ছেলেটির নাম রুদ্র। খুব সাধারণ একটি গ্রাম — মাটির রাস্তা, চারদিকে কাঁচা ঘর, নদীর পাড়ে বসে বিকেলে ছেলেরা মাছ ধরে আর মেয়েরা ফুল তোলে। সেই গ্রামেরই এক কোণে, অর্ধভাঙা ঘরে জন্ম রুদ্রের। মা নেই, বাবা নেই, আছে শুধু দিদা। দিদা তাকে মানুষ করেছে গরিবির মধ্যে। তার ছোটবেলা কেটেছে অন্যের বাড়ির উঠানে বসে খেলার দিকে তাকিয়ে। বই কেনার সাধ ছিল, কিন্তু টাকা ছিল না।
যখন তার বয়স দশ, তখন একদিন স্কুলে শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন,
— রুদ্র, বড় হয়ে কী হতে চাস?
রুদ্র মৃদু হাসল। বলল না কিছুই। কারণ, বড় হয়ে কী হবে, সেটার স্বপ্ন দেখার সাহসও ওর ছিল না।
জীবনের প্রথম ঝড়
দিদা হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে গেল। রুদ্র গ্রামের হসপিটালে দৌড়াল। কিন্তু ডাক্তার বলল, "বয়স হয়েছে, যা হবার হয়েছে।" সেই দিনই রুদ্র বুঝল — এই পৃথিবীতে নিজের জন্য কিছু করে নিতে না পারলে কেউ পাশে দাঁড়াবে না।
দিদার মৃত্যুর পর রুদ্র পুরোপুরি একা। স্কুলের খরচ জোগাড় করা কঠিন হয়ে যায়। পেটের ক্ষুধা মেটানোই যখন চ্যালেঞ্জ, পড়াশোনা দূরের কথা। তবু রুদ্র স্কুল ছাড়েনি। কারণ, ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে রোদের মতো একটা স্বপ্ন প্রতিদিন ওর বুকের মধ্যে ঢুকে যেত।
রুদ্র শুরু করল সকালে মাঠে কাজ করা, দুপুরে স্কুলে যাওয়া। সন্ধ্যায় বাজারে ছোট দোকানে কাজ করে যা আয় হত, তার অর্ধেক জমাত, বাকি দিয়ে চাল-ডাল কিনত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাতের অন্ধকারে বসে পড়া চালিয়ে যেত।
একটি অদ্ভুত সন্ধ্যা
একদিন সন্ধ্যায়, স্কুল থেকে ফেরার পথে রুদ্র দেখল গ্রামের স্কুলের পুরনো দোতলায় একটি আলো জ্বলছে। কৌতূহল নিয়ে কাছে যেতেই দেখল, একজন বৃদ্ধ লোক বসে কাগজে কিছু লিখছেন। তিনি রুদ্রকে ডেকে নিলেন।
— কী নাম তোর?
— রুদ্র।
— পড়াশোনা করিস?
— করি দাদু।
— কেমন লাগছে?
— ভাল লাগে, কিন্তু বুঝতে পারি না সব। মাথার মধ্যে কথাগুলো এসে জট পাকিয়ে যায়।
বৃদ্ধ মৃদু হাসলেন। বললেন,
— "জানিস রুদ্র, জীবনের সবচেয়ে বড় জট খুলে যায় যখন তুই নিজের গল্প নিজে লিখতে শেখ."
রুদ্র বুঝল না। কিন্তু মনে গেঁথে নিল।
নিজের গল্প লিখতে শেখা
এরপর রুদ্র প্রতিদিন সেই বৃদ্ধের কাছে যেত। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ শেখালেন — শুধু বইয়ের পড়া নয়, নিজের জীবনের পাঠও পড়তে হয়। রুদ্র বুঝতে শিখল, জীবন মানে কষ্টের সাথে যুদ্ধ, আর যুদ্ধ মানেই জয় অথবা শিক্ষা।
বৃদ্ধের নাম ছিল মৃণাল চৌধুরী। এক সময় শহরের বড় লেখক ছিলেন, এখন অবসরে গ্রামে চলে এসেছেন। তিনি রুদ্রকে হাতে ধরে দেখালেন, কীভাবে নিজের অভিজ্ঞতাকে গল্পে রূপ দিতে হয়।
গল্পের জন্ম
রুদ্র নিজের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা লিখতে শুরু করল — দিদার কথা, খালি পেটের কথা, স্কুলে না পারার কথা, আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর কথা। তার গল্পগুলো ধীরে ধীরে স্কুলের দেয়ালে সবার মন কাড়তে লাগল। শিক্ষকরা উৎসাহ দিলেন।
একদিন স্কুলের শিক্ষক তার গল্পগুলো নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় পাঠালেন। সেখানে গল্প প্রকাশ হল — "অন্ধকার থেকে আলোয়"।
গল্পটি স্থানীয় মানুষের মন ছুঁয়ে গেল। প্রথমবারের মতো রুদ্র বুঝল, নিজের গল্প কেউ পড়ছে, কেউ অনুভব করছে।
ঘুরে দাঁড়ানো
সেখান থেকেই রুদ্রের জীবন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। গল্প লেখার জন্য এক জায়গা থেকে বৃত্তি পেল। সেই টাকা দিয়ে সে পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি চালিয়ে যেতে লাগল।
গ্রামের ছোট ঘর ছেড়ে কলেজে ভর্তি হল। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোর মধ্যে হারিয়ে যায়নি, বরং বুকের ভেতর শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল দিদার শেখানো কথা — "যদি পড়ে যাস, উঠে দাঁড়াবি।"
চূড়ান্ত যুদ্ধ
কলেজে পড়া শেষ করে রুদ্র শহরের এক পত্রিকায় সাংবাদিকের চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু অফিসে সবাই শহুরে, ইংরেজি জানে, স্টাইলিশ। গ্রামের ছেলে রুদ্র একটু আলাদা। প্রথম দিকে মজা করত সহকর্মীরা।
কিন্তু একদিন সম্পাদক ডেকে বললেন,
— "তুমি শহরের গল্প ধরতে পারো না, কিন্তু গ্রামকে তুমি যেভাবে বোঝো, অন্য কেউ বোঝে না। গ্রামের মাটির ঘ্রাণ তোমার লেখায় থাকে। এটাই তোমার শক্তি।"
রুদ্র সেই শক্তিকে আঁকড়ে ধরে একের পর এক প্রতিবেদন লিখতে শুরু করল গ্রামের জীবন নিয়ে। কীভাবে শহরের আলো গ্রামের মানুষকে ছুঁতে পারে না, কীভাবে ছোট ছোট স্বপ্ন হারিয়ে যায়, সেই গল্পগুলো ছাপা হতে শুরু করল দেশের বড় কাগজে।
শেষের দিকে নতুন শুরু
একদিন রুদ্র শহরের এক বইমেলায় নিজের বই প্রকাশ করল — "নিঃশব্দ ছায়া"। তার নিজের জীবনের গল্প।
বইটির প্রচ্ছদে লেখা ছিল:
"এ গল্প আমার। এ গল্প তোমার। এ গল্প সেই সবার, যারা অন্ধকারে থেকেও আলো খোঁজে।"
বইটি পাঠকদের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলে দিল। কিন্তু রুদ্রের মধ্যে কোনো অহংকার এল না। সে তখনো মনে মনে বলে — "আমি কেবল আমার গল্প লিখছি। জীবন লিখছে বাকিটা।"
গল্পের শেষ কথা
একদিন এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিল,
— "আপনি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন, এমন জায়গায় আসবেন?"
রুদ্র হেসে বলেছিল,
— "আমি কোনো দিন স্বপ্ন দেখি নাই বড় কিছু হওয়ার। আমি শুধু প্রতিদিনের গল্প লিখতে শিখেছিলাম। এবং জীবন আমাকে লিখে দিলো এমন গল্প, যা আমি নিজেও জানতাম না।"
এভাবেই নিঃশব্দে এক গ্রামের ছেলেও নিজের গল্প লিখতে পারে। এবং সেই গল্প কোনো কল্পকাহিনি নয় — পুরোপুরি বাস্তব।
কারণ জীবন সবসময় এমন গল্প লিখে, যা আজও কেউ লিখে নাই।
শেষ।
88
View