একটি প্রাচীন শহরের পাশেই ছিল এক রহস্যময় পাহাড়, যেটি "নীরব পাহাড়" নামে পরিচিত ছিল। শহরের লোকেরা পাহাড়ের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতো না, কারণ তারা বিশ্বাস করতো, পাহাড়ে কিছু অদ্ভুত শক্তি বিরাজমান। নানা ধরনের কিংবদন্তি ও গল্প শোনা যেতো, কিন্তু এর সত্যতা কেউ জানতো না। কেউ বলতো, পাহাড়ে একটি প্রাচীন মন্দির আছে, যেখানে একসময় এক ভয়ঙ্কর দেবতা বাস করতো, যাকে কখনো শান্ত করা যায়নি। সে দেবতা তার পূজারীদের হত্যা করেছিলো, আর তার পরে তার অস্তিত্ব পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
কিন্তু একদিন, শহরে এসে পৌঁছালো রাজীব নামক এক যুবক। সে ছিল একজন অভিযাত্রী এবং পুরনো ইতিহাস ও রহস্যের অনুসন্ধান করতে খুবই আগ্রহী। রাজীব শুনেছিলো নীরব পাহাড়ের সম্পর্কে অনেক অদ্ভুত গল্প, এবং তার মনে হয়েছিলো, এখানে কিছু গভীর রহস্য লুকানো রয়েছে। সে ঠিক করলো, একদিন পাহাড়ে চড়বে এবং সেই পুরনো মন্দিরটি খুঁজে বের করবে।
রাজীব এক সকালে পাহাড়ের দিকে রওনা হলো। শুরুর দিকে, পাহাড়ের পথ ছিল খুবই সহজ, তবে যতই সে উপরের দিকে উঠছিলো, ততই আশপাশের পরিবেশ ঘুটিয়ে যাচ্ছিলো। তার চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল, যেন পাখিরাও আর গান গাইছে না। তার পা চলতে থাকলেও, চারপাশে কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছিলো না। পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছানোর পর, রাজীব এক ভীষণ পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলো। মন্দিরটির দেয়ালে ভীতিকর চিত্র আঁকা ছিল, আর চারপাশে অনেক অদ্ভুত সুরক্ষামূলক চিহ্ন ছিল।
রাজীব তখন মন্দিরের ভিতরে ঢুকলো। ভিতরে ঢুকতেই তার শরীর জড়িয়ে ধরলো এক ঠাণ্ডা হাওয়া, আর তার চোখের সামনে তৎক্ষণাত অন্ধকার ভর করে এল। রাজীব চোখ বন্ধ করে দেখলো কিছু অদ্ভুত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর ভীষণ এক কণ্ঠে বললো, "তুমি কেন এসেছো এখানে? এই মন্দিরে কেউ আসবে না।"
রাজীব মাথা উঁচু করে তাকালো, এবং দেখতে পেলো মন্দিরের মাঝখানে একটি প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। মূর্তির মুখে রক্তের দাগ ছিল, এবং তার চোখ দুটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো। রাজীব মূর্তিটির দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু মূর্তিটি হঠাৎ নিজে থেকে ঘুরে গিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। রাজীব ভয়ে পিছিয়ে গেলো, তবে তার পা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই মুহূর্তে, মূর্তির চোখের মধ্যে অন্ধকারের এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়লো, আর রাজীব অনুভব করলো, যেন কিছু অদৃশ্য শক্তি তাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে।
হঠাৎ, তার পা নড়তে শুরু করলো, আর সে নিজের অজান্তেই মূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনই, মন্দিরের মধ্যে অদ্ভুত একটা শব্দ শোনা গেলো, যেন পাহাড়ের গভীরতা থেকে কিছু ভীষণ শক্তি বেরিয়ে আসছে। রাজীব মুখ খুলতে গিয়ে দেখতে পেলো, মন্দিরের দেয়ালগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে এবং চারপাশে রক্তের ধারা বইতে শুরু করেছে।
রাজীব কোনোমতে মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও, সে দেখতে পেলো যে, পাহাড়ের পথ আর সোজা নেই—যতই সে দৌড়াচ্ছিলো, ততই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। তার পা যেন আটকে যাচ্ছিলো মাটিতে, আর তার শরীরে ভয়ের শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো। তারপর, হঠাৎ করে তার চোখের সামনে পাহাড়ের অদ্ভুত মুখাবয়ব ফুটে উঠলো—এটা ছিল সেই দেবতার মুখ, যার চোখে শুধুই রক্ত ছিল।
রাজীব জানতো, সে যদি এখান থেকে বেরোতে না পারে, তবে সে কখনো মুক্তি পাবে না। অবশেষে, সেই ভয়ানক শক্তি তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলো, আর তার পরে আর কেউ রাজীবের কোনো খোঁজ পেলো না। পাহাড়ে থাকা লোকেরা বলতো, মাঝে মাঝে, সন্ধ্যার পর পাহাড়ের দিকে তাকালে, সেখান থেকে এক অদ্ভুত মন্ত্রের আওয়াজ শোনা যায়—এমনকি আজও।