১৭ মার্চ ১৯৭২। ঐতিহাসিক এক দিন। এই দিনেই বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে ভারতের ‘রাজহংস’ বিমান। এই বিমানে করে আসা ব্যক্তি শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক নন; তিনি সেই নেত্রী, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, আহার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য কূটনৈতিক লড়াই করেছেন এবং এক পর্যায়ে ভারতকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছেন।
বিমানবন্দরে সস্ত্রীক শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই এগিয়ে যান ইন্দিরা গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানাতে। দিনটি আবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন—স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর প্রথম জন্মদিন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফরের জন্য এই বিশেষ দিনটিই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও এটি ছিল রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন, বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিনে কোনো ছুটি থাকবে না। বরং এ দিন হবে কঠোর পরিশ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন। ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ সংখ্যার প্রথম পাতায় এই ঘোষণা প্রকাশিত হয়।
ওই সফরে বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল শর্ত ছিল—
• দুই দেশ একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।
• কেউই অপর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
• কোনো পক্ষই স্বাক্ষরকারী অপর দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক জোটে অংশ নেবে না।
যদিও বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা একে ‘গোলামির চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছিল, বাস্তবে এই চুক্তির মাধ্যমেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি দৃঢ় হয়। তবে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে সেই সম্পর্কটিকে পুরোদস্তুর ভারতীয় স্বার্থের আনুকূল্যে নিয়ে যায়। গেল বছর জুলাই গণ-আন্দোলনে দেশছাড়া হয়ে সেই ভুল রাজনীতির খেসারত দিতে হয় তাদেরকে।
এর আগে, মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে ৭০ লাখ শরণার্থীর পুনর্বাসন সম্পন্ন হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় সৈন্যদের দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ ছাড়ার অনুরোধ করেন। প্রথমে ২৫ মার্চ সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরের দিন নির্ধারিত হয়, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন—তার আগেই সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করবেন। ফলে নতুন তারিখ ঠিক হয় ১৫ মার্চ ১৯৭২।
১২ মার্চ, ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্ণাঢ্য বিদায়ী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। শেষ ভারতীয় সেনা বাংলাদেশ ছাড়ে ১৫ মার্চ। ফলে ১৭ মার্চ, তাঁর জন্মদিনে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন ও ভারতীয় সেনামুক্ত বাংলাদেশকেই সবার কাছে উপস্থাপন করলেন।
সেনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে কথোপকথনের একটি অংশ মুক্তিযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন—
শেখ মুজিব: ম্যাডাম, ভারতীয় সৈন্য কবে নাগাদ বাংলাদেশ ছাড়বে?
ইন্দিরা গান্ধী: বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো কিছুটা নাজুক। পুরো পরিস্থিতি আপনার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি ভালো হবে না? তবে আপনি যেভাবে বলবেন, আমরা তাই করব।
শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ৩০ লাখ লোক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার জন্য যদি আরও ১০ লাখ মানুষ প্রাণ দেয়, তবুও চলবে। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে ভারতীয় সৈন্য দ্রুত প্রত্যাহার করা হলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
ইন্দিরা গান্ধী: এক্সেলেনসি, কারণটা আরেকটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হবো।
শেখ মুজিব: এখন সময় বাংলাদেশের পুনর্গঠনের। এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরোধীতা কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সেনার উপস্থিতিকে ইস্যু করে বিরোধীরা দ্রুত সংগঠিত হয়ে উঠতে পারে। ম্যাডাম, আপনিও নিশ্চয় এমন কিছু চান না। তাই কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন?
ইন্দিরা গান্ধী: (সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন) এক্সেলেনসি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে ১৭ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
শেখ মুজিব: ম্যাডাম, এই বিশেষ দিন ১৭ মার্চই কেন?
ইন্দিরা গান্ধী: কারণ, এই দিনটি আপনার জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ করবে।
ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি -বাংলার মাটি ত্যাগ করে ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ। ১৭ মার্চ স্বাধীন দেশে নিজের প্রথম জন্মদিনে ইন্দো-পাকিস্তানি সৈন্যমুক্ত বাংলাদেশে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন শেখ মুজিব। ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিজয় লাভের পর মার্চের মধ্যভাগেই তিনি পেয়েছিলেন ভারতীয় সেনা মুক্ত একটি বাংলাদেশ—একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র।
এই বিশেষ দিনটি প্রমাণ করে, স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শুধুই একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, যিনি সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেছিলেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই।
তথ্যসূত্র:
• দৈনিক ইত্তেফাক
• বিবিসি বাংলা
• প্রথম আলো
• চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত: বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার
• এম আর আখতার মুকুল: চল্লিশ থেকে একাত্তর
লেখক: সাংবাদিক
১৭ মার্চ ২০২৫