Posts

ফিকশন

নরকের দ্বার

March 24, 2025

Nilasish Basu

78
View

রাজা এসে দাঁড়ালো ছোটো স্টেশনটার একদম শেষ প্রান্তে। এটাকে হল্ট স্টেশন বলাই ভালো। সারাদিনে একটাই মাত্র ট্রেন এখানে থামে। স্টেশনে দূর দূরান্তে একটা লোকও চোখে পড়ছেনা। নামে নন্দনগড় হলে কী হবে! এরকম পোড়ো স্টেশন ভূভারতে আর আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু কিছুই করার নেই। পানিশমেন্ট ট্রান্সফার হলে তো এরকম বিদঘুটে জায়গাতেই হবে, সেটাই স্বাভাবিক। অগত্যা আর কিছু না ভেবে রাজা হাঁটা দিল স্টেশনের বাইরে। 
আর কিছুক্ষণেই সন্ধ্যা নামবে। আকাশে মেঘও দেখা দিয়েছে। এক্ষুনি এখানকার থানায় না পৌঁছাতে পারলে মুশকিল হবে। বেশ ছিল চূঁচূড়ায় থানার সেকেন্ড অফিসার হয়ে। লোভে পড়ে ওই প্রোমোটারটার থেকে ঘুষ নিতে গিয়েই বিপদে পড়লো। ঘুষ ওর ওপরের অফিসাররাও নিয়েছিল। তবে বলির পাঁঠা করা হয়েছে রাজাকেই। সেই পরিণামস্বরূপ এই নন্দনগড়ে তাঁকে শাস্তিমূলক বদলি করে পাঠানো হয়েছে।
স্টেশন থেকে থানা কতো দূর কে জানে! থানা থেকে কেউ আসেওনি তাঁকে নিয়ে যেতে। তাই স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে রাজা, যদি কোনও গাড়ি পাওয়া যায় বা কারও দেখা পাওয়া যায়, সেই আশায়। কিন্তু এই অদ্ভূত জায়গায় দূর দূরান্তে গাড়ি তো ছাড়, কোনও জনপ্রাণীর দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা! কী করবে এখন? ভাবতে থাকে রাজা।

এমন সময়েই হঠাৎ খ্যাঁক খ্যাঁক হাসিটা কানে আসে তাঁর। একটু চমকেই যায় সে। নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে তাঁর সামনে হাজির হয় একটা লোক। মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ। পড়নে ময়লা ছেঁড়া জামা আর মুখে সেই খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি। রাজার একদম মুখের কাছে এসে বলে "ফিরে যা! ফিরে যা! এটা অভিশপ্ত জায়গা!  মারা পড়বি! সবাই মরবে! সবাই!" আর সঙ্গে সেই পিত্তি জ্বালানো হাসি। একটু ঘাবড়েই যায় রাজা। যেমন হঠাৎ হাজির হয়েছিল তেমনই হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল পাগলটা।

রাজা বুঝতে পারেনা বিষয়টা। রাস্তা-ঘাটে এমন পাগল অনেক ঘোরে। কিন্তু এমন জনমানবহীন ভূতুরে জায়গায় এরকম একটা উৎকট পাগল এসে রাজাকে একটু ভয়ই পাইয়ে দিয়েছে। রাজার কপাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।

"বাবু কই যাবেন? এলাকায় নতুন নাকি?" পাশ থেকে কথাগুলো কানে যেতেই রাজা দেখে একটা ময়লা ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়া বুড়ো বিড়ি টানছে একটা প্যাডেল ভ্যানে বসে। আবারও অবাক হয় রাজা। সে নিশ্চিত, এতক্ষণ কেউ ছিল না তাঁর আসেপাশে। কিসব অদ্ভূতুরে কান্ড ঘটছে আজ! কিন্তু একটু সাহসও যেন পায় সে। যাক! কারও তো একটা দেখা পাওয়া গেল। এবার এই ভ্যানেই লোকাল থানায় যাওয়া যাবে। স্বস্তি পেয়ে রাজা লোকটাকে নিজের পুলিশোচিত গম্ভীর গলাতেই জিজ্ঞাসা করল – “থানাটা কতোদূর? আমাকে নিয়ে চল।“

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে লোকটা বলল – “থানায় কী কাজ বাবু?”

“আমি এখানকার নতুন অফিসার। আর দেড়ি নয়, নিয়ে এসো ভ্যান।“ – রাজা ভেবেছিল সে পুলিশ এই কথা জানলে লোকটা হয়তো একটু সমীহ করবে! কিন্তু সেদিকে লোকটার কোনও ভ্রূক্ষেপ দেখা গেল না। সে আপন মনে বিড়ি টানতে লাগল।

'এ তো আচ্ছা জ্বালাতন! কী ঘাড়ত্যাঁড়া লোক রে বাবা!' - বিরক্ত হয়ে উঠল রাজা।

একটু ধমকেই বলল - "কী হল? শুনতে পাচ্ছো না! কথা কানে যাচ্ছে না? ভ্যানটা এদিকে আনো। আমাকে লোকাল থামায় নিয়ে চলো।"

আবারও একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে একটু কেশে নিয়ে লোকটা বলল - "বিড়িটা খেতে দেন মনের সুখে। তারপর যাবো।"

রাজা অবাক হয়ে গেল। এটা কেমন জায়গা! সামান্য একজন ভ্যানওয়ালাও পুলিশের নামে ভয় পাচ্ছেনা। তাঁর এক হাঁকে লেকজনকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতে দেখেই সে অভ্যস্ত। আর এই গন্ডগ্রামের একজন সামান্য ভ্যানওয়ালা তাঁকে পাত্তা দিচ্ছে না দেখে রাজার গা-পিত্তি জ্বলে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে পুরো আকাশকে। অস্বস্তিও হতে লাগলো মনের ভিতর। তাড়াতাড়ি থানায় পৌঁছে জয়েন না করলে তো বিপদ হবে। এদিকে এমন পান্তব বর্জিত জায়গায় এই ভ্যানওয়ালা ছাড়া একটা কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছেনা! এসব ভাবতে ভাবতেই আবারও চমকে উঠল রাজা। একি! এই তো লোকটা ওখানে ভ্যানে বসে বিড়ি টানছিল, ওর কথাকে পাত্তাই দিচ্ছিল না। এখন একদম ওর সামনে ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাওয়া কালো দাঁতগুলো বের করছে হাসছে!

"তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন বাবু! বৃষ্টি আসতে পারে। থানা অনেক দূর! এই তো তাড়া দিচ্ছিলেন! এখন অমন করে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন? বসুন বসুন। তাড়াতাড়ি বসুন।"

লেকটার কথায় সম্বিত ফিরে পায় রাজা। কিন্তু কিছুই তাঁর মাথায় ঢুকছেনা! এসব কী ঘটছে! না কি ওরই চোখের ভুল এসব। মুহুর্তের মধ্যে ওর অগোচরে একটা লোক আর একটা ভ্যান উদয় হল! সেটা ছিল ওর থেকে প্রায় বিশ গজ দূরে। আবার চোখের নিমেষে ওর সামনে এসে হাজির। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে রাজার। এমন সময় মেঘ গর্জে উঠল। মেঘের ডাক যেন রাজাকে তাড়া দিয়ে বলল আর দেড়ি করে ভ্যানে উঠে বসতে। রাজাও বাকি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভ্যানে উঠে বসল। লোকটা প্যাডেলে চাপ দিল।

ভ্যান গড়াতে শুরু করল তার নিজস্ব ছন্দে। কিন্তু রাজা জানতো না কোন অনিশ্চিতের পথে এগিয়ে চলেছে সে!

 আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। স্টেশন চত্বর ছেড়ে ভ্যানটা চলেছে একটা এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা ধরে। মাঝে মধ্যে একটা দু'টো বড়ো গাছ বাদ দিলে বাকি জায়গাটা ন্যাড়া। রাজার মনে হল যেন একটা বিস্তির্ণ মাঠের মধ্যে দিয়ে সে চলেছে। যতদূর চোখ যাচ্ছে এই মাঠের কোনও সীমানা চোখে পড়ছে না।

জোরে হাওয়া বইতে শুরু করল। মেঘের গর্জন ক্রমাগত বাড়ছে। কথায় আছে 'যত গর্জায় তত বর্ষায় না'। রাজা মনে মনে ভাবলো না বর্ষালেই ভালো। বৃষ্টি নামার আগে থানায় পৌঁছাতে পালেই মঙ্গল। কিন্তু মনের ভিতর একটা অস্বস্তি থেকেই গেছে রাজার। সেই অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য রাজা লেকটার সঙ্গে আলাপ জমাতে চাইল - "তোমার নামটা কী?"

লোকটা কেমন দার্শনিকের মতো বলল - "সে অনেককাল আগে বাপ-মা একটা নাম দিয়েছিল! এখন আর সেসব নাম ধাম লাগে না।"

"আরেহ! লাগে কি না সে তো পরের বিষয় নিজের নামটা জানো না?"

