বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস, যা বাংলা নববর্ষের (পহেলা বৈশাখ) সূচনা করে। তবে, বৈশাখ শব্দের উৎস সংস্কৃত ভাষার "বৈশাখ" (Vaishakha) মাস থেকে, যা হিন্দু ক্যালেন্ডারে দ্বিতীয় মাস ছিল। বাংলা পঞ্জিকায় বৈশাখ মাসের স্থান প্রথম হওয়া সত্ত্বেও, শব্দটির ইতিহাস সংস্কৃত থেকে এসেছে এবং হিন্দু ক্যালেন্ডারে এটি দ্বিতীয় মাস হিসেবে পরিচিত ছিল। বাংলা পঞ্জিকা সংস্কৃত পঞ্জিকায় প্রভাবিত হওয়ায়, বৈশাখ মাসের নামও সংরক্ষিত হয়েছে। 'বৈশাখ' শব্দটি এসেছে বিশাখা নামক নক্ষত্রের নাম থেকে। এই মাসে বিশাখা নক্ষত্রটিকে সূর্যের কাছে দেখা যায়। বিশাখা হলেন রাধার অষ্টসখী বা আটজন প্রধান সখীর মধ্যে একজন। অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধের প্রধান মহিলা পৃষ্ঠপোষকের নাম বিশাখা। বিশাখার শাব্দিক অর্থ তারা বা আলোকরশ্মি।
অপরদিকে "মঙ্গল" শব্দটির উৎস সংস্কৃত ভাষা থেকে। সংস্কৃতের "মঙ্গল" (Mangala) শব্দের অর্থ হলো শুভ, কল্যাণকর বা সৌভাগ্যদায়ক। এটি মূলত কোনও কিছু বা ঘটনার শুভতা বা কল্যাণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলায় "মঙ্গল" শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই শুভতা, সাফল্য বা ভালো কিছু বোঝাতে ব্যবহার হয়, যেমন "মঙ্গল শোভাযাত্রা", "মঙ্গল কামনা", বা "মঙ্গলপ্রদ", যার মাধ্যমে ভালোবাসা, সুখ, ও সমৃদ্ধির কামনা করা হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে যাচ্ছে বৈশাখী শোভাযাত্রা। আমরা এখন কোনদিকে যাব?
ঐতিহ্য বিশারদরা বলছেন, বৈশাখী শোভাযাত্রার ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব বেশি, কারণ এটি বাংলা নববর্ষের অংশ হিসেবে ৫ 'শ বছরের পুরনো ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নববর্ষ উদযাপন প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সমাজে ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে, এবং এটি সংস্কৃতি, কৃষিকাজ, ব্যবসা ও পারিবারিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, মঙ্গল শোভাযাত্রা যদিও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক উদ্ভাবন। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথমবার ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় এবং তারপর থেকে এটি একটি বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে বিকশিত হয়েছে। যদিও এরও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব রয়েছে, তবে এর ইতিহাস অপেক্ষাকৃত কম পুরনো।
তাহলে, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত গুরুত্বের দিক থেকে বৈশাখী উৎসব অনেক বেশি প্রাচীন এবং ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
আমাদের তিন পার্বত্য জেলার নৃগোষ্ঠীরাও বছরের প্রথম দিন বৈসাবি উৎসব পালন করেন। বৈসাবির সাথে বৈশাখের খানিকটা শব্দগত মিলও আছে বৈকি।
ঠিক আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিরিখে আপনাদের বৈশাখী শোভাযাত্রা গণভোটে পাস করিয়ে দিলাম। কিন্তু মহাশয় বৈশাখ তো একটা হিন্দুয়ানি শব্দ, যার সাথে জুড়ে আছে বুদ্ধিজমও। এর বদনাম কীভাবে দূরীভূত হবে? বৈশাখ দিয়ে নাহয় মঙ্গল ঢাকলেন, গন্ধ যাবে কীসে?
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে শুভতা বা মঙ্গল সম্পর্কিত ধারণা অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। প্রাচীনকাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সময় মঙ্গল কামনা করা হয়। সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৫৫৬ সাল থেকে পহেলা বৈশাখের সূচনা হয়, এবং এটি বাংলার কৃষকদের জন্য একটি বিশেষ দিন হিসেবে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে মিষ্টিমুখের মতো শুভ কার্যক্রমও হত। তাই, পহেলা বৈশাখের সাথে মঙ্গল বা শুভতা একত্রিত হয়ে একটি ঐতিহ্যবাহী অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাহলে পহেলা বৈশাখের সাথে শুভতা বা মঙ্গল ব্যাপারটি তো রয়েই গেল। মঙ্গল শোভাযাত্রার দোষটা কী হলো? বৈশাখ থেকে এই মঙ্গলেরে তিরোহিত করবেন কেমনে?
লেখক: সাংবাদিক
২০ মার্চ ২০২৫