা নারীর শাড়ি নিয়া আগ্রহ দেখাইতেছে মুস্তাকিমের ভাই! যেই নারীর শাড়ি আর টিপের রঙ নিয়া তার এত আগ্রহ, আনফরচুনেটলি সেটাও আবার আমি!
 
কফি অর্ডার করার পর আমরা একটু গান বাজনা নিয়া কথা বলার ট্রাই করতেছিলাম। পিঙ্ক ফ্লয়েড, ডোরস, ড্রিম থিয়েটার নিয়া কথা বলতে বলতে সিগারেট আফটার সেক্সে গিয়া থামলাম। এমন না যে সিগারেট আফটার সেক্সের নাম নিয়া আমার কোনো ট্যাবু আছে! কিন্তু এই ব্যান্ডের কথা বলার সময় মুস্তাকিমের ভাই যেমনে সিগারেট টানতে টানতে ঠোঁটের কোনায় একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ঝুলাইয়া রাখছিল, সেইটাই বরং আমারে কিছুটা নার্ভাস ফিল করাইতেছিল। ব্যাপারগুলা কি পরিকল্পিত; না কি আমিই বেশি বেশি ভাবতেছি, বুঝতেছিলাম না। দুনিয়ার অন্য কোনো জুনিয়রের সামনে কোনো বিষয় নিয়া কথা বলতেই আমি বিব্রত হইতাম না। এই ছেলের সামনে খানিকটা হইতেছি৷ এমনও না যে বিষয়গুলা খুব বিব্রতকর, কিন্তু আমার খামাখাই কেমন যেন অস্বস্তি হইতেছে। মুস্তাকিমের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য পাঁচ। আমার থেইকা মুস্তাকিমের ভাইয়ের বয়সের পার্থক্যও ওই রকমই হবে। বয়স টয়সও বিষয় না, বিষয় হইলো সে মুস্তাকিমের ভাই!
 
মুস্তাকিমের সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ নাই। দেখা-সাক্ষাৎও নাই। তার ভাইয়ের সঙ্গে কেমনে যোগাযোগ হইলো, এইটা বিরাট ইন্টারেস্টিং বিষয়! ঘটনা ঘটছে আসলে ইনস্টাগ্রামের কারণে। ইনস্টাগ্রামের ট্রেন্ড অনুযায়ী নিজের কিছু খোলামেলা ছবি পোস্ট করছিলাম। খোলামেলা বললে অবশ্য মানুষ ভুল ভাবতে পারে। মানে, অত খোলামেলাও আবার না। দুই-একটা ছবিতে ব্লাউজের উপর দিয়া ক্লিভেজ দেখা যাইতেছে। তো কম বয়সী ছেলেদের এমনিতেও তো একটু বেশি বয়সী নারীদের সুডৌল বাহু এবং স্তনের প্রতি আকর্ষণ থাকে। ওইসব ছবি মাই ডে’তে দিলে এই ছেলে “ও-য়া-ও” লেইখা যেমনে মুখ হা করার ইমো দিতে থাকে, তাতে না বোঝার কিছু নাই যে সেও ওই তরুণদের দলেরই লোক! এইটা দোষের কিছু না। সমস্যা ওই একটাই, সে মুস্তাকিমের ভাই!
 
ইনস্টার ইনবক্সে হাই-হ্যালো হইতে হইতেই ঘটনা কফি শপ পর্যন্ত পৌঁছাইলো। তবে দুইটার পারপাস ভিন্ন। কিংবা আমি শুধু আমার পারপাস সম্পর্কেই নিশ্চিত। সে যখন দেখা করতে চাইছে, আমি নানা ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বাইর কইরা আসছি কারণ তার সঙ্গে দেখা করার মধ্যে দিয়া হয়তো আমি আমার ভার্সিটির অলি-গলি আর পুরানা দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইছি মূলত। মানুষ যেমন প্রিয় মানুষের বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডরে দেখলেও পুলকিত বোধ করে, ওই রকম নিষ্পাপ ফিলটাই হয়তো আমি পাইতে চাইছি সাবকনশাস মনে। কফি শপে মুখামুখি বসার আগ পর্যন্ত ফিলটা ওই রকমই ছিল। তবে এখানে আসার পর কেমন যেন গোলমাল লাইগা গেছে। ঘটনাটা হয়তো অত জটিল না, যতটা জটিল কইরা আমি ভাবতেছি। কিন্তু তবুও সে তো আসলে মুস্তাকিমের ভাই, ওই জায়গাতেই প্যাঁচটা জিলাপির মতো দেখাইতেছে।
 
কফি শপ থেকে বাইর হওয়ার পর হুট কইরাই মনে হইলো বাসায় কিছু ফ্রুটস নেওয়া দরকার। আগোরাতে যাবো বইলা মুস্তাকিমের ভাইয়ের কাছ থেইকা বিদায় নিতে চাইলাম। সে বিদায় না দিয়া আমার পিছ পিছ আগোরাতে ঢুইকা পড়লো। ফ্রুটস কিনতে কিনতে দেখলাম মুস্তাকিমের ভাই আশে পাশে নাই। এদিক-সেদিক তাকাইতেই বিল কাউন্টারের সামনে দেখি সে দাঁড়াইয়া পাঞ্চ মেশিন চাপতেছে। সম্ভবত ক্রেডিট কার্ডের পিন দিতেছিল। সামনে আগাইয়া আমিও বিল দিয়া বাইর হইলাম। আমার পেছন পেছন আইসা সে হাতে একটা ডার্ক চকলেটের প্যাকেট আগাইয়া দিয়া কানের কাছে ফিসফিস কইরা বললো, “আই লাআআআআআআ.......ভ ডার্ক চকলেট!” কী বলবো বোঝার আগেই আমার হাতে চকলেটটা ধরাইয়া দিয়া “বাসাতেই তো যাবেন, নাকি? চলেন, ড্রপ করে দিই” বইলা মুস্তাকিমের ভাই চোখে চোখ রাইখতেই আল্লাহর কসম আমার বুকটা ধক্ কইরা ওঠলো! ওর চোখ দুইটা আমারে ১৮ বছর আগের মুস্তাকিমের কথা মনে করাইয়া দিতেছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হইছে, ওইটা মুস্তাকিমই! সমস্যাটা মূলত এইখানেই- ডার্ক চকলেট পছন্দ করা এই ছেলেটা মুস্তাকিমের আপন ছোট ভাই!