Posts

চিন্তা

বিশ্ববিদ্যালয় : একটি মৃত্যুর দরজা

March 19, 2025

ভোঁতা পেন্সিল

93
View

যদি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে থাকেন অথবা বর্তমানে পড়ুয়া হয়ে থাকেন তাহলে আপনি হয়তো শিরোনামটি অনুধাবন করতে পারবেন । উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর শুরু হয় উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশের দৌড়ঝাঁপ । উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি । শুরু হয় কোচিং করা । কোচিং সেন্টার গুলোর প্রচারণা , সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সিনিয়রদের অনুপ্রেরণামূলক আলোচনা , বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানান সুযোগ-সুবিধা প্রচার , সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের উচু নজরে দেখা সাথে বাবা মায়ের স্বপ্ন এবং নিজের স্বপ্ন সব মিলিয়ে শুরু হয় ভর্তি প্রস্তুতি । অনেকের জন্য ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে সুদিন পাওয়ার উপায় হিসেবে বিবেচিত হয় এটি । শুরু হয় দিনরাত একাকার করে পড়াশোনা । মাথায় প্রচুর চাপ নিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করে যায় সবাই । খাওয়া-দাওয়া , ঘুম কোনো কিছুর বালাই নেই । শরীরে অসুখ বেধে গেলেও পড়া কিন্তু থেমে নেই । এত পরিশ্রম করেও যখন কোচিং এর পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হয় তখন শুরু হয় দুশ্চিন্তা আর  হতাশা । তাহলে কী আমাকে দিয়ে সম্ভব নয় ? আমি তো এত পড়ি তবু কেন মনে থাকে না ? কীভাবে পড়ব ? কী পড়ব ? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায় । আপনার এসব প্রশ্নের কারণে হতাশা যতটুকু থাকবে তার চেয়ে কয়েক হাজারগুণ বৃদ্ধি পাবে যখন কোচিং এর স্যার , ভাইয়া আর আপুদের মোটিভেশন শুনবেন ( উল্লেখ্য , কেউ কেউ সঠিক মোটিভেশন দিলেও বেশিরভাগই ভুল মোটিভেশন দেয় । ) । আপনাকে কিছু চটকদার কথা শুনিয়ে আপনার হতাশা বাড়িয়ে দিবে হাজারগুণ । তখন আপনার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া । অথচ এটা কত তুচ্ছ ! এভাবে সময় যেতে থাকবে । শুরু হবে ভর্তির আবেদন । এ যেন দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য মেলা । যেখানে সব বিক্রেতা আঁতাত করে নিজেদের মধ্যে , যেন কোনো ভাবেই অন্য কারো বাণিজ্যে ক্ষতি না হয় । আবেদনের সময়সীমা এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যে আপনি বাধ্য হবেন হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে । এর সাথে আছে ইউনিট বাণিজ্য । যত বেশি ইউনিট তত বেশি আবেদন তত বেশি টাকা । অকারণে দু একটা বিষয় নিয়ে একটি ইউনিট , উপ ইউনিট তৈরি করবে যেন আপনাকে আলাদাভাবে আবেদন করতে হয় । এদিকে আপনার পেছনে এত এত টাকা ব্যয় করা বাবা মায়ের প্রত্যাশার বেলুন ও ফুলতে থাকে দিন দিন । এটা অমূলক নয় । এর পর শুরু হবে পরীক্ষা । নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পরীক্ষা দেয়ার পর যখন তার ফলাফল হাতে আসবে তখন ই শুরু হবে নতুন সমস্যা । যদি আপনি ভালো ফলাফল করেন তাহলে আপনাকে সপ্তাহখানেক মাথায় তুলে নাচবে সবাই । আপনাকে নিয়ে নতুন বাণিজ্য শুরু হবে । কোচিং সেন্টারগুলো টানা হেচড়া শুরু করবে আপনাকে নিয়ে । বাবা মা খুব আদর করবে । আত্মীয় স্বজন খোজ খবর নিবে । কেউ আপনাকে মিষ্টি খাওয়াবে তো আপনি কাউকে মিষ্টি খাওয়াবেন । মনে হবে , চারিদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ । 
অন্যদিকে  , যদি আপনি খারাপ ফলাফল করেন অথবা অকৃতকার্য হন তাহলে আপনার সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটবে । তখন কোনো কোচিং সেন্টার আপনাকে নিয়ে টানা হেচড়া করবে না । আত্মীয় স্বজন খোজ খবর নিবে না । বাবা মা ভালো ভাবে কথা বলবে না । সামান্য কারণে রাগ দেখাবে । সেই সাথে আশপাশে যারা ভালো ফলাফল করেছে তারা আপনাকে মিষ্টি খাওয়াবে । আপনার বাবা মাকে মিষ্টি খাওয়ানোর নাম করে হেয় প্রতিপন্ন করবে । ফলে আপনার বাবা মার আরো রাগ বেড়ে যাবে আপনার ওপর । তখন চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখবেন ।
