পোস্টস

গল্প

বেঁচে ফিরবার আগে

১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাশেদ স্বপ্ন

মূল লেখক রাশেদ স্বপ্ন

.
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করলাম আমি মারা গেছি। 

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, একই সাথে ভীতিকরও। কেউই জেগে উঠে নিজেকে মৃত দেখার চিন্তা করে ঘুমাতে যায় না। যদিও আমার বয়স হয়েছে। মৃত্যুর চিন্তা মনে যে আসে না তা একেবারেই না। তবুও আকস্মিক মরণ আকস্মিকই। যতই প্রস্তুতি নেয়া থাকুক না কেন, হুট করে মরে যাওয়ার পরে ঠিকই মনে হবে, "যাহ! মরে গেলাম?"  অন্যদিকে মৃত জীবনে যে আবেগ অনুভূতি জীবিত জীবনের মত একইভাবে কাজ করে, সে খবরও আমার জানা ছিলো না। ঠিক এই কারনে এই অদ্ভুত এবং ভীতিকর ঘটনাটা বুঝতে আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল। প্রথমে বুঝিইনি একেবারে। ভাবলাম দুঃস্বপ্ন দেখছি। আজকাল মাঝে মাঝে এরকম স্বপ্ন দেখি। বয়সের দোষ। বুড়ো হলে ঘুমের মাঝে মানুষ কত কী আজব জিনিসপত্র দেখে। আমিই বা বাদ যাব কেন? আর দশজন থেকে তো আলাদা নই!

স্বপ্নে ফিরে আসি। আজব কিছু দেখি সেখানে। দেখা যায়,হঠাৎ এক মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বুক জুড়ে প্রচণ্ড পানির পিপাসা। অস্থির হয়ে চোখ খুলে দেখি, আমি শূন্যে ভাসছি। ঠিক নিচ বরাবর বিছানায় আমার শরীরটা পড়ে আছে। চোখ বন্ধ, মুখ খোলা, হৃদস্পন্দন নেই। অবশ্যই ভীতিকর একটি দৃশ্য। তাছাড়া অন্যের মৃতদেহ দেখলে আমার সবসময় ভয় লাগে। মনে হয় এখনই চোখ খুলে তাকাবে। তারপর উঠে বসবে। যদিও সেইসকল মৃতদেহ কখনই জেগে উঠে বসে থাকে নি। আমার দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতেও তাকায় নি। তারপরও আমি এইসকল চিন্তাধারা থেকে বের হতে পারি নি কখনো। মৃতদেহ বিষয়ক আমার এসকল ব্যক্তিগত তত্ত্ব ঠিক ঠিক নিজের মৃতদেহের উপরেও খেটে গেল। নিজের মরা লাশ দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যাওয়ার মত আজব ঘটনা স্বপ্ন ছাড়া আর কোথাও ঘটা সম্ভব নয়। তাই প্রতিবারই ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখেছি আমি বেঁচে আছি। প্রথম প্রথম বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে গিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতাম। মিলিয়ে নিতাম, আমি মারা গেলে আমাকে স্বপ্নের মতই দেখাবে কি না! আজকাল অবশ্য চুপচাপ শুয়ে থাকি। ভাবি, এক জিনিস আর কতবার? 

চেনা দুঃস্বপ্নের কারণে নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখে আজ মনে হল দেজাভ্যু হচ্ছে। মনে হচ্ছিল আমি ঠিক ঠিক জানি এরপর কি হবে। কিছুক্ষন পরেই এই চার দেয়াল, নরম বিছানা, চেনা শরীর সবকিছু ছেড়ে আমি দূরে সরে যেতে থাকব। মনে হবে এই দেহ, এই ঘর, এই বিছানা কিছুই চাই না। শুধু একটু মুক্ত বাতাস চাই। ক্লস্টোফোবিক একটা অনুভুতি জাপটে ধরবে আমাকে। তারপর ভাসতে ভাসতে বিশাল এক তেপান্তরের মাঠে এসে পৌঁছাব। সেখানে মুক্ত বাতাসের ঝাপটায় ভালো লাগতে থাকবে। বেশ কিছুক্ষন পর, এক সময় হঠাৎ মনে হবে, শরীর ছাড়া এই আমাকে কি আমি বলা যায়? আমি তো পূর্ণ না। অপূর্ণ আমির এই প্রশান্তি কি আদৌ তৃপ্তি আনবে?  তখন আবার শরীরে ফেরার জন্য শুরু হবে আরেক আকুলতা। ফিরে আসতে গিয়ে দেখব পথ হারিয়ে ফেলেছি। শরীরে ফিরতে না পারায় অস্থির হয়ে উঠব। তারপর একসময় ছটফট করতে করতে আমার ঘুম ভেঙে যাবে। দেখব, শুয়ে আছি বিছানায়, সারা শরীর ঘামে ভেজা।

দেজাভ্যু বিষয়ক এই সকল ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে প্রমাণ করে দিল একটি কন্ঠস্বর। কে যেন হঠাৎ ভারী গলায় বলে উঠলো, " কি, কেমন মজা হল এবার?"
আওয়াজটা চেনা চেনা লাগে। বহুদিন আগে এই গলায় কেউ একজন কথা বলত। কিন্তু সে এখানে কিভাবে আসবে ভেবে অবাক হলাম। তার তো এখানে আসার কোন সম্ভাবনাও নেই। এতক্ষণ তাকিয়েছিলাম নিচে বিছানার ওপর।  নিজের লাশের দিকে। আওয়াজটা এসেছে আমার ডান দিক থেকে। তারপর সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম! আমার থেকে ঠিক এক হাত দূরত্বে অনিমেষ! সেও ভাসছে। ঠিক আমার মতই। 

