
সম্প্রতি গুগল তাদের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের মাধ্যমে ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান Wiz-কে ২৩ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। Wiz-এর প্রতিষ্ঠাতারা ইসরায়েলের berUnit 8200 নামে পরিচিত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ছিলেন। এই ইউনিট সাইবার গোয়েন্দাগিরি, নজরদারি এবং ডাটা বিশ্লেষণের জন্য BER 'ইসরায়েলের NSA" হিসেবে পরিচিত।
এই চুক্তির ফলে গুগলের ক্লাউড, সাইবার নিরাপত্তা এবং ডাটা ম্যানেজমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কার্যত ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দাদের প্রভাবাধীন হতে যাচ্ছে, যা গোটা বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বিশ্বের জন্য হুমকি কী?
১. গোপন নজরদারি ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি
- গুগল বিশ্বব্যাপী ৭০-৮০% ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ডাটা নিয়ন্ত্রণ করে।
- ইসরায়েলের Unit 8200 অতীতে বেশ কিছু সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।
- গুগলের ক্লাউড এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে আসার ফলে বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্র, সংস্থা বা ব্যক্তির তথ্য ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের হাতে পৌঁছাতে পারে।
২. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কৌশলগত হস্তক্ষেপ
- বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশ ইসরায়েলের সাইবার কার্যক্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন।
- গুরুত্বপূর্ণ সরকারী নথিপত্র, সামরিক ডাটা এবং কর্পোরেট তথ্য ইসরায়েলের হাত হয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।
- গ্লোবাল পলিটিক্স ও ইকোনমিক ওয়ারফেয়ারে গুগল আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে, যা নিরপেক্ষতার অভাব সৃষ্টি করবে।
৩. ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের হুমকি
- গুগল অধিগ্রহণের ফলে অনেক দেশ তাদের ইন্টারনেট স্বাধীনতা হারাতে পারে।
- চীন যেমন গুগল, মেটা (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ) ও মাইক্রোসফটকে ব্লক করেছে, অনেক দেশ হয়তো একই পথে হাঁটতে বাধ্য হবে।
বিকল্প কী?
১. গুগলের বিকল্প প্রযুক্তি পরিষেবা

২. দেশভিত্তিক প্রযুক্তি বিকল্প গ্রহণ
- চীন: নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন Baidu, ব্রাউজার UC Browser, এবং ভিডিও প্ল্যাটফর্ম Bilibili ব্যবহার করে।
- রাশিয়া: Yandex সার্চ ইঞ্জিন, VK সোশ্যাল মিডিয়া এবং RuTube ভিডিও প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
- ইউরোপ: GDPR নীতিমালা অনুসারে বিকল্প প্রযুক্তি গড়ে তুলছে, যেমন ProtonMail, NextCloud, Startpage ইত্যাদি।
৩. সার্বভৌম প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা
- দেশগুলোকে নিজেদের ক্লাউড স্টোরেজ, সার্চ ইঞ্জিন, ব্রাউজার এবং সোশ্যাল মিডিয়া তৈরি করতে হবে।
- জাতিসংঘ বা বৃহৎ অর্থনৈতিক ব্লক (EU, BRICS) একটি স্বাধীন প্রযুক্তিগত কাঠামো তৈরি করতে পারে।
করনীয় কী?
১. ব্যক্তি পর্যায়ে
- Google Chrome-এর পরিবর্তে Brave বা Firefox ব্যবহার করুন।
- Gmail-এর পরিবর্তে ProtonMail বা Tutanota ব্যবহার করুন।
- Google Drive-এর পরিবর্তে Mega বা pCloud ব্যবহার করুন।
- DuckDuckGo বা Startpage-এর মাধ্যমে সার্চ করুন।
২. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে
- গুগলের বিকল্প প্রযুক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ করা (যেমন চীন, রাশিয়া ও ইউরোপ করছে)।
- জাতীয় তথ্য ও ডাটা সুরক্ষার জন্য গুগলের পরিষেবার উপর নির্ভরতা কমানো।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
৩. আন্তর্জাতিকভাবে
- ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি করা।
- Big Tech কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙার জন্য বিকল্প প্ল্যাটফর্মকে উৎসাহিত করা।
- জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন হলে গুগলের বিকল্প পরিষেবাগুলো ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
উপসংহার
গুগলের Wiz অধিগ্রহণ শুধু একটি ব্যবসায়িক চুক্তি নয়; এটি বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করতে পারে।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে গুগল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে।
যদি দেশগুলো স্বাধীন প্রযুক্তি তৈরি না করে, তাহলে ভবিষ্যতে তথ্যের নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যাবে।
বর্তমানে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সরকার—তিন পর্যায়েই গুগলের বিকল্প খোঁজার এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।