বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি শক্তি, যারা ইচ্ছা করলেই বহু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে। বিশেষত, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও চরমপন্থার উত্থান দমন করা তাদের ক্ষমতার বাইরে নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মার্কিন প্রশাসন অনেক সময় নিজ স্বার্থে উগ্রবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে কিংবা পরিস্থিতিকে তার অনুকূলে ব্যাখ্যা করেছে -এমন অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’—রাষ্ট্রের দৃশ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের অদৃশ্য প্রভাবশালী শক্তি —যারা বহুবার বিশ্ব রাজনীতির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী, কূটনৈতিক মহল, কর্পোরেট লবি— এদের সমন্বয়ে গঠিত এই শক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা স্বীকার করি বা না করি, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পক্ষে এই বলয়ের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র কূটনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা সহজ নয়। বিশেষত, মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর ওপর মার্কিন প্রভাব অত্যন্ত প্রবল, এবং সেই প্রভাবকে এড়িয়ে কোনো দেশ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে পারে না।
প্রশ্ন হলো, মার্কিন উদ্বেগ: কৌশল নাকি বাস্তবতা? মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড ভারত সফরে এসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। দিল্লিতে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার লঙ্ঘন ও তাদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে, ইসলামি উগ্রবাদ এবং তথাকথিত ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ধারণা বিশ্বব্যাপী কীভাবে হুমকি তৈরি করছে, সে বিষয়েও সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
গ্যাবার্ডের বক্তব্যের মূল দিকগুলো হলো—
ক. বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে।
খ. হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
গ. বাংলাদেশে ইসলামি উগ্রবাদ বেড়ে চলেছে এবং এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
ঘ. ট্রাম্প প্রশাসন এই সংকট মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গ্যাবার্ডের এই বক্তব্যের জবাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের মন্তব্য ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশ সরকার এটিকে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টা হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। বিবৃতির মূল প্রতিপাদ্য ছিল—
• বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল রাষ্ট্র।
• উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
• বাংলাদেশকে ‘ইসলামি খেলাফত’ ধারণার সঙ্গে যুক্ত করা বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক।
• বাংলাদেশেও চরমপন্থার চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সেটি সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্ন, শুধুমাত্র সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয় নয়।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে— বাংলাদেশ কি সত্যিই উগ্রবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে? নিঃসন্দেহে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সহিংসতা গত কয়েক দশকে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ বারবার উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন, রাজনৈতিক দাঙ্গা, হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল, মাজার ও উপাসনালয় ভাঙচুরের ঘটনাও সামনে এসেছে। বিগত সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ও দল ঘণিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও এন্তার অভিযোগ আছে।
তবে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি— জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। ধর্ষণ, লুটপাট, গণপিটুনির মতো ঘটনাগুলোও বাড়ছে। তাই শুধু সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টিকে আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
এখানে কৌশলগত দিকটিও লক্ষণীয়। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উগ্রপন্থা বহুবার আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই উগ্রবাদ নির্মূল করতে চায়, তাহলে তারা ৭ দিনের মধ্যেই তা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তারা বরং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উগ্রবাদকে ব্যবহার করে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া— প্রতিটি ক্ষেত্রেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়েছে।
এমন বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশ সরকার যদি মার্কিন প্রশাসনের এই উদ্বেগ পুরোপুরি অস্বীকার করে, তাহলে সেটিও বাস্তবতাবিবর্জিত হবে। আবার, গ্যাবার্ডের বক্তব্যকে অন্ধভাবে মেনে নিলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর বিদেশি প্রভাব বিস্তারের পথ প্রশস্ত হবে।
আমরা বরং বলতে পারি, বাংলাদেশও বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার অংশ হতে চায়। এটি সত্য যে, আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা সংকট রয়েছে, কিন্তু সেই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইতিবাচক সহযোগিতাই কাম্য, একতরফা সমালোচনা নয়।
বাংলাদেশ একটি উদীয়মান রাষ্ট্র, যার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। উগ্রপন্থা ও সহিংসতা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ, তবে সেটি কেবল বাংলাদেশকেন্দ্রিক নয়, বরং বৈশ্বিক সমস্যা। মার্কিন প্রশাসনের উচিত সত্যিকার অর্থে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা, যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার পাশাপাশি সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
আমাদেরও বুঝতে হবে, ডিনায়াল তথা অস্বীকার করবার প্রবণতা কোনো সংকটের সমাধান হতে পারে না। বরং বাস্তবতাকে স্বীকার করে কৌশলীভাবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়াই উত্তম। বাংলাদেশের জনগণের উচিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া এবং একতরফা সমালোচনা রেখে আন্তর্জাতিক মহলের উচিত সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা, যদি তারা বিশ্বকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল অবস্থানে দেখতে চায়।
মার্কিনিদের আসল স্বার্থ হলো তাদের বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখা, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার করা, এবং বাংলাদেশ যেন চীনের প্রভাব বলয়ে না চলে যায়, তা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো হয়ত অনেকটাই অজুহাত, যা প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় কূটনৈতিক চাপ তৈরির জন্য। আত্মস্বার্থনিমগ্ন আমরাও মার্কিন স্বার্থের বাইরে না। মার্কিন সরকারের নীতি নির্ধারকদের অন্যতম ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির উদ্যোগ ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক বাংলাদেশে নিয়ে এসেছি না, তা খরচ যত চড়াই হোক!
লেখক: সাংবাদিক
১৮ মার্চ ২০২৫