অনিমেষ মারা গেছে প্রায় তিরিশ বছর হল। অনেকটা সময়। অনেকগুলো দিন, অনেকগুলো মাস, অনেকগুলো বছর। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই, কিভাবে  এই মানুষটাকে  ছেড়ে এতটা সময় পার করে দিলাম! দীর্ঘদিন একা থাকার অভ্যাসের পরও কখনো ভুলতে পারিনি আমি অনিমেষবিহীন একটা জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সে যে নেই, এই দুঃখবোধ সবসময়েই আমার মনের ভেতর জেগেছিল। কী এক অদ্ভুত কারণে সারাজীবন বহু আজব স্বপ্ন দেখে আসলেও অনিমেষ মারা যাওয়ার পর, তাকে কখনো স্রেফ একটিবারের জন্যেও স্বপ্নে দেখি নি। মৃত অনিমেষ যেন তার সকল স্বত্তা নিয়ে আমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের জীবনে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা দমকা হাওয়ার মত আসে, আবার হুট করেই চলে যায়। মাঝখানে শুধু নিজের অস্তিত্ব টা রেখে যায়, একদম স্পষ্ট করে। প্রথমটায় তাদের চলে যাওয়াটা বিরাট একটা ধাক্কা দিয়ে বসে। তারপর একসময় তৈরী করে শূন্যতা, যেই শূন্যস্থান কোন কিছুতেই পূরণ হয় না। তাদের অনুপস্থিতি প্রতিটা সময় আমাদের পোড়ায়। আমরা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাই, তবুও তাদের ভুলতে পারি না। ভুলে যাওয়ার থেকে বরং পুড়তেই ভালোবাসি। আমার জীবনে অনিমেষ ঠিক এরকম একটা মানুষ। এল, দেখল, আমাকে জয় করে শেষমেষ চলে গেল। মাঝখানে রেখে গেল একগাদা স্মৃতি। তাই আঁকড়ে ধরে আর চোখের জলে মাঝরাত্তিরে বালিশ ভিজিয়ে আমি বেঁচে রইলাম এই  তিরিশটা বছর। তারপর আজকের এই মাঝরাতে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে এসে টের পেলাম আমি মারা গেছি আর আমার পাশে আজ তিরিশ বছর পরে অনিমেষ বসে আছে। বসে আছে ঠিক বলা যায় না। শূন্যে ভাসছে।

অনিমেষের এই আকস্মিক আধিভৌতিক  আগমনের হেতু কি, তখনো পর্যন্ত জানি না। ওকে দেখে ওর চলে যাওয়ার দিনটার কথা পড়ে। কেন জানিনা সে চিরতরে যাওয়ার জন্য আমাদের বিয়ের ঠিক দশ বছর পূর্তির দিনটাই বেছে নিয়েছিল। কথা ছিল অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসব। একটু ঘোরাঘুরি, ভালোমন্দ খাওয়া, এই আর কি! ভেবেছিলাম বাসায় ফিরে বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে সেদিন মাঝরাতে ওর কাঁধে মাথা রেখে বারান্দায় বসে থাকব। চারপাশে তখন ঘন অন্ধকার ঘিরে থাকবে আমাদের। আমার হাতে থাকবে কফির মগ আর ওর মুখে জীবনানন্দের কবিতা। হঠাৎ করেই ও নিজের কবিতা আবৃত্তি করে অবাক করে দিবে আমায়। হয়তো এমন কিছু বলবে, ভীষণ লজ্জা পেয়ে যাব। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার সেই রাতে অনিমেষ আমাকে লজ্জায় রাঙ্গা হতে দেখবে না। শুধু স্পর্শে অনুভব করবে আমি উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছি।
মানুষ ভাবে এক, বিধাতা ঠিক করেন আর এক। সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে অনিমেষ অফিস গেল। নয়টায় বের হল, দশটায় ফিরে এল। রোড এক্সিডেন্ট, স্পট ডেড। তারপর মাঝখানে এই ত্রিশটা বছর।
এই দীর্ঘ সময়ে কখনো কখনো অবসন্ন অবসরে আমি পেছন ফিরে তাকিয়েছি। মনে হয়েছে যেন এক বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর পাড়ি দিচ্ছি। যাপিত জীবনের বহু আকস্মিক দৃশ্যপট কখনো থমকে দিয়েছে আমায়। কখনো মরীচিকার তীব্র হাতছানিতে ঠকেছি, কখনো প্রবল মরুঝড়ে মুখ থুবরে পড়ে গিয়েছি। তারপর আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। বারবার হেরে গিয়ে ফিরে আসার কি এক আকুল প্রচেষ্টা! তারপর হঠাৎ একদিন দেখি জীবনযুদ্ধ নামের এই সুবিশাল মরুপ্রান্তর পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। আমার আটপৌরে জীবনে স্থিতিশীলতা এসেছে। ছেলেরা বড় হয়েছে। তাদের আলাদা সংসার হয়েছে। এই জীবনের একাকীত্ববোধটাও এতদিনে সহ্য হয়ে এসেছে। অনুভব করি অনিমেষের অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দিলেও আর আগের মত পোড়ায় না। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পরে আমি আবার তার  গলা শুনতে পাচ্ছি। চোখের সামনে তাকে হাসতে দেখছি সেই পুরনো দিনগুলোর মত। সেই হাসি শুনে আমার বহুদিনের তৃষিত অন্তরে এতগুলো বছর পরে আবার জলের তেষ্টা পায়। ইচ্ছা হয় অনিমেষ আঁজলা ভরে আমার মুখে জল ঢেলে দিক। অনেকদিনের এই অন্তর্জ্বালা মিটিয়ে দিক। দেহহীন এই অবয়বে এই চাওয়া সম্ভব নয় ভেবে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। চেনা দুঃস্বপ্নের মাঝে যেমন হয়, শরীরে ফেরবার জন্য ঠিক তেমন একটা আকুলতা শুরু হয়েছে। আমার ভেতরের ছাইচাপা আগুন অনিমেষ উষ্কে দিচ্ছে নিজের অজান্তেই।

মৃত মানুষকে চোখের সামনে হাসতে দেখলে ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু এই চিরচেনা প্রিয় হাসিমুখ আবার দেখতে পাওয়ার বহুদিনের জমানো একটা আকাঙ্ক্ষা আমাকে ভয় পেতে দিল না। শুধু যতটুকু চমকানোর, ঠিক ততটুকুই চমকে গিয়েছিলাম। তারপর একসময় চমকটা সরে গিয়ে একটা খারাপ লাগা এসে ভর করল। সেটা সাথে নিয়েই সেই হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম এক দৃষ্টে। সাথে শরীরটা থাকলে বলতাম ব্যাথাতুর দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। এখন তো শরীর নেই, তাই দৃষ্টির ব্যথা আছে কি না টের পাচ্ছি না। কেন জানি না, অনিমেষের হাসতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ মনে হল, "আহারে আমার তিরিশ বছর!"

