Posts

নন ফিকশন

ট্রিকল ডাউন থিওরি: বৈষম্যের পক্ষে সাফাই গায় যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব।

March 16, 2025

Fojla Rabbi

324
View

সময়টা সবেমাত্র শিল্পবিপ্লবের শুরুর কাল। কৃষিভিত্তিক শিল্প থেকে বের হয়ে ভারী শিল্প ও বৃহদায়তন উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে সমাজ। মানুষও ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক জীবিকা থেকে বের শিল্প নির্ভর জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরের দিকে ছুটছে। তাদের স্বপ্ন একটাই। সামান্তবাদী ও জমিদারি নির্ভর আয়-উপার্জনের উৎস থেকে বের হয়ে এসে একটি বৈষম্যহীন জীবনের সন্ধান করা। ফলে মানুষ দলে দলে গ্রাম থেকে শহরে এসে যোগ দিতে থাকে শিল্প-কারখানার কাজে। প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের এই শিল্পবিপ্লব মানুষকে মুক্তির আশা দেখালেও ক্রমেই তা পরিণত শ্রম শোষণের অন্যতম উৎসে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মানুষের আয় বৈষম্য ও সামাজিক অসমতার।

এই আয় বৈষম্য ও অর্থনৈতিক অসমতা নতুন করে অর্থনীতিবিদদের চিন্তার খোরাক যোগায়। আলোচনা ও গবেষণা চলতে থাকে কিভাবে কমানো যায় সামাজিক অসমতা ও আর্থিক বৈষম্য। ফলাফল হিসাবে বের হতে থাকে নর্ডিক ইকোনমিক মডেল, গ্রোস হ্যাপিনেস ইনডেক্সের মতো নানান অর্থনৈতিক ধারণার৷ এসব মতবাদকে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করে গিয়েছেন জোসেফ স্টিগলিজ, অর্মত্য সেন ও জেমস রবিনসনের মতো অর্থনীতিবিদগণ।

তবে এই বৈষম্য ও অসমতা মুক্ত পৃথিবীর গড়ার সংগ্রামের মাঝেও কিছু ভিন্ন ধারণা ও তত্ত্ব জন্ম নেয় যেগুলো প্রচলিত সব মতবাদকেই উলটপালট করে দেয়। তেমনই একটি ধারণা হলো "ট্রিকল ডাউন থিউরি" বা উপচে পরার তত্ত্ব। আক্ষরিক অর্থে এর মানে এটা বুঝায় যে, যদি একটি বড় টেবিল প্রচুর পরিমান খাবার দিয়ে পূর্ণ থাকে ও সেগুলো খাওয়ার জন্য অতি অল্প কিছু মানুষ থাকে তবে সেই টেবিলের কিছু পরিমান হলেও খাবার উচ্ছিষ্ট থাকবে ও খাবার খাওয়ার সময় কিছু অংশ নিচে পরবে। এই উচ্ছিষ্ট ও নিচে পরে যাওয়া খাবারই হবে একটি সমাজের অবশিষ্ট মানুষের বড় একটি অংশের বেঁচে থাকার উৎস। অর্থাৎ এই বৃহৎ অংশের জীবন ধারণের জন্য টেবিলে বসে থাকা অতি অল্প কয়েকজনের খাবারের অঢেল প্রাচুর্য থাকতে হবে।

সাধারণ অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই তত্ত্ব এটা বলে যে যদি সমাজের সাধারণ মানুষের অর্থাৎ বৃহৎ অংশের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে হয় তবে সবার আগে কিছু লোককে ধনী বা অতিধনী হবার সুযোগ দিতে হবে। এবং এই সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ পরবর্তীতে বঞ্চিত অংশকে আয়-রোজগারের সুযোগ করে দিবে। আর এই সুবিধাটি সাধারণত নিশ্চিত করা হয় বড় বড় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা কর্পোরেট হাউজগুলোকে কর ছাড়ের সুবিধা প্রদান করার মাধ্যমে। ধারণা করা হয় যদি ধনী ও বড় ব্যবসায়ীদের ওপর করের হার কমানো হয় এবং তাদের জন্য ব্যবসা-বান্ধব নীতি প্রণয়ন করা হয়, তাহলে তারা বিনিয়োগ বাড়াবে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে৷