"কী হবে জেনে?"

আচ্ছা অশিক্ষিত অভদ্র ত্যাঁদোড় লোক তো! নাম জেনে কী হবে মানে! আলাপ জমাতে গিয়ে আরও বিরক্ত হয়ে গেল রাজা। মনে মনে ভাবল - 'দাঁড়া থানায় পৌঁছাই, তারপর তোর মজা দেখাচ্ছি!' মুখে বলল - "থানা আর কত দূর?"

কাটখোট্টাভাবে লোকটা উত্তর দিল - "সবে যাত্রা শুরু, এখনও অনেক দূর পথ যেতে হবে বাবু।"

অথচ রাজার বেশ মনে পড়ছে মোটেই সবে যাত্রা শুরু হয়নি। তারা রওনা দিয়েছে প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল! সে ভালো করে চারদিকে তাকালো।

একি! ওই তো স্টেশন দেখা যাচ্ছে! যেখান থেকে সে ভ্যানে উঠেছিল, আবারও সেখান দিয়েই ভ্যানটা যাচ্ছে! এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে এই অচেনা জায়গায়! ম্যাজিক নাকি! লোকটা কি ছ্যাবলামি করছে! নাকি তাঁকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে? সেও পুলিশ, এতো সহজে ভয় পেলে চলবেনা। কিছু একটা গন্ডগোল আছে। এবার বেশ কড়া আর গম্ভীর গলায় রাজা বলল - "তুমি আবার সেই একই জায়গায় আমাকে নিয়ে এলে! কী  হচ্ছে এটা? মজা করছো আমার সঙ্গে!  দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমার মজা!" এই বলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে ফোন করার জন্য। কিন্তু এখানেও সমস্যা! ফোনে কোনও নেটওয়ার্ক নেই! আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল।

একটু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে লোকটা বলে - "কোথায় একই জায়গায়!  এই তো দেখুন গাঁয়ের মধ্যে এসে পড়েছি।"

"কোথায় গাঁয়ের মধ্যে। এই তো স্টেশন..." কথা শেষ হলো না রাজার। তাঁর চমকের পালা এখনও শেষ হয়নি। অবাক চোখে চারিদিকে চেয়ে দেখে সত্যিই একটা গ্রামের মধ্যে এসে পড়েছে! এবার সব গুলিয়ে যাচ্ছে রাজার! এবার বেশ ভয় ভয় করছে ওর। চারিদিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলো ও। এটাকে কি ঠিক গ্রাম বলা যায়! কয়েকটা মাটির বাড়ি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বটে; কিন্তু এখানেও কোনও মানুষের অস্তিত্ব ও টের পেল না। এমনকি রাস্তায় একটা কুকুর বিড়াল পর্যন্ত নেই!

স্টেশন থেকেই বিষয়টা ও খেয়াল করছে। এই অদ্ভূত জায়গাটায় মানুষ তো নেই বটেই, একটা কুকুর-বিড়াল, এমনকি কাক পর্যন্ত ওর চোখে পড়েনি!

জোরে বিদ্যুৎ চমকে চারিদিক একবারের জন্য আলোকিত করে তুলল; আর তার সঙ্গেই মেঘের গর্জন। সেই গর্জন ছাপিয়ে খ্যাড়খ্যাড়ে গলায় ভ্যানওয়ালাটা বলে উঠল - "বৃষ্টি আসবে বোধহয় বাবু। আজ আর থানায় পৌঁছাতে পারবেন না।"

একটু ঢোক গিলে নিজের মনের ভিতরের ভয়টা কোনওরকমে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে রাজা বলল - "তাহলে কী হবে? থাকবো কোথায় এই দুর্যোগের মধ্যে?"

"ছি! ছি! বাবু, আপনি আমাদের অতিথি। আপনার কোনও অসুবিধা করতে পারি। আপনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা আমি করবো। এই গরিবের ঘরেই নাহয় একটু কষ্ট করে থাকবেন, আর রাতে দু'টি ডাল-ভাত খাবেন।"

রাজা বুঝতে পারছেনা কী উত্তর দেবে! তাঁর মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। এই দুর্যোগের রাতে একটা আশ্রয়ও দরকার, আবার এই অদ্ভূত লোকটাকে ঠিক বিশ্বাস করতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সে নিরূপায়। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো।

"যা! দেখলেন বাবু বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চলেন সামনেই আমার বাড়ি। সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন।"

রাজারও আর কিছুই করার নেই এই পরিস্থিতিতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থাপনাতেই রাজি হল সে। বরং লোকটার প্রতি একটু যেন সমীহ জাগলো ওর ভিতর। লোকটাকে প্রথমে যেমন ভেবেছিল, ততোটাও খারাপ সে নয়। নিজের বাড়িতে এরকম অজানা অচেনা কাউকে কে আর আজকাল আশ্রয় দেয়! বিপদে যে সাহায্য করে, সেই তো প্রকৃত বন্ধু। তাই মন থেকে সব সঙ্কোচ দূর করে রাজা বলল - "চলো, তোমার বাড়িতেই তাহলে নিয়ে চলো। আর অনেক ধন্যবাদ তোমায়, এই দুর্যোগের সময়ে আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য।"

উত্তরে শুধু খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল লোকটা। রাজা বুঝতেও পারেনি কখন একটা বাড়ির সামনে ভ্যানটা এসে থেমেছে। বাড়িটা এই অন্ধকারে প্রায় মিশে গেছে। ভালো করে নজর না করলে দেখা যাবেনা। মাটির বাড়ি। সামনের দিকটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। একটা ছোট্ট দাওয়া আর দু'টো মাটির ঘর। কিন্তু এই বাড়িটাতেও বাইরে থেকে কোনও মানুষ আছে মনে হলো না রাজার।

"বসে বসে ভিজছেন কেন বাবু! আসুন, গরিবের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিন। গামছা দিচ্ছি গা-মাথা মুছে নিন।"

রাজা গলাটা শুনতে পেল, কিন্তু সামনে তাকিয়ে সে আর লোকটাকে দেখতে পেল না। রাজার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো!

"এই তুমি কোথায় গেলে?" নিজের অজান্তেই রাজার গলা থেকে চিৎকারটা বেড়িয়ে আসে।

"এই তো বাবু। আসুন ঘরে, ভিজছেন কেন?"

ভোজবাজি নাকি! রাজার চোখের সামনেই লোকটা উদয় হয়েছে আবার। রাজার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে বলল - "তুমি তো ছিলে না এখানে! কেথায় চলে গেছিলে? আবার এলেই বা কখন?"

"আমি তো আপনার সামনেই আছি বাবু! এই অন্ধকারে ঠিকমতো ঠাওর করতে পারছেন না। আসুন, আসুন ভিতরে আসুন তাড়াতাড়ি, নাহলে ভিজে ঠান্ডা লেগে যাবে।"

সত্যিই এই অন্ধকারে ঠিকমতো কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু চোখের ভুল একবার হতে পারে, বারবার একই জিনিস হয় নাকি! তাও রাজা পা বাড়ালো বাড়ির ভিতর। কিন্তু অন্ধকারে তাঁর চোখ চলছেনা। তারপর বৃষ্টির জল এসে ঝাপসা করে দিচ্ছে দৃষ্টিপথ। অথচ লোকটা কী অনায়াসে রাজার আগে আগে যাচ্ছে, যেন ওর চোখে হাজার ওয়াটের টর্চ লাগানো আছে! চেনা জায়গা বলে হয়তো লোকটার অসুবিধা হচ্ছেনা! ভাবল রাজা। কোনওরকমে বাড়িটার দাওয়ায় এসে উঠল সে। কিন্তু বাড়িটার অদ্ভূতভাবে ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। কোনও আলোও জ্বলছে না। নিদেনপক্ষে একটা লম্ফ বা মোমবাতি কিচ্ছু না!

"বাবু গামছাটা নিন। গা মাথা ভালো করে মুছে নিন।" - লোকটা একটা গামছা এগিয়ে দিল রাজার দিকে।

লোকটা কখন ঘরের ভিতরে গেল আর কখনইবা গামছা নিয়ে এলো! ওরা দাওয়ায় উঠেছে আধ মিনিটও হয়নি! আর এ কি! লোকটা একদম খটখটে শুকনো! শরীরে একবিন্দু জল নেই, অথচ সেই আগের পোষাকই পড়ে আছে! সেগুলোও শুকনো! রাজা অবাক হওয়ার সমস্ত স্তর অতিক্রম করেছে। কোনওরকমে গামছাটা নিয়ে বলল - "তুমি কি একাই থাকো? বউ ছেলে-মেয়ে নেই কেউ? কাউকে দেখছি না তো!"