অনিমেষ আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। বলল, 
"এইবার আবার তোমাকে পেলাম। কেমন ভালো হল, বলতো? তিরিশ বছর একা থাকা কি যে সে ব্যাপার?" 
ওর কথা শুনে আমার কেমন জানি লাগে। আমি শরীরে থাকলে হয়তো চোখে জলে এসে যেত। টের পাই আমার ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বহুদিন আগে অনিমেষ কাছে এলে এরকম লাগত। মনে হত বুকের মধ্যেখানে অদ্ভুত উঠাল পাথাল ঢেউ উপচে পড়ছে। তীব্র সেই ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তীরের সব কিছু। কিন্তু প্রমত্তা সেই ঢেউয়ে অস্থিরতার বদলে আশ্চর্য শান্ত এক শব্দ হয়, ছলাৎ ছলাৎ। অনেকদিনপর আমার আবার ইচ্ছে হয় ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। 

শরীরের মায়া বড় অদ্ভুত। যা কিছু নেই তা অনুভব করার ব্যর্থ প্রয়াস আমরা কেন করি তা জানি না। যার চোখ নেই তার চোখে দেখার কি অদ্ভুত আকুলতা। যে কথা বলতে পারে না, তার সব ভাষা যেন চোখের তারায় এসে জমে যায়।  কখনো নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেলে আমরা অস্থির হয়ে যাই একবিন্দু আলোর জন্য। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। একটা এক্সিডেন্টে বাবা পা হারিয়েছিলেন। তারপর কখনো কখনো বাবাকে দেখতাম হুইল চেয়ারে বসে হারানো পায়ের জন্য আক্ষেপ করতে। খুব করে চাইতেন শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে। কোন কোন সকালবেলায় আমরা ধরে নিয়ে শিশিরভেজা ঘাসে বসিয়ে দিতাম । কোনদিন সাথে আমি যেতাম, কোনদিন মা। বাবা মাটিতে বসে ঘাসেদের আদর করার মত করে সেই শিশির দুহাতে মাখিয়ে নিতেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট বাচ্চার মত খুশি খুশি লাগত তাকে। তখন মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম, আমার যদি পা না থাকত, কেমন লাগত তবে? ভাবতে ভাবতে একসময় শিরশিরে অনুভূতি হত পায়ে। খুব অস্বস্তি লাগত।  ছিটকে বেরিয়ে আসতাম চিন্তার জগত থেকে। 

মানবশরীরের এই অদ্ভুত আকুলতা আমার ক্ষেত্রেও ঠিক ঠিক কাজ করছে এখন। শরীর বিহীন এই অবস্থায় অনিমেষকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্থির হয়ে যাচ্ছি।  কিন্তু ছুঁবো কি করে? হাত-পা তো সব নিচে পড়ে আছে শরীরের সাথে, বিছানার ওপর! পুরনো অস্বস্তিটা ফিরে আসে। পা না থাকার কথা ভাবলে যেমন শিরশিরে অনুভূতি হত, তেমন। পার্থক্য একটাই। শিরশিরানিটা এবার পা ছাড়িয়ে অস্তিত্ব জুড়ে ভর করছে। কি আর করা, শরীরটা তো নেই সাথে! 

অনিমেষ বোধহয় আমার অস্থিরতা টের পায়। বলে, 
"একটু অপেক্ষা করো, দেহ সৎকার এর কাজ শেষ হলেই শরীরটা ফিরে পাবে। তখন আবার আমরা হাত ধরাধরি করে ঘুরবো।"
সৎকার শব্দটা আলাদা করে শোনা যায়। অবাক লাগে। এটা আবার কোথা থেকে এল? 
"দেহ সৎকার মানে?" আমি জিজ্ঞেস করি। 
ও কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। জিজ্ঞেস করে, 
"এখনও বুঝতে পারোনি?" অনিমেষের গলায় বিস্ময় টের পাই আমি। 
"না তো!কি হয়েছে?"
"অনসূয়া, তুমি মারা গেছো! "

সারাজীবন অন্যের মৃত্যুসংবাদ শুনে এসে শেষকালে নিজের মারা যাওয়ার খবর শুনতে কেমন লাগে?আমি ঠিক জানি না আমার কেমন বোধ হল। শুধু মনে হল যেনো কিসের একটা ভার নেমে গেল আমার ওপর থেকে। হয়তো জীবনে বেঁচে থাকাটাই মনের অজান্তে একটা ভার হয়ে বসে গিয়েছিলো। সেটাই নেমে গেলো এখন। দীর্ঘদিন পর, আজ নিজেকে বেশ হালকা বোধ করলাম। কখনো কখনো মৃত্যুও আকাঙ্খিত হয়। বুঝতে পারছিলাম না, অনিমেষকে ঠিক কি উত্তর দিব। বোকার মত জিজ্ঞেস করে বসলাম, "কখন?"

অনিমেষ আবার হাসে। জানায়, রাত বারটা বাজার ঠিক বিশ মিনিট পরে আমার নাম মৃতদের খাতায় লেখা হয়েছে। দেহ থেকে আত্মা আলাদা হয়েছে রাত তিনটার দিকে। এরপর মৃত্যুর সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে এই কিছুক্ষণ আগে আমাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। তবে এখনো কিছু কাজ রয়ে গেছে। মরনশীলদের পৃথিবীতে দেহ সৎকার সমাপ্ত হলেই আমাকে অবয়বে ফিরিয়ে আনা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিতদের পৃথিবীতে আমার দেহ সৎকারবিহীন থাকবে, ততক্ষণ আমাকে এইভাবেই থাকতে হবে।  অনিমেষ বলে, আমাকে নাকি এখন হালকা জমাট বাঁধা কুয়াশার মত লাগছে। ধোঁয়া ধোঁয়া। 

আমার অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে। আমি তখন অনেক ছোট। তখনো বাবা এক্সিডেন্টে পা হারাননি। বাবার চাকরীসূত্রে আমরা তখন থাকতাম রাজাপুরের  সরকারি কলোনীতে। ঝালকাঠীর অখ্যাত একটা মফস্বল সেটা। অখ্যাত ছোট্ট শহরের সেই কলোনীটা আমার কাছে এখনো একটা স্বপ্নপুরীর মত। পুরোনো দোতলা বিল্ডিং, ইট বিছানো রাস্তা, তার একপাশে ফুলে ফুলে লাল হয়ে থাকা বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছ, বালু ভর্তি মাঠ, খোলা ছাদ আর আত্মীয়ের মত প্রতিবেশীরা, একদল সমবয়সী ছেলেপেলের হুটোপুটির আটপৌড়েবিকেল, চাঁদ রাতের উচ্ছ্বাস... এইসমস্ত স্মৃতি প্রায়ই আমাকে পিছুডাক দেয়। দোতলা বাড়িগুলোর নোনাধরা দেয়ালেও যে এত গল্প জমে থাকে, তা বড় হওয়ার আগে কে জানত? স্বপ্নের মত সুন্দর সেই কলোনীর পেছনে বিশাল একটা পুকুর ছিল। বর্ষাকালে সেখানে টইটুম্বুর পানি। শীতকাল বা গ্রীষ্মকালে আবার শুকিয়ে পুকুরঘাটের শ্যাওলা ধরা বিশাল সিঁড়ি বের হয়ে আসত। তখন পুকুরটাকে দেখতে লাগত দুর্ভিক্ষের পাঁজর বেরিয়ে আসা কঙ্কালসার দেহের মত। রোজ সকালে বাবা সেই পুকুরে স্নান করতে যেতেন। আমিও পিছু পিছু যেতাম। উদ্দেশ্য একটাই, সাঁতার শেখা। সেরকম একদিন,  বাবা আমাকে ঘাটে বসিয়ে রেখে মাঝ পুকুরে গেলেন। বলে গেলেন কোথাও যেন না যাই। আমি শান্ত বালিকার মত ঘাড় কাত করে "ঠিক আছে" জানালাম। কিন্তু খানিকবাদেই চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। সাঁতার না জানার পরও কেন জানি না হঠাৎ মনে হল, আমি তো এখন বড় হয়েছি। সাঁতরে বাবার কাছে চলে গিয়ে বাবাকে চমকে দেব। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু পানিতে লাফ দিয়ে আমি টের পেলাম সব সময় যেই ভাবা সেই কাজ আশানুরূপ হয় না। বুঝতে পারছিলাম ডুবে যাচ্ছি। পাগলের মত হাত পা ছুঁড়ছি, তবু আমার শরীর ভেসে উঠছে না। ডুবে যাচ্ছি গভীর জলে। সেইদিন প্রথম আমি জানতে পারি, পানির তলায় চোখ খুললে চোখের সামনে একটা সবুজ পর্দা ঝুলে থাকে।  