ট্রিকল ডাউন থিওরির ধারণা ১৯২০-এর দশকে প্রথম প্রচলিত হয়, তবে এটি জনপ্রিয়তা পায় ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার-এর অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে। এটি মূলত "সাপ্লাই-সাইড ইকোনমিক্স" (Supply-Side Economics)-এর একটি অংশ, যেখানে দাবি করা হয় যে কর কমানো হলে এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতি নিলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেও লাভবান করবে।

এই তত্ত্ব প্রয়োগের বাস্তব উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের Reaganomics। সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের  প্রশাসন ১৯৮০-এর দশকে উচ্চবিত্ত ও কর্পোরেটদের জন্য কর কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছিলো। এর ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, তবে আয়বৈষম্যও বাড়ে। যদিও ধনী ও বড় কর্পোরেশন লাভবান হয় তবে নিম্নবিত্তরা প্রত্যাশিত সুবিধা পায়নি। তাছাড়া ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক উদারীকরণ (Liberalization) নীতিও কিছুটা ট্রিকল ডাউন পদ্ধতির মতো কাজ করেছে। ১৯৭৮ সালে দেং শিয়াওপিং বাজার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করলে চীনে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়। বড় ব্যবসাগুলোর প্রবৃদ্ধি বাড়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে এর সুফল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীও পায়। তবে আয়বৈষম্যও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর বাইরে ১৯৯১ সালের উদারীকরণ নীতির ফলে ভারতীয় কর্পোরেট খাতের বিকাশ ঘটে, এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়। তবে ভারতের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই প্রবৃদ্ধির সুফল পুরোপুরি পায়নি। তাছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কর্পোরেট কর কমানো হলেও বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো ও ধনী উদ্যোক্তারা লাভবান হয় তবে, নিম্নবিত্তের জন্য প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি।

এই ট্রিকল ডাউন থিওরির কিছু বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বেশ প্রাসঙ্গিক। যেমন এসব দেশে সাধারণত ধনী ও বড় ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হয়, কিন্তু নিম্নবিত্তের উন্নয়ন তুলনামূলকভাবে কম হয়।তাছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ কম মজুরিতে কাজ করে, এবং তাদের জীবনমান উন্নত হয় না। এর বাইরেও  সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে বড় ব্যবসায়ীরা কর ছাড় পেলেও, তারা শ্রমিকদের কল্যাণে যথেষ্ট ব্যয় করে না। এর বাইরেও অর্থ পাচারের মতো সামাজিক সমস্যাও তীব্র মাত্রায় দেখা যায়।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও ট্রিকল ডাউন থিওরির কিছু উপাদান কার্যকর রয়েছে যেমন, এটি এককভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সরকারি নীতি নির্ধারকদের উচিত ট্রিকল ডাউন তত্ত্বের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক উন্নয়ন (Inclusive Growth) নীতিও গ্রহণ করা। এতে সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান নিশ্চিত করা যাবে।

রেফারেন্স
1. Krugman, P. (1994) – Peddling Prosperity: Economic Sense and Nonsense in the Age of Diminished Expectations
2. Stiglitz, J. E. (2012) – The Price of Inequality: How Today’s Divided Society Endangers Our Future
3. Bhagwati, J., & Panagariya, A. (2013) – Why Growth Matters: How Economic Growth in India Reduced Poverty and the Lessons for Other Developing Countries
4.  Basu, K. (2006) – Globalization, Poverty, and Inequality: What Is the Relationship? What Can Be Done?
5. Rahman, M., & Moazzem, K. G. (2020) – Income Inequality and Growth: The Case of Bangladesh (Centre for Policy Dialogue - CPD)

Comments

    Please login to post comment. Login