এখান থেকেই শুরু হয় মূল গল্প । ঝরে যায় তাজা তাজা প্রাণ । আত্মহননের পথ বেছে নেয় অনেকেই । ব্যর্থতার গ্লানি সইতে না পেরে পাড়ি জমায় পরলোকে । কেউ বা ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে বেড়ায় । গল্প এখানেই শেষ নয় । যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় তাদের মধ্যে অনেকেই আবার স্নাতক শেষ করার আগেই নানান কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় । এখন প্রশ্ন আসে যারা ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আত্মহত্যা করে তাদের ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম কিন্তু যারা সুযোগ পেলো তারা কেন আত্মহত্যা করলো ? তারা তো সফল হয়েছিল । সমাজে এত দাম তাদের । তবুও কেন শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো ? এর মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে বেশিরভাগ , ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশ অথবা প্রেম ভালোবাসায় আঘাতপ্রাপ্ত । এদের এই হতাশাও কিন্তু তৈরি হয় কোচিং এর স্যার, ভাইয়া আর আপুদের বড় বড় মোটিভেশন থেকে । তারা এদেরকে বুঝিয়েছিল যে , বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেই জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করা সম্ভব । ( যদিও ইদানিং এমন কথা খুব কম মানুষই বলে , কারণ এখন অনেকেই এটা বোঝে যে ভর্তির সুযোগ পাওয়াটাই সব নয় । )
আসলে আপনি যেটাকে সফলতা মনে করছেন সেটা হয়তো অন্য কারো কাছে ছেলেখেলা মাত্র । আমাদের দেশে যারা মেডিকেলে পড়ে তারা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের খাটো করে দেখে । আবার , যে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে সে সলিমুল্লাহ মেডিকেল পড়ুয়াকে খাটো করে দেখে । ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ারা মেডিকেল এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের খাটো করে দেখে । এর মধ্যে বুয়েট পড়ুয়ারা অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের খাটো করে দেখে । আবার , সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যান্যদের খাটো করে দেখে । তেমনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে তুলনামূলক ভালো বিভাগে পড়া শিক্ষার্থী তার চেয়ে খারাপ বিভাগে পড়া শিক্ষার্থীকে খাটো করে দেখে । সুতরাং , অন্যের মাপকাঠিতে আপনি নিজেকে পরিমাপ করতে গেলে দেখবেন আপনার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে । 
চলুন এবার মুদ্রার ওপিঠ দেখি ।
বলুন তো কোনো শিক্ষার্থী কী এমন আছে যে , কোচিং এ ভর্তি হয় আত্মহত্যা করতে ? দেখেছেন কখনও এমন কাউকে ? 
একটু ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি বিজ্ঞপ্তি পড়লেই দেখবেন সেখানে লেখা থাকে , " ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্জিত জ্ঞান যাচাই করা ।" তাহলে , উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্জিত জ্ঞান যাচাই করতে কেন উচ্চ মাধ্যমিকে না পড়া বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হয় ? কেন উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর পর পরীক্ষা না নিয়ে কয়েকমাস পরে পরীক্ষা নেয়া হয় ? উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর পর উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস অনুসারে পরীক্ষা হলে কোচিং সেন্টারগুলো এভাবে নোংরা বাণিজ্য করতে পারত না ।
কোচিং সেন্টারের স্যার , ভাইয়া আর আপুরা যে মোটিভেশন দেয় তাতে ভারসাম্য বজায় রাখলে শিক্ষার্থীর হতাশা কম হবে । ফলে অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকবে । কোচিং সেন্টারের স্যার , ভাইয়া আর আপুরা , আপনারা অনেক সময় বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে জীবন বৃথা । কিন্তু কথাটা বলার আগে কখনও কি চিন্তা করেছেন কী বলছেন আপনি ? আপনি যখন এমন চটকদার কথা শুনাচ্ছেন তখন আমাদের পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলার জন্য সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা পড়াচ্ছেন , আমাদের শরৎচন্দ্রের গল্প পড়াচ্ছেন কিংবা সুফিয়া কামাল ও বেগম রোকেয়ার