আমি জানতাম জলের নিচে শ্বাস নেয়া যায় না, কিন্তু জানতাম না , এক বুক বাতাসের জন্য সেখানে ইচ্ছামতো ছটফটও করা যায় না। যত হাত পা নাড়াই, ধীর গতিতে চলে সবকিছু। চারপাশটা কেমন স্থির, নিশ্চল, অথচ আমার ফুসফুস অশান্ত হয়ে গিয়েছে একটুখানি অক্সিজেনের জন্য। মুখ হাঁ হয়ে যায়। বুদবুদ শব্দ তুলে অনেকখানি পানি ঢুকে যায় গলায়, ধাক্কা দেয় ভেতরে। একরাশ পানির দেয়াল, গলার কাশিটাকে গলাতেই আটকে রাখে। প্রচন্ড কষ্ট হয় সারা শরীর জুড়ে। মনে হয় এখনই বিকট শব্দ করে ফুসফুস ফেটে যাবে আমার। একসময় শরীর দূর্বল হয়ে আসে, আমি হাল ছেড়ে দেই। দুহাত ছরিয়ে দিয়ে তলিয়ে যেতে থাকি জলের অতলে, স্থবির জড় পদার্থের মত। পানির নিচে যত গভীরে চলে যাই, তত টের পাই, আশপাশের তাপমাত্রা কমে আসছে। জলাশয়ের গভীর অংশের  পানি বেশি ঠান্ডা, এই সত্যটাও আমি সেই মুহূর্তে জানতে পারি।  তলিয়ে যাওয়ার ঠিক ওই সময়টায় আমার সামনে মায়ের হাসিমুখ ভেসে ওঠে।  আফসোস হয়, ইশ! কেন লাফ দিলাম? 

হঠাৎ আমার চুলে এক হ্যাঁচকা টান টের পাই। কয়েক মুহুর্ত পরে নিজেকে আবিষ্কার করি জলের ওপরে। বাবার মুখে গভীর উদ্বেগ। আমি প্রাণ ভরে নিঃশাস নেই, গলায় আটকে থাকা কাশিটা বেরিয়ে আসে। সাথে অনেকখানি পানি। একসময় দ্রুত হয়ে যাওয়া হৃদস্পন্দন ধীর হয়ে আসে। গভীর জলের অন্ধকার থেকে এসে ডাঙার আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আমার। আমি বেঁচে আছি, সেটা বুঝতে সময় লাগে। টের পাই, বাবার চোখে স্বাদু পানি-লোনা পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। 

ডুবে যাওয়ার সেই সময়ে  মৃত্যুর একটা হালকা আঁচড় আমি টের পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন, এই সময়ে মনে হয়, এই  সত্যিকার মৃত্যুর অনুভুতি সে আঁচড় থেকে যোজন যোজন দূরের কিছু। কোন ভয় না, কোন আতঙ্ক না, কোন অনুভুতি না, শুধু চুপচাপ চোখ বুজে চিরনিদ্রায় চলে যাওয়া। দরজার ওপাশে।

২.
অনিমেষের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। দূর হতে ভেসে আসা প্রাচীন সাইরেনের মতন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। নিচু থেকে স্পষ্ট হয় কথা। আমি শুনতে পাই, অনিমেষ ডাকছে আমায়। 
-অনসূয়া
-হুম? 
-কি ভাবছ? 
-এই যে বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে  কীভাবে মরে গেছি, তাই ভাবছি। 
অনিমেষের দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আমি আবার ভাবনায় ডুবে যাই। একা থাকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। 

বড় ছেলে বিদেশে থাকে বছর পনেরো হল। সেই মাস্টার্সের বছর দুয়েক পর পিএইচডি করতে গেল ফিনল্যান্ডে। পিএইচডি শেষে জানালো, ওখানেই কাজের অফার পেয়েছে, থেকে যাবে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাওয়ার শখ আমার নিজেরই ছিলো। নানা কারণে আর হয়ে ওঠেনি তা। সুতরাং ছেলের এই সিদ্ধান্তে আমি আর কি বলব। শুধু বললাম, একবার দেশে এসে কিছুদিন থেকে তারপর না হয় যা। কতদিন হয় তোকে দেখি না! 
সে এল না। সেই পনের বছর আগে বড় ছেলেকে চোখে দেখা, তারপর সব শুন্য। জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষের অভাব কি ভিউকার্ড আর ভিডিও কলে পূর্ণ হয়? 
ছোটটাও ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাড়ি জমালো কানাডা। সবমিলিয়ে বাড়িটা ফাঁকা দশবছর ধরে। 

একা থাকাটা খুব কষ্টের। অনিমেষ মারা যাওয়ার পর প্রথম যখন একা হলাম।  এই বাড়ি, এই চারদেয়াল যখন শুন্য লাগা শুরু হল, তখন মনের  ঠিক কোথায় যেন একটা চিকন ব্যাথার মত লেগেছিল। তারপর একে একে বাবা চলে গেলেন, মা চলে গেলেন। প্রতিবার যাওয়ার সাথে সাথে সবাই একটা করে গর্ত করে দিয়ে গেলেন মনের ভেতর। সেই গর্ত ভর্তি স্মৃতির চোরাবালি। যেই না একটু মনে করতে যাই, অমনি গিলে ফেলে। নিখাদ অন্ধকার চোরাবালির সেই গর্তে ডুবে গেলে দেখা যায়, চারপাশে শুধু বিষাদের নীল। 

