" গ্রীক থেকে রোমান"
প্রথম পাতা "(মেসিডোনিয়া এবং গ্ৰীক ও রোমান)"
প্রাচ্য শব্দটি বিশেষ্য এবং বিশেষণ দুভাবেই ব্যবহৃত হয় , ভারতীয় উপমহাদেশ হচ্ছে প্রাচ্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থল এবং প্রাচ্যবিদ্যা মানে বেদ ও উপনিষদের মধ্যে অন্তর্নিহিত জ্ঞান , এইখানে প্রাচ্য বিশেষণ । মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ এশীয় মহাদেশে অবস্থিত তুরস্ক থেকে পারস্য ভূখণ্ড বা বর্তমানে ইরান যেখানে ভারতের পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়েছে , প্রায় সমসাময়িক ব্রহ্মদেশ থেকে ভিয়েতনাম ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেসিয়া সহ সভ্যতার বিকাশ লাভ করে এবং এই সম্পূর্ণ এলাকা হচ্ছে দূরপ্রাচ্য , এইখানে প্রাচ্য বিশেষ্য । অপরদিকে পাশ্চাত্য অর্থাৎ প্রাচ্যের বিপরীত দিকে অবস্থিত ভূখণ্ড কিংবা মহাদেশ অর্থাৎ ইউরোপ এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ যেখানে ভিন্ন সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। পশ্চাৎ মানে পিছনে ( পশ্চাত্ +ষ্ণ= পাশ্চাত্য )। এক কথায় প্রাচ্য শব্দটি দ্বারা এশীয় অঞ্চলের দেশ সমূহ এবং পাশ্চাত্য শব্দটির মাধ্যমে অ্যামেরিকা এবং ইউরোপের দেশ সমূহকে বুঝানো হয়ে থাকে। তাছাড়া ব্রহ্মদেশ নামটি বার্মা নামের সাথে সম্পর্কযুক্ত, সংস্কৃত ভাষায় এই দেশটিকে ব্রহ্মদেশ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে, বর্মী ভাষায় দেশটিকে মিয়ানমা ও চৈনিক ভাষায় মান্দারিন বা মিআন ও মিআনদিআন , মিয়ানমার বর্মী নাম এবং দাফতরিক নাম মিয়ানমার সংঘ প্রজাতন্ত্র ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি দেশ বিশেষ। দূর প্রাচ্য বলতে সাধারণত
রাশিয়ার দক্ষিণা অঞ্চল থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের উত্তর সীমানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলকেই বোঝানো হয়ে থাকে, দূরপ্রাচ্যের দেশগুলো হচ্ছে চীন, জাপান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া , মঙ্গোলিয়া এবং তাইওয়ান। আবার মধ্যপ্রাচ্য হলো এশিয়া এবং আফ্রিকার মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল বিশেষ। আবার প্রতীচ্য এবং পাশ্চাত্য শব্দ দ্বারা পশ্চিমের দেশগুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে, তবে পাশ্চাত্য শব্দটি এখন বেশি প্রচলিত এবং জনপ্রিয়, পাশাপাশি অন্যদিকে ইংরেজিতে ইস্টার্ন অপেক্ষা ওরিয়েন্টাল এবং অক্সিডেন্টাল অপেক্ষা ওয়েস্টার্ন শব্দ বেশি ব্যবহার করা হয়। ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই বহু বৈদেশিক এবং ভারতীয় শিক্ষানুরাগী মানুষের প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দেশে অর্থাৎ ভারতবর্ষের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে জোয়ার বা প্রসার ঘটে , এই শিক্ষাবিস্তারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিকে প্রাচ্য শিক্ষার সমর্থন করেন, কিন্তু পরবর্তীতে সরকারিভাবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তার নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় , এবং এই বিতর্কই প্রাচ্য - পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব নামে বিশেষ ভাবে পরিচিত। ১৮১৩ সালের সনদ আইন বা উপনিবেশিক শাসনকালে ১৮১৩ সালের সনদ আইন অনুসারে ভারতীয় শিক্ষাখাতে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত ধার্য করা হয়, কিন্তু এই অর্থ প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন খাতে ব্যয় করা হবে এই নিয়ে শুরু হয় "প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব ", পক্ষে যেমন ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বিপক্ষেও ছিলেন , প্রাচ্য শিক্ষার যারা সমর্থক তাঁরা মনে করেন, কোম্পানির শিক্ষানীতি হওয়া উচিত ভারতীয় ভাষায়। অপরপক্ষে পাশ্চাত্যবাদীদের যুক্তি বা তাঁরা মনে করেন শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত ইংরেজি ও বিষয় হওয়া উচিত পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান। মূলত ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে চলতেই থাকে, শেষ পর্যায়ে এসে " "General Committee Of Public Instruction "এর সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফ্রেব্রুয়ারি "মেকলে মিনিট " নামক এক রিপোর্ট পেশ করেন এবং তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে সরকারি অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং এইভাবেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান নিরসন হয়।
সনদ আইন হলো ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে আইন প্রচলন করেন তাই সনদ আইন নামে অভিহিত। যারা ভারতবর্ষের মধ্যে প্রাচ্য শিক্ষাকে সমর্থন করেন তাঁরা হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, কোলব্রুক ,হেনরি প্রিন্সেস এবং উইলিয়াম জোন্স সহ আরো অনেকেই ও ইতিহাসে উনারা প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট নামে পরিচিত, উনাদের অভিমত প্রাচ্যশিক্ষাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা
এবং এর কারণ এইদেশের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে এই শিক্ষা অতপ্রতভাবে জড়িত । ওরিয়েন্টাল লার্নিং
বা প্রাচ্য শিক্ষা হলো একটি একাডেমিক শৃঙ্খলা যা এই ভারতবর্ষের পূর্বের এবং সুদূর পূর্বের সমাজের সমাজ ব্যবস্থার সামাজিক ধারা প্রবাহ , সংস্কৃতি ,ভাষা, ইতিহাস , প্রত্নতত্ত্ব সহ সবকিছুরই অধ্যয়ন, জ্ঞান আহরণ এবং শিক্ষা প্রদান। অপরদিকে যারা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য মত প্রকাশ করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টমাস ব্যাবিংটন মেকলে , আলেকজান্ডার ডাফ , সন্ডার্স, কোলভিল , চার্লস গ্রান্ট , ডেভিড হেয়ার প্রমূখ এবং তাঁরা ইতিহাসে পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট নামে সুপরিচিত । উনাদের অভিমত এই ইংরেজি ভাষা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাষাও এই ভাষায় রচিত সাহিত্য অতি সমৃদ্ধ এবং তাই যথোপযুক্ত, সুতরাং এক কথায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বলতে পশ্চিমাদের রীতিনীতিকেই বোঝানো হয়ে থাকে ও বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার মানুষদের প্রথা ও অদূর ভবিষ্যতে এই ভাষা এইদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে সমৃদ্ধময় করবে , তাই ইংরেজি শিক্ষার জন্যই সরকারি টাকা বরাদ্দ করা সমীচীন। নামের বানানের বিভিন্নতা ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত অভিধানের মধ্যে যা উল্লেখ করা আছে তাই সকলের কাছেই গ্ৰহনযোগ্য ।
