Posts

গল্প

নামহীন বৃষ্টি

March 27, 2025

Maskawat Hasan

120
View

(এমনই এক শরতে। বসে আছি দিয়াবাড়ির কোনো এক ঝিলের ধারে, কাশফুলে চারিদিক ভরে উঠেছে। মনে হচ্ছে সাদা কোনো গালিচা চারিদিকে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।)

 আজ আকাশটা বেশ পরিষ্কার। গত দুইদিন যে বৃষ্টিটা পড়ল, মাটি এখও সেঁতসেঁতে হয়ে আছে। তবে এই আবহাওয়াটাই কেন জানি বড্ড ভালো লাগে! এই পরিবেশটা বেশ আবেগ ঘনও বটে। হঠাৎ কেমন জানি স্মৃতি কাতর হয়ে পরছি। কাজই না… হুম আজই… । কি পরিমান পাগল ছিলাম তাই না! থুক্কু ছিলাম না আজও সেই পরিমানই পাগল !

দুইটি অভ্যাস আমার আজও যাই নি। একটা নিজের সাথে নিজের কথা বলা আর একটা হলো কবিতা লেখা। এই দুইটা জিনিসকেই আমি যে অনেক ভালোবাসি,ছাড়ি কী করে। সাধারণ আমি মোবাইলেই কবিতাগুলো লিখি কিন্তু আজ এই অসাধারণ প্রকৃতিতে যান্ত্রিক সব কিছুকেই সামান্য বিদাই জানাতে চাই। আমার মতো মানুষকে তেমন কেউ কল করারও নেই । বিয়ে-সাদীও করিনি আর করাও হবে না বোধহয় কোনো দিন। তাই সেই ঝামেলা- ঝঞ্ঝাও নেই। তাই মোবাইল মহাশয়কে রেখেই আজ এসেছি একটা খাতা আর কলম নিয়ে। 

পরন্ত বিকেল- চেষ্টা চলছে ছন্দ ছাড়ানোর । কত ছন্দও তো আসছে মনে কিন্তু জীবনের চেয়ে ছন্দময় আর কি কিছু হয় ! জীবনই যে এক মহাকাব্য; এই প্রচন্ড ছন্দ আবার সব ছন্দ হারিয়ে চরম ছন্দ পতনে হাবু-ডুবু খাওয়া। সে যাগগে! আজ হঠাৎ-হঠাৎ চোখটার যে কি হচ্ছে, নাহ… আবার বোধহয় ডাক্তার দেখাতে হবে। চশমটাও তো আজ পরে আছি তাও যে চোখ এমন করছে কেন বুঝতে পারছি না। 

‘হা…হা…হা…।‘ হঠাৎ একটা ক্ষীণ হাসি পিছন দিক থেকে শুনতে পেলাম, চাপা কিন্তু বোঝা যায় অভ্যাস তার অট্ট হাসির। হঠাৎ বুকের মধ্যে ধড়াস্ করে উঠল, হৃৎস্পন্দন যেন আস্মকিকভাবে বেড়ে গেলে কয়েকগুণে। ধুক্-ধুক্-ধুক্ বারিগুলো যেন নিজ কানেই শুনতে পাচ্ছি। আর নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে হয়ত প্রতিপদ্যক্রিয়াই বোধহয় শরীরের উপরের অংশটা নিয়ে সবেগে ঘুরে তাকালাম; কেন জানি মনে হচ্ছে এই হাসি আমার বড্ড চেনা- খুব চেনা- আমার থেকে হয়ত কেউই এই হাসি এতো ভালো করে কেউ চেনে না। তাকানোর বেলায় নিজের চোখ দু’টিকে যথেষ্ট সতর্ক করে নিয়েছিলাম, দেখলাম একটা মেয়ে, খুব বেশি বয়স না। বোধকরি আমার বয়সেরই হবে। খুব সুন্দর একটা গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি পরে আছেন তিনি। আর হেঁটে চলে যাচ্ছেন আমারই পাশ দিয়ে। হেঁটে যাওয়ার সময় কেন জানি বুকের ভিতরটা আরেকবার ধরাস্ করে উঠল; তবে কি উনি… আমি যাকে মনে করছি তিনিই কি…? না না… এ আমার ভ্রম মাত্র অন্য কিছুই নয় ! আহারে… আমার চোখ এমন করছে কেন? এবার আর ডাক্তার না দেখালে হবে না!

