Posts

চিন্তা

রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও কথা বলবার প্রাধিকার

March 23, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

131
View

সেনাপ্রধানের সাথে বৈঠক বিষয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র দাবি মিথ্যা নয়, তবে তিনি আংশিক সত্য বলেছেন। মিস্টার আব্দুল্লাহ্'র দাবি তাদেরকে ডেকে নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। সেনা মুখপাত্র বলেছেন, বৈঠকটি সারজিস আলমদের ঐকান্তিক ইচ্ছায় হয়েছে। এবং হাসনাতদের বক্তব্যকে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বলেছে সেনাসদর।

শনিবার নেত্র নিউজকে দেয়া সেনা সদরের এক বিবৃতিতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আব্দুল্লাহকে “ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগে”র অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বরং হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তার দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, হাসনাতের বক্তব্য “অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার”।

নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদক হাসনাত আব্দুল্লাহকে প্রশ্ন করেন, সেনানিবাসে তিনি যে বৈঠকটির কথা বলছেন, তা কি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে হয়েছিল কিনা। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি সরাসরি জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান।

তিনি বলেন, “আমিতো সেখানে ‘ক্যান্টমেন্ট’ উল্লেখ করেছি, আপনারা কথা বলতে পারেন সেখানে।”

হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কিত বয়ানটি তাঁর দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কি সমর্থন করে? এর স্পষ্ট উত্তর হলো না। গতকাল শনিবার সিলেটে এক ইফতার মাহফিলে দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরউদ্দীন পাটোয়ারী হাসনাতের ওই ফেসবুক পোস্টকে “শিষ্টাচারবর্জিত” হিসেবে উল্লেখ করেন।

পরোক্ষভাবে হলেও সেনাসদরের বক্তব্য পাওয়া গেল। তাহলে মিস্টার আব্দুল্লাহ্ যে বললেন, 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনা ও আসন ভাগাভাগির বয়ান এসেছে' -তার কী হবে? এটার স্পষ্ট সমীকরণ হলো এখনই দুইপক্ষের কারো কথায় পুরোপুরি আস্থাবান না হয়ে আরো খানিকটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

আর্মি চাইলে ওই দিনের আলাপনের টোটাল ভিডিও ফুটেজ হাজির করতে পারবে, একটা প্রশিক্ষিত বাহিনীর সেই ক্যাপাবিলিটি আছে। পাশাপাশি হাসনাতদের ওপরেও দায় বর্তাবে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তাদেরকে ডেকে নেয়া হয়েছে এটার অথেনটিক প্রমাণ হাজির করা। যা কথা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ ডকুমেন্ট হাজির করা। এতটা জটিল কেইসে মুখের কথায় আর চিড়ে ভিজবে না।

প্রশ্ন উঠছে সেনাপ্রধান রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দেয়ার প্রাধিকার রাখেন কিনা? যদি এটা ৫ আগস্টের আগের বাংলাদেশ হতো তাহলে উত্তর হতো না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বাহিনী প্রধান রাজনৈতিক বিষয়ে বাতচিত করতে পারেন না এটাই রাষ্ট্রীয় বিধি। কিন্তু ৫ আগস্টে এই সেনাপ্রধান ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানই রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলবার বৈধতা আদায় করে নিয়েছেন। তাঁর নিয়োগকর্তা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বহাল থাকা অবস্থাতেই জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত কমান্ড অমান্য করে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন করেছেন। আন্দোলন সফল করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর সব রাজনৈতিক দলকে এক কাতারে নিয়ে এসে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। ঠিক যেদিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য আপনারাই জেনারেল ওয়াকারকে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়ে বসেছেন। সেনাবাহিনী তাদের কর্মকুশলতা দিয়ে সিভিল প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রিসি পাওয়ার আদায় করে নিয়েছে। এখন যদি বলেন, জেনারেল ওয়াকারের সেনাবাহিনী রাজনীতির কেউ না ওই কথা ধোপে টেকে না, সেটা হয় বালখিল্যতা এবং বোধের অপলাপ।

সর্বোপরি জেনারেল ওয়াকার বলেই দিয়েছেন, তাঁর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নাই। একটা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেই তার ছুটি। আর কোনো চাওয়া-পাওয়া তাঁর নাই। ৫ আগস্টে তিনি যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন তাতে এইটুকু চাওয়া তাঁর অনধিকার বা অনভিপ্রেত নয়।

আচ্ছা ধরুন আজকে জেনারেল ওয়াকার নাই হয়ে গিয়ে আপনাদের খুব পছন্দমতো ঘনিষ্ঠ কেউ আর্মির কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল গ্রহণ করলেন। চৌকষ ৯ ডিভিশন তাঁর কথায় উঠবস করে। ওই সেনাপ্রধানের যদি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকে তাঁকে ঠেকানোটা খুব সহজসাধ্য কাজ হবে? মোটেই না। ক্ষমতা আত্মীয়, স্বজন, নিকটজন, পিতা-পুত্র কিছুই দেখে না। ক্ষমতার একটাই কাজ বহু রক্তপাত ও অগণন ত্যাগের মধ্য দিয়ে হলেও অভীষ্ট লক্ষার্জন।

মোদ্দাকথা হলো, পতিত স্বৈরশাসক যে দলটির নিষিদ্ধের দাবি উঠছে, এরচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো তাদের অপরাধ প্রমাণের মাধ্যমে যথার্থ শাস্তি নিশ্চিত করা। শাস্তির আসল আলাপ বাদ দিয়ে নিষিদ্ধের আলাপ করা মানেই হলো গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালবার শামিল।

এমনিতেই দেশের রাজনীতি এখনো টালমাটাল অবস্থায় আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সকল সংস্কারে সায় দিচ্ছে না বড় দল বিএনপি। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্থিতিশীলতার আলাপ না করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে শত্রু জ্ঞান করায় ভালো কোনো ফলাফল বয়ে আনবে না।

শিষ্টাচার বর্জন, মিথ্যাচার ও স্ট্যান্টবাজি দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি চলে না। সাধুতার কদর গণমানুষে এখনো আছে। দেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রযাত্রার স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে বিষয়টা খেয়াল রাখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক 
২৩ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login