তাই বাস্তবিক অর্থে মূল বিরোধ এইখানেই অর্থাৎ ১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতবর্ষের শিক্ষার উন্নতির জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা
প্রদান এবং এই টাকা প্রাচ্যশিক্ষার খাতে ব্যয় হবে নাকি পাশ্বাত্য শিক্ষার উন্নতিকল্পে? পাশ্চাত্যবাদী বা পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে তাঁরা আ্যাংলিসিস্ট এবং প্রাচ্য শিক্ষা বা সনাতনী শিক্ষার পক্ষে তাঁরা হলেন ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী। পরবর্তীতে জনশিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়
এবং এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রদান করা হয় যার নাম "জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন " প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদদের নিয়েই এই কমিটি গঠিত হয় ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে 'জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন' বা 'জনশিক্ষা কমিটি' । লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতের গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে আইন সদস্যরূপে যোগদান করেন , তিনি জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন এবং মেকলে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন ও ভারতীয় সভ্যতা এবং চিরাচরিত শিক্ষা ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে এক প্রস্তাব (Minutes) পেশ করেন যা "মেকলে মিনিট" নামেও পরিচিত , মেকলে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে তথ্য বা 'filtration theory' প্রচার করেন , টমাস ব্যাবিংটন এডওয়ার্ড মেকলে হলেন একাধারে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব এবং কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন এর সভাপতি ,তিনি প্রাচ্যশিক্ষার পরিবর্তে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিষয়ে যে বিখ্যাত প্রস্তাব পেশ করেন " ১৮৩৫ খ্রি, ২ ফেব্রুয়ারি তাই মেকলে মিনিটস " বা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত । লর্ড বেন্টিঙ্কের সরকার টমাস ব্যাবিংটন মেকলের প্রস্তাবগুলি গ্রহণ করেন এবং প্রাচ্য পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্বে শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয় লাভ করেন । প্রাচ্যবাদীদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে উইলিয়াম বেন্টিং ১৮৩৫ সালের ৭ই মার্চ এক নির্দেশিকা জারির মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
এটি গেলো আমাদের ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনামলে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ভাবে, পাশাপাশি এমন একটি দেশ আছে যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতা একি সাথে মিশে আছে এবং তা হচ্ছে তুরস্ক । তুরস্ক এমন একটি দেশ যেখানে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য তাদের ইতিহাস ও শিক্ষা এবং সংস্কৃতিসহ ও ভৌগোলিকভাবে একসঙ্গে মিশে গেছে, বিশেষত এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী দেশরূপে চিহ্নিত এবং তুর্কি সভ্যতা অতিব প্রাচীন সভ্যতা। রোমান, লাতিন, বাইজেনটাইন এবং অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় ১৬ শ’ বছর ধরে এই দেশের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইউরোপের আধুনিকতা এই দুইয়ের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে তুরস্কের সংস্কৃতি ও ইস্তাম্বুল শহর, ইস্তাম্বুলকে বলা হয়ে থাকে " "ইউরোপিয়ান ক্যাপিটাল অফ কালচার", ইস্তাম্বুল তুরস্কের রাজধানী না হলেও সবচেয়ে বড় শহর এবং দেশের অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতির পীঠস্হান, পাশাপাশি ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগর ঘিরে রেখেছে এই শহরকে, রেল চলাচলের মাধ্যমে এই শহর ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যুক্ত। ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত তুরস্ক । গ্রীক, পার্সিয়ান এবং রোমানদের নিয়ন্ত্রনে ছিল এই দেশ তুরস্ক এবং একসময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের আসন ছিল। আনুমানিক ১১ শতকে মধ্য এশিয়া থেকে তুর্কি যাযাবররা এই অঞ্চলে চলে আসেন , ধীরে ধীরে সমগ্র এশিয়া মাইনর জয় করে নেন । প্রথমে সেলজুক ও তারপরে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্য ক্ষমতায় আসেন , পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন এবং দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপে ইসলাম নিয়ে আসেন , ১৯১৮ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে তুরস্কে , বাস্তবিক অর্থে এমন একটি দেশের সন্ধান করছিলাম যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মিলন ঘটেছে, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম এশিয়ার দেশ তুরস্ক, ভৌগোলিকভাবে এশিয়া এবং ইউরোপ দুই মহাদেশজুড়ে অবস্থিত হওয়ায় বিশ্ব রাজনীতিতে এর গুরুত্ব বিশেষভাবে তাৎপর্যমন্ডিত ইউরোপের রুগ্ন শিশু
নামে খ্যাত এই দেশটি, ১২৯৯ সালের দিকে বর্তমান তুরস্কের আনাতলিয়ায় গড়ে উঠে অটোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া তিন মহাদেশের বিভিন্ন অংশকে নিজেদের শাসনে আনেন , বর্তমান গ্রিস, মিশর, ইসরাইল, জর্ডান, রোমানিয়া, আলজেরিয়া, হাঙ্গেরি, মেসোডনিয়া, লেবানন, সিরিয়াসহ বেশ কিছু আরব এবং আফ্রিকান অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয় হলে অটোমান সাম্রাজ্যের ইতি ঘটে, ১৯২২ সালে মিত্র শক্তির চাপের মুখে ১৯২৩ সালে "লুসান চুক্তি" স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন তুরস্ক, অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের ৬০০ বছরের মধ্যে প্রায় ৪০০ বছর মক্কা এবং মদিনার নিয়ন্ত্রণ ছিল তুর্কিদের হাতেই ও আনুমানিক ১২৯৯ সালে যাত্রা শুরু করা অটোমান সাম্রাজ্যের দশম শাসক ছিলেন সুলতান সুলেমান The Magnificent, প্রায় পাঁচ দশক সাম্রাজ্য শাসন করেছেন তিনি, তাঁর সময়ে অটোম্যানরা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে উঠেন, ইউরোপের রোম, হাঙ্গেরিসহ অনেক অঞ্চল অটোম্যানদের অধীনে আসে এবং ইউরোপে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান জানান দেন তুরস্ক। পৃথিবীর একটিমাত্র শহর, যা দুটি মহাদেশজুড়ে অবস্থান করছে এবং শহরটি তুরস্কের ইস্তাম্বুল, একসময় কসতুনতুনিয়া, বাইজেন্টাইন ও কনস্ট্যান্টিনোপল হিসেবেও পরিচিত ছিল, ১৯২৩ সালে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে পরিবর্তিত হয়ে ইস্তাম্বুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এই শহর ইস্তানবুল তুরস্কের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল, শহরের মোট আয়তন ৫৪৬১ বর্গকিলোমিটার প্রায়ই। ইস্তাম্বুল মূলত তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রদেশ, শহরটিকে দুই ভাগ করে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে বসফরাস প্রণালি, উত্তরে কৃষ্ণ সাগর এবং দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর, এর পশ্চিম দিক এশিয়ার মধ্যে পড়েছে। আর পূর্বদিক ইউরোপে। সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির পাশাপাশি ধর্মীয় দিক থেকেও শহরটির রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য, তিনটি বড় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহর এবং তা হচ্ছে রোমান, বাইজেন্টাইন ও অটোম্যান সাম্রাজ্যের, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে এইখানে বসতি গড়ে উঠে, ইস্তাম্বুল কেবল তুরস্কের নয়, এশিয়া মহাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর। ইস্তাম্বুলের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বসফরাস, বসফরাস প্রণালিতে অবিরাম বয়ে চলা পানির ধারাটি সংযুক্ত করেছে এশিয়া এবং ইউরোপকে, এশিয়া ও ইউরোপকে একত্রে বলা হয় ইউরেশিয়া, যার বিভাজন রেখা হলো বসফরাস প্রণালি, যে প্রণালির অবস্থান ইস্তাম্বুলে, এই কারণেই মূলত ইস্তাম্বুলকে বলা হয় দুটি মহাদেশের একটি শহর, কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ইস্তাম্বুল নগরী একসময় তুরস্কের রাজধানী ছিল, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই নগরী শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে রাজধানীকে স্থানান্তর করে আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া হয়, রাজধানী স্থানান্তর হলেও ইস্তাম্বুলের গুরুত্ব কোনো অংশেই কমেনি, বরং এই শহর আগের মতোই ও তুরস্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত, ইস্তাম্বুলের প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ শিল্পস্থাপত্য, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো দেশবিদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে। বসফরাস ব্রিজ, এটিই সেই স্থান যা দুই মহাদেশকে সংযুক্ত করেছে, খুবই সম্ভবত ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এই সেতু,সেতুটি অর্টকোই (ইউরোপে) এবং বেলেবারি (এশিয়ায়) মধ্যে বিস্তৃত, মূলত এটি ঝুলন্ত সেতু, দুই পাশে দুটি টাওয়ার ছাড়া মাঝখানে কোনো পিলার নেই, ১৯৭৩ সালে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর বিশ্বের চতুর্থ দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু হিসেবে স্বীকৃতি পায়, প্রথম তিনটি ঝুলন্ত সেতু হচ্ছে নরওয়ের ভেরেজানো ব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন গেট ব্রিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে ম্যাকিন্যাক ব্রিজ, এখন আসবো উল্লেখিত বসফরাস প্রণালীর কথায়, বসফরাস প্রণালি পৃথিবীর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যা অধিকার করার জন্য বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে রাশিয়া এবং তুরস্ক যুদ্ধ (১৯৭৭-১৯৭৮) অন্যতম, ১৬ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্য সমস্ত কৃষ্ণ সমুদ্র অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিলে বসফরাস প্রণালি দিয়ে রাশিয়ার সব যুদ্ধ জাহাজ এশিয়ায় প্রবেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, পরে বসফরাস প্রণালি দিয়ে যান চলাচলের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে লিউসিন চুক্তির মাধ্যমে বসফরাস প্রণালি ভৌগোলিকভাবে তুরস্কের অধীনে থাকলেও এই পথ দিয়ে সব দেশের জলযান চলাচল করতে পারবে, এই চুক্তি তুরস্ক অস্বীকার করে বসফরাস প্রণালিতে সামরিক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন, পরে ১৯৩৬ সালের মনট্রিক্স কনভেনশনে বলা হয় কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলের দেশগুলো ছাড়া বসফরাস প্রণালি দিয়ে তুরস্ক অন্য সব দেশের যান চলাচল সংরক্ষণ করতে পারবেন, ২০২৩ সালে শেষ হতে গেছে আন্তর্জাতিক বসফরাস চুক্তি, এই চুক্তি শেষ হলে তুরস্ক হবে বসফরাস প্রণালির একমাত্র অধিকারী, নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ইউরোপ থেকে এশিয়াগামী সব দেশের সব ধরনের জলযান।
৪০০ বছর পরও তুরস্কের নীল মসজিদ আজও পৃথিবীর সুন্দর মসজিদের স্থানে গৌরবের সঙ্গে তালিকাভুক্ত হয়ে আছে, এটি ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আহমদ বখতি নির্মাণ করেন, এটিকে শুধু মসজিদ বললে ভুল বলা হবে, দীর্ঘকাল ধরে তুরস্কের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে আছে এই মসজিদ,মসজিদটিতে মুসল্লির ধারণক্ষমতা ১০ হাজার। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত আরেক ঐতিহ্য আয়া সোফিয়া বা হায়া সোফিয়া, ৯১৬ বছর পর্যন্ত এটি ছিল ক্যাথলিক চার্চ, সুলতান ফাতেহ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর প্রথম একে মসজিদ ঘোষণা করেন এবং এর উপর একটি উঁচু মিনার নির্মাণ করেন, সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের শাসনকালে এর উপর আরেকটি সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করা হয়, এখন আয়া সোফিয়ায় সুদৃশ্য চারটি মিনার আছে, গ্রিক ভাষায় হায়া মানে পবিত্র আর সোফিয়া মানে জ্ঞান, সম্রাট কনস্টান্টিন যে গির্জাটি তৈরি করেন তা আকারে খুব একটা বড় ছিল না, আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে সেটি বিরাট আকারে পুনর্নির্মিত হয়, ৪৮১ বছর মুসলমানরা এইখানে নামাজ পড়লেও ১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্ক আয়া সুফিয়ায় আজান এবং নামাজ নিষিদ্ধ করে এটাকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন, ১৯৯১ সালে আয়া সুফিয়ার পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং মসজিদটির দরজা আয়া সোফিয়ার দিকে খুলে দেওয়া হয়, মানুষ সেখানটায় নামাজ পড়তে থাকে এবং ২০১৬ সালে এটি আবার মসজিদে রূপান্তর করা হয়, ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমদ জামে মসজিদের কাছেই ঐতিহাসিক ইমারত আয়া সোফিয়ার অবস্থান, আয়া সোফিয়া পৃথিবীতে স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়, এইখানে রোমান এবং তুর্কি স্থাপত্যশিল্পীরা নিজ নিজ সময়ে অমর কীর্তির স্বাক্ষর রেখে পৃথিবীকে চমকিত করেছেন, আজও প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক স্থাপত্যশিল্পের এই বিস্ময় দেখতে যান। ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম তোপকাপি প্রাসাদ, এটি ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়, বাইজেন্টাইন কনস্টান্টিপল জয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের নির্দেশে স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৪৫৯ সালে, রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে এর গুরুত্ব উঁচুতে হলেও প্রাসাদে প্রায় চার হাজার লোকের বাসস্থান ছিল, যা পূর্বে একটি বিশাল তীরবর্তী এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল, পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে ১৫০৯ সালের ভূমিকম্প এবং ১৬৬৫ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে প্রাসাদ চত্বরটির সম্প্রসারণ করা হয়, ১৯২১ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর তোপকাপি প্রাসাদ সরকারি রায়ে ১৯২৪সালের ৩ এপ্রিলে সাম্রাজ্যিক সময়ের জাদুঘরে পরিণত হয়, তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরটি বর্তমানে সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, প্রাসাদ চত্বরে কয়েকশ ঘর এবং প্রকোষ্ঠ আছে, প্রাসাদে উসমানীয় স্থাপত্যকলার বহু নিদর্শনসহ বিপুলসংখ্যক চীনামাটির বাসন, পোশাক, অস্ত্র, ঢাল, বর্মআবরণ, ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিক হস্তলিপির সংগ্রহ রয়েছে, পাশাপাশি এইখানে রয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) উনার আলখাল্লা ও তরবারি, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মিলন স্থল তুরস্কের মধ্যে এমন কিছু স্থাপনার কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি যার ইতিহাস হাজারো বছরের। সাংগঠনিক বসবাসের ক্রমোন্নত স্তর হচ্ছে সভ্যতা, এর অর্থ হলো এর নিজস্ব আইন, সংস্কৃতি এবং জীবনব্যবস্থা ও আত্মরক্ষার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে, অধিকাংশ সভ্যতারই নিজস্ব কৃষিব্যবস্থা এবং রাজতন্ত্র বা নির্বাচন ব্যবস্থার ন্যায় সরকারপদ্ধতি রয়েছে, তারা একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের নিজস্ব ধর্ম ও শিক্ষাব্যবস্থাও থাকতে পারে, সুমেরীয় এবং মিশরীয় থেকে শুরু করে সকল সভ্যতারই নিজস্ব লিখন পদ্ধতি বিদ্যমান ছিল, এই লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা তাদের জ্ঞান সংকলন ও সংরক্ষণ করতেন, রোমান সাম্রাজ্য হচ্ছে বৃহৎ সভ্যতার একটি উদাহরণ, এটি রোম নগরী থেকে সরকারিভাবে পরিচালিত হতো, এই সাম্রাজ্য এইকালের স্কটল্যান্ডের সীমান্ত থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা এবং উত্তর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল ল্যাটিন, রোমান সভ্যতা মোট ১০০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা টিকে ছিল তার থেকে বেশি দিন। রোমান ও মিশরীয়গণ অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁতে রোমানরা জয়ী হওয়ায় মিশর রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। লাতিনএকটি প্রাচীন ইন্দোইউরোপীয় ভাষা, যা প্রাচীন রোম এবং পার্শ্ববর্তী লাতিউম এলাকাতে প্রচলিত ছিল, রোমান শক্তির বিস্তারের সাথে সাথে প্রাচীন ইউরোপ এবং সংলগ্ন প্রায় সব অঞ্চলে ভাষাটি ছড়িয়ে পড়ে ও পশ্চিম ইউরোপের প্রধান ভাষাতে পরিণত হয়, ১৮শ শতক পর্যন্ত এটি ইউরোপে জ্ঞানচর্চা ও কূটনীতির ভাষা ছিল, আজ পর্যন্ত এটি রোমান ক্যাথলিক ধর্মীয় রচনাবলির ভাষা, ইন্দো-ইউরোপীয় বা হিন্দ ইউরোপীয় ভাষাসমূহ হচ্ছে পশ্চিম এবং দক্ষিণ ইউরেশিয়ার স্থানীয় একটি ভাষা পরিবার, ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশকে একত্রে ইউরেশিয়া বলা হয় পূর্বেই উল্লেখ করেছি , যার মিলন স্থল এই তুরস্ক বা প্রাচ্য সভ্যতা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার কেন্দ্র। বুঝার সুবিধার্থে এটি উল্লেখ করছি ভাষা পরিবার বা ইংরেজিতে Language family হচ্ছে বংশগতভাবে সম্পর্কিত একাধিক ভাষাকে বোঝায় এবং বলা হয় , এইগুলো একটি সাধারণ আদিভাষা থেকে উদ্ভূত, বেশীর ভাগ ভাষাই কোনও না কোনও ভাষা পরিবারের অন্তর্গত, বিশ্বে প্রায় ১০০টির বেশি ভাষা পরিবার বিদ্যমান। সভ্যতার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Civilization, শব্দটি Latin শব্দ "Civilis" থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো নাগরিক, তাই Civilization শব্দটির অর্থ হচ্ছে সুসভ্য নাগরিক সমাজ এবং যেখানে নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে, নগররাষ্ট্র হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, পাশাপাশি এটিকে ছোট স্বাধীন দেশ হিসেবেও বর্ণনা করা যায়, এটি সাধারণত একটি শহর এবং এর উপর নির্ভরশীল অঞ্চল নিয়ে গঠিত, ইতিহাসে রোম, এথেন্স, কার্থেজ এবং রেনেসাঁর সময়ে ইতালিয়ান নগররাষ্ট্র গুলো এটির অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই উল্লেখিত নগর রাষ্ট্রের বয়স দুই বা তিন হাজারেরও বছরের অধিক এবং প্রাচীন সভ্যতার সাথে সম্পর্কযুক্ত তাই উল্লেখ করেছি "রোম,এথেন্স ও কার্তেজ ", ২০১৯ সাল পর্যন্ত অল্প কিছু নগররাষ্ট্রেরই অস্তিত্ব আছে ,যদিও তারা আদৌ নগররাষ্ট্র কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু বর্তমানে সর্বসম্মতিক্রমে শুধুমাত্র লুক্সেমবার্গ, মোনাকো, সিঙ্গাপুর ও ভ্যাটিকান সিটির ক্ষেত্রে এই শব্দটি প্রযোজ্য, মাঝে মাঝে নগররাষ্ট্রকে ক্ষুদ্ররাষ্ট্রও বলা হয়ে থাকে, যেখানে এরি মাঝে খুব ছোট দেশের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোও বিদ্যমান, কিন্তু এটিকে ক্ষুদ্রজাতি বললে সেটি ভুল বলা হবে। বিভিন্ন গবেষকগণ বিভিন্ন ভাবে সভ্যতার সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন, কিছু গবেষক বলেন সভ্যতা হচ্ছে ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি আশীর্বাদপুষ্ট ফসল। আবার অন্য আরেকটি দল বলেন আমরা যেসব উপকরণ এবং দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহার করি সেসব একযোগে হলো আমাদের সভ্যতা। পাশাপাশি আরেকটি ধারনা সভ্যতা বলতে আমরা একটি সাংস্কৃতিক জটিল রূপকে বুঝি যা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট সমাজের প্রধান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো দ্বারা গঠিত। অন্য আরেকটি দলের কথা সভ্যতা হচ্ছে সংস্কৃতির অধিকতর জটিল এবং বিবর্তিত রূপ, সংস্কৃতির অধিকতর জটিল এবং অগ্রগতির ফল যা বংশপরম্পরায় লাভ করা যায়, বস্তুত এটি হলো নগরের বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ঘটে এবং নগরের ধ্বংসের সাথে সাথে সভ্যতাও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, মুলত সভ্যতার হাত ধরেই মানুষের আজকের এই অবস্থান। ইতিহাসের প্রাচীন