পোস্টস

গল্প

বিশ্বাস করেন, রাসেল ভাই

১৪ মে ২০২৩

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

খরখরা রোদে পাঠাও থেইকা নাইমাই মেজাজ খারাপ হইলো! একটার দিকে ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারের গেট লাগাইয়া দেয়। বাইরে হাজার লক্ষ মানুষ থাকলেও কিংবা যে যত দূর থেইকা, যত ইমার্জেন্সিতেই ভিসার অ্যাপ্লাই করতে আসুক না কেন, ভেতরে ঢুকতে দেবে না। একটা এখনো বাজে নাই। ২৫ মিনিট বাকি আছে। এরমধ্যেই আমারে এখন ভিসার জন্য পেমেন্ট করতে হবে। ভেতরে যদিও জায়গায় জায়গায় দালালরা দাঁড়াইয়া থাকে যেকোনো সার্ভিস দেওয়া জন্য। ভিসার ফি থেইকা দুইশ টাকা বেশি দিলেই তারা পেমেন্ট কইরা দেবে। কিন্তু আমি দালালদের টাকা দিতে মোটেও আগ্রহী না। দরকার হইলে আজকে ভিসার কাগজপত্র জমা না দিয়াই চইলা যাবো!

টাকা দেওয়ার লাইন তেমন একটা দীর্ঘ না। দেরি কইরা আসলে একটা লাভ আছে, বেশিক্ষণ কোনো লাইনেই দাঁড়াইয়া থাকতে হয় না। টাকাটুকা দিয়া গরমে গজ গজ করতে করতে ভিসা সেন্টারের টোকেন নিয়া দেখি আমার সিরিয়াল নম্বর ২০৮৩। সেন্টারের জায়গায় জায়গায় ডিজিটাল বোর্ড লাগানো। একটার দিকে চোখ রাইখা দেখলাম, ট্যুরিস্ট ভিসায় এখন ১৬৩৫ সিরিয়াল নম্বর চলতেছে। আরো প্রায় চারশ আটচল্লিশ জন মানুষের পরে আমার সিরিয়াল নম্বর আসবে! ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারের লোকগুলারে আমার কখনোই পছন্দ না। প্রথম যখন ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করতে আসছিলাম, চিল্লাচিল্লি লাইগা গেছিল। ভিসা না দিলে তোমরা ট্রিটমেন্ট করাইবা কই, ঘুরবা কই, ব্যবসা করবা কই- এই রকম একটা এটিটিউড এদের চোখেমুখে স্পষ্টই ফুইটা থাকে! আমরা না গেলে তোমরা এত টাকা কামাইতা কই- এই এটিটিউডটা রাইখা আমিও ততদিক বিরক্তি নিয়া এদের সঙ্গে কথা বলি। দাঁড়াইয়া থাকতে দেবে না। বসেন বসেন বইলা মাইকে একজন সিকিউরিটি গার্ড চিল্লাইয়া যাইতেছে। মোবাইলে কথা বলা যাবে না। সেন্টারের ভেতরে ছবি তোলা যাবে না। ব্লা ব্লা ব্লা…আরো কত কত নিয়মের ফিরিস্তি দিতেছে ননস্টপ। আমার মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হইয়া গেছে এইসব বক বকে।

সিট খালি পাবো কই বসতে! দুনিয়ার মানুষ গিজ গিজ করতেছে! সামনের সিটগুলা সবই বুকড। মানুষের মাঝখান দিয়া হাসি হাসি মুখে ‘এক্সকিউজ মি’ বইলা বসতে বিরক্ত লাগবে। কিছু করার নাই! আপাতত এরচেয়ে বিরক্তিকর লাগতেছে ঘন ঘন কানের সামনে সিকিউরিটি গার্ডের ‘কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সিট খালি আছে, বসে পড়ুন।‘ চিল্লানি। কোন সিটে বসা যায় খুঁজতে খুঁজতে চোখ আটকাইয়া গেল ৫ নম্বর সারিতে। আমার মতো বাইট্টা হাইটের একজন মানুষের পক্ষে ওইদিকে কী কী প্রকারের মানুষ বইসা আছে, তা ঠিকঠাক দেখতে পারার কথা না! কিন্তু আমি দেখতে পাইলাম। সবাইকে না। একজনকে। এইটার কারণ তার হাইট। লম্বা একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা লোক হাত দিয়া তার লম্বা চুল ঠিক করতেছে দেইখাই চোখ ওইদিকে গেছে! বাকিটা ইতিহাস!  