"ওই তো আমার বউ। ওর থেকেই তো আপনি গামছা নিলেন বাবু।"

রাজা দেখলো পাটকাঠির মতো রোগা একজন মহিলা এক মাথা ঘোমটা টেনে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। অথচ ওর স্পষ্ট মনে আছে, লোকটার থেকেই ও গামছা নিয়েছে। এখন লোকটার জায়গায় সেই মহিলা দাঁড়িয়ে, আর লোকটা দাঁড়িয়ে তাঁর উলটোদিকে। রাজার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে!

একটা জোলো বাতাস এসে ওর মনের ভয়টাকে যেন একবার ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল। ওই হাওয়াতেই ঘরের দরজাও খুলে গেল।

লেকটা বলল - "ঘরের ভিতর চলুন বাবু।"

মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজার পা লোকটার পিছন পিছন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। ঘরটা যেন নিকষ অন্ধকার দিয়ে তৈরি। কোনও অনন্ত নরকের অন্ধকার যেন ঘরটাকে গ্রাস করে রেখেছে। কোনওরকমে ঢোক গিলে রাজা বলল - "একটু আলো জ্বালো না, কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না।"

"সব আলো নিভে গেছে বাবু। আলো জ্বালা নিষেধ।"

'মানে?'

"কিছুনা বাবু। আলো তো জ্বলছে।"

"কই? কোথায় আলো?"

"এই তো আলো।"

রাজা দেখলো সত্যিই ঘরের ঘরের মাঝে একটা লম্ফ জ্বলছে, সেটা ওই অন্ধকারকে দূর না করে একটা অদ্ভূত আলো-আঁধারি তৈরি করেছে। কিন্তু এক মুহুর্ত আগেও কোনও আলো ছিলো না, এটা রাজা হলফ করে বলতে পারে। এবার ও সত্যিই ভয় পেল। কানের পাশ দিয়ে একটা চোরা ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়লো। এমন সময় একটা ফিসফিসানি যেন ওর কানের কাছে শুনতে পেল। কিন্তু অস্পষ্ট কথাগুলোর কিছুই ও বুঝতে পারলো না। কে বলল সেটাও বোঝার কোনও উপায় নেই। শুধু কেঁপে উঠল ওর পুরো শরীর। এমন সময় হঠাৎ দেখে ওর সামনে সেই মহিলা হঠাৎই উদয় হয়েছে, হাতে একটা থালা।

পাশ থেকে লোকটা বলল - "অনেকক্ষণ বেড়িয়েছেন, দু'টো ভাত খেয়ে নিন বাবু। খিদে পেয়ে গেছে আপনার।"

খাওয়ার কথা শুনে রাজা বুঝতে পারলো, খিদে তাঁর সত্যিই পেয়েছে। কিন্তু এসব আশ্চর্যজনক ঘটনায়, খাওয়ার কথা আর মাথায় আসেনি। ততোক্ষণে মাটিতে একটা আসনও পাতা দেখতে পেল। কোনও কথা না বলে রাজা আসনে বসল, সেই মহিলা থালাটা রাজার সামনে দিল। লম্ফ'র আবছা আলোয় রাজা দেখল তাতে কিছুটা ভাত আর কিছুটা ডাল আছে। খিদের সময় এটাই অমৃত। রাজা খাবারের থালার দিকেই মনোনিবেশ করল ঠিকই; কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মশালের মতো জ্বলন্ত চোখগুলো তাঁর নজর এড়িয়ে গেল।

ভাতের থালাটার দিকে হাত বাড়ালো রাজা। ডাল দিয়ে মেখে এক গ্রাস ভাত মুখে তুলতে গেল, কিন্তু মুখের কাছে আনতেই কেমন যেন গা'টা গুলিয়ে উঠল ওর। এরকম বিশ্রী গন্ধ কোথা থেকে আসছে! কিন্তু ভাবলো অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি, তাই হয়তো গা গোলাচ্ছে। মুখে ভাতটা দিতেই বুঝতে পারলো কিছু একটা গন্ডগোল আছে। এটা ঠিক সাধারণ ভাতের স্বাদ তো নয়!

একটু নোনতা, একটু সোঁদা স্বাদ। ভাতগুলো চিবাতেও যেন দাঁত ভেঙে যাওয়ার অবস্থা। আর পারলো না সে, মুখ থেকে মাটিতে ফেলে দিল ভাতটা। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিকই আছে যেমন সে মুখে দিয়েছিল। তখনই থালার দিকে নজর গেল রাজার। এ কি! ভাতগুলো এমন লালচে লাগছে কেন!

জমাট বাঁধা রক্ত দিয়ে যেন ভাতগুলো মাখা হয়েছে! পুরো থালাটা যেন রক্তের পুকুরে পরিণত হয়েছে। আর সেখানে ভেসে আছে দু'টো জ্বলন্ত চোখ। আর সামলাতে পারলো না রাজা। সেখানেই বমি করে দিল।  

"আরে বাবু! কী হল? শরীর খারাপ লাগছে?"

লোকটার গলায় সম্বিত ফিরে পেল রাজা। এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না লোকটার কথা। কোনওরকমে বলল - "না...না...ভাতের থালায় ওগুলো কী? রক্ত...ওই চোখ...!"

খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে লোকটা বলল - "কোথায় কী বাবু! সবই তো ঠিকাছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি, তাই হয়তো অম্বল হয়ে উল্টোপাল্টা দেখছেন আর গা গুলিয়ে বমি হয়েছে। আপনি একটু বিশ্রাম নিন বাবু।"

রাজা দেখলো সত্যিই ভাতের থালা আবারও আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ওখানে বসে থাকা অবস্থাতেই কাঁপুনি শুরু হল রাজার।  জ্বর আসছে নাকি! চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠছে। কেমন ঘোলাটে লাগছে চারদিক।

এমন সময় একটা দমকা হাওয়া ঘরে এসে ঢুকলো, আরও কেঁপে উঠল রাজা। আর হাওয়াটা এসল ওই লম্ফটা নিভিয়ে দিল। আবারও নিকষ নরকের অন্ধকার ঘরটাকে গ্রাস করেছে।

ঘোলাটে চোখে রাজা শুধু দেখতে পাচ্ছে দু'টো জ্বলন্ত চোখ। মশাল জ্বলছে যেন। আর তাঁর কানের পাশে আবারও সেই অবোধ্য ফিসফিস আওয়াজ। কখনও কাছে, কখনও আবার বহু দূর কোনও অতল থেকে ভেসে আসছে যেন ওই শব্দ! রাজা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা, ধীরে ধীরে এলিয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর। মাথাটা ঘুরছে আর বিকট একটা গন্ধ ওর নাককে পুরো কব্জা করে ফেলেছে! পুরোপুরি চেতনা লোপ পাওয়ায় আগে ওর কানে এলো একটা অস্বাভাবিক গলা, সেটা যেন ইহজগতের কারও গলা নয়, কোনও নরকের জীব যেন বহু দূরের কোনও কোনও অতল গহ্বর থেকে বলছে -

"ঘুমাও বাবু! ঘুমাও! অনেক দূর যেতে হবে...অনেক পথ বাকি! আর ফেরার উপায় নেই। ঘুমাও।"

অন্যদিকে নন্দনগড় পুলিশ স্টেশনে কিছুটা চিন্তিত মুখে বসে আছে সেকেন্ড অফিসার অভি। পুরো নাম অভিজিৎ সর্দার। নতুন অফিসার আসার কথা, এখনও তার পাত্তা নেই! এদিকে এমন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। এই দুর্যোগে কোনও অঘটন ঘটলো নাকি!

থানাটা বড়ো নয়। নন্দনগড়ের আশপাশের প্রায় ২৫ মাইল এলাকা দেখতে হশ এই ছোটো থানাকেই। এতোদিন অফিসার বলতে একা অভিকেই সবটা সামলাতে হত। আর ও জনা ছয়েক কনস্টেবল আছে। এই সাত আটজন মিলে একটা সেই পুরানো আমলের জিপের ভরসায় এতবড়ো এলাকা সামাল দেওয়া মুখের কথা নয়! তাই নতুন অফিসার আসছে শুনে অভি কিছুটা খুশিই হয়েছিল। অভির বয়স কম, নন্দনগড়েরই ছেলে সে। তাই এলাকা পুরোটাই তাঁর চেনা। ভেবেছিল জিপটা নিয়ে স্টেশনে যাবে নতুন অফিসারকে আনতে। কিন্তু তারই মধ্যে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। আর জিপের একমাত্র ড্রাইভার রামপ্রসাদেরও জ্বর! অগত্যা তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে!

এমন সময় ৫০ বছর বয়স্ক হেড কনস্টেবল অজয় বাবু এসে বললেন "স্যার! নতুন অফিসার তো এখনও এলেন না। বাইরে এই দুর্যোগ! কোনও বিপদ ঘটলো না তো!"

