Posts

চিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট: বর্তমান বাস্তবতা ও প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা

March 15, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

129
View

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সফেদ পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে রোহিঙ্গা কম্যুনিটির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হাসিমুখে সালাম বিনিময় করছেন, সুন্দর বক্তব্য দিচ্ছেন এবং একসাথে বসে ইফতার করছেন -দারুণ দৃশ্যময়ময়তা তৈরি করল নিশ্চয়ই। কিন্তু এতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনে কতটা প্রভাব পড়বে?

রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল ও বহুমাত্রিক মানবিক সমস্যা, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ের জন্যই গুরুতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক সফর এবং রোহিঙ্গা শিবিরে ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এই সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে, রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য সহায়তা হ্রাস এবং প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।​

খাদ্য সহায়তা হ্রাস ও এর প্রভাব:
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) ২০২৫ সালের মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য সহায়তা সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে কমিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে তহবিলের অভাব উল্লেখ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, রোহিঙ্গা শিবিরে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, যা অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি, সামাজিক অস্থিরতা এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, খাদ্য সহায়তা হ্রাসের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ বাড়তে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।​

প্রত্যাবাসনের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ:
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা আগামী ঈদে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন। তবে, মিয়ানমারে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে সামরিক সরকারের শাসন এবং আরাকানে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন, প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে, তাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। এছাড়া, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান বৈষম্য ও সহিংসতা তাদের প্রত্যাবাসনের পথে বড় বাধা।​

বাংলাদেশের উপর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ করণীয়:
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২-১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে, যা দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর মতে প্রতিবছর প্রায় ৩০,০০০ নতুন শিশুর জন্ম এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি, মাদক পাচার ও মানব পাচারের মতো সমস্যা বাংলাদেশের নিরাপত্তায় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ, তহবিল বৃদ্ধি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।​

বিগত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের এই দেশে পুনর্বাসন করে কি খারাপ কাজ করেছিলেন? তার সিদ্ধান্ত মানবিকতা নাকি কৌশলগত ভুল? এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে এই সংকট যতদিন থাকবে।

রোহিঙ্গা সংকট একটি জটিল আন্তর্জাতিক ও মানবিক ইস্যু, যেখানে কেবল শেখ হাসিনার ভূমিকা নয়, বরং ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক চাপ, মানবিকতা ও নিরাপত্তার মতো বহু বিষয় জড়িত।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের মুখে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন— "আমরা একবেলা খাবো, কিন্তু ওদের না খাইয়ে মরতে দেব না।" শেখ হাসিনা নোবেল লরিয়েট হওয়ার জন্য এমনটা করেছিলেন, তেমন অভিযোগ উঠলেও সেসময় এটি ছিল একটি মানবিক সিদ্ধান্ত, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন সংকটে পড়েছে:
• অর্থনৈতিক চাপ: রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল ক্রমশ কমছে, ফলে বাংলাদেশকে বাড়তি ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।
• নিরাপত্তা ঝুঁকি: মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে।
• প্রত্যাবাসন অনিশ্চয়তা: মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যত অনাগ্রহী।
• কূটনৈতিক চাপ: চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের দুয়ার খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটি কি সত্যিই ভুল ছিল? কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনা একটি তাৎক্ষণিক মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের ঢল ঠেকাতে বাংলাদেশ আরও কৌশলী ভূমিকা রাখতে পারত— যেমন সীমান্তে নিয়ন্ত্রিত শরণার্থী অঞ্চল তৈরি করা বা কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করা।

তবে এটাও ঠিক, সে সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনা ও মানবিক বিপর্যয় হতো, যা বাংলাদেশের জন্য অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করত।

বিগত সরকার হয়তো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক কাজ করেছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় কৌশলগত ভুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক কূটনীতি, চীন-ভারতের ভূমিকা এবং জাতিসংঘের কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ, মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করবার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে সকল পক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা অপরিহার্য।​ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা আন্তোনিও গুতেরেস কি সেই কঠিন পথকে মসৃণ করতে পারবেন?

লেখক: সাংবাদিক 
১৫ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login