রাজনীতির মঞ্চে নবগঠিত দল এনসিপি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি) এখন নিজেরাই নিজেদের চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে। দলটির নেতারা একনায়কের পতনের পর যে শক্তি, মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল, তা এখন তাদের নিজেদের অসংগতি ও দ্বিচারিতার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
জুলাই আপ্রাইজিং-এর শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইফতারের আয়োজন করা হলো। তাদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হলো প্লাস্টিক প্যাকেটে। অথচ অন্যদিকে, ফাইভ-স্টার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ১,৩০০ বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য রাজকীয় ইফতারের ব্যবস্থা করা হলো, যেখানে ব্যয় করা হলো দেড় কোটি টাকা! প্রশ্ন উঠছে—এই বিলাসী আয়োজনের ব্যয় কি শহীদের রক্তের দামে অর্জিত?
শুধু অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যই নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও এনসিপির নেতাদের মধ্যে সুস্পষ্ট মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার রিট হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। এর পেছনে কার ইন্ধন কাজ করল? দলীয় শীর্ষনেতা হাসনাত-সারজিস কেন এত দ্রুত ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলেন? কোন স্বার্থ জড়িত ছিল সেখানে?
অন্যদিকে, আগস্ট পরবর্তীকালে সময় টিভির কয়েকজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে চাওয়ার অভিযোগ উঠে হাসনাতের বিরুদ্ধে। ওই টিভির এমডিকে মব প্রেশারাইজ করেন বলে খবর বের হয়। পরে তিনি সেটি অস্বীকার করলেও, তার দোদুল্যমান অবস্থানই প্রশ্ন তৈরি করছে—প্রকৃত সত্যটা আসলে কী?
এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীল অবস্থান। কিন্তু এনসিপির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। কিছুদিন আগেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলা হলো, অথচ এখন বলা হচ্ছে—'দেশপ্রেমিক সেনারা গুলি চালায়নি, তাই আমরা তাদের ভালোবাসি।'
এই বক্তব্যের পরপরই এনসিপির আরেক নেতা নাসীরউদ্দীন পাটোয়ারী হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র আগের বক্তব্যকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ বলে অভিহিত করলেন। এখন আবার হাসনাতের সামরিক বাহিনী-বিষয়ক বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন সারজিস আলমও। তার মতে, 'ফেসবুকে প্রকাশিত কথাগুলোর উপস্থাপনাভঙ্গি সমীচীন হয়নি এবং এটি আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের ডেকে পাঠানো হয়নি, আমরাই গেছি সেনানিবাসে।'
এনসিপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখানেই শেষ নয়। মিস্টার পাটোয়ারী যখন জামায়াতে ইসলামীর অবৈধ পুনর্বাসনের জন্য সেনা জনতার অভ্যুত্থানের ফসল লুটকারী আখ্যা দিয়ে জিয়াউর রহমানকে দায়ী করছেন, তখন হাসনাত-সারজিস তার বিরোধিতা করছেন। এত পরস্পরবিরোধী অবস্থান কি দলটির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে না?
উপরের কথাগুলো স্রেফ কতগুলো উদাহরণ মাত্র। এমন রসিকতা শত শত সৃজিত হয়ে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এনসিপিতে রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতার বড় অভাব। রাজনীতিতে দলীয় ঐক্য অপরিহার্য। আগস্টে একনায়কের পতন নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে এনসিপির এখনকার পদাধিকারীদের বড় সাফল্য। কিন্তু সেই অর্জন ধরে রাখতে হলে তাদের সুসংগঠিত ও পরিপক্ব হতে হবে।
বর্তমানে এনসিপির নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, দলীয় নীতি ও কার্যক্রম নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
হাসনাত না ওয়াকার' এই স্লোগান দেয়া অর্বাচীনতা। যার যার জায়গা তার তার। আপনি এখনি কেন নিজেদেরকে আরেকজনের চেয়ে বড় বলে দাবি করে বসছেন। গণমানুষের কাছে ভোটের জন্য যেতে হবে না আপনাদের? বয়স কম বলে পার পাওয়ার তো উপায় বা সুযোগ নাই।
এনসিপির নেতাদের বুঝতে হবে, রাজনীতি হলো একটি সুচিন্তিত শিল্প। ফিলোসফিক্যাল আর্ট। যেখানে হারমনি বা ঐক্য না থাকলে সবকিছু বিশৃঙ্খলায় পরিণত হতে বাধ্য। দলীয় নেতৃত্ব যদি নিজেদের অবস্থান নিয়েই একমত হতে না পারে, তাহলে তারা কীভাবে একটি জটিল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবে?
এনসিপিকে টিকে থাকতে হলে দলীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হবে। তাদের উচিত হবে নিজেদের পূর্ববর্তী কার্যক্রমের স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দেওয়া, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এড়িয়ে চলা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টিগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
অন্যথায়, জনগণের মধ্যে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা দ্রুতই ক্ষয়ে যাবে, এবং একনায়কের পতনের যে সাফল্য তারা অর্জন করেছিল, তা অচিরেই অতীতের এক ব্যর্থ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হবে।
লেখক: সাংবাদিক
২৩ মার্চ ২০২৫