
বাংলার ইতিহাসে ১২০৪ সালের একটি ঘটনা আজও কৌতূহলের বিষয়—ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজির মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে লক্ষণ সেনের বিশাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটানো। এটি কেবল একটি যুদ্ধের গল্প নয়, বরং এটি শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, জনঅসন্তোষ, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং নবযুগের সূচনার প্রতিচ্ছবি। আর আশ্চর্যের বিষয়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণআন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পতনও একই ধরনের ঘটনার প্রতিধ্বনি।
প্রেক্ষাপট: ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকা বাংলাদেশ
২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। একদলীয় শাসন, বিরোধী দলের দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্নীতি, এবং সর্বোপরি মানুষের বাকস্বাধীনতার সংকোচন জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে।
২০২৪ সালের শুরু থেকেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শিক্ষার্থীদের বেকারত্ব, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দমননীতি নিয়ে জনগণের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজ, এবং সাধারণ জনগণ ধীরে ধীরে রাস্তায় নামতে শুরু করে। প্রথমদিকে আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হলেও, জুলাই মাসের শুরুতে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: লক্ষণ সেন বনাম আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব
লক্ষণ সেন ছিলেন বাংলা সেন সাম্রাজ্যের শেষ স্বাধীন রাজা। যদিও তার পূর্বপুরুষরা একসময় অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন, কিন্তু শাসনের শেষ সময়ে সেন রাজবংশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রশাসনের ভেতরে দুর্নীতি, অভিজাতদের বিলাসী জীবনযাপন, এবং সাধারণ জনগণের প্রতি উদাসীনতা সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিল।
ঠিক তেমনই, ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগ সরকারও একই ধরনের বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। একসময়ের জনপ্রিয় দল ক্রমাগত জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, যাদের অনেকেই গোপনে আন্দোলনকারীদের সমর্থন দিতে শুরু করে। দলের নেতারা বাস্তবতা বুঝতে পারলেও শীর্ষ নেতৃত্ব পরিস্থিতি এড়িয়ে যায়, যেমন লক্ষণ সেন করতেন।
ঝটিকা আক্রমণ: বখতিয়ার খিলজির ১৭ জন বনাম আন্দোলনের তরুণ নেতৃত্ব
ইখতিয়ার খিলজি যখন মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী নিয়ে নদীয়ার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখন লক্ষণ সেনের বিশাল বাহিনী পালিয়ে যায়। সাম্রাজ্যের রক্ষীরা যুদ্ধের বদলে আত্মসমর্পণ করে বা পালিয়ে যায়।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনেও দেখা যায়, কিছু তরুণ নেতৃত্ব ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে গেলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশের অনেক সদস্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাত মেলায়, কিছু সরকারি কর্মকর্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, এমনকি দলের অনেক নেতাও পরিস্থিতি অনুধাবন করে গা ঢাকা দেন। একপর্যায়ে, শীর্ষ নেতৃত্ব রাতের অন্ধকারে দেশত্যাগ করে—যেমন লক্ষণ সেন করেছিল।
সাম্রাজ্যের পতন: একই দৃশ্যপট, ভিন্ন সময়কাল
ইতিহাস বলে, বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের পর সেন রাজবংশ কার্যত শেষ হয়ে যায়। কিছু প্রতিরোধের চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি, এবং বাংলা এক নতুন শাসনব্যবস্থার অধীনে চলে যায়।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পরও একই চিত্র দেখা যায়। দীর্ঘদিনের শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে, নতুন শক্তি ক্ষমতায় আসে। যারা এতদিন ক্ষমতায় ছিল, তারা হয় পালিয়ে যায়, নয়তো আত্মগোপনে চলে যায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন আসে, প্রশাসনের পুরনো দালালরা নতুন শাসকদের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা করে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা: নতুন শাসকের জন্য বার্তা
বখতিয়ার খিলজি বাংলা দখলের পর প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার বংশধররা সেই কাঠামো ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে দিল্লির সুলতানদের হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে।
২০২৪ সালের আন্দোলনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তাদের জন্যও এই ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। যদি তারা জনগণের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, যদি তারা পূর্ববর্তী শাসকদের মতো স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যতেও একই পরিণতি ঘটতে পারে।
উপসংহার: ইতিহাসের চাকা ঘুরবেই
১২০৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল—সময়ের ব্যবধান ৮২০ বছর, কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বদলায়নি। ক্ষমতার অতি আত্মবিশ্বাস, জনবিচ্ছিন্নতা, এবং অবিচারের বিরুদ্ধে গণজাগরণের পরিণতি সবসময় এক হয়। ইতিহাস আমাদের শেখায়, জনগণের শক্তিকে অবহেলা করলে, যতই শক্তিশালী সাম্রাজ্য বা সরকার হোক না কেন, পতন অবশ্যম্ভাবী।
২০২৪ সালের গণআন্দোলন আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি শাসকের উচিত জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, এবং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করা। অন্যথায়, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কেউ আটকাতে পারবে না।