তবুও এইসব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা এই একাকিত্বের বিষাদ আমাকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে দিতে পারে নি শুধু মাত্র ছেলেদের জন্য। যত আঘাতই আসুক, বারবার ওদের কথা ভাবতে গিয়েই নিজের দুঃখ কষ্টটা ঠিক সেভাবে অনুভব করিনি কখনই। শেষমেশ দুই ছেলে যখন পাকাপাকিভাবে দেশের বাইরে চলে গেল,  ওই প্রথম মহাকাল আমাকে মনে করিয়ে দিল, "অনসূয়া, যাপিত জীবনের এই বিশাল তেপান্তরে, তুমি একা।"
অনিমেষ আবার আমাকে ডাকে। সেই ডাকাডাকিকে মনে হয় বহুদূর থেকে ভেসে আসা আবছা কিছু আওয়াজের মত। আমার সম্বিত ফিরে আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগে বোধহয়। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি অনিমেষ চেয়ে আছে। তিরিশ বছর আগে যখন সকাল বেলায় ওর পরে ঘুম থেকে উঠতাম, তখন ওর চোখে এই দৃষ্টি দেখা যেত। চোখ খুলেই দেখতাম এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেই দুটি চোখভর্তি রাজ্যের দুষ্টুমি। 

অনিমেষ হেসে বলল, "পাশে দেখো তো, কে এসেছে!"
পাশ ফিরে তাকাতে মনে হয়, এই দৃশ্যের জন্য  আমি বহুদিন ধরে তৃষিতের মত অপেক্ষায় আছি। ঠিক ডানপাশে বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মুখভর্তি হাসি যেন উপচে পড়ছে। যেভাবে অনিমেষ হাসছে, ঠিক সেভাবে হাসছেন তাঁরা। অনিমেষ চলে গেলে আমি কোনদিন ভাবিনি, মা-বাবা-অনিমেষ তিনজনকেই একসাথে আবার কখনো দেখতে পাব। দেহহীন অববয়বে কাঁদা যায় না। একটুখানি কেঁদে ফেলার জন্য আমার ভেতরে আবার ছটফটানি শুরু হয়।  মনে হয়, যদি একটু কাঁদতে পারতাম, খুব ভালো লাগত। 

হঠাৎ টের পাই কেন জানি ভারী হয়ে আসছি আমি। এতক্ষন ভাসতে ভাসতে নিজেকে বেশ হালকা লাগছিল। পাখির পালকের মতন। পাতলা ফুরফুরে একটা অনুভুতি হচ্ছিল। যদিও শরীর না থাকার অস্বস্তিটা রয়েই গিয়েছিল, তবুও সেই অবস্থায় থাকতে মন্দ লাগছিলো না। কিন্তু এখন ক্রমাগত ওজন বাড়ায় শরীর  না থাকার চেয়ে বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই ওজন হয়ে যাবে একশ কেজি, আর আমি ধপ করে বিছানায় পড়ে যাব। 

আমার অস্বস্তিটা সবাই টের পায়। মৃতদের দুনিয়ায় হয়ত সবাই সবার অনুভুতি বুঝতে পারে। মা বললেন, "সৎকারের কাজ শুরু হয়েছে তো, দেহ ফিরে আসছে তোর। এইবার আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর আবার আমরা একসাথে ঘুরব। তুই আসবি বলে আজকে তোর প্রিয় ছানার সন্দেশ বানিয়ে রেখেছি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বাড়ি চল, অনেক অনেক গল্প করব আমরা।" 
নিচে আকিয়ে দেখি দেহটা নেই। ভাবতে ভাবতে কত সময় চলে গিয়েছে, টেরই পাই নি! অদ্ভুত একটা আনন্দময় অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে আমার ভেতরে। কতদিন পরে আবার সেই পুরোনো খুশিরা ফিরে আসছে। অস্থিরতা বাড়ে, এই দেহহীন অবয়বে আর কতক্ষন? সৎকার শেষ হচ্ছে  না কেন এখনো? এত দেরি হয়?

মা পাশে এসে বসেন, বাবা আর অনিমেষ কথা বলতে থাকে। আমার আবার পুরোনো কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। 
বিয়ের তিনবছর পর অনিমেষের চাকরী চলে গেল। কোম্পানি দিনদিন দেউলিয়া হচ্ছিল। অতএব নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই। সেই ছাঁটাইয়ে কাটা পড়ে অনিমেষও। আত্মসম্মানটা বরাবরই বেশি ছিলো ওর। আমাকে ছাড়া কাউকে জানালো না। সেই দুইবছর, দুজনে ছেলে পড়িয়ে, সেলাই করে রোজগার করেছি। একবেলা আধাবেলা না খেয়ে থেকেছি, তবু আমাদের ভালোবাসা কখনো একবিন্দু কমে যায় নি। কিসব কষ্টের দিনছিল সেসব।  বছর দুয়েক পড়ে হুট করেই ওর চাকরীটা হয়ে গেলো। বেসরকারি অফিসের বড় পোস্ট। টাকার অভাবটা আমাদের আর রইল না। এর বছরখানিক পড়ে বড় ছেলের জন্ম। তারও দু'বছর পরে ছোট ছেলে। এই যার সাথে দশটা বছর সকল হাসিকান্না ভাগ করে নিলাম, তার অনুপস্থিতির দহনটা হাজার চাইলেও প্রকাশ করা যায় না। আমি পারি না প্রকাশ করতে। কোথা থেকে জানি একরাশ মন খারাপের কালো মেঘ এসে ঘিরে ধরে। 

মায়ের টানাটানিতে আবার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়। দেখি মা আমার হাত ধরে টানছেন আর বলছেন, "ওঠ, ওঠ। সৎকার শেষ। যেতে হবে আমাদের।" উঠে বসে দেখি শরীর ফিরে এসেছে আবার। অনিমেষ এগিয়ে এসে হাত ধরে বলল, "চলো এবার।" 

বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখি ঘরভর্তি মানুষ। সবাই কাঁদছে। জমিরের কান্নাটা বেশি কানে লাগে। বড় আজব ছেলে ছিল জমির। আমার ছোট ছেলের বয়সী। মা-বাবা নেই, গ্রাম থেকে এনে ওকে বাড়ির বাগানে মালীর কাজ দিলাম। একা একাই থাকত আর কাজ করতে করতে গাছেদের সাথে কথা বলত। 
"বুঝলা মন্টু মিয়া, মানুষ হইতেসে জলের মত। যে পাত্রে রাখবা, ওই পাত্রের আকার নিব। এই যেমন অনু মাসি আমারে কইল মালী হইতে, আমি মালী হইয়া গেলাম। আবার যদি বলত, দাড়োয়ান হইতে, তাইলে তাই হইতাম। খালি তোমরা গাছেরা, একজায়গায় খাড়াই থাকো, আর মানুষের বোকামী নিয়া হাসো। এইটা কিন্তু একেবারেই ঠিক না। মানুষ হইল সবার সেরা। নাজিম হুজুরে কইসে, মানুষ হইল আশরাফুল মাখলুকাত। আশরাফুল মাখলুকাত মানে জান? সৃষ্টির সেরা জীব। এ কী!  তুমি আবার হাসতেসো?  ঝন্টু মিয়া, তোমার বন্ধুরে হাসতে মানা করো। নির্বোধ গাছ গাছড়া আমার পছন্দ না।"
ঝন্টু-মন্টু  হচ্ছে বাগানের অভিজাত সদস্যদের দুইজন। চকলেট কসমসের দুইটি গাছ। কোন একটা অদ্ভুত কারনে জমির ওদের সাথেই বেশি কথা বলত। 
সেই জমির এখন বারাদায় হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। এই কান্নাটা বিশুদ্ধ কান্না। কষ্টের কান্না। জমির জানে না গ্রামের বাড়ির বেশ কিছু জমি আমি তার নামে করে রেখেছি। 

