পোস্টস

চিন্তা

নিতুন কুন্ডুর অটবি ও কমার্শিয়াল আর্ট

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কৃপাসিন্ধু পাল জয়

মূল লেখক কৃপাসিন্ধু পাল জয়

নিতুন কুন্ডুর আগে কেউ কী কখনো আমাদের বাংলাদেশে এবং এর আগে পূর্ব পাকিস্তানে কমার্শিয়াল আর্টের সাথে যুক্ত ছিলেন না?অবশ্যই ছিলেন।নিতুন কুন্ডুর আগেও ছিলেন,উনার সমসাময়িকও অনেকে ছিলেন,উনার পরেও অনেকে এই সেক্টরে কাজ করতে এসেছেন এবং অনেক নতুন মানুষও এই সেক্টরে এখন যোগ দিচ্ছেন ও কাজ করে যাচ্ছেন।তাহলে এখানে প্রশ্নটা দাঁড়ায় যে, তবে নিতুন কুন্ডুই কেন বাকি সবার চাইতে আলাদা হয়ে যেতে সক্ষম হলেন আর অন্যদের প্রায় সবাই অক্ষম?কয়েক কথায় এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া সহজ হবে না।
নিতুন কুন্ডু ১৯৭০ সালের দিকে যোগদান করেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী সংখ্যা বিটপীতে।এইটারে উনার শিল্পী জীবনের একটা বড় অংশ বলা যায়।কারণ এর আগে উনি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন,নিজেও অনেক ছবি আঁকছেন,উনার একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জায়গায়;তবে কমার্শিয়াল আর্টের সাথে উনার যাত্রাটা এই বিটপীতে এসেই শুরু হয়।তবে সেই সময়ের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার কারণে এই জায়গায় বেশি সময় কাজ করা উনার জন্য সম্ভব হয় নাই।কারণ পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৭১ সালে শুরু হয়ে যায় আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম।নিতুন কুন্ডু যোগ দেন সেখানে।যদিও সরাসরি মাঠে ময়দানে যুদ্ধে অংশ নেন নাই তিনি।তবে যুক্ত ছিলেন অন্যভাবে।কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হয়ে জনসংযোগ বিভাগে কাজ করতেন।এখানে তাকে কাজ করতে হতো পটুয়া কামরুল হাসানের সাথে।এইখানে তাকে বেশ ভালো কিছু কাজ উপহার দিতে দেখা গিয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে কোনো বাধা ধরা চাকরির সাথে যুক্ত না থাকা নিতুন কুন্ডু সৃষ্টি করেন অটবি।তাঁর কমার্শিয়াল আর্টের জন্য বড় একটা পথচলা শুরু হয়েছিল এর মাধ্যমে।
অটবির আগে আসবাবপত্র তৈরি করার প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে ছিল।এর পরেও অনেক এসেছে।কিন্তু নিজেদের কাজে অটবি যেভাবে রাজত্ব করেছে এবং এখনও করছে তা আর কারো দ্বারা সম্ভব হয় নাই এখন অবধি।এর কারণ কী বা কেন অটবি নিজেদের সেক্টরে রাজ করছে সেইটা নিয়ে আলাপ আজকে না,অন্য কোনো দিনে করা যাবে।তবে এই বিষয়ক কিছু কথা বলা যায়।
আসবাবপত্রের মাঝে একটু পরিমাণ শিল্পের ছোঁয়া,আরও একটু সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর করা,কেবল শোয়া-বসার জন্য আসবাবপত্র ব্যবহার না করে সেইটার মাঝে সৌন্দর্যকে যোগ করে একটু অন্যরকম দেওয়াটা নিতুন কুন্ডুর অটবিকে অন্যদের চাইতে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে।অটবির রাজত্ব করার পেছনে অনেকেই এটাকে বড় একটা কারণ বলে মনে করে থাকেন।
অটবি আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরি করে সেখানে যে কেবল শিল্পকে কেবল নামে মাত্র স্পর্শ করেছে এমন কিন্তু না।তাদের অনেক কাজের মাঝেই গভীর শৈল্পিক চেতনা এবং সৃষ্টিশীলতা খুঁজে পাওয়া যায় একটু মন দিয়ে দেখতে পারলে।
নিতুন কুন্ডু নিজে অটবির জন্ম দেওয়ার মধ্য দিয়ে নীরবে নিভৃতে এক আন্দোলনের শুরু করেছিলেন।যে আন্দোলন নিয়ে আমরা কেউই কথা না বললেও যার ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে আমাদের সবার আশেপাশে।আন্দোলনটার মূল লক্ষ্য ছিল সকল সকল জায়গায় শিল্পকে ছড়িয়ে দেয়া।অটবির স্রষ্টা হয়তো এত চিন্তা ভাবনা করে অটবি তৈরি করেন নাই কিন্তু এর পরেও আন্দোলনটা ছিল।এখনও আছে।আসবাবপত্রের মাঝে শিল্পের ছোঁয়া এনে দেওয়ার মাঝে দিয়ে যে আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল তা আশা করা যায় ছড়িয়ে পড়বে সামনের দিনগুলোতে আগের চাইতে আরও বেশি করে।
কমার্শিয়াল আর্টের জন্ম হয় ব্যবসায়িক কারণ থেকে।কমার্শিয়াল আর্টের মূল লক্ষ্য থাকে কোনো ব্যবসার মাঝে একটু শিল্প এনে সেখানে আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করা।অনেকেই ভাবতে পারেন যেকোন ব্যবসাতেই তো মানুষ যুক্ত থাকে।যেসবের অনেকটাতেই শিল্পের কোনো নাম-গন্ধ পর্যন্ত থাকে না।তবে কমার্শিয়াল আর্টের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?ধরুন আপনি কোন একটা জিনিস কিনতে সেই জিনিসের জন্য নির্দিষ্ট দোকানে গেলেন।দোকানে যারা কাজ করে তাদের মাঝে একজন আপনাকে আপনার চাহিদা মতো দুইটা পণ্য দেখালো।যার দুইটাই একই ধরণের।তবে একটা সিম্পল।যে কাজের জন্য বানানো কেবল সেইটাই করতে পারা যায়।আলাদা আর কিছু নেই।অন্য যে আরেকটা পণ্য আছে সেটাও একই কাজের।তবে এটা সুন্দর করে বানানো।দেখলে ভালো লাগে।যদি সুন্দর পণ্যটা অন্যটার তুলনায় দামে বেশি হলেও যাদের কেনার সামর্থ্য আছে তাদের অনেকেই দামি ও সুন্দর পণ্যটাই কিনবে।ধরে নিলাম যে কাজের জন্য এই দুইটি পণ্য তৈরি করা হয়েছে সেই কাজ দুইটা পণ্যই সমানভাবে করতে পারে।যেখানে একই কাজের জিনিস একই দোকানে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেটা দিয়ে কাজও ঠিকঠাক মতো করে ফেলা যাবে তবে কিছু মানুষের দামি জিনিসটা কেনার কারণ কী?এইখানে এসেই কাজ করে ব্যবসায়িক শিল্প বা কমার্শিয়াল আর্ট।একই ধরণের এবং একই পরিমাণে কাজ করা পণ্যের মাঝে সুন্দর পণ্যটাই মানুষ বেশি কিনবে কারণ এটি শৈল্পিক।পাঠকগণ হয়তো এতক্ষণে কমার্শিয়াল আর্টের পেছনে যে কারণগুলো কাজ করে সেইটা বুঝে ফেলতে সক্ষম হয়ে গেছেন।হ্যাঁ,কারণটা হলো অধিক পরিমাণে ক্রেতাকে নিজেদের পণ্যের প্রতি আকর্ষণ করা।নিতুন কুন্ডুর হাত ধরে জন্ম হওয়ার পর থেকে অটবি নিজেদের তৈরি করা জিনিসপত্রের মধ্যে এই বিশেষ ব্যবসার পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে।আর এর সুফল যে ব্যাপক তা নিজ ক্ষেত্রে অটবির প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সাফল্যের মাঝেই দেখতে পাওয়া যায়।