চিন্তিত গলায় অভি বলল - "আমিও তাই ভাবছি অজয় বাবু! কী করা যায় বলুন তো!"

গলাটা একটু নীচে নামিয়ে গম্ভীরভাবে অজয় বাবু বললেন - "তারওপর স্টেশনের পাশের ওই গ্রামটা..." - অজয়ের কথা শেষ না করতে দিয়েই গম্ভীরভাবে অভি বলল - "কিন্তু উপায় কী, এই বাদলার সময়ে! বাইরে পৃথিবী যেন ভেসে যাচ্ছে। আর যদি ওই গ্রাম সংক্রান্ত কিছু হয়েও থাকে, এই অবস্থায় তো আমরা কিছু করতেও পারবো না! কেউ যেতেই চাইবেনা সাহস করে! এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।"

বিরস বদনে অজয় বাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কাছেপিঠেই কোথাও একটা জোরে বাজ পড়লো। অজয় বাবু কী বললেন, বাজের আওয়াজে সেটা ঢাকা পড়ে গেল। থানার ভিতরে জ্বলতে থাকা একমাত্র টিমটিমে বাল্বটা নিভে গেল। শুধুমাত্র অভি'র বিরক্ত গলা শোনা যায় - "ধ্যার! এই অবস্থায় আবার কারেন্টটাও গেল!"

অজয় বাবু করিৎকর্মা মানুষ। বড়ো সাহেবের মেজাজ খারাপ বুঝে ঝপপট মোমবাতি এনে জ্বালিয়ে দিলেন। - "স্যার একটু চা খাবেন নাকি? হরিকে বানাতে বলি?"

"চায়ের সরঞ্জাম আছে নাকি? থানার যা অবস্থা, তাতে কোনও সরঞ্জামই তো নেই।" একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল অভি।

অজয় বাবু বুঝলেন, স্যার আসলে রেগে আছেন ওপরওয়ালাদের ওপর। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওপরওয়ালারা এই থানা সংস্কারে কোনও মনোযোগ দেয়নি। দয়া করে এতোদিন পরে একজন অফিসার পাঠিয়েছে, এই দুর্যোগের সময় সেও এখনও পৌঁছাতে পারেনি। যে কোনও মানুষেরই চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। অজয় তাই অভিকে শান্ত করার জন্য বলল - "আছে স্যার, নতুন অফিসার আসবেন বলে আমি ওবেলাতেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।"

"আর নতুন অফিসার! আপনি তো ব্যবস্থা করে রেখেছেন, কিন্তু সেই অফিসারই তো এখনও বেপাত্তা। যোগাযোগও করা যাচ্ছেনা, ওনার ফোনটাও বলছে লাগাতার নেটওয়ার্ক পরিষেবার বাইরে। তারওপর এই আবহাওয়া! কি যে করি ছাই! করুন একটু চা'ই করুন, মাথাটা ধরেছে, ছাড়াতে হবে। কড়া লিকার করবেন।" এই বলে অভি একটা সিগারেট ধরালো। সত্যিই এবার তাঁর চিন্তাটা আরও বাড়ছে।

অজয় বাবু তখন যা বলতে যাচ্ছিলেন, মানে এই নতুন অফিসার যদি ওই গ্রামে...আর ভাবতে পারলো না অভি। ভাবলেই তাঁর পুরো শরীর শিউড়ে উঠলো। সে বুঝতে পারছে, এখনই নতুন অফিসারের খোঁজে তাঁর বেরোনো উচিত, কিন্তু সেও নিরূপায়। দিনের বেলাতেই কেউ ওই গ্রামের ত্রিসীমানায় যেতে চায়না, আর এই আঁধারে বৃষ্টি-বাদলায় কাউকেই সঙ্গে পাবে না সে। আশপাশের গ্রাম থেকেও কোনও সাহায্য সে পাবে না ওই মৃত্যুনগরীতে যাওয়ার জন্য।

এইসব ভাবতে ভাবতেই অজয় চা নিয়ে এসে ওর সামনে টেবিলে রাখলো। "স্যার চা'টা খান, ভালো লাগবে। আপনার উৎকন্ঠাটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু তো করারও নেই। হাত-পা বাঁধা।"

"শালা! আজকের দিনেই রামুদার জ্বর হলো, আর আজকেই এই দুর্যোগ! এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে অজয় বাবু। লোকটার কিছু হয়ে গেলে, আমাকে শুধু জবাবদিহী করতে হবে তাই নয়, আমিও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমরা জানতাম এরকম সম্ভাবনা আছে, তাও আমরা ওনাকে নিয়ে আসতে গেলাম না, এই দায় তো আমাদেরই।"

"আমি বুঝতে পারছি স্যার। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে নতুন অফিসার ওই গাঁয়ের আটকায়নি। অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে এই বৃষ্টিতে।"

অভিকে সান্ত্বনা দিতে অজয় এই কথা বলল বটে, তবে সেও জানে এটা সম্ভব নয়! কারণ স্টেশনের সবথেকে কাছে ওই গ্রামটাই আছে। বেশ কিছুটা ঘুরে গিয়ে ওই গ্রামটাকে এরিয়ে অন্যপথ দিয়ে বাকওরা যাতায়াত করে। আর ওরকম ঘটনার পর থেকে স্টেশনে যাওয়া তো লোকেরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সবাই এখন শহরে যেতে গেলে বহু ঘুরে নদী পার হয়ে বড়ো রাস্তায় গিয়ে বাস ধরে যাতায়াত করে।

অজয় বাবুর মনে পড়ে গেল সেইবারের ঘটনা। যা মনে পড়লে এখনও তাঁর রাতের ঘুম উড়ে যায়। প্রায় দশটা গ্রাম নিয়ে এই নন্দনগড় থানা। স্টেশনের সবথেকে কাছে ওই গ্রাম - 'সুখচর'। বেশিরভাগ লোকই রোজগারের সন্ধানে পাড়ি দিত ভিনরাজ্যে। করোনার সময়ে বাড়ি ফেরে কয়েকজন, তাদের থেকে বাকিদের মধ্যেও ছড়ায় রোগটা। কোনও চিকিৎসা হয়নি। প্রায় গোটা গ্রামটাই উজার হয়ে যায়। ওদের সৎকার করতে পর্যন্ত কোনও লোক যায়নি। আর এই অজপাড়াগাঁয়ে সরকারী কোনও লোক এসেও কোনও ব্যবস্থা করেনি। পুরো গ্রামটার মৃতদেহগুলো ওখানেই পড়ে থেকে পচে ছিল। তারপরে তো লকডাউন উঠল, মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবন শুরু করলো। কিন্তু নন্দনগড়ের কাছে 'সুখ চর' গ্রামটা দুখের চর হয়ে উঠল। ওটা হয়ে উঠল একটা আস্ত নরক। সৎকার না হওয়া অতৃপ্ত প্রেতেদের রাজত্ব। তারপর থেকে ওই পথে গিয়ে কতো মানুষ যে হারিয়ে গেছে চিরতরে, কতজনের ছিন্নভিন্ন দেহ পরে উদ্ধার হয়েছে স্টেশনের কাছে তার ইয়ত্তা নেই। এখন ওই অভিশপ্ত গ্রামের নাম কেউ মুখেও আনে না। অজয় মনে মনে বেশ বুঝতে পারছিল, নতুন অফিসার রাজা বিশ্বাস নিশ্চিত ওই গ্রামের অশরীরীদের পাল্লাতেই পড়েছে। কিন্তু কে যাবে তাঁকে উদ্ধার করতে! আর ওই অভিশপ্ত জায়গা থেকে কাউকে উদ্ধার করা কি আদৌ সম্ভব! আশপাশের গাঁয়ের লোকেরা মিলে কতো ওঝা ডাকল, ঝাড়ফুঁকের চেষ্টা হল কিছুই হলোনা, উল্টে যারা এগুলো করতে গেল, তাদের মৃতদেহগুলোই আর পাওয়া গেল না। কে জানে, তারাও হয়তো এখন অশরীরী হয়ে ওই নরকেরই বাসিন্দা!