৩.
কেমন কুয়াশায় ঘেরা একটা পথ। ঝাপসা আলোর আভা ছড়িয়ে আছে এমাথা থেকে ওমাথা। ঠান্ডা হিমহিম হাওয়া। গা শিরশির করে। আমার হাত ধরে রেখেছে অনিমেষ। ওকে অনুসরণ করেই এগোতে থাকি। আশপাশে আরো মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু স্পষ্ট করে কাউকেই দেখা যায় না। অদৃশ্য কোলাহলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। খুব ছোটবেলায় বাবার সাথে মেলায় যেতাম। তখনকার পরিবেশের সাথে আশ্চর্যরকম একটা মিল পাচ্ছি। মেলায় অনেক অনেক মানুষ দেখে মাথা ঘুরে যেত। ভীরের মাঝে মনে হত কী একটা ঘোরের মাঝে হাঁটছি। চারপাশে অনেক শব্দ, অনেক জীবনের উচ্ছ্বাস, তার মাঝে ছোট্ট আমি আর বাবা। শক্ত করে ধরে রাখতাম বাবার কড়ে আঙুলটা। বিশাল জনসমুদ্রের কোলাহলে বাবাকে মনে হত সাগরের তলদেশ অব্দি শেকড় ছড়ানো মহীরূহ। তাকে আঁকড়ে ধরেই আমার বেঁচে থাকার চেষ্টা। 
অনেকটা সময় হেঁটে আমরা হলরুমে পৌঁছালাম। হলরুম যায়গাটা বিরাট। ঝকঝকে সাদা দেয়াল, উপর হতে গম্বুজের আকৃতি নিয়ে নিচে নেমে এসেছে। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে। আলোর উৎসটা কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। পুরো আলোটা সাদা দেয়াল, সাদা মেঝেতে প্রতিফলিত হয়ে একসাথে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। কেবল ছড়িয়ে পড়েই ক্ষান্ত হয় নি, এই প্রতিফলিত আলো স্বয়ং আসল আলোর উৎসটাকেই ঢেকে ফেলেছে। স্রষ্টাকে অতিক্রান্ত করে যাওয়া সৃষ্টির মতন। 

আমার খানিকটা ভয় ভয় লাগে। আবার উত্তেজনার অনুভূতিটাও হচ্ছে বেশ স্পষ্টভাবে। মা বলেছেন খানিকবাদে হিসেব নেয়া হবে। যাদের যাদের দুনিয়া ছেড়ে আসার কথা সবাই এসেছে কি না। এই কাজটাতেই বেশ সময় লাগে। প্রতিদিন প্রায়  দেড় লক্ষ মানুষের নাম নথিবদ্ধ হয়। সবাই এসেছে কী না খতিয়ে দেখাটা  তাই বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যদিও এখানে কাজ হয় বেশ দ্রুত। পৃথিবীতে এই কাজ শেষ করতে চার-পাঁচদিন লেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে তা হয় না। সবাই নিজের নাম লিখে জমা দেয় সাথে সাথে তালিকা থেকে নাম কাটা যায়, যাদের নাম থেকে যায় তারা বেঁচে যাওয়া মানুষ। কোন একটা কারনে তাদের আত্মা ও দেহ আলাদা করা হয়ে ওঠেনি। ওদের মৃত্যু আবার বহুদিন পরে হয়। 

কতক্ষণ ধরে চেকিং হচ্ছিল জানি না। এখানে বসার সুযোগ নেই। দাঁড়িয়ে থাকাই নিয়ম। দীর্ঘক্ষণ ধরে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন পায়ে খিল ধরে যাচ্ছিল,  মনে হচ্ছিল আর পারব না, মার্বেল পাথরের এই মেঝেতেই  চীৎ হয়ে শুয়ে পড়ব ঠিক তখন রুমের মাঝ থেকে ঘোষণা এলো চেকিং শেষ। আমরা যেতে পারি। পাশ থেকে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বিরক্ত গলায় অনিমেষকে বললেন, "শুনছ? আজ পুতিনের জানও কবচ করার কথা ছিল। ব্যাটা নাকি ব্ল্যাক ম্যাজিক করে নাম কাটিয়েছে। এই পাপীগুলোর  কপালে খুব খারাবি আছে, দেখে নিও।" 
অনিমেষ কিছু না বলে বোকার মত হাসতে থাকে। মহিলা গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কে উনি? কি বলে গেলেন কিছুই তো বোঝা গেল না।"
"উনি সম্পর্ক আমার  লতায় পাতায় পিসি হন। মাঝে মাঝে দেখা যাক্ষাৎ হয় আর কি।"
"আর ওই যে কি সব ব্ল্যাক ম্যাজিকের কথা বলে গেলেন? ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাথে এখানকার সম্পর্ক কী?" 
অনিমষ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে, 
"অনসূয়া, পৃথিবীতে মৃত্যু কাটানোর একটাই উপায় আছে। তা হচ্ছে এই ব্ল্যাক ম্যাজিক। এ ছাড়া কোনভাবেই তুমি মৃত্যুকে এড়াতে পারবে না। নথিবদ্ধ হওয়ার মানে হচ্ছে এটা হবেই।দৈব কিছু কারনে প্রতিদিনই অবশ্য তালিকাবদ্ধ হয়েও অনেকে বেঁচে যাচ্ছে, কিন্তু সেই সৌভাগ্যবান দেড় লক্ষ মানুষের মাঝে তিন চারজন হন। বাকি রইল এই ব্ল্যাক ম্যাজিক। সাধারণত ব্ল্যাক ম্যাজিক বলতে যা বুঝি আমরা এটা ঠিক তেমন না। আরো বেশি ভায়োলেন্ট, আরো বেশি ভয়ঙ্কর। অস্বাভাবিক কিছু রিচুয়াল পালন করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে হয় মৃত্যু হবার ঠিক আধ ঘন্টা আগে আগে। একদম ঘড়ি ধরে কাঁটায় কাঁটায় আধাঘন্টা। এক সেকেন্ড এদিক ওদিক না। বুঝতেই পারছ, মৃত্যুর সময় আগে থেকেই ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ড ধরে জানা না থাকলে কিছুই করা সম্ভব না। এমনকি সময় জানা থাকলেও অত্যধিক দক্ষ পুরোহিত ছাড়া কিছুতেই এই ম্যাজিক সঠিক সময়ে শেষ করা অসম্ভব।  আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কার মৃত্যু কখন কবে হবে কেউ জানে না। যারা এই ম্যাজিকের সাহায্য নিচ্ছে, কিভাবে নিচ্ছে কেউ জানে না। মর্ত্যলোকের এই ব্যাপারটি এখানে এখনো ধোঁয়াশা হয়ে আছে। সমাধান করা যাচ্ছে না। অতএব ঠিক করা হয়েছে যারা এই প্রক্রিয়ায় মৃত্যুকে ধোঁকা দেবে ওদের মৃত্যুর পরে শাস্তির মাত্রাটা বেড়ে যাবে। ভয়ঙ্কর শাস্তি।"

আমি বোকার মত চেয়ে থাকি ওর দিকে। অনিমেষ বলে চলে, 
"সাধারণত শিল্পীরা কেউ কেউ এর আশ্রয় নেন। মৃত্যুকে ফাঁকি দেন। যেমন ধরো বব মার্লে, জর্জ হ্যারিসনদের আমি নিজের চোখে সাজা পেতে দেখেছি। এখানে প্রথম যেদিন আসি, সেদিন বাবা আমাকে জানিয়েছিলেন এই কথা। একদিন ভাবলাম ওদের শাস্তিটা কিরকম হয় দেখে আসি। তারপর গেলাম একসময়। কিন্তু গিয়ে কি দেখি জান? মার্লে, হ্যারিসনদের পাশাপাশি এই তালিকায় সবচে বেশি নাম রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। ভিক্টোরিয়া, রুজভেল্ট, রাসপুতিন, লেনিন থেকে শুরু করে হিটলার, ট্রুম্যান, রাজীব গান্ধী, গ্লিগর্ভ প্রত্যেকে একবার হলেও এর সাহায্য নিয়ে মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরেছেন। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রো। তার ছয়শ চৌত্রিশবার মৃত্যুকে ধোঁকা দেয়ার অস্বাভাবিক ইতিহাসে পরলোক থেকে সরাসরি মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়েছিল দশবার।বাকি ছয়শ চব্বিশবার মানুষের চেষ্টা ছিল।সেগুলতে এমনিতেও তিনি মরতেন না, কিন্তু এই দশবারের ন'বার তিনি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেঁচে গিয়েছেন। এই জন্য এই পরলোকের সবচে ভয়ঙ্কর শাস্তিটা তার কপালেই জুটেছে। একটানা সাত হাজার নয়শ চুরাশি কোটি বছর উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা। এর মধ্যে সারাদিন রোদের প্রচন্ড তাপে চামড়া পুড়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়, আর এই অবস্থায় হয় লবণ বৃষ্টি। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা অনসূয়া। আবার অন্যদিকে সারাদিন ঝুলে থেকে থেকে পুরো শরীরের সব রক্ত মাথায় এসে জমে যায়। জমতে জমতে একসময় রক্তের অত্যধিক চাপে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। সারারাত ওভাবে যন্ত্রণা ভোগ করত থাকে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে। পরদিন সকালে আবার নতুন করে মাথা তৈরি হয়, আবার সেই যন্ত্রণা শুরু হয়। একদম জিউস যেভাবে প্রমিথিউসকে  অনন্তকালের জন্য সাজা দিয়েছিলেন, ঠিক তেমন। পার্থক্য একটাই, প্রমিথিউসকে উদ্ধারের জন্য একজন হারকিউলিস ছিলেন। এই পরলোকে কাস্ত্রো সাহেবের  কোন হারকিউলিস নেই।"

সমগ্র প্রক্রিয়াটা চিন্তা করে আমার শরীর গুলিয়ে উঠল কেমন জানি। অনিমেষ বলল, 
"চলো, মৃত্যুর পরের সবচে সুন্দর মুহুর্তটা উপভোগ করতে নিয়ে যাই তোমাকে। সবাই এই সুযোগটা পায় না। শুধু মাত্র যারা মৃত্যু পরবর্তী শাস্তি থেকে মুক্ত, তারাই পায়। এখানে মৃত্যু পরোয়ানা জারির সময়েই ঠিক করে রাখা হয় মৃত ব্যক্তি এখানে শাস্তি পাবে না সুখ। ধরো হানাহানি, অন্যায়, অবিচার, খুনোখুনি, রাহাজানি থেকে দূরে থেকে,  কারো ক্ষতিসাধন এড়িয়ে থেকে মোটামুটি ভালো মানুষ হলেই তুমি পাশ। এই  ক্ষেত্রে তুমি যথেষ্ট ভালো নাম্বার পেয়েই পাশ করেছ। "

আমি জানতে চাইলাম, "তা এই সবচে মধুর অনুভুতি প্রদানকারী বস্তুটির নাম কি?"
অনিমেষ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, "তোমাকে সজ্ঞানে মৃত্যুর স্বাদ দেয়া।"
মনে মনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। শুধু ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, "চলো।"

৪.
ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা ঠিক তিন ছুঁই ছুঁই। স্পষ্ট করে সেকেন্ডের কাঁটার টিক টিক আওয়াজ পাওয়া যায়। মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা পাখার আওয়াজ যেন জানিয়ে দিচ্ছে এখন সময় ঘুমানোর, গভীর ঘুমে ডুবে থাকার। বিছানায় শুয়ে থাকলেও আমার চেতনাটা কেন জানি পুরো বাসা জুড়ে কাজ করছে। হঠাৎ টের পাই, জামিলের রুমে কাদের মাঝে যেন বেশ ধস্তাধস্তি চলছে। টেবিলে ধাক্কা লাগছে,পানির জগ উল্টে পড়ে যাচ্ছে। স্রোএকা জামিলের সাথে ওরা তিনজন পেরে উঠছে না। 

শেষ পর্যন্ত অনেক কসরতের পর জামিলকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। জামিল চীৎকার করার চেষ্টা করছে, মুখে কাপড় গুঁজে দেয়ায় পারছে না। এদিকে ওরা তিনজন এখন এগিয়ে আসছে আমার রুমের দিকে। সবার পরনেই কালো পোশাক, মুখে কালো মুখোশ। ওরা জানে না মুখোশে ঢাকা থাকলেও আমি ওদের সবার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এমনকি নিজেদের মাঝে যে ফিসফিস করে কথা বলছে, সেই ফিসফিসানিও স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি আমি। পরলোক থেকে আসার সময় আমাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, শুয়ে থাকলেও কোথায় কখন কি হবে সব কিছু আমি এমনিতেই টের পাব। 
"লকারটা চেক কর, ওখানেই দলিলগুলো রাখা। বুড়িকে কতবার নিষেধ করলাম, জায়গা জমিগুলো এভাবে অকাতরে দান কর দিও না। তা না, উনি জামিলকে গ্রামের বাড়ির নবাবি দিয়ে দিচ্ছেন, বাড়িতে বৃদ্ধাশ্রম বানাচ্ছেন। ঢং দেখে বাঁচি না। ছেলেরা বিদেশ থাকে বলে কি সব সম্পত্তি এভাবে বিলিয়ে যেতে হবে? "

ওদের কথা শুনে আমি মনে মনে হেসে ফেলি। 
আমার মুখে বালিশ চাপা দেয়া হয়েছে। আমি চাইলেই উঠেবসে ওদের ভড়কে দিতে পারতাম, কিন্তু অনিমেষ আমাকে বলেছে চুপচাপ শুয়ে থেকে পুরোটা দেখতে। 
বালিশের চাপায় নাকে মুখে বাতাসের আনাগোনা বন্ধ হল। ক্রমাগত সেই চাপ বাড়ছে। স্বতস্ফূর্ত প্রক্রিয়াতেই শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অক্সিজেনের তীব্র অভাবটা আবার টের পাই আমি। সেই ছেলেবেলায় পানিতে ডুবে যাওয়ার মুহুর্তের অনুভূতির মতন। একটু বাতাসের জন্য একবুক হাহাকার। শরীরের সমস্ত মাংসপেশী যেন খিঁচ ধরে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রনায় বার বার খিঁচুনীর মত হচ্ছে। মস্তিষ্কের সমগ্র মনোযোগ এখন একটু অক্সিজেন কিভাবে পাওয়া  যায় সেদিকে। বারবার ছটফট করছে শরীর, তবু মুক্তি পাচ্ছি না। সমস্ত দেহ-মন জুড়ে  অসহ্য যন্ত্রণা। শুধু বাতাস চাই। সৌরজগতের এই নীল গ্রহের অল্প একটু বাতাস, যার শতকরা ৭৮% নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন। 

হঠাৎ মনে হয় লাভ নেই। কিভাবে কিভাবে জানি মস্তিষ্ক টের পেয়ে গিয়েছে অক্সিজেন আসবে না। এটাই ধ্রুব সত্য। মিছে শক্তি খরচ করে লাভ নেই। যা আসবে না তা কি জোর করে আনানো যায়? শরীরকে সংকেত দেয় মস্তিষ্ক, "থামো! লাভ নেই!" থেমে যায় শরীরের ছটফটানিও। শান্ত হয়ে আসে দুজন। মাথার দুপাশের দপদপানি থেমে যায় হুট করেই। নরম হয়ে আসে শরীর জুড়ে শক্ত হয়ে থাকা পেশীরা। আশ্চৰ্য এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে পা থেকে মাথা অব্দি।
 
কোথা থেকে যেন বেলী ফুলের ঘ্রাণ আসে। তীব্র একটা ঘ্রাণ। ঘরময় সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। কতকাল আগে অনিমেষ প্রতিরাতে বেলীর মালা নিয়ে আসত। রাগ করতাম বাজে খরচা বলে। রাতে ঠিকই মাথার পাশে নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। পুরনো সেই সুবাস যেন পৃথিবীর পাতায় আমার শেষদিনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এদিকে শীতের নদীর মত আমার দেহ মন স্থির। ঢেউ নেই, স্রোত নেই। বরফ শীতল জলের এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকার মতন। এই দেয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ, সিলিং ফ্যানের ঘরঘর আওয়াজ চীৎকার করে আমাকে জানান দিতে চায়, "অনসূয়া, তূমি মারা যাচ্ছ। তোমাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।"
আমি স্মিত হেসে জবাব দেই, "চুপচুপ, কথা বলো না। দেখছো না এই পরিবেশ কত সুন্দর, শীতল শান্ত জলের মতন! কেন চীৎকার করে এই জলে ঢিল ছুঁড়ছ? কথা বলো না। এই আশ্চর্য নিরব সুন্দর পরিবেশটা নষ্ট করো না। যাও তো, যাও। ছেলেরা মেরে ফেলছে? জানি তো আমি। ওদের মুখোশের নিচে সবার চেহারা দেখেছি । তৃতীয় ব্যাক্তিটি যে কে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু বাকি দুটোকে যে আমিই পেটে ধরেছি সন্দেহ নেই। যাক গে সে কথা, লোভ করছে, করতে দাও ওদের। নিজেরাই বুঝবে একদিন। 

একি! অনিমেষ কাঁদছ কেন? ও দেয়াল ঘড়ি, অনিমেষ কাঁদে দেখো! ও কি ভেবেছিল ওর ছেলেরাই একদিন ওর অনসূয়াকে মেরে ফেলবে? এই যে বেলীর ঘ্রাণ, যাও তো ওর মন ভালো করে দাও। আমি আসছি একটু পরেই।  এখন আপাতত তুমি যাও, সিকিভাগ মন ভালো করে দাও। বাকিটা আমি আসলেই হয়ে যাবে।"
আমার চারপাশে সবাই কাঁদে।  এই সিলিং ফ্যান কাঁদে, দেয়ালঘড়ি কাঁদে। বোকাসোকা জমিরটাও ও ঘরে কাঁদছে আকুল হয়ে।  পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। বেচারা জানলো না তার অনু মাসী চলে যাচ্ছে। কতকাল বলতো, "ও মাসী, তুমি বাড়ি চলো, দেইখে শুইনে একটা মেয়া ঠিক করে দাও। একা একা ভালো লাগতিসে না আর।" ওর বোকা বোকা কথা শুনে আমি হাসতাম। এ মাসের শেষে ওর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আমার আর কোথাও যাওয়া হবে না। জমির কি বিয়ে করবে কোনদিন? জমিরের সেই জীবনে তার অনু মাসীর গল্পটা থাকবে তো? 

ঘুম আসছে প্রচুর। শেষবার কবে এমন প্রশান্তিময় ঘুম এসেছিল জানি না। মনেও নেই ঠিক। ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা বুজে যায় অজান্তে। চলে যাওয়ার তীব্রতম সৌদর্যের মুহুর্তকে অতিক্রম করে ঘুমিয়ে যাওয়াটাই বেশি গুরুত্ব পায় আমার কাছে। আমি চোখ বুজি।  

এখন দরজার এপাশে, সব কিছু অন্ধকার। আর ওপাশে, আলো ঝলমলে পরলোকে অনিমেষ-মা-বাবার হাতছানি। এখন আমি স্পষ্ট করে জানি, মরে যাওয়া বলতে কিছু নেই। সবই বেঁচে ফিরে আসা।