সময়কে ইতিহাসপূর্ব সময় কিংবা পুরাতন পাথরের যুগ বা প্রত্নপ্রস্তর যুগ বলে অভিহিত, আধুনিকপূর্ব বলতে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব সময়কে বোঝানো হয়ে থাকে। এই দীর্ঘ সময়ের তারিখ ধরা হয় প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১০,০০০ প্রথম পাথরযন্ত্র নির্মাণের সময় থেকে, মানুষ ছিলেন যাযাবর, তারা অন্যান্য প্রাণীর অনুসরণ করতেন এবং ভোজ্য গাছপালা অনুসন্ধান করতে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতেন , তারা প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ সংঘবদ্ধ ভাবে সামান্য শিকার এবং খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতেন ও ইতিহাস অনুযায়ী ৫০০০,০০০ থেকে ২০০০,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব ছিল এমন সময়, যখন প্রাচীন মানুষ পাথরযন্ত্র নির্মাণ করেন। পুরুষ এবং নারীরা সাধারণ যন্ত্র ও অস্ত্র তৈরি করেন, যেমনঃখননকারী লাঠি, বর্শা ও কুঠার। প্রায় ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর আগে পদার্থ শক্তি, সময় ও মহাশূন্য যা বিগ ব্যাংগ হিসেবে পরিচিত তা অস্তিত্ব লাভ করেছে, তাদের আবির্ভাবের প্রায় ৩ লাখ বছর পরে পদার্থ ও শক্তি পরমাণু নামক জটিল আকার গঠনে মিলিত হতে শুরু করে, যা তখন অণুতে সংযুক্ত হয়, প্রায় ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামক গ্রহে বিশেষ অণুগুলো জীব নামে বিশেষভাবে বড়ো এবং জটিল আকার ধারণ করা শুরু করে, প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির জীবগুলো আরো বিশদ আকার গঠন করতে শুরু করে। প্রায় ৫ হাজার ৫০০ বছর আগে লেখা আবিষ্কার দিয়ে ইতিহাস শুরু হওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে, কিন্তু পূর্ব ইতিহাস নিয়ে লেখা উন্নত করার আগেই মানবজাতির ইতিহাস শুরু হয়, সবচেয়ে সহজলভ্য প্রামাণিক তথ্য ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা পূর্ব আফ্রিকায় প্রায় ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম মানবাকৃতির প্রাণীর অস্তিত্ব চিহ্নিত করছেন, মানুষ এবং মানুষাকৃতির যে প্রাণী আগে একত্রে ছিলেন তা হোমিনিড নামক প্রাণীর দলে অন্তর্ভুক্ত, প্রথম মানবপূর্ব হোমিনিড প্রায় সাড়ে ৩ ফুট থেকে ৫ ফুট লম্বা ছিলেন এবং দুই পায়ে হাঁটতেন, তাদের ছোট্ট মস্তিষ্ক এবং চ্যাপটা নাক ও লম্বা দাঁত ছিল। বিজ্ঞানীরা মানুষের গোত্র হোমোকে তিনটি প্রজাতিতে ভাগ করেন, যা দেহাকৃতিতে কিছুটা ভিন্ন ছিল এবং বিভিন্ন সময়ে আগমন করেন , তিনটি প্রজাতির সবচেয়ে প্রথমটি ছিল অতি প্রাচীন হোমো হেবিলিস, যাদের সক্ষমতা ছিল, তারা প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন বছর আগে পর্যন্ত জীবনধারণ করেছিলেন, হোমো হেবিলিসের পর পূর্বমানুষের দ্বিতীয় প্রকারটি হোমো ইরেকটাস, যারা খাড়াসিধা হাঁটতেন, ১০ হাজার এবং ২ লাখ বছর পূর্বসময়ের মধ্যে তাদেরকে অনুসরণ করে অন্য একটি প্রজাতি, যাদের নাম হোমো সেপিয়েন্স এবং যারা চিন্তা করতে পারতেন, আজ সকল মানুষ হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। ২ মিলিয়ন ১০ হাজার বছর পূর্বসময়ের মধ্যে পৃথিবী ঠান্ডা জলবায়ুর দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং যা বরফযুগ হিসেবে পরিচিত, বলা হয়ে থাকে শেষ বরফযুগ ১০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বে শেষ হয়েছিল, বরফযুগের সময়গুলোতে প্রকান্ড হিমবাহ মেরু থেকে বিস্তৃত হয়ে ভূমিরূপকে ক্ষত করে এবং ভূমিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু বরফের আস্তরণ গঠিত হয় কাজেই সমুদ্র স্তর ৩০০ ফুটেরও বেশি নিচে নেমে গিয়েছিল। পুরোনো মানুষ বিভিন্নভাবে বরফযুগের পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রত্যুত্তর দেন, অনেকে অধিকতর উষ্ণ স্থানগুলোতে স্থানান্তরিত হন, পাশাপাশি অন্যরা নিজেকে উষ্ণ রাখতে উপায় উন্নত করেছেন যেমনঃ পোশাক এবং আগুন। যারা খাপ খাওয়াতে পারেননি তারা অনাহার বা ঠান্ডায় মারা যান।পুরাপলীয় কিংবা পুরাতন পাথরযুগ শুরু হয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন বছর আগে হোমো হেবিলিস কর্তৃক প্রথম যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে এবং এটি প্রায় ১২,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, মেসোলিথিক বা পুরাতন পাথরযুগ সচরাচর ১২,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে প্রায় ৮,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত। নবোপলীয় বা নতুন পাথরযুগ স্থায়ী ছিল প্রায় ৮,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত। হোমো ইরেকটাসের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকায় এবং সেখানে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন থেকে ৩০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত বসবাস করেছিলেন , তাদের বসবাসের এলাকাগুলো আফ্রিকার বনভূমি এবং তৃণভূমি থেকে এশিয়া ও ইউরোপের বনাঞ্চল ও সমতল ভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, হোমো ইরেকটাস নারীরা সংগ্রহ করতেন ফলমূল, বাদাম ও বীজ। পুরুষরা মাংস অনুসন্ধান করতেন ও বর্শা এবং লাঠি দিয়ে ছোট্ট প্রাণী শিকার করতেন, হোমো ইরেকটাস প্রায় ১ দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন বছর আগে ঐ অঞ্চলে পৌঁছেছিলেন , হোমো ইরেকটাস ৪ লাখ ৬০ হাজার বছর আগে চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো কঙ্কালগুলো সম্ভবত হোমো ইরেকটাসের এবং প্রায় ৪ লাখ বছর আগের। হোমো সেপিয়েন্স আধুনিক মানব প্রজাতির প্রামাণিক স্বাক্ষর, যা প্রায় ২ লাখ বছর আগের বিষয় ছিল, যখন হোমো সেপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটে তখন অত্যাধুনিকায়নের সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে , প্রথম হোমো সেপিয়েন্স ছিলেন সম্ভবত নিয়ান্ডারথালস, যাদের নামকরণ করা হয়েছিল জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকা অনুসারে এবং যেখানে ১৮৫০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রথম তাদের অবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছিল, নিয়ান্ডারথালস মানুষেরা আফ্রিকাতে উৎপত্তি লাভ করেছেন এবং প্রায় ১ লাখ বছর আগে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়াতে শুরু করেন, নিয়ান্ডারথালস ছিলেন প্রায় সাড়ে ৫ ফুট লম্বা এবং তাদের গাট্টাগোট্টা দেহ ছিল। তারা ছিলেন যাযাবর শিকারি, যারা ছোটো দলে ভ্রমণ করতেন , হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে আফ্রিকাতে উৎপত্তি লাভ করেছে, ২০ হাজার বছরের মধ্যে তারা অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাতে স্থানান্তরিত হন। ৫ হাজারেরও বেশি সময় মানুষ খাবার শিকার ও সংগ্রহ এবং উৎপাদন করার মধ্যে অবস্থান করেন , এই উন্নয়নকে বলা হয়ে থাকে নবোপলীয় বিপ্লব যা মানুষের কাজ এবং জীবনধারায় বিশাল পরিবর্তনের দিক খুলে দিয়েছিল। নবোপলীয় বিপ্লব ঘটেছে ধীরে ধীরে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সময়ে, মধ্যপ্রাচ্যে কৃষির প্রামাণিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বের পূর্ব পর্যন্ত। পক্ষান্তরে, চীন এবং আমেরিকাতে ৫,০০০ ও ৪,০০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগে কৃষিকাজ ছিল না। নবোপলীয় মানুষ পানি মজুত এবং পরিবহনের জন্য রৌদ্রশুকানো শক্ত কাদামাটির মৃৎশিল্প প্রস্তুত করতেন। অনেক ক্ষেত্রেই খামার তখনকার জীবনকে অধিকতর সহজ করে তুলে, এটি খাদ্য সরবরাহ আনয়ন করে এবং মানুষকে এক স্থানে দীর্ঘসময় থাকতে সাহায্য করেছে ।বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন যে, ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৯০ মিলিয়ন ছিল। বর্তমানে ইসরাইলের দখলকৃত পশ্চিম তীরে অতি পুরোনো গ্রামগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জেরিকো, যা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বেরও আগে, বর্তমান টার্কির অন্য একটি গ্রাম ক্যাটাল হিউকের অস্তিত্বের আবিষ্কার হয় ৭০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ৬৩০০ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে। পরিশেষে নবোপলীয় কৃষকেরা লাঙল আবিষ্কার করে এবং ষাঁড়গুলোকে এটি টানতে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজকে আরো সহজ ও উৎপাদনশীল করে তুলেছেন ।তারা শিখেছেন কীভাবে ছাই , মাছ এবং সার দিয়ে জমি উর্বর করা যায়, নবোপলীয় গ্রামবাসী পশমও আবিষ্কার করেন এবং লিনেন ও উলের পোশাক তৈরি করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তারা চাকা আবিষ্কার করেন এবং এটি পরিবহনে ব্যবহার করেন , তারা নির্মাণকাজের জন্য কাদামাটির ইট তৈরির উপায় বের করেন, ইতিমধ্যে তারা শিখে ফেলেন কীভাবে স্বর্ণালংকার এবং অস্ত্র তৈরিতে কপার, লিড ও সোনার ধাতুগুলো ব্যবহার করা যায়। মূলত কৃষিপদ্ধতি জীবনকে অনেক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, মানুষ ঋতু পরিমাপ করতে এবং কখন গাছ ও ফসল লাগানো যায় তা নির্দিষ্ট করতে ক্যালেন্ডার তৈরি করেন।
এখন যদি বলা হয় বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতা বা Ancient Civilizations of the World তা কী কী? কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া এক কথায় উত্তর হবে এই , আজ থেকে কয়েক হাজারো বছর আগে অনেক সভ্যতার উত্থান পৃথিবীতে ঘটে তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছেঃ১.সুমেরীয় সভ্যতা২ ব্যাবিলনীয় সভ্যতা৩.অ্যাশেরীয় সভ্যতা৪.ক্যালডীয় সভ্যতা৫.মিশরীয় সভ্যতা৬.গ্রিক সভ্যতা৭.সিন্ধু সভ্যতা
৮.হিব্রু সভ্যতা৯.পারস্য সভ্যতা১০.সিন্ধু সভ্যতা১১.হিট্টাইট সভ্যতা১২.চৈনিক সভ্যতা১৩.ইজিয়ান সভ্যতা১৪.হেলেনিস্টিক সভ্যতা এবং ১৫.রোমান সভ্যতা। কিন্তু কখনো কী ভেবে দেখেছেন আমাদের এই প্রাণপ্রিয় বাংলা বা প্রাচীন বাংলা কিংবা অবিভক্ত বাংলা বা বাংলাদেশের
প্রাচীন এবং একেবারে আদি সভ্যতা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে জীবনধারাটি কেমন ছিল?মূলত প্রাগৈতিহাসিক যুগকে ধরা হয় প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর আগে থেকে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ এবং এই সময়কালকে ৩টি প্রধান যুগে ভাগ করা হয়ে থাকেঃ ক. প্রস্তর যুগ খ. ব্রোঞ্জ যুগ এবং গ .লৌহ যুগ । আজকের বাংলায় যে জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার শুরু এবং বিকাশ হঠাৎ করে একদিনে ঘটেনি, প্রাচীন বাংলার আমাদের তথা মানুষের হাতেই রচিত হয়েছে এর ভিত বা গোড়াপত্তন ও যুগে যুগে নানান ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এর বিকাশ ঘটেছে, তাই আজকের এই বাংলাদেশের সমাজে অনেক পরিবর্তন এলেও আগের দিনের অনেক বৈশিষ্ট
অক্ষুন্ন আছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা ধারাও লক্ষ্য করা যায়, মানুষের জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়েছে, আজকের বাংলাদেশের সংস্কৃতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এতে প্রাচীন বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান এবং বিশেষ করে বাঙালির মধ্যে জীবনধারা বিকাশে প্রাচীন বাংলার প্রভাব স্পষ্ট, সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধর্ম এবং অসাম্প্রদায়িক এই বাংলাদেশের মানুষের বেশির ভাগ হলেন মুসলমান, কিন্তু এইদেশে ইসলাম ধর্ম এসেছে মধ্যযুগে, তাই প্রাচীন বাংলায় ইসলামের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়না, তখন হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মই ছিল সমাজের প্রধান ধর্ম, এইখানে প্রাচীন বাংলা বলতে বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের সীমানাকে উল্লেখ করছি।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলা বা ভারতে প্রাচীন যুগের শুরুকে দেখা হয়ে থাকে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে, কিন্তু তার আগেও মানব সমাজের বিকাশ ঘটেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এবং যার কোনো ধরনের লিখিত ইতিহাস বিদ্যমান নেই, এই প্রাগৈতিহাসিক যুগকে নাম দেয়া হয়েছে প্রস্তর যুগ, এই প্রস্তরযুগকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়ে থাকে ১)পুরনো প্রস্তরযুগ,২) মধ্যপ্রস্তর যুগ এবং ৩)নব্য প্রস্তরযুগ। ভারতে প্রস্তুরযুগের সূচনা ঘটে ২০ লক্ষ বছর আগে বলে মনে করা হয়, এই সময়ে "হোমো হাবিলিস" নামের মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল এই ভারতে এবং হোমো হাবিলিসের কিছুটা ব্যাখ্যা পূর্বেই তুলে ধরেছি এবং আরো ব্যাখ্যা টানছি বুঝার সুবিধার্থে। এই সময় মানুষ পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করতেন, ফলমূল কুড়িয়ে, পশুশিকার বা মাছ ধরে তারা জীবন নির্বাহ করতেন ও যাযাবর জীবনযাপন করতেন, অনুমান করা হয়ে থাকে প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে "হোমো স্যাপিয়েন্স" নামক মানব প্রজাতি পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত বর্ষে আগমন করেন ও এরাই হলেন সমকালীন দক্ষিণ এশিয়ার জনগোষ্ঠীর আদি পুরুষ, খুবই সম্ভবত ভারতে কৃষির সূচনা হয়েছে আনুমানিক নয় হাজার বছর আগে এবং তার বিস্তার ঘটেছে আরও তিন হাজার বছর ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত বেলুচিস্তানের মেহেরগড়ে গ্রাম গড়ে উঠেছিল, মানুষ আবিষ্কার করেন লাঙলের আদিরূপ ও শুরু হয় চাষাবাদ, পশূকে পোষ মানান ও শুরু করেন স্থায়ী গোষ্ঠীগত জীবনযাপন, সুতরাং কৃষির আবিষ্কারই সূচনা করে মানুষের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়, সিন্ধু নদীর পলি সমৃদ্ধ জমিতে ফলে প্রচুর ফসল ও উৎপাদিত হয় অনেক উদ্বৃত্ত খাবার, যার ফলে গড়ে উঠে বাজার এবং গড়ে উঠে শহর। ব্যবসায়ী, প্রশাসক, পুরোহিত ও যোদ্ধারা নিয়োজিত হতে থাকেন অকৃষিজ পেশায়, একেই বলা হয়ে থাকে "নগর বিপ্লব"।বাংলাদেশে কখন মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি, কিন্তু ইতিহাসবিদ এবং গবেষকদের অনুমান বাংলার মানুষও সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তর পার হয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছেন, পাথরের হাতিয়ারের নিদর্শন পাওয়া গেছে কুমিল্লার লালমাইয়ে, চট্টগ্রাম এবং সিলেট অঞ্চলে ও এই থেকেই বুঝা যায় প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় মানুষ বাস করে আসছেন। নানান জায়গা এবং দেশ থেকে এসে যারা বহুকাল এইদেশে বসবাস শুরু করেছেন তাদের রক্ত বাঙালির রক্তে মিশেছে, ভাষা এবং সংস্কৃতির পরিচয়ে বড় বড় যে সব জাতি এইখানে এসেছেন তার মধ্য থেকে অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং আর্যদের প্রভাবই বেশি দেখা যায় এবং অনেক জাতির মিশ্রণ ঘটেছে বলেই বাঙালিকে বলা হয়ে থাকে সংকর বা মিশ্র জাতি।জীববিজ্ঞানের ভাষায় দুটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আন্তঃপ্রজননের ফলে উদ্ভূত নতুন প্রজন্মকে ওই দুই প্রজাতির সংকর বলে, সংকর করার প্রক্রিয়াটিকে সংকরায়ন বলে, সংকর জীব তাদের নিজস্ব গুণাবলির অধিকারী হতে পারে, অনেক ক্ষেত্রে সংকরটি তার পিতামাতা থেকে ভিন্ন এবং উন্নত বৈশিষ্ট্যও হতে পারে এবং কখনো কখনো পিতামাতার চেয়ে বড় বা লম্বা হয়।
সুতরাং এই কথা বলা যায় বাংলাদেশে মধ্যে আদিম সমাজের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল, মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করতেন এবং এটিই আদিম যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য । নদীমাতৃক সমতল এই বাংলায় অনেক আগে থেকেই কৃষির প্রচলন ঘটেছে, বাঙালির আদি পুরুষ অস্ট্রিকরাই কৃষিকাজ শুরু করেন, এবং জানলে হয়তোবা অবাক হবেন " লাঙল শব্দটি এসেছে অস্ট্রিক ভাষা থেকেই ", পরিবেশের কারণে মাছ শিকার এবং ধান উৎপাদন বাঙালির প্রধান জীবিকা ছিল যা অন্যান্য আদিম সমাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ , বহু পূর্ব থেকেই বাঙালিরা নৌকা বানাতে জানতেন ও জলপথে সহজে যাতায়াত এবং ব্যবসার কাজে তারা নৌকা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা উন্নয়নশীল এবং আধুনিক কালে কৃষি ও শিল্পভিত্তিক সমাজের মিলিত রূপ বাংলাদেশে বিরাজমান এই ধরনের সমাজ ব্যবস্থাই উন্নয়নশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য।ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমে প্রাচীন কালে বিকাশ ঘটেছে নগর সভ্যতার ও যেটি সাধারণভাবে সিন্ধুসভ্যতা নামে পরিচিত, কিন্তু প্রাচীন নগরসভ্যতার একই ধারায় বাংলাদেশে সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি। প্রাচীন ভারতের নগরসভ্যতাকে সাধারণভাবে সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়েথাকে , আবার এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত, সিন্ধু নদ এবং এর শাখা নদী ইরাবতী এবং রাভী নদীর তীরে এই সভ্যতার বেশিরভাগ নিদর্শন পাওয়া গেছে, সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আনুমানিক এবং সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে এইখানে পরিকল্পিত একটি নগর গড়ে উঠে ও এই সভ্যতার বড় দুটি নগরের নাম একটি হরপ্পা
অন্যটি মহেঞ্জোদারো, " হরপ্পা বর্তমান ভারতের অংশে আর মহেঞ্জোদারো পাকিস্তানের অংশে অবস্থিত "। মনে করা হয়ে থাকে ভারতের এই প্রাচীন সভ্যতাটি ১৯০০ থেকে ১৭০০খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগে ধ্বংস হয়ে যায়। সিন্ধু সভ্যতা কেন ধ্বংস হয়ে যায় তা জানা সম্ভব হয়নি, তবে অনুমান করা হয় জলবায়ুর পরিবর্তন এবং অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর আক্রমণে এই সভ্যতার পতন ঘটেছে , অনেকে অনুমান করেন এই সময়ে দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ার জলবায়ু শীতল হয়ে যাওয়ার কারণে ইন্দোআর্য নামের এক যাযাবর জনগোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করেন, এরাই সূচনা করেন বৈদিক যুগের ও হিন্দুধর্মের, সৃষ্টি হয় বেদের প্রার্থনাসংগীত, মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনী। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ভূমির উৎপত্তি যদিও প্রাচীন তবুও নদনদী বেষ্টিত জঙ্গলে ঘেরা এই নিম্নভূমিতে মানুষের বসতি শুরু হয়েছে অনেক পরে। পলিমাটিতে গড়া বাংলাদেশের এমনো অনেক অঞ্চলের মাটি লাখ লাখ বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল, আজকের বাংলাদেশে উত্তরের বরেন্দ্রভূমি, মধ্য অঞ্চলের মধুপুরের গড় এবং পূর্বদিকে লালমাই, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মাটি অনেক পুরনো এবং গবেষকরা খোঁজ পেয়েছেন এই পুরনো মাটির কোনো কোনো অংশে পাথরযুগের মানুষ বিচরণ করতেন। ভারত উপমহাদেশে আদি মানবের যে বিচরণ ছিল তার প্রমাণ মিলেছে, পাওয়া গেছে পুরনো পাথরযুগের হাতিয়ার ও এগুলোর মধ্যে আছে শিকারের অস্ত্র, হাতুড়ি এবং হাতিয়ার প্রভৃতি।জায়গা উল্লেখ করলে বলতে হয় প্রস্তর যুগের কিছু নির্দশন পাওয়া যায় উত্তর বাংলার বরেন্দ্রভুমিতে, কুমিল্লার লালমাইয়ে , চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে, সিলেটের হবিগঞ্জে এবং নরসিংদীর উয়ারিবটেশ্বরে, কিন্তু বাংলাদেশে সেই কালের চিহ্ন ব্যাপকভাবে পাওয়া সম্ভবপর হয়নি, তবে এই নিদর্শন থেকে বুঝা যায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বিচরণ ছিল এদেশের বিভিন্ন স্থানে, এমন মনে করাও অমূলক নয় বাংলাদেশের উপর দিয়ে আদি মানুষ পাড়ি দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ায় বা অস্ট্রেলিয়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপদ গড়ে উঠতে শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ৩২০০ বছর আগে অর্থাৎ লৌহযুগের সূচনা থেকে বনজঙ্গল কেটে মানুষ এইখানে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন। বাংলাদেশে ঠিক কখন কৃষিযুগের সূচনা হয়েছে তাও এখনো পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি, কৃষির সাথে সাথে গড়ে উঠতে থাকে শহর, লোহার ব্যবহার কৃষির উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পরবর্তীতে গড়ে উঠে সমৃদ্ধ নগরএবং উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি উয়ারিবটেশ্বরে এর প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। উয়ারি ও বটেশ্বর গ্রাম দুটির পাশ দিয়ে প্রাচীনকাল থেকে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ এবং এর শাখা আড়িয়ালখাঁ, গঙ্গাজলি এবং কয়রা নদী, উয়ারিবটেশ্বরে খনন করে নানান ধরনের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে, পরীক্ষা করে দেখা গেছে পুণ্ড্রনগরে সভ্যতা গড়ার কিছুটা আগে এইখানে নগর নির্মাণ করা হয়েছিল, মূলত এটি ছিল বাণিজ্য নগরী ও সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে মাটির দেয়ালে ঘিরে দেয়া হয়েছিল নগরটি। মহাস্থানগড়ে প্রথম নগর গড়ে তোলেন ভারতের মৌর্য বংশের সম্রাটরা ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিল উত্তর বাংলায়, এর নাম হচ্ছে পুণ্ড্রবর্ধন, এই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল আজকের মহাস্থানগড়ে, যেটি এখন বগুড়া জেলায় অবস্থিত, সেইসময় এই রাজধানীর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর, পৃথিবীর অধিকাংশ নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর তীরে, কারণ নদী থাকার কারণে কৃষি কাজে সুবিধা ও বন্যার পর জমিতে পলি পড়ে উর্বর হয় মাটি, উর্বর মাটিতে ভালো ফসল ফলে ও নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়, তাছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ব্যবসাবাণিজ্য করতে নদী বড় ভূমিকা পালন করে এবং নদীর সুবিধা নিয়েই মহাস্থানগড়ে নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেই প্রাচীনকাল থেকেই করতোয়া নদী বয়ে গেছে মহাস্থানের পাশ দিয়ে, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মাটি খনন করে মৌর্য যুগের অনেক নিদর্শন পেয়েছেন। তাছাড়া ইতিহাস অবলোকন করলেই চোখে পড়ে আজকের বাংলাদেশ প্রাচীনকালে একক কোনো দেশ ছিল না, তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাঢ়, গৌড়, বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল প্রভূতি নামে জনপদ গড়ে উঠে এবং আজ থেকে তিন হাজার বছর আগেকার বাংলাদেশে উন্নত সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে, প্রাচীনকালে বাংলায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজবংশের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও মৌর্যদের সময় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মৌর্য শাসনের প্রমাণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ, বগুড়ার মহাস্থানগড় ছিল এই শাসনের কেন্দ্রস্থল, গুপ্ত শাসনামলে বাংলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ ও সেই আমলে তাম্রলিপ্তি ছিল বিরাট বাণিজ্য কেন্দ্র, সপ্তম শতাব্দীতে শশাংক বাংলায় গৌড় রাজ্যের শাসন চালু করেন, তাঁর মৃত্যুর পর একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী শাসনের তথ্য পাওয়া যায় না, পাল বংশের প্রতিষ্ঠিতা গোপাল এই বিশৃঙ্খলা অবস্থার অবস্থান ঘটান এবং প্রতিষ্ঠা করেন পাল সাম্রাজ্য এবং তাঁরা এই প্রাচীন বাংলায় ৪০০ বছর শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
এই প্রতিবেদনের মধ্যে উল্লেখিত বেদ এবং উপনিষদ , বেদ প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ তত্ত্বজ্ঞান সংক্রান্ত একাধিক গ্রন্থের একটি বৃহৎ সংকলন, বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সংস্কৃত সাহিত্য সূচিত হয় বেদ রচনার মাধ্যমে
এবং হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলো সবই সংস্কৃতে লেখা।
সংস্কৃত সাহিত্য বা ভারতীয় সাহিত্য আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আলোচনা করতে হয় বৈদিক সাহিত্য,
রামায়ণ রচনার পূর্ববর্তী কাল পর্যন্ত বেদ সম্বন্ধিত সকল প্রকার সাহিত্যকে বৈদিক সাহিত্য বলা হয়ে থাকে, বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ২০৪৩৪ টি ও বেদের সংখ্যা চার ক্রমান্বয়ে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। বেদের অন্তিম ভাগ বা শেষাংশ জ্ঞান কান্ড রূপে প্রচলিত উপনিষদ বা বেদান্ত , মূলত এটিই ঋষিগণের দার্শনিক চিন্তাভাবনার চূড়ান্ত প্রতিফলন
এবং উপনিষদ শব্দের ব্যুৎপত্তি অর্থ এই গুরুর কাছে বা পাশে বসে আলোচনা । পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল ভিত্তি এবং উৎস সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই গ্রিক এবং রোমানদের সময়ে ফিরে যেতে হবে, কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতা মূল ভিত্তি গ্রিক সভ্যতা থেকে উৎসারিত, এই সভ্যতা থেকেই পাশ্চাত্য সভ্যতার নীতিমালা আহরণ করা হয়েছে,তাই গ্রিক সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারলে পাশ্চাত্য সভ্যতার উপাদান এবং বিশেষত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি করা সম্ভবপর হবে। পাশ্চাত্য সভ্যতার তাত্ত্বিক মতাদর্শ ইউরোপ এবং আমেরিকা সহ ও সমসাময়িক পশ্চিমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, তাত্ত্বিক শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে তত্ত্বসম্বন্ধীয় সত্য, বাস্তবানুগ তত্ত্বীয় এবং তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি। বাস্তবতার নিরিখে এই মানব সমাজের ইতিহাস বহু প্রাচীন ও ধারাবহিক, পাশাপাশি বিভিন্ন চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক এই সমাজবদ্ধ এবং ধারাবহিক জীবনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন, বিভিন্ন মানব সমাজ সম্পর্কিত তাঁদের এই চিন্তা ও জ্ঞান যখন অন্তদৃষ্টি বা মনের গভীর থেকে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকাশিত হয় তখন তা আধুনিক সমাজে এসে Theory বা তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, পাশাপাশি মতাদর্শ হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনের একটি রূপ যেখানে ব্যবহারিক উপাদানগুলো তাত্ত্বিকগুলোর মতোই বিশিষ্ট এবং এটি এমন একটি ধারণার ব্যবস্থা যা বিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে ও বিশ্বকে পরিবর্তন করতে উভয়কেই সাহায্য ও সহযোগিতা এবং উৎসাহিত করে, আবার অন্য ভাবে বললে বলতে হয় মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ কিংবা অধিবিদ্যা হচ্ছে এই এটি এক ধরনের সচেতন ও অসচেতন ধারণা যা কোন ব্যক্তির বিশ্বাস লক্ষ্য ও প্রত্যাশা এবং প্রেরণার সমষ্টি হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে এবং এই শব্দটি বিশেষভাবে ধারণা ও আদর্শের একটি ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে যেখান থেকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সেখান থেকে উদ্ভূত নীতিমালার ভিত্তি তৈরি করে এবং বাস্তবতা সