অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলা মূলত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ছিল, কারণ এই ভাষা তাদের মাতৃভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটি তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন প্রদর্শনের একটি প্রচেষ্টা। তবে, এই পদক্ষেপ মিয়ানমারের প্রচারণাকে শক্তিশালী করতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে।
এমনটা যদি হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে একটি কৌশলগত ভুল এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানের জন্য বিপজ্জনক। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের নীতিগত অবস্থান হলো—তারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং সেখানে তাদের প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার ঘটনা সেই নীতিকে দুর্বল করে দিতে পারে।
কেন এটি সমস্যা সৃষ্টি করবে?
• মিয়ানমারের প্রচারের সুযোগ: মিয়ানমার সরকার বরাবরই দাবি করে আসছে যে রোহিঙ্গারা আদতে বাংলাদেশি অভিবাসী, যারা ব্রিটিশ আমলে কাজের সন্ধানে রাখাইনে গিয়েছিল। যদিও ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা সেই অঞ্চলে শত শত বছর ধরে বাস করছে, কিন্তু বাংলাদেশের একজন সরকার প্রধান যদি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন, তাহলে মিয়ানমার তার পক্ষে সেই ব্যাখ্যাকে আরও জোরালো করতে পারবে।
• আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাব: মিয়ানমার এই বক্তব্যকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে যে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই রেখে দেওয়া উচিত। এতে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে যেতে পারে।
• রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কূটনীতি দুর্বল হবে: বাংলাদেশ বরাবরই চীন, ভারত, আসিয়ান এবং জাতিসংঘকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মিয়ানমার যদি এই বক্তব্যকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে, তাহলে বাংলাদেশের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে নাকি?
• ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সংকট: মিয়ানমার যদি তার দাবিকে আরও জোরালো করতে সক্ষম হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারে বা কোনো বড় শক্তিকে তাদের পক্ষে আনতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ কী করতে পারে?
• সরকারি ব্যাখ্যা: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার করতে পারে যে এটি নিছক একটি ভাষাগত বিষয়, নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন নয়।
• কূটনৈতিক প্রচার: বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার যে ভাষাগত মিল থাকলেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের প্রত্যাবাসনই সমাধান।
• মিয়ানমারের প্রচারের পাল্টা জবাব: আন্তর্জাতিক মহলে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা দরকার যে রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবে আরাকানের বাসিন্দা এবং তাদের অধিকার মিয়ানমারেই নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চাটগাঁর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি হয়ত তাৎক্ষণিক নয়, ভেবেচিন্তেই বলেছেন; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। তেমনটা যদি মনে হয়, তবে এখন সরকারের দায়িত্ব হবে দ্রুত এবং কৌশলী উপায়ে এই ক্ষতি সামাল দেওয়া। ভাষার ব্যবহার মানবিক যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিয়ানমার এই ঘটনাকে তাদের দাবির সমর্থনে ব্যবহার করতে পারে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি নিদর্শন হলেও কূটনৈতিক স্তরে এই বিষয়টি বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়াটাই অধিকতর সমীচিন।
লেখক: সাংবাদিক
১৬ মার্চ ২০২৫