কবিতা , প্রবন্ধ পড়াচ্ছেন । যারা কি না আপনার ভাষ্যে ব্যর্থ মানুষ । এটা কি হাস্যকর নয় যে , আমি সফল হতে ব্যর্থদের গল্প পড়ছি । তাছাড়া , কোচিং সেন্টারগুলোর উচিত তারা যেমন ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেয় তেমনি যারা খারাপ ফলাফল করেছে তাদের মানসিক শক্তি যোগাতে ও উৎসাহ প্রদান করতে বিভিন্ন সভা , সেমিনার আয়োজন করা । কারণ , সবাই সমপরিমাণ টাকা দিয়েই কোচিং এ ভর্তি হয় । তাদের  সঠিক পরামর্শ দানের পাশাপাশি তাদের বাবা মা কেও বুঝিয়ে বলা যে তারা যেন সন্তান কে সমর্থন করেন । বাবা মার সমর্থন থাকলে আত্মহত্যার হার অনেক কমে যাবে । সমাজের মানুষ যাই বলুক তাতে কেউ হতাশ হবে না ।
এছাড়া , যে কোনো শিক্ষার্থীর ই উচিত কোচিং এ ভর্তি হওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের ভালোভাবে বুঝিয়ে নেয়া যে আপনি ভর্তির সুযোগ পাবেন কি না এটা অনিশ্চিত । আপনি সুযোগ পেতেও পারেন নাও পেতে পারেন । কারণ , আসন সংখ্যা সীমিত কিন্তু পরীক্ষার্থী অনেক । এটা কোচিং এ ভর্তির আগেই বুঝিয়ে বলুন । তাছাড়া , একজন মানুষের অসময়ে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দরকার তার পরিবার থেকে । তাই , পরিবারের সদস্যদেরও বোঝা উচিত যে , তার খারাপ ফলাফলের জন্য আমাদের যতটা খারাপ লাগছে ঐ পরীক্ষার্থীর এর চেয়ে আরো বেশি খারাপ লাগছে । তাই , খারাপ ফলাফল করলে পরিবারের সদস্যদের উচিত তাকে স্বান্তনা দেয়া । একবার ভেবে দেখুন , সবাই যদি নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতো তবে গল্পটা কত সুন্দর হতো ! তবে অধিকাংশ মানুষ আত্মহত্যা করে কারণ তারা পরিবারের সমর্থন তো পায় ই না বরং পরিবারের মানুষও তার সাথে খারাপ আচরণ করে এই জন্য । অতএব , পরিবারের সদস্যদের এখন এটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে , তাদের কাছে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ ? আপনার পরিবারের সদস্যের জীবন নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ ? যদি কোনো পরিবার পরের বিকল্পটি বেছে নেয় তবে সে পরিবারের সন্তানদের   আল্লাহ খুব কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে  , এটা বলাই বাহুল্য ।
সর্বশেষ , আপনি আপনার জীবন কে কতটা মূল্যবান মনে করেন তার উপর নির্ভর করে আপনি কত কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখেন । আপনি যদি এমন তুচ্ছ একটা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য আত্মহত্যা করেন , তাহলে আপনার জীবন এই পরীক্ষার মতই তুচ্ছ । তাছাড়া , এই জীবনটা আল্লাহর দেয়া আমানত । এর খেয়ানত আপনি করতে পারেন না । এই জীবন যেহেতু আপনার সৃষ্টি নয় তাই এই জীবন ধ্বংসের কোনো অধিকার আপনার নেই । কত মানুষ তো পড়ালেখাই করে নাই জীবনে । তাতে কী তাদের জীবন থেমে গেছে ? না । কত মানুষ তো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েও বেকার বসে আছে । কত মানুষ তো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেও ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি । তার আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি । সে একজন মূর্খ মানুষের মতোই আচরণ করে । তবে , আপনি কোন কারণে এত হতাশ ? তাহলে , আপনি কি সেই খারাপ মানুষদের একজন হতে চান ? আপনি একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠুন । আপনার রবের প্রিয় হন । সেটাই হবে আপনার আসল সফলতা । সমাজের মানুষ আপনাকে কী বলল আর না বলল এতে আপনার কী এমন আসে যায় , যদি আপনি আপনার রবের প্রিয় হন । তাদের কথায় কেন আপনি লজ্জা পাবেন ? যারা নিজেরাই নির্লজ্জ । আপনি কেন এতটুকু নির্লজ্জ হতে পারবেন না ? আসলে যারা আপনাকে অপমান করবে এদের প্রায় সবাই ই কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং ব্যর্থ মানুষ । তাদের নিজেদের জীবনে তেমন কোনো অর্জন নেই । তাদের কথায় মাথা ঘামানো কি সত্যিই খুব দরকার ? কিংবা আপনি সফল হলেন , সমাজের মানুষ আপনাকে বাহবা দিলো । কিন্তু , আপনি আপনার রবের প্রিয় হতে পারলেন না , তাতে আপনার কী সত্যিই কোনো লাভ হলো ? চলুন একটু নির্লজ্জ হই ।

Comments

    Please login to post comment. Login