এই যে যেকোনো কিছুর মাঝে শিল্পকে ঢুকিয়ে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ লাভ করার বিষয়টা 
এটা ঠিক কি না এই প্রশ্নের জন্ম অনেকের মাঝে আসতে পারে।এখানে বলে রাখা ভালো ব্যবসার পসার ঘটাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক প্রকারের পদ্ধতি ব্যবহার করতে দেখা যায়।এখানে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন আসা অমূলক।তবে নিজেদের জিনিসপত্রের পসার ঘটাতে গিয়ে অটবি যেভাবে শিল্পকে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেটা প্রশংসা করার মতো কাজ।


আমরা হয়তো সবাই শিল্পের কোনো ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত নেই।তবে নিত্যদিনে যদি আমরা আমাদের আশপাশের জিনিসপত্র এর মাঝে শিল্পের ছোঁয়া অজান্তেই আনন্দের জন্ম দেয়।এই কাজটাকে নিতুন কুন্ডু কয়েক দশক জুড়ে করে গেছেন।উনার মৃত্যুর প্রায় দেড় যুগ হয়ে গেলেও অটবি এই কাজ এখনও করে যাচ্ছে।যদিও অটবি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তবে শিল্পের প্রসারও যে তারা নিজেদের ব্যবসার মধ্য দিয়ে ঘটাচ্ছে তার জন্য একটা স্যালুট শিল্পপ্রেমীরা দিতে পারেন বিনা দ্বিধায়।