Posts

গল্প

যে পাখি ঘর বোঝে না

March 19, 2025

ক্যামেলিয়া আফরোজ

28
View

খাঁচার পাখিটাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করছিল জারা। রোজই চেষ্টা করে, ঠিক বিকেল বেলায়, জারার অবসর সময়ে। পাখি কথা বলবেই না, জারা কথা বলিয়েই ছাড়বে, দুজনের এ যেন এক নিরলস প্রচেষ্টা।

নাঃ, জারার বিশ্বাসই হতে চায় না যে টিয়াটা এমনই। এমনও তো হতে পারে যে টিয়াটা খুব মনযোগী আর খুবই বুদ্ধিমান।

হয়তো-বা ভাবছে জারা নিজেই একদিন বিরক্ত হয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিবে, ওমনি পাখিটা উড়াল দিয়ে উড়ে যাবে আকাশে।

অথবা এখনও তার মনে উঁকি দেয় ফেলে আসা নদী, বন, গাছ অথবা, খোলা আকাশের ছবি।সেই স্মৃতি মন থেকে মুছে না যাওয়া পর্যন্ত পাখিটা যেন কথা বলবেই নাহ্।

ব্যালকনিতে ঝোলানো লোহার খাঁচাটাকে এদিক সেদিক করে দেখে জারা। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে টিয়াটাকে,
"কিরে কথা বলবি না?"

টিয়াপাখি তরতর করে খাঁচা বেয়ে উল্টোদিকে চলে যায়। জারাও ছাড়বার পাত্রী নয়, খাঁচার তারে মুখ রেখে নরম করে বলে,
"বল্ জারা, জারা।"

নাঃ, পাখিটা কেনা তার মনে হয় ঠকাই হয়েছে। তাই না হলে মোটেই কথা বলার আগ্রহ হবে না কেন?

একবার পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল জারাকে, আবার সরে গেল।

সামান্য ক'টা টাকার জন্য কেন যে মানুষ মানুষকে ঠকায়! চাইলে তো সে পাখিওয়ালাক এমনিতেই দশ বিশ টাকা দিতে পারতো, পারতো না? দেয়াই যায়।

যাই হোক, জারার বিকেলের সময়টুকু এখন কাটে পাখিটাকে নিয়ে। যদিও তার মা তাকে বারবার নিষেধ করেছিল, এমন একটা সময়, নিজেকে ব্যস্ত না রাখলে চলেও না। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে।

জারার সাথে মজার একটা ব্যাপারও ঘটে গেছে অবশ্য। শুধু বাড়িতেই সময় কাটানোই কি সবকিছু না কি! ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মা রাও তাই মনে করে। তাই ছোটখাটো এক দুইটা কাজ না করলে চলেই না।

এই সুবাদে সে ছোট একটা চাকরি নিয়েছে পড়ালেখা শেষ করে। সেখানে তার এক ওয়ার্কমেট তাকে এক বক্স লেমন-টি গিফট করেছে তার বার্থডে তে।

লেবু চা জারার যে ভালো লাগে না এমন কিন্তু না। যদিও এখন পর্যন্ত ভুল করেও কেনার কথা মনে আসেনি।

তারপরও এমন একটা উপহার পেলে কার খারাপ লাগে! সাথে আবার একটা চিঠিও পাঠিয়ে দিয়েছে সেই ছেলে। চিঠিটা তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা–
"তুমি আয়না দেখো না, আয়না ভেঙে যাবে।"

এটা কেমন কথা। প্যাকেট খোলার আগে সে ভেবেছিল ভিতরে হয়তো একটা আয়না আছে। কিন্তু নাঃ, তাহলে এটা লেখার দরকার-টা কি!

এইটা না-কি আবার তারই লেখা একটা কবিতার লাইন। ছেলেটা মিথ্যেবাদী যাই হোক।জারার এখনও মনে পড়ে এই গানটা। আবার কি-না চিঠির উত্তর চেয়েছে বিনয়ের সাথে।

ইতিবৃত্তে সেই ছেলের নাম, জাহিদ। এদিকে বাড়ি থেকে জারার বিয়ে দেখা হচ্ছে। সুতরাং এসব কিছুই হেঁয়ালি লাগে তার কাছে।

কেমন যেন একটা শীত শীত ভাব। হিম হিম বেলকনি আর তার কেনা টিয়াপাখি তাকে যে খুব টানে এমন কিন্তু না। তাও জারা বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে।

পৃথিবী শীতল হচ্ছে ক্রমশ। বায়ুমন্ডলে পাতলা কুয়াশার পর্দা। নিচেই অত্যুজ্জ্বল রাস্তার বাতি। দূর থেকে তাও কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। চতুর্দিকের দরজা জানালা বন্ধ, ইটের অবয়বগুলোকেও কেমন যেন ভৌতিক লাগে জারার কাছে।

কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে যায় জারা। তার নিজেকে কেমন যেন খাঁচার পাখিটার মত বন্দি মনে হয়। তবে কি সে পাখিটাকে মুক্ত করে দিবে? কি দরকার জোর করে ভাষা শিখানোর?

রাস্তায় কিসের যেন একটা হর্ণ বেজে যায়। ঘুম ভেঙে যায় খাঁচায় বন্দী টিয়াপাখির। কোত্থেকে যেন সকালের এক চিলতে রোদ এসে পড়ে জারাদের শীতকালীন নিঝুম বাড়িতে। সামনে তার এক নির্দয় শীতের সকাল।

পাখিটাকে যদি বিড়াল ধরে নিয়ে যায়, যাক মরুকগে পাখিটা। এতটুকু মায়া জাগে না জারার বন্দি পাখিটাকে দেখে।

রাতের আকাশে জেগে থাকা চাঁদের মতোই সে হঠাৎ নিঃসঙ্গ বিদায় দিতে চায় পাখিটাকে। পাখিটা কি তার মনের কথা শুনতে পেল? খাঁচার দরজাটা অবচেতন মনে খুলে দেয় জারা।

পাখিটা প্রথমে বেলকনিতে উড়ে যেয়ে বসে, পড়ে বেলকনি ছেড়ে সাঁ করে উড়ে গেল সামনের বাড়ির একটি ছাদে, এরপর যেয়ে বসে ছোট্ট একটি গাছের ডালে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে আরও দূরে – দেখতে দেখতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল পাখিটা।

এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। জারার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, পাখির গতিতে টেবিল থেকে চিঠিটা বারান্দায় নিয়ে আসে জারা।

দু'হাতে কুটি কুটি করে ছিঁড়তে থাকে সে চিঠিটা। ভাসিয়ে দেয় বাইরে। যেন একরাশ দুঃখ আর অনুযোগ ঝরে পড়ে পাখিটা চলে যাওয়ায়।

Comments

    Please login to post comment. Login