রাজার মনে হতে লাগল, ও ঘোরের মধ্যে কোনও এক অজানা পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রময়। চতুর্দিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার ক্রমাগত গ্রাস করছে ওকে। ও গলা ছেড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটা চাপা গোঙানি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ ওর গলা দিয়ে বেরলো না। মাকড়সার জালের মতো আষ্টেপৃষ্টে কেউ যেন ওকে জড়িয়ে ধরছে আর ও তলিয়ে যাচ্ছে...এমন সময় হঠাৎই চোখ খুলল ও। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। নিজের হৃৎস্পন্দন নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছে ও। ওর ঘোলাটে দৃষ্টি শুধু বুঝতে পারছে কয়েক জোড়া জ্বলন্ত চোখ ওর দিকে চেয়ে আছে।

বাইরে বোধহয় বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘের ক্লান্তিহীন ডাকের কোনও বিরাম নেই। বৃষ্টির পরের ভেজা বাতাস এসে ঠান্ডা ঘরটাকে আরও বরফশীতল করে তুলছে। রাজার কাঁপুনি উত্তরোত্তর বাড়ছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর শরীর।

ওই কয়েক জোড়া জ্বলন্ত চোখগুলোর মধ্যে থেকে, ও শুনতে পেলো সেই খ্যানখ্যানে গলাটা। সেই লোকটার গলা, কিন্তু এই গলায় সেই স্বাভাবিকত্ব নেই। এই গলাটাই সে অচেতন হয়ে যাওয়ার সময় শুনেছিল। আবারও সেই ভয়ংকর গলা বলে উঠল - "ঘুম ভাঙল? কতো যুগ হয়ে গেল, এই গাঁয়ের লোক ঘুমায় না বাবু।"

আড়ষ্ট গলায় কোনওরকমে রাজা বলল - "কে...কেন? ঘুমায় না কেন? আর তোমাদের চোখগুলো ওমন জ্বলছে কেন?"

"ওগুলো জ্বলবেই। আমাদের চিতার আগুন নেই, সব আগুন ওই চোখে জমা হয়েছে।"

রাজার ভিতরে তখন ভয়ে উথাল-পাথাল চলছে। জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে গেছে। কোনওরকমে ও বলল - "মা...মা...মানে?"

"কোনও মানে নেই বাবু। এবার আপনাকেও আমাদের দলে ভিড়তে হবে।" বলেই বিকট শব্দে একটা আকাশ ফাটানো হাসি পুরো ঘরটা জিড়ে ছড়িয়ে গেল। এর সঙ্গেই আরও অনেকগুলোর গলায় সেই ভয়াবহ হাসির রোল উঠল।

রাজার মনে হল, হাসিগুলো সমবেত ভাবে যেন ওকে গিলতে আসছে। ও আর স্থির থাকতে পারলো না৷ উঠে বসার চেষ্টা করলো। শরীরে কোনও জোর নেই৷ মাথায় যেন কেউ ভারি পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। হাত-পা যেন লেহার শিকল দিয়ে বাঁধা। নড়ার কোনও ক্ষমতা ওর নেই। পুরো শরীর ওর ভারি হয়ে আছে। কোনওরকমে একটু উঠেই আবার ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল রাজা। চোখগুলো আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা ভাবটা ওর শরীরে জাঁকিয়ে বসছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ওর চারদিক ঘিরে কিছু জ্বলন্ত চোখ আর সেই ভয়াবহ বিভৎস হাসি - 'হাহাহাহাহাহাহাহাহাহা...'। এই হাসি এই দুনিয়ার কোনও মানুষের নয়। হতে পারেনা। নরকের জীবগুলোর এই হাসি যে কোনও সাধারণ মানুষের হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আবারও অতলে তলিয়ে যাচ্ছে রাজা।

চা খাওয়া শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে অভি বলল - "অজয়বাবু বৃষ্টিটা একটু কমেছে। চলুন তো একবার খুঁজে আসা যাক।" ওর অস্থিরতাটা তখন থানার সবার মধ্যেই সঞ্চারিত হয়েছে। সবার মনেই একই আশঙ্কা - কিন্তু কেউই সাহস করছেনা সেই আশঙ্কায় ভর করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে! সবার ঘরেই বউ-বাচ্চা আছে। কে আর যেতে মৃত্যুর মুখে যেতে চাইবে!

কিন্তু বড়ো বাবুর নির্দেশ অমান্য করারও সাহস কারও হচ্ছে না। অভি একবার ভালো করে সবার মুখের দিকে তাকালো। সেও বুঝতে পারছে বাকিদের মনের অবস্থা। কিন্তু ওকে তো কিছু একটা করতেই হবে; নাহলে ওপরওয়ালাদের কাছে জবাবদিহি করবে কোন মুখে! সরকারী কাজে তো আর ভূতুরে গ্রামের কথা তারা মানবে না! তাছাড়াও মানবিকতা বলেও একটা বিষয় আছে। একজন মানুষ, যে তাদেরই কলিগ, সদ্য জয়েন করতে এসেছে তাঁর এলাকায়, সে যে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন, এটা জানার পরেও তো অভি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনা! কিছু একটা করতেই হবে।

নিজের মনের সমস্ত দোলাচল ঝেড়ে ফেলে ও একটু শান্তভাবে বলল - "আপনারা জানেন আমাদের কোথায় যেতে হবে আর কাদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের আছে! তাই আমি কাউকে জোর করবো না। কিন্তু আমাদের একজন কলিগ ভয়ংকর বিপদে। আমাদের শেষ চেষ্ট করতেই হবে তাঁকে বাঁচানোর। আমি অবশ্যই আশা করবো তিনি সুখচর গ্রামে নেই, অন্য কেথাও আশ্রয় নিয়েছেন এই দুর্যোগে। কিন্তু আপনারাও জানেন আশা-আশঙ্কার মধ্যে আমাদের আশঙ্কাটাই সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। আমি যাচ্ছি। কেউ যদি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে যেতে চান চলুন। আবারও বলছি এই কাজে আমি কাউকে জোর করবো না।"

সবার আগে অজয় এগিয়ে এসে বলল - "আমি আপনার সঙ্গে যাবো স্যার।" বাকিরাও বা কীভাবে চুপ করে বসে থাকে; যেখানে তাদের বড়োবাবু একা এরকম একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন - কনস্টেবল হরিকে নিয়ে বাকি ৬ জনের দলটা জিপে উঠল।

এমন সময় অজয় বললেন - "স্যার পাশের গ্রাম হরিদেবপুর থেকে কয়েকজনকে নিলে হতো না?"

আরেকজন কনস্টেবল বিকাশ বলল - "কিন্তু অজয়দা, কেউ কি যেতে রাজি হবে!"

অভি বলল - "যেতে রাজি না হওয়ারই কথা। তবুও চলো একবার দেখা যাক। হরিদেবপুরে একজন গুণিন আছেন না? কণাদ না কী যেন নাম!"

"হ্যাঁ স্যার, কণাদ গুণিন। ওঁকে একবার বলে দেখা যায়, যদি রাজি হয়। আমার বাড়ির কাছেই থাকে সে, চলুন আমি রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি।" - সায় দিল অন্য একজন কনস্টেবল।

অভি নিজেই বসেছে জিপের চালকের আসনে। গাড়িতে স্টার্ট দিল সে। বৃষ্টির গতি কমে এসেছে। জলো হাওয়া বইছে। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে কাদামাখা পথ দিয়ে এগিয়ে চলল গাড়িটা।

একটু একটু করে চেতনা ফিরছে রাজার। কিন্তু পুরোপুরি নয়। অবচেতনেই ও দেখতে পেল কয়েকটা নরকঙ্কাল ওকে ঘিরে আছে। নিকষ অন্ধকারেও কঙ্কালগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা কঙ্কালের শরীরে কয়েক জায়গায় লেগে আছে কিছু পচে যাওয়া মাংস। তাদের মুখ আর চোখের কোটর থেকে অনবরত বেড়িয়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন পোকা। এগুলো রাজার অচেনা। এগুলো নরকের কীট। সাধারণ মনুষ্য দুনিয়ায় এইসব পোকাদের দেখা পাওয়া যায়না। রাজা বুঝতে পারছে ও ক্রমশ শূণ্যে উঠে যাচ্ছে। অনেকগুলো অদৃশ্য হাত যেন ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে ধরেছে। রাজার শরীরটা ঘরের বাইরে নিয়ে এলো শূণ্যে ভাসতে ভাসতে। ঝাপসা চোখে রাজা তাকানোর চেষ্টা করলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ওর চোখ মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে অবিরতভাবে। জল-কাদার মধ্যে রাজার শরীরটা ধপ করে আছড়ে পড়ল। যেন এতোক্ষণ যেসব অদৃশ্য হাতগুলো ওর শরীরটা ধরে ছিল, সেগুলো হঠাৎই ওকে ছেড়ে দিয়েছে, আর ও এসে পড়েছে জল-কাদার মধ্যে। আবারও সেই বিভৎস হাসি ওকে ঘিরে ধরলো। ওই তো লোকটা, যে ওকে ভ্যানে করে নিয়ে এসেছে এই অভিশপ্ত জায়গায়। সেই একই পোষাক, কিন্তু ওর মুখটা দেখে রাজা চোখ বন্ধ করে ফেলল। এমন মুখ কোনও মানুষের হতে পারেনা। মুখটার একদিকে কেউ যেত খুবলে খেয়েছে। চামড়াহীন কিছু মাংস ঝুলছে সেখানে আর একপাশে শুধুই করোটি দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে জ্বলছে তার মশালের মতো চোখ দু'টো। এমনই বিভৎস সব অবয়ব এখন রাজার চারিদিকে। চোখ খুলে সেগুলোর দিকে তাকানোর সাহস হলো না রাজার।

"চোখ খুলুন বাবু। দেখুন আমাদের। করোনার সময় এই সভ্য সমাজ আমাদের কোনও সাহায্য করেনি। আমাদের মরে পড়ে থাকা দেহগুলোকে সৎকার পর্যন্ত করেনি কেউ। এখানেই আমরা পচেছি, শেয়াল-কুকুরে খুবলে খেয়েছে আমাদের শরীরগুলো। নরকেও আমাদের ঠাঁই নেই। আমাদের এই গ্রামটাই আমাদের নরক হয়ে উঠেছে, আমাদের মুক্তি নেই। চোখ খুলুন, দেখুন আমাদের।" - এই কথা বলে আবারও আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা অট্টহাসি দিল নরকের জীবটা।

রাজা ভয়ে ভয়ে ধীরে চোখ খুলল। আর দেখল ঠিক ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে একটা একটা বিভৎস মুখ। এটার বর্ণনা করা কথায় সম্ভব নয়। সেটার শীতল মাংসহীন হাড়ের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে রাজার মুখের ওপর বোলাচ্ছে। একটা চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে এসে গালের ওপর ঝুলছে। মাথার অর্ধেকটা নেই, ঘিলুগুলো গলে গলে সারা মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে আর সেখানে বাসা বেঁধেছে অদ্ভুত দর্শন সব কীটেরা। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ রাজার নাড়িভুঁড়ি সব নাড়িয়ে দিল।

আঙুলগুলো রাজার মুখের ওপর চলাফেরা করতে করতে ওর গলায় চেপে বসতে শুরু করেছে। চাপ ক্রমশ বাড়ছে। রাজা বুঝতে পারছে তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে অশরীরীগুলো খিলখিলিয়ে হাসছে - 'হাহাহাহাহাহাহাহা...হিহিহিহিহিহিহি!'

ক্রমশ আবার চেতনা লোপ পাচ্ছে রাজার। কাদা-জলের মধ্যে ওই উঠানে পড়ে থাকল রাজার অচৈতন্য শরীরটা। এমন সময় একটা বাজ এসে পড়লো কাছের একটা নারকেল গাছে। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল গাছটা। অশরীরীগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এমন সময় একটা ঠান্ডা স্পর্শে রাজা আবার ওর চেতনা ফিরে পেল। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে ওর মুখের সামনে ঝুঁকে আছে ওই ঘোমটা টানা মহিলা। এর আঙুলগুলোতেও মাংসের নামগন্ধ নেই। শুধু হাড়। রাজা কোনওরকমে উঠে বসার চেষ্টা করছে, ওই হাতটা রাজাকে ধরে ধরে বসালো। রাজার কোনও সম্বিত নেই৷ ও বুঝতেও পারছেনা কী ঘটছে। একবার এরা ওকে মারার চেষ্টা করছে, আবার এদেরই একজন ওর জ্ঞান ফিরিয়ে ওকে উঠে বসতে সাহায্য করছে। সেই ঘোমটা টানা মুখটা ওর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল - "এখান থেকে পালাও। ওরা ভেবেছে তুমি মরে গেছে। পালাও। আর যদি পারো আমাদের গ্রামটা জ্বালিয়ে দিও, পুরো গ্রামটা জ্বলে গেলে, আমাদের শরীরগুলোও তার সঙ্গে পুড়বে। আমরা মুক্তি পাবো। পালাও তুমি পালাও। ওরা আবার এলে আর বাঁচবে না পালাও।"

রাজা বুঝলো এখানে আসার পরে যে ফিসফিসানি কয়েকবার ওর কানের পাশে শুনেছে সেটা এরই। তখন একটা কথাও বুঝতে পারেনি, এবার সে বুঝতে পারছে বেশ ভালোই। - "কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করছো কেন?"

"আমি মুক্তি চাই। গাঁয়ের উত্তরদিকে কিছুটা গেলে একটা মাটির রাস্তা দেখবে, সেটা দিয়ে পশ্চিম মুখে চলে যাবে। তিন কিলোমিটার গেলে বড়ো রাস্তা পাবে। সেখানে পৌঁছাতে পারলে এরা আর তোমাকে ধরতে পারবেনা। এরা ওখানে যায়না। ওদিকে গ্রামকে বেঁধে রেখেছে কণাদ গুণিন। পালাও তুমি, পালাও। আর জ্বালিয়ে দিও এই গ্রাম" তারপর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে।

হতভম্ব রাজা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে এটাই তাঁর বাঁচার শেষ সুযোগ, এটা বুঝতে পেরেছে। কোনওরকমে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো সে। তাকিয়ে দেখলো সামনের নারকেল গাছটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সে উত্তর দিকে মুখ করে টলতে টলতে জল-কাদার ওপর দিয়ে দৌড় শুরু করলো। আছাড় খেলো বারকয়েক। কিন্তু দৌড় থামালো না। এই তো সামনে মাটির রাস্তা। এখান দিয়ে, পশ্চিমে যেতে হবে - কিন্তু পশ্চিম কোনটা! এতো ঘটনার ঘনঘটায় দিক মনে করতে পারছেনা রাজা। কোনওরকমে একটা দিকে আবার দৌড় দিল সে। জানে না ওই নরকের জীবগুলো বুঝে গেছে কিনা, যে সে তখন মরেনি আর এখন পালাচ্ছে তাদের নাগাল থেকে! যদি বুঝে ফেলে তাহলে এটাই তাঁর শেষ সুযোগ। প্রাণপণে ছুটছে রাজা। হঠাৎ আবারও সেই বিভৎস হাসির শব্দ ভেসে এলো দূর থেকে - যা তার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল।

অভি গাড়িটা এনে দাঁড় করালো কণাদ গুণিনের বাড়ির সামনে। এই দুর্যোগেও গ্রামে পুলিশের গাড়ি ঢুকেছে এই কথা রটে গেছে লোকমুখে। বেশ কিছু কৌতুহলী জনতার একটা ছোটোখাটো ভিড় জমে গেছে কণাদ গুণিনের বাড়ির সামনে। কণাদ অভিদের মুখ থেকে সব শুনে বলল - "হয়তো উনি ওই গ্রামের পিশাচগুলোর পাল্লাতেই পড়েছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছু করার সাধ্য আমার নেই। আমার এতো ক্ষমতা নেই। আমার বড়ো বড়ো গুণিন-ওঝারা গিয়ে আর প্রাণ নিয়ে ফেরেনি সেখান থেকে। আমি আমার সাধ্যমতো বড়ো রাস্তার এদিক দিয়ে ওই গ্রামকে বেঁধে রেখেছি যাতে ওরা এদিকটায় না আসতে পারে। তার বেশি কিছু তো আমি করতে পারবো না।"

অভি একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেও, ওর গলায় খেদ আর কাতরতা ঝরে পড়লো - "আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনিই একমাত্র ভরসা। আমার ওপরওয়ালারা এসব ভূত-পিশাচের কাহিনী মানবেনা। আর একবার শেষ চেষ্টা আমরা করবোনা মানুষটাকে বাঁচাতে?"

অজয় বলল উঠল - "কণাদদা, আমরা সবাই তো এই নন্দনগড়ের। অনেককে হারিয়েছি আমরা৷ কিন্তু বাইরের একজন মানুষ, যে কিছুই জানে না, তাঁকে একবার বাঁচানোর চেষ্টা করা যায় না?"

কণাদ খানিক্ষণ কিছু চিন্তা করল। তারপর গম্ভীরভাবে বলল - "চেষ্টা করাই যায়; তবে সেই চেষ্টা ধরে নাও নিরানব্বই ভাগ বিফল হওয়ারই সম্ভাবনা। আর মনে রেখো এটা জেনেশুনে মৃত্যুর দিকে পা বাড়ানো। ঠিকাছে তোমরা এসেছো যখন চলো তাহলে, দাঁড়াও ঘর থেকে আমার ঝোলাটা আনি। যদিও কোনও কাজ ওতে হবেনা, তবুও থাক, ওটাই অন্ধের যষ্টি।"

গ্রামের যে ক'জন জড়ো হয়েছিল, পুলিশের সামনে কিছু না বলতে পারলেও নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করে দিল যে এরা মরতেই যাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনা। গাঁয়ের লোকেদের সঙ্গে বিশুও এসেছিল পুলিশ কেন এসেছে দেখতে। সব বিষয় শুনে বিশুর মনের ওর পুরানো ব্যথাটা আবার চাগাড় দিল। ওর ভাইটা একদিন এমনভাবেই ওই গাঁয়ের কাছে হারিয়ে গেছিল। তখন অনেক করে বলেও গাঁয়ের কারও সাহায্য ও পায়নি ভাইকে বাঁচানোর। কেউ এগিয়ে আসেনি। আজ এতোগুলো মানুষ যখন যাচ্ছে, তখন ওর মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহাটা জেগে উঠল নতুন করে। ওই গ্রামটাকে ও শেষ করে দেবে। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি হলেও, বিশুর পেটাই শরীর। জমিতে হাল জুতে জুতে এখনও ও শরীরটা ধরে রেখেছে। ও এগিয়ে এলো - "স্যার আমিও যাবো আপনাদের সঙ্গে।" কয়েক জার কেরোসিন তেল আর বেশ কয়েকটা মশাল বিশু যোগার করে আনল।

কণাদ আর বিশুকে বসিয়ে আবার গাড়ি এগোতে শুরু করল বড়ো রাস্তার দিকে।

রাজা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে চলেছে৷ আর বিভৎস হাসিগুলো যেন তেড়ে আসছে ওকে। ও আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না, শরীরে আর কোনও শক্তিও অবশিষ্ট নেই, তবু বাঁচার শেষ চেষ্টা করতেই হবে।

ওই তো বড়ো রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আর একটুখানি। ওখানে পৌঁছে গেলেই এই যাত্রা সে বেঁচে যাবে। বিভৎস হাসিগুলো ক্রমাগত কাছে আসছে। রাজা দৌড়ের তাঁর দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কিসে একটা হোঁচট খেয়ে কাদার মধ্যেই ছিটকে পড়লো সে। তখনই কোনওরকমে নিজেকে টেনে তুলে আবার দৌড়াতে যাবে, কিন্তু ওর পা চলছে না। কিসে যেন টেনে রেখেছে ওকে।

নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা মাংসহীন হাত ওর পা'কে জাপটে ধরে আছে। ও অন্য পা দিয়ে লাথি দিল কয়েকটা, কিন্তু সাঁড়াশির মতো শক্ত ওই বজ্রমুষ্ঠি ছাড়ানোর ক্ষমতা ওর লাথিতে নেই। আর কয়েক পা এগোলেই বড়ো রাস্তায় গিয়ে উঠত ও। সেই অলৌলিক হাসিগুলো আরও কাছে এসে পড়েছে।

তাহলে কি সব আশা শেষ! ওর জীবনের পরিসমাপ্তি এভাবে হবে! বাড়িতে থাকা বাবা-মায়ের মুখগুলো ভেসে উঠলো হঠাৎ। ভয়ে-হতাশায়-রাগে ওর চোখ ফেটে জল গড়াতে শুরু করলো। আরও কয়েকবার লাথি মারল ওই হাতটায়। কিন্তু হাতের মুঠো আলগা হলো না। ওর পা'টা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো হাতটা। মুখ থুবড়ে পড়লো রাজা। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে দেখল ওই নরকের জীবগুলো তাঁর থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে হাড় কাঁপানো হাসিতে চারিদিক বিদীর্ণ করছে। এবার সব শেষ। কিছুটা দূরে বড়ো রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আর উপায় নেই। চিৎকার করতে গেল রাজা, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে তাঁর। ওই ভয়ংকর নারকীয় জীবগুলো এগিয়ে আসছে একটু একটু করে ওর দিকে। ভয়ে রাজা চোখ বন্ধ করে নিল।

চোখ বন্ধ রাজা দেখতে পেলো না বড়ো রাস্তায় একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে এই দিকেই।

অভি বেশ জোরেই গাড়িটা চালাচ্ছে। উত্তেজনায় একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিচ্ছে, আর গাড়ির গতি যতোটা সম্ভব বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন পুরানো যুগের ঝরঝরে এলটা জিপ। এতোজনে নিয়ে আর কতো জোরে ছুটবে! তবুও এই নির্জিব বস্তুটাও বোধহয় আজ রাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে; তাই এযাবৎকালের সবথেকে বেশি গতিতে সে ছুটছে কোনওরকম অসুবিধা ছাড়াই। এই কালো রাতটাও যেন শেষ হচ্ছেনা আজ। বৃষ্টিটা একদমই ধরে গেছে।

দূর থেকেই হেডলাইটের আলোয় সবাই লক্ষ্য করেছে বিষয়টা। বেশ কিছু অস্পষ্ট অবয়ব আর কাদার মধ্যে পড়ে থাকা মানুষটাকে খেয়াল করেছে সবাই। আর দেখেই যা বোঝার সবাই বুঝে নিয়েছে।

পিছনের সিটে বসা কনস্টেবলরা ভগবানের নাম নিতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র বিশুর চোয়াল শক্ত হচ্ছে। কণাদ গুণিনের মুখ ভাবলেশহীন। একহাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাতে হলস্টারে রাখা পিস্তলটা আঁকড়ে ধরেছে অভি। অজয়ও নিজের রাইফলটা শক্ত করে ধরেছে।

সবাই অনুমান করেছে সামনে কী হতে চলেছে। তাদেরও শেষ পরিণতি কী হবে সেটাও সবাই জানে। কিন্তু জেনেবুঝেও আজ তারা এসেছে। এই বিভীষিকার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার শেষ চেষ্টা আজ তারা করবেই।

বিশু সঙ্গে আনা কেরোসিন তেলের জারগুলো আর মশালগুলো ভালো করে দেখে নিল। অভি আরও দ্রুত গাড়িটা চালিয়ে বড়ো রাস্তা থেকে নামিয়ে একদম হুড়মুড় করে এনে ফেলল একদম রাজার কাছে।

রাজা তখন ভাবছিল তাঁর জীবনের এখানেই ইতি। আর কোনও আশা নেই। এমন সময়ে হেডলাইটের তীব্র আলোয় ওর চোখ ঝলসে গেল। কোনওরকমে চোখ খুলে সামনে গাড়ি আর মধ্যে থেকে পুলিশের পোষাক পরিহিত একজনকে নামতে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। তাঁর কিছু বুঝে ওঠার আগেই অভি হলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে এক রাউন্ড গুলিয়ে চালিয়ে দিল কিছুটা দূরে দাঁড়ানো অবয়বগুলোর দিকে।

কিন্তু সেই গুলির আওয়াজ ছাপিয়ে শুধু বিকট বিভৎস হাসির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে থাকল চতুর্দিকে। একটা অবয়বও তার জায়গা থেকে নড়ল না। সেই অবয়বগুলোর বীভৎস রূপ দেখে তখন গাড়িতে বসে থাকা কনস্টেবলদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগার। কিন্তু অজয়ের তাড়া খেয়ে কোনওরকমে কাঁপতে কাঁপতে ওরাও নামলো গাড়ি থেকে। বিশু একহাতে একটা মশাল আরেক হাতে কেরোসিনের জার নিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। সবার শেষে নামল কণাদ গুণিন।

ওই অবয়বগুলো ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছে ওদের দিকে। রাজার পা'টা এখনও সেই হাতটা আঁকড়ে ধরে আছে। অভি হাতটা লক্ষ্য করে আরেক রাউন্ড গুলি চালালো, তাতেও কিছুই হলো না। অবয়বগুলো এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। সবার আগে সেই ভ্যানওয়ালা।

অভি আরেক রাউন্ড গুলি চালাতে যাচ্ছিল, কণাদ বাঁধা দিল - "এভাবে হবে না স্যার।" বলে ঝুলি থেকে কিছু একটা নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র বলে ছুঁড়ে মারল ওই হাতটার দিকে। হাতটা কিছুটা আলগা হলো বটে, তবে রাজা পা পুরোপুরি ছাড়লো না।

কণাদ অভির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল - "শুনুন স্যার, এদের আমরা হারাতে পারবো না। কাছেই বড়ো রাস্তা। ওটায় উঠে গেলে এরা ওখানে যেতে পারবে না। আমি বেঁধে রেখেছি ওখানে গ্রামকে। আমি চেষ্টা করছি ওই হাতটাকে ছাড়ানোর। যেই ছাড়াতে পারবো, তখনই দৌড়ে সবাইকে নিয়ে বড়ো রাস্তায় গিয়ে উঠতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই।"

অভি কণাদের কথায় সায় দিল। আবারও মন্ত্র পড়ে কণাদ কিছু একটা ছুঁড়ল মারল ওই হাতটার দিকে। এবার হাতটা আরেকটু আলগা হয়েছে। অভি ছুটে গিয়ে রাজাকে ধরে এক টান মেরে ছাড়িয়ে নিল হাতটা থেকে।

নাহ্! গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে পালানোর সময় নেই। ছুটে গিয়ে উঠতে হবে বড়ো রাস্তায়। অভি জোড়ে চিৎকার করে উঠলো - "দৌড়াও সবাই"।

কিন্তু ওর চিৎকার করাই বৃথা। ততক্ষণে ওই অবয়বগুলো একদম কাছে এসে পড়েছে ওদের। এবার বোধহয় আর কারোরই নিস্তার নেই। অভি প্রমাণ গুণল। বাকিদের মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেছে। কণাদ গুণিন শেষ চেষ্টা করল; জোরে চিৎকার করে বলল - "একদম কাছে ঘেঁষবিনা। ভস্ম করে দেবো তোদের। যেতে দে আমাদের।"

সেই ভ্যানওয়ালা বিকট গলায় বলল - "তুই আমাদের কিচ্ছু করতে পারবিনা। আজ তোদেরও জীবনের শেষ দিন। কেউ বেঁচে ফিরবিনা।" বলে কানফাটানো হেসে উঠল। সেই হাসি শুনে সবার হৃদপিন্ড যেন থেমে গেল।

মাংসহীন কয়েকটা হাত এগিয়ে যাচ্ছে ওদের দিকে। কয়েকজন কনস্টেবল ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রাজার নিজের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। অজয় আর অভির কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। শেষ রক্ষা আর হলো না।

নরকের জীবগুলোর হাসি অবিরাম চলছে। হাতগুলো ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে ওদের দিকে। এবার সব শেষ!

অভির মনেও ভয় জেঁকে বসছে। কণাদ গুণিন তাঁর ঝোলা থেকে আরও কিসব নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে সেগুলো ছুঁড়ে মারল হাতগুলোর দিকে। কিছুটা থমকে গেল হাতগুলো, কিন্তু আবারও ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল সেগুলো। সমস্ত শক্তিই নিস্প্রভ এই নরকের শক্তির কাছে।

অদ্ভুতভাবে চোয়াল শক্ত করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল বিশু। একটা কথাও সে বলেনি এতোক্ষণ। তার হাতে মশাল আর কেরোসিন তেল একইভাবে ধরা আছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে অভিকে উদ্দেশ্য করে ধীরে ধীরে বলল - "স্যার আপনার লাইটারটা একটু দেবেন আমাকে।"

এই সময় এরকম ফালতু কথা শুনে অভি একটু অসন্তুষ্ট হল। রাগত গলায় বলল - "এখন তুমি লাইটার দিয়ে কী করবে!"

"দিন না। এদের থেকে বাঁচার একটাই উপায় আছে।"

অভি একবার আড়চোখে বিশুর দিকে তাকালো। তারপর একহাতে রাজা ধরে অন্য হাত দিয়ে চট করে লাইটারটা বের করলো।

বিশু বলল - "আমি যখন বলবো, তখনই আপনি লাইটারটা জ্বালবেন।"

অভি আস্তে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। হাতুগুলো একদম কাছে এসে পড়েছে। আর ওই ভয়াল অবয়বগুলোও এগিয়ে এসেছে একদম ওদের কাছে। বিশু চটজলদি কিছুটা কেরোসিন মশালে ছিটিয়ে নিয়ে বলল - "স্যার এইবার"।

অভি লাইটারটা জ্বালতেই বিশু মশালটা জ্বালিয়ে নিল সেই আগুনে। জ্বলন্ত সবার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো বিশু। ওর চোখ দুটো তখন রাগ আর প্রতিশোদের আগুনে জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে বিশু চিৎকার করে উঠল - "আয় শয়তানের দল, সামনে আয়। একেকটাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেব।"

বিশুর এই রূপ আর ওর হাতের জ্বলন্ত মশাল দেখে বিভীষিকাময় অবয়বগুলো থামকে দাঁড়ালো। বিশু এগোতে থাকা একটা হাতের ওপর মশাল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল, দাউ দাউ করে জ্বলে ছাই হয়ে গেল হাতটা।

কণাদ চিৎকার করে উঠল - "সবাই এক পা এক পা করে পিছিয়ে বড়ো রাস্তায় চলে এসো। ওরা আগুনকে ভয় পাচ্ছে। এই সুযোগ।"

কণাদের কথা শুনে সবাই পিছিয়ে আসতে শুরু করলো। কিন্তু বিশুর রক্ত তখন প্রতিশোধস্পৃহায় টগবগ করে ফুটছে। বিশু জ্বলন্ত মশাল হাতে এগিয়ে যেতে লাগলো অবয়বগুলোর দিকে। অভি চিৎকার করে বলল - "চলে এসো বিশু। চলে এসো। যেও না ওদিকে।"

কিন্তু সেই কথা বিশুর কানে ঢুকলো না। নেশাগ্রস্তের মতো গর্জন করতে করতে বিশু জ্বলন্ত মশালটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওই অবয়বগুলোর দিকে - "আজ আমার ভাইয়ের প্রতিশোধ নেবো। আজ শান্তি পাবে আমার ভাই। আজ তোদের সবকটাকে শেষ করবো হারামজাদা।"

আরেকজন কনস্টেবলকে ডেকে রাজাকে ধরতে বলে অভি গাড়ি থেকে আরেকটা মশাল আর কেরোসিনের জার নিয়ে এগিয়ে গেল বিশুর পাশে। বিশুর মশাল থেকে তার মশালটা ধরিয়ে, সেটাকে আগে বাড়িয়ে ধরল সে। তারপর বিশুর হাত ধরে টান মেরে বলল - "এখন চলো বিশু, সকাল হতে আর দেড়ি নেই, সকালে আরও লোক এনে এই গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেব আমরা। এখন চলো।"

কিন্তু কথা শোনার পাত্র বিশু নয়। এক ঝটকায় অভির হাতটা ছাড়িয়ে বিশু ওর জ্বলন্ত মশালটা ছুঁড়ে মারল। সেটা গিয়ে লাগল ওই ভয়াল দর্শন ভ্যানওয়ালার গায়ে। বিকট চিৎকারে যেন সবার কানে তালা লেগে গেল। দাউ দাউ করে জ্বলছে শয়তানটা আর বিকট আসুরিক চিৎকারে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করছে। বাকি অবয়বগুলো ততোক্ষণে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়েছে।

অন্যদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। হরিদেবপুরের মানুষ সেদিন রাতে আর ঘুমায়নি। এতোগুলো মানুষ মৃত্যুর মুখে গেছে। তাদের সঙ্গে আছে সেই গ্রামেরই কণাদ আর বিশু। সবাই চিন্তায় প্রায় সারারাত জেগেই কাটিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই প্রায় গোটা গ্রাম চলল বড়ো রাস্তায়, কারণ ওরা জানে সেখান পর্যন্ত নিরাপদ। ওই শয়তানগুলো বড়ো রাস্তায় উঠতে পারেনা, কণাদ গুণিন বেঁধে রেখেছে। বিশুকে ওরা দেখেছিল মশাল আর কেরোসিন নিয়ে যেতে। ওরাও তাই সঙ্গে করে বেশ কিছু মশাল আর কেরোসিন নিয়ে এগিয়ে চলল।

বড়ো রাস্তায় উঠেই দূর থেকে ওরা দেখতে পেল প্রায় সবাই জীবিত। একটা শয়তান দাউ দাউ করে জ্বলছে আর আকাশ ফাটানো চিৎকার করছে। বিশুর পাশে জ্বলন্ত মশাল হাতে ইন্সপেক্টর অভিকেও দেখতে পেল ওরা।
 
এই দৃশ্য দেখে বুকে বল পেয়ে হইহই করে গ্রামের লোক মশাল জ্বালিয়ে ছুটে এলো ওদের দিকে। সবে ভোরের আলো ফুটেছে। রাতে ওই মেঘভাঙা বৃষ্টির পরে ভোরের আকাশ বেশ পরিষ্কার।

বিশু চিৎকার করে সবাইকে বললো - "এটাই সময়। জ্বালিয়ে দিতে হবে এই গ্রাম। তাহলেই এই শয়তানগুলো শেষ হবে।"

কষ্ট করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এল রাজা। সে গত রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সুখচর নামক যে গ্রামটাকে জ্বালিয়ে দেওয়াতেই যে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে আর এটা যে সে জেনেছে ওই অভিশপ্ত জীবগুলোরই একজনের থেকে, সেটাও সে বলল।

যে কটা মশাল ছিল সবাই মিলে জ্বালিয়ে সবাই সুখচরের ভিতরে ঢুকে সবকটা বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। বৃষ্টি ভিজে থাকার জন্য জ্বলতে সমস্যা হলেও, হাওয়া দেওয়াতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকল আগুন।

আগুনে গোটা গ্রামটা ছাই হয়ে গেল। নন্দনগড়ের অভিশপ্ত গ্রামটার আর কোনও অস্তিত্ব রইলো না।

পরে রাজার ভয়ানক জ্বর হয়। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে। কিছুই মনে থাকতো না তার। ধীরে ধীরে মানসিক বিকার দেখা দেয়। বহু চিকিৎসাতেও রাজা সুস্থ্য হয়নি। সারাক্ষণ সেই বীভৎস চেহারাগুলো ওর চোখের সামনে এসে পড়ে। চিৎকার করে ওঠে সে। প্রলাপ বকে।  সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার জের তাঁকে বইতে হচ্ছে আজীবন। (সমাপ্ত)

Comments

    Please login to post comment. Login