‘রাসেল ভাই…আমরা আপনাকে ভালোবাসি!’- ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারের মাঝখানের কলামের পাঁচ নম্বর রো’তে যেই লোকের দিকে আমার চোখ পড়লো, তারে দেইখা ২০ বছর আগে কালার পেপার কাইটা ৩ নং লাইনের ক্লাবের বাইরে লেইখা ঝুলাইয়া রাখা এই লাইনগুলা ঝট কইরাই ফ্ল্যাশব্যাকে চোখে ভাসলো! আমি মোটামোটি নিশ্চিত এটা রাসেল ভাই-ই। ২০ বছর আগের এবং পরের মধ্যে পার্থক্য ক্যাজুয়াল রঙ-বেরঙের টি-শার্ট জিন্সের বদলে রাজনৈতিক নেতাদের মতো সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর চুলগুলা সামনের দিকে এবং জুলফির দিকে ধূসর রঙ হইয়া যাওয়া! এই লোক রাসেল ভাই না হইয়া অন্য কেউ হওয়া সম্ভবই না! ছোট্টবেলার ক্রাশরে কেউ ভুলতে পারে না। আর রাসেল ভাই তো ছিল ৩ নং লাইনের জাতীয় ক্রাশ!

ওইখানে গিয়া বসবো নাকি ভাবতে ভাবতে রিস্কটা নিয়া নিলাম। বুকে এত বছর পরও কেন ধুক ধুক করতেছে, বুঝতেছি না! রাসেল ভাই আমার সাত বছরের বড় ভাইয়ের চেয়েও ম্যালা বড়। তার সঠিক বয়স আমি আজও জানি না। আমার ছোট চাচারেও দেখতাম তারে রাসেল ভাই ডাকতে, আমার ফুফুরা অবশ্য তারে নাম ধইরাই ডাকতো। সেই হিসেবে ঠিক সময়ে বিবাহ করলে আমার সমান না হইলেও কাছাকাছি বয়সের একজন পুত্র বা কন্যা যে রাসেল ভাইয়ের থাকতো, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই! যাই হোক, ক্রাশ তো ক্রাশই! তার বয়স দিয়া কী হবে! রাসেল ভাইয়ের একটা সিট পরে বসার জন্য খালি পাওয়া গেল। মোবাইল চাপতে চাপতে বইসা পড়লাম। তেরছা চোখে রাসেল ভাইয়ের দিকে তাকাইয়া দেখলাম, উনার দিন-দুনিয়ার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই, এক হাতে চুল ঠিক করতে করতে উনি মোবাইল দেখতেছেন।

লোকটা এখনো আগের মতোই সুদর্শন আছেন। আরেকটু বেশি সুদর্শন হইছেন কি? 'সাজন' সিনেমায় সঞ্জয় দত্তের মতো বড় চুল তার বরাবরই ছিল। এখনো আছে। উনার মতো স্মার্ট লোক আমি মিরপুর এলাকায় দেখতে পারছিলাম, এইটা একটা অবাক করার মতো ঘটনা। ২০ বছর আগের মিরপুর এত আধুনিক ছিল না। মিরপুররে বরং আমার ধানমন্ডিতে থাকা বন্ধুরা গ্রাম বইলা টিটকারি করতো। শুক্কুরে শুক্কুরে দুই দিন হইলো মেট্রোরেলের ছোঁয়ায় মিরপুর এত উত্তরাধুনিকে পরিণত হইছে। দাদার বাড়ি ওই এলাকায় হওয়ার সুবাদে কয়েক বছর আমারে মিরপুরে থাকতে হইছে। আমার জীবনের প্রথম ক্রাশ রাসেল ভাইরেও আমার সেইখানেই পাওয়া। আমাদের বাসার একটা বাসা পরেই রাসেল ভাইদের বাসা।

রাসেল ভাইরে আমরা সব সময় দেখতাম একটা পালসার নিয়া ঘুইরা বেড়াইতেছেন। মাঝে মাঝে খয়েরি কালারের একটা টয়োটা করোলা নিয়াও উনি বাইর হইতেন। সেইটা অবশ্য যেকোনো বিশেষ অকেশনে। গাড়ি নিয়া রাসেল ভাই এলাকা থেইকা বাইর হইতেছেন বা এলাকায় ঢুকতেছেন, এটা আমরা চোখে না দেখলেও টের পাইতাম হাই ভলিউমে ছাইড়া রাখা একটা মাত্র গানে! রাসেল ভাই যখনই আসতেন-যাইতেন, আমরা ঘরে কিংবা এলাকায় যেইখানে থাকি না কেন, শুনতে পাইতাম- ‘বিছরে আভি তো হাম ব্যাস কাল পারশো/জিয়ুঙ্গি ম্যায় ক্যায়সে ইস হাল ম্যায় বারসো/মউত না আয়ি, তেরি ইয়াদ কিঁউ আয়ি/লামবি জুদায়ি…’। এটা জানা সত্ত্বেও যে এমন একটা চরম বিচ্ছেদের গান রাসেল ভাই বাজাইতেন আজমেরি আপার স্মরণে, এই লাইনগুলা কানে যাওয়া মাত্রই এলাকার উঠতি বয়সী কিশোরীরা যে যেখানে থাকতো, হুড়মুড়াইয়া বারান্দায়, জানালায় বা বাড়ির দরজার কাছে চইলা আসতো রাসেল ভাইরে একবার দেখার জন্য।

৩ নং লাইনের লোকজন বেশ সংস্কৃতিমনা। মিল্লাত ক্যাম্পের পাশ ঘেঁইষা থাকা এই এলাকা আগে ঠিক এমন ছিল না। জাপান-ইতালি ফেরত কিছু মধ্য বয়স্ক চাচা এবং রাসেল ভাই আর তার বন্ধুদের এইক্ষেত্রে অনেক অবদান আছে। এলাকার ক্লাবরে তারা নারী-পুরুষ সবার জন্য ফ্রেন্ডলি বানাইতে পারছিলেন। বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ দিবসগুলাতে ওইখানে কালচারাল এবং গেমিং অ্যাক্টিভিটিজ হইতো। যদিও এলাকার যারা বেশি মুরুব্বি, তাদের এইসব খুব একটা পছন্দ ছিল না। কিন্তু তারা এই বিষয়ে চুপ থাকতেন রাসেল ভাইয়ের ভয়ে। রাসেল ভাইরে কোনো একটা বিশেষ কারণে সবাই সমীহ কইরা চলতো। তারে ভয় পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা আমার চোখে কোনোদিন পড়ে নাই। নিজে নামাজ না পড়লেও প্রতি ওয়াক্তের নামাজের সময় মসজিদের মোড়ে দাঁড়াইয়া তারে গল্প করতে দেখতাম। আসা-যাওয়ার পথে প্রত্যেক মুরুব্বিরে সালাম দিয়া উনি শরীর-স্বাস্থ্যের খবরা-খবর নিতেন। একমাত্র আজমেরি আপার আব্বারে দেখলেই মোড়ের দোকানের ভেতর ঢুইকা যাইতেন রাসেল ভাই। আজমেরি আপার আব্বা মসজিদে না ঢুকা পর্যন্ত সে আর দোকান থেইকা বাইর হইতেন না।

আজমেরি আপা আর রাসেল ভাইয়ের প্রেমের ঘটনা এলাকার সবার কাছেই ওপেন সিক্রেট। মুরুব্বি থেইকা বাচ্চা বাচ্চা এই গল্প জানে। যদিও একেক জনের ভার্সন একেক রকম। অধিকাংশ চাচী-ফুফুদেরই রাসেল ভাইয়ের প্রতি সমব্যথী হইতে দেখছি। আজমেরি আপার আব্বা কেমন নিষ্ঠুরের মতো আচরণ কইরা আজমেরি আপারে জোর কইরা এক কানাডা প্রবাসী লোকের সঙ্গে বিয়া দিয়া দিছিলেন, এই গল্প বলতে বলতে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেদিন রাতে আজমেরি আপার বিয়ে হয়, রাসেল ভাই নাকি ৬০টা ঘুমের ওষুধ খাইয়া হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ১৫ দিন তারে লাইফ সাপোর্টে রাখা হইছিল। রাসেল ভাই যে বাঁচবেন, এই আশাই ছাইড়া দিছিল সবাই। রাসেল ভাইয়ের আব্বা নাকি একমাত্র ছেলে মরে যাইতেছে আশঙ্কায় বুক থাপড়াইয়া কাঁন্দছিলেন। ওই ঘটনার পর রাসেল ভাইয়ের আব্বা কোনোদিন রাসেল ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কারণে উচ্চস্বরে কথাও বলে নাই। বছর পাঁচেকের মধ্যে ৩ নং লাইনের বাড়িটাও উনারা ভাড়া দিয়া মিরপুর ১২-এর দিকে চইলা যায়। তাতে খুব একটা লাভ হয় না। রাসেল ভাই ঘুইরা ঘুইরা এই এলাকাতেই পইড়া থাকতো।

৩ নং লাইনে আমরা যারা সমবয়সী ছিলাম, তারা রাসেল ভাইরে নিয়া প্রতি বিকালেই মিটিংয়ে বসতাম। ক্লাবের ওয়ালে বইসা পা দুলাইতে দুলাইতে রাসেল ভাইরে নিয়া কে কী স্বপ্ন দেখছে, রাসেল ভাই কার দিকে তাকাইয়া হাসছে, কার গাল টিপছে, কারে চকলেট কিইন্যা দিছে, এসব নিয়া আলাপ চলতো মাগরিবের আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত। এরমধ্যে যদি ভাগ্যক্রমে রাসেল ভাইয়ের দেখা মিলতো, আমাদের একেকজনের মাথা ঘুরাইয়া পড়ার মতো উপক্রম হইতো। আমরা একটা কমিটি গঠন করছিলাম, নাম দিছিলাম- ‘রাসেল আর্নল্ড গার্লস ক্লাব’।  একবার আমরা ক্লাবের দেয়ালে 'রাসেল ভাই, আমরা আপনাকে ভালোবাসি' লেখা একটা রঙিন কাগজ টাঙাইয়া দিছিলাম। এইটা অবশ্য আমাদের করতে হইছিল খুব গোপনে! পরের দিন সকালে গিয়া অবশ্য দেখছি কে জানি ওইটা ছিঁড়া ফেলছে!

রাসেল আর্নল্ড নামে শ্রীলংঙ্কান একজন ক্রিকেটার ছিল আমাদের সময়ে। তো আমরা আড়ালে রাসেল ভাইরে রাসেল আর্নল্ড ডাকতাম। এই ডাক অবশ্য আমাদের বড় ভাইদের সামনে ডাকা নিষিদ্ধ ছিল। তারা যে আমরা যেই স্কুলে পড়ি, সেটা অলরেডি পাশ কইরা আসছে, এটা আমরা প্রথমে বুঝতে পারি নাই। কিশোরী বয়সের এই ভুলের কারণে একবার আমি আমার বড় ভাইয়ের কাছে চিঠি নিয়া ধরা খাইলাম। সেই চিঠি কোনো পুরুষের না, নারীরই। আমাদের রাসেল আর্নল্ড গার্লস ক্লাবের মেয়েরা একজন আরেকজনরে চিঠি লিখতো। মানে, যার লগে যার বেশি খাতির, সে তারে চিঠি লিখতেছে, এমন ছিল ব্যাপারটা। তো শিখা নামে আমার এক পাড়াতো বান্ধবী ছিল, যার লগে আমার ব্যাপক দোস্তি ছিল ওই সময়। শিখা এক চিঠিতে আমারে লিখছে, ‘আজকে রাসেল আর্নল্ড আমাদের বাসায় আসছিল আব্বার কাছে কী জানি কাজে। যাওয়ার সময় সামনের দোকান থেইকা আমারে কিটক্যাট কিইন্যা দিছে। চকলেট খাইয়া প্যাকেট আমি ডায়েরির মধ্যে রাইখা দিছি’…ইত্যাদি ইত্যাদি…। 

তো ওই চিঠি আমি পড়ার পর ঘরের ড্রয়ারে রাইখা দিছিলাম। আমার ভাই আইসা কোনো ছেলের চিঠি সন্দেহ কইরা পড়তেই রাসেল আর্নল্ড নাম দেখলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না, কে এই রাসেল আর্নল্ড। যথারীতি আম্মার কাছে বিচার দিয়া আমারে ব্যাপক মাইর খাওয়াইলো। পরে বুঝতে পারছিলাম, এলাকার সব কম বা বেশি বয়সী ছেলেরা রাসেল ভাইরে সমীহ করলেও এক প্রকার জেলাসি তাদের মধ্যে কাজ করে। আমি নিজে আমার ভাইয়ের প্রেমিকারে একদিন বলতে শুনছি, রাসেল ভাই যা-ই পরে, তারে দেখতে প্রিন্স চার্লসের মতো লাগে! প্রিন্স চার্লস এমন সুদর্শন কেউ না, সম্ভবত রয়্যাল ব্ল্যাড বইলা উনি সৌন্দর্যের এক্সাম্পলে প্রায়োরিটি পাইতো।

ডিজিটাল বোর্ডের স্ক্রিনে দেখা যাইতেছে, ট্যুরিস্ট সেকশনে সিরিয়াল চলে ১৮৫৭! আমার সিরিয়াল আসতে আর কত দেরি, পাঞ্জেরি? রাসেল ভাই আর আমার মাঝখানে বইসা থাকা মহিলা হঠাৎ উইঠা দাঁড়াইলো। সম্ভবত তার সিরিয়াল চলে আসছে। উনি উইঠা যাইতেই আড়চোখে একবার রাসেল ভাইয়ের দিকে তাকাইলাম। ইশ! ২০ বছর! কত সময়! রাসেল ভাইয়ের কোনো চেঞ্জ আসে নাই। শরীরে এক ফোটা মেদ নাই। খুব সুন্দর একটা পারফিউমের স্মেল পাওয়া যাইতেছে তার দিক থেইকা। আগেও উনি দামি দামি পারফিউম ইউজ করতো। উনি সামনে দিয়া গেলে অনেকক্ষণ যাবত আমরা ওই পারফিউমের ঘ্রাণ পাইতাম। অনেক সময় এমনও হইতো যে রাসেল ভাই আশেপাশে নাই, অথচ আমি উনার পারফিউমের ঘ্রাণ পাইতেছি। তখন ওইটা বুঝতাম না, বলতাম যে রাসেল ভাইয়ের শরীরের গন্ধ পাইছি। এজ ইফ রাসেল ভাইয়ের শরীরের কোনো আলাদা গন্ধ আছে। এটা একটা আবিষ্কার করার মতো বিষয়। আসলেই কি এক্সট্রা কোনো সুগন্ধি ছাড়া মানুষের শরীরের কোনো আলাদা ঘ্রান থাকে?

ফোনের রিংটোনটা হঠাৎ বাইজা উঠলো। সাইলেন্ট মুডে রাখতে ভুলে গেছিলাম। রাসেল ভাই তার মোবাইল থেইকা চোখ সরাইয়া আমার দিকে তাকাইলো। আমি দেখি নাই এমন একটা ভঙ্গীতে ফোনের লাইন কাটলাম। খেয়াল করলাম যে রাসেল ভাই তাকাইয়াই আছে। চোখে চোখ পড়তেই উনি আরো ভালো কইরা আমারে দেখার চেষ্টা করলেন। আমি হাইসা দিয়া বললাম- রাসেল ভাই? রাসেল ভাইও রীতিমতো চিৎকার কইরাই বললেন- ‘আরেএএএএএএএএএএ…তুমি?’ রাসেল ভাইয়ের সিরিয়াল নম্বর চলে আসছে। উনি আমারে চোখের ইশারা দিয়া উইঠা গেলেন ১১ নম্বর কাউন্টারের সামনে। পাশের লাইনে দাঁড়াইয়া থাকা দুইটা মেয়ে রাসেল ভাইয়ের দিকে ড্যাব ড্যাব কইরা তাকাইয়া আছে। ২০ বছর পরও আমার এই দৃশ্য দেইখা জেলাস ফিল হইতেছে, যেমন জেলাস ফিল হইতো রাসেল আর্নল্ড গার্লস ক্লাবের অন্য মেয়েগুলার উপর।

এলাকার বাড়ি ভাড়া দিয়া দেওয়ার পরও রাসেল ভাইয়ের ৩ নং লাইনে যাতায়াত বন্ধ হয় নাই। তবে একদিন সত্যি সত্যিই বন্ধ হইলো। এক শুক্রবার বিকালে আমাদের বাসার সামনে বাইক থামাইয়া রাসেল ভাই কলিং বেল বাজাইলো। গেট খুললাম আমি। মাত্রই ভাত ঘুম দিছিলাম। ঘুম ভাঙায় ব্যাপক বিরক্তি নিয়া যখন গেট খুলতেই রাসেল ভাইরে দেখলাম, মনে হইতেছিল আমি স্বপ্ন দেখতেছি। রাসেল ভাই আমার মাথায় টোকা দিয়া বললো, ‘ঘুমাইতেছিলি? চাচা বাসায় না?’ বইলা উনি ভেতরে ঢুইকা গেল। আব্বা ঘরেই জিসিনেমাতে অমিতাভের ‘জাঞ্জির’ দেখতেছিলেন। রাসেল ভাইরে দেইখা শোওয়া থেইকা উইঠা বসলেন। আমারে ডাইকা বললেন, ‘ভাইয়াকে চা খাওয়াও, মা।‘

অন্য কেউ হইলে আমি এখন আব্বার দিকে একটা রাগের লুক দিতাম। রাসেল ভাইয়ের জন্য চা বানাইতে বলায় দৌড় দিয়া রান্নাঘরে ঢুকলাম। চা নিয়া আইসা শুনি রাসেল ভাই আব্বার কাছে দোয়া চাইতে আসছেন। এলাকার সব মুরুব্বির কাছেই যাইতেছেন। পরের সপ্তাহেই উনি জার্মানি চইলা যাবেন। বাংলা সিনেমার মতো আমার হাত থেইকা কাপটা না পড়লেও হালকা টলতেছিল। চোখ এমন টলমল শুরু করছিল যে তখনই যদি ওইখান থেইকা সইরা না যাইতাম, একটা বেইজ্জতি কাণ্ড ঘটতো। যাই হোক, পরের সপ্তাহে সত্যিই রাসেল ভাই চইলা গেল। রাসেল ভাইয়ের ফ্লাইটের টাইম আমরা জানতাম। এয়ারপোর্টে গিয়া তারে সি অফ করার সামর্থ্য বা সাহস আমাদের কারোর ছিল না, তাই আমরা রাসেল আর্নল্ড গার্লস ক্লাবের সবাই ওই টাইমে যার যার ঘরে বইসা শুনতেছিলাম- ‘বিছরে আভি তো হাম ব্যাস কাল পারশো/জিয়ুঙ্গি ম্যায় ক্যায়সে ইস হাল ম্যায় বারসো…'।

রাসেল ভাইয়ের ডকুমেন্টস জমা দেওয়ার কাজ শেষ। আমার সামনে আইসা উনি বিদায় নিতে গিয়া বললো, তুমি তো বেশ সুন্দরী হইয়া গেছো। চিনতেই পারতেছিলাম না প্রথমে। আমি লজ্জা পাইয়া হাইসা দিলাম। রাসেল ভাই বিদায় নিয়া চইলা যাইতে যাইতে আমার সিরিয়াল চইলা আসছে। উনার যাওয়ার দিকে তাকাইতে গিয়া মনে মনেই বিড় বিড় করলাম, বিশ্বাস করেন, রাসেল ভাই...আমরা আপনাকে ভালোবাসতাম!