মেয়েটি কিন্তু একা ছিলো না। সাথে একটা পুরুষ মানুষ আছে বটে! শুধু পুরুষ মানুষ বললে কম হয়ে যাবে অত্যন্ত সুপুরুষ যাকে বলে ! লম্বা চুল, সুঠাম দেহ, দৃঢ় মাংসপেশি বিশিষ্ট,  উঁচু নাক, লম্বা-বেশ লম্বা মেয়েটি থেকে। বয়সেও বোধকরি বছর চার-পাঁচ বড়। পেশায় ঠিক কী করেন তা তো আর মুখ দেখে বলা যায় না তবে মিলিটারিতে থাকতে পারে আবার সিভিলিয়ানও হতে পারে। আমার সামনে দিয়ে যখন এই দুইজন চলেগেলো দুইজনই কুট্ -কুট্ করে কথা বলছিলো। হয়ত সেই সুপুরুষের কোনো এক কথায় মেয়েটি সেই চাপা হাসিটি হেসেছিলো। যখন হেঁটে গেলো দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল, মেয়েটির হাত সেই সুপুরুষের হাতের কবজি বরাবর ছিলো। আহারে চোখ… কি রে তোর কি! আজের মতো এতো সুন্দর দিনেই নষ্ট হতে হলো! কোথায় প্রকৃতি দেখব আর কবিতা লিখব সেইখানে…। 

একটু পরে আবার সেই অট্ট হাসির চাপারূপ কানে এসে ধরা দিলো। আবার প্রতিপদ্যক্রিয়ার ধক্কায় ঘুরে গেলাম। দেখলাম সেই দম্পতিকে কাশবনের দিকে অকাতরে হেঁটে যাচ্ছে। আমি যা ভাবচ্ছি, এর মানে কি তাই…?

এসব চিন্তা করা বাদ দিয়ে কবিতায় মনোযোগ দে! যাই হোক আমার কী! আমার কী যায় আসে! প্রকৃতি দেখি। কিছু সময় তাদের ভুলে থাকার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু এই পৃথিবীতে সব থেকে অবাধ্য মীর জাফর হলো মন। যা বলা হয় তা করবে না, যা করতে মানা করা হয় তাই বেশি করে করবে। উফ, এমন কেন লাগছে? কতগুলো বছরে কেটে গেছে। দশ বছর তো হবেই! ইস, আমার চোখ!

কিছুক্ষণের জন্য সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে উঠলাম। কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিলাম, হয়ত অতিতে! সংবিদ ফিরে পেলাম একটা বেশ শক্ত জুতোর শব্দে। আমি যে ঝিলের পাশে বসে ছিলাম সেই ঝিলের পাশের সেই সুপুরুষ এসে দাঁড়িয়েছেন; তার পায়ের দামি জুতোই বুঝা যায় ভদ্রলোকের অর্থের অভাব তো নেইই বরং বেশ ধনী ও সৌখিন মানুষ বটে। তিনি একা নন সাথে সেই হলুদ শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি। তাদের একে অপরের চোখ চাওয়া-চাওয়ি ভংগি দেখলেই বোঝ যায় তাদের সম্পর্ক যে সে সম্পর্ক না, বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। খুব আবেগ ঘন ! মেয়েটি অস্পষ্ট সুরে বলল, চলো না ঐ ঝিলটার পাশে গিয়ে বসি। এই মসৃণ ঘাসে বেশ লাগবে কিন্তু। সুপুরুষ কোনো আপত্তি না জানিয়ে বেশ একটা সুন্দর হাসি হেসে সায় দিলেন। সত্যিই তাকে সুপুরুষ বলাটাও কম হয়ে যায়, হাসিটাও যে অসাধারণ। আবার একটা একটা চাপা গলায় শুনতে পেলাম, একটা মানুষের হাসি এতোটা সুন্দর কি করে হতে পারে ! বোধহয় মেয়েটিই এটা বলল। কিন্তু শব্দগুলো যেন কানে বিঁধল, আবার বুকের ভিতরে ধরাস্ করে উঠল। এই কন্ঠটা কি আমি চিনি...?

তারা দুইজনই আমার থেকে সামান্য দূরে বসে আছে। কুট-কুট করে কথা বলছে, সেই কথা শোনার সাধ্য কারও নেই, আর আমার ইচ্ছাও নেই। অন্যের কথায় কান পাতাকে বড্ড অপছন্দ করি। এতোক্ষণ যা শুনেছি নেহাতিই অনিচ্ছায়- আস্মকিকভাবে ! খুব ভালো হতো যদি এই কথাগুলোও না শুনতে হতো। তাদের এই অতি সামান্য স্বরে কথা বলার চেষ্টা বোধকরি তাদের কথা যেন শোনা না যায় তারই জন্যে। কিন্তু তারা কি জানেন আমার মতো এক পাগল-অকর্মন্য-নিরস মানুষ তাদের এতো চেষ্টার পরেও ভুলে দু’টি মাত্র বাক্য শুনে ফেলেছেন? খুব খারাপ হয়েছে! খুব খারাপ!

তারা দুইজন পা সামান্য সামনের দিকে এলিয়ে দিয়ে কথা বলছে। এত কিছুর মধ্যে কেন জানি এই সুপুরুষের দিকে তাকাতে পারছি না। কেন পারছি না জানি না তার চেহারা তো যেন আসমানের জোৎস্না চাঁদ। তবু পারছি না! আমার হঠাৎ মনে হলো তাদের  একাকিত্ব দেওয়াই শ্রেয়  কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কেন জানি উঠতে পারলাম না; কোনো এক মহাচৌম্বকিয় শক্তি আমাকে এক অপার্থিব শক্তিতে বেঁধে রেখেছে। এবার অতি কষ্টে সেই সুপুরুষের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে আর চোখ নামাতে পারলাম না, তাকিয়ে রইলাম। কেমন জানি কোথায় একটা হারিয়ে গেলাম- কোথায়- কোথায়? মাঝে-মাঝে মুচকি-মুচকি হাসছিলাম। হঠাৎ সেই সুপুরুষের চোখ পরল আমার দিকে। আমার দিকে তাকিয়েই ব্রু কুঁচকে দিয়ে একটা ঝলসানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। একটু পরে অতি বিরক্তে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা উত্তেজনায় বলল। তারপর উভয়ে হনহনিয়ে আমার পাশ দিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বুঝতে পারলাম তিনি ভেবেছেন আমি তার সঙ্গীনির দিকে তাকিয়ে মুচকি-মুচকি হাসছিলাম। কিন্তু সে কি জানে আমি তার সঙ্গীনির দিকে একবারও তাকাইনি। আমি তাকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে হাসছিলাম। কে  জানে কী বলছিলো, মনে হয় বলছিল, চলো তো এখান থেকে। দেখো ওই যে বদমাইশ, দেখো-দেখো কেমন করে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে! এই সব ছেলেদের সুন্দরী মেয়ে দেখলে আর মাথা ঠিক থাকে না। হয়ত আরও অনেক কিছুই ভেবেছে। ভাবুক-ভাবতে তো আর আমি বাধা দেই নি। ভাবুক! আল্লাহ বাঁচিয়েছেন যদি রেগে-মেগে আমায় মারতে আসতো! আসলে-আসতো ! আহা আমার চোখ…। এইটুকু বয়সে বুড়ো হওয়া যাকে বলে আরকি!

আমি আবার নিজের মনে কবিতা লেখার চেষ্টায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আজ এমন কেন হচ্ছে, ছন্দের এতো পতন কেন? কবিতা যে আমার সত্তার অংশ কিন্তু আজ কেমন জানি মনে হচ্ছে আমি কোনোদিন কবিতাই লিখিনি কিংবা কবিতা লিখতে জানি না। জানি না, জানি না কিচ্ছু জানি না। 

ক্ষণেক ক্ষণের মধ্যেই আবার পরিবেশ পুরো স্বাভাবিক। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত, আর হ্যা সেই দুইজনও। হয়ত আমি এতোক্ষণে তাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছি। মানুষের জীবনে এতো ঘটনা ঘটে কোনটা রেখে কোনটা মনে রাখবে বলো তো!

আচ্ছা উনি এখন কোথায় থাকতে পারে? কেমন আছেন উনি? বোধহয় এই কাশবনেই কোথাও একটা। কেন হঠাৎ আমার এমন মনে হচ্ছে? শুধু-শুধু ! তার মতো মেধাবীর কী কোনো স্থানের কমতি আছে ! হয়ত দেশেই নেই। একবার মনে আছে, স্কুলের ম্যাগাজিনের তার একটা খুব সুন্দর কবিতা ছেপে ছিলো। সেই কবিতার পাশের তার একটা ধব-ধবে সাদা হিজাব পরা ছবি ছিলো। সেই সাদা হিজাবটি এতোটাই নির্মল ও মায়াবী ছিলো আজকের শরতের এই সাদা কাশবনকে তা নিঃশর্তে কয়েক হাজার বার হার মানাতো- হাজার বার হার মানাতো। একদিন তাকে বলেছিলাম, আপনাকে খুব কিউট লাগছিলো। অথচ আমি তার চেহার একবারের জন্যও দেখিনি। উনি আমাকে কৌতুহলী হয়ে জীজ্ঞাস করলেন, তুমি না দেখে কী করে বুঝলে আমি কিউট? আমি বলেছিলাম, সব কিছু দেখতে চোখ লাগে না! আজ হয়ত উনি আরও অনেক কিউট হয়েছেন। আমি আমার পুরো জীবনে তাকে একবারের জন্যও স্বেচ্ছায় দেখিনি, আজও চোখ বন্ধ করে তাকে কল্পনা করতে চাইলে কোনো চেহারা কিন্তু ভেসে উঠবে না, উঠা সম্ভবও না কিন্তু তার কন্ঠ-অট্ট হাসি যে আমার বড় চেনা। উনার উপস্থিতি কেমন করে যেন আমি বুঝতে পারতাম। আচ্ছা আজ কি বুঝতে পারব? এখন তো অনেক বড় হয়েগেছে। অনেক পরিবর্তন হয়ত হয়েছে। একদিন তাকে বলেছিলাম, কোনো দিন বড় হয়েন না। উনি বলেছিলন, আমি তো অনেক আগেই বড় হয়ে গেছি!আজকে তাকে কি আমি চিনতে পারব? জানি না- জানি না আমি। আচ্ছা তার কি আমাকে মনে আছে? মনে হয় নেই। ছিঃ কি ভাবছি আমি এসব ! কেন ভাবছি ! আজকে তো দেখছি চোখ ডলতে ডলতে শেষ হয়ে যাওয়া লাগবে…! ভাল্লাগে না…। 

আর ভালো লাগছে না একটু দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে যেই পিছনে তাকালাম সেই দেখলাম, সুপুরুষ ও হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটি এখনও আছে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে সূর্য ডুবেছে প্রায়, শেষ দিগন্তে সূর্য। মেয়েটির হাতে একটা কাশফুল ছিল, তাদের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, হাত ধরে থাকা সেই সুপুরুষটি কাশফুলটি তার হাত থেকে নিয়ে তার চেহারায় একটা নাড়া দিলো। এতে মেয়েটি আবার হেসে উঠল, এবার হাসিটা স্পষ্টভাবেই শোনা গেলো। যেনে বিধে বসল আমার কানে……। 

সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সবাই যে যার গন্তব্যে আস্তে-আস্তে ফিরছেন । 

যেতে যেতে সুপুরুষটি হঠাৎ কী এক কারণে সেই হলুদ শাড়ি পরিহীতা মেয়েটি কে একটা নাম ধরে ডাক দিলো,

নামটা যেন কী বলল, কী বলল!

যেই মাত্র নামটা বলল আকাশটা কালো হয়ে এলো, হঠাৎই একি বৃষ্টি! বৃষ্টি-অঝোর ঝারায় মুষলধারে বৃষ্টি; এই বৃষ্টি আর কেউ থামাতে পারল না। 

অস্পষ্ট শব্দে সেই নামের উচ্চারণ, ‘মে..হ...না...জ...’। আবার আমার চোখ দু’টি শুরু করল। এদের নিয়ে আর বাঁচি না, এমন হলে চলে!

কবিতার খাতাটায় আর লেখা গেলো না। 

বৃষ্টি-বৃষ্টি-বৃষ্টি-খবু উথাল-পাতাল বৃষ্টি। ঝড় হাওয়ার বৃষ্টি । বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেলো 

 বৃষ্টি-বৃষ্টি-বৃষ্টি।

 উথাল-পাতাল বৃষ্টি।


 

Comments

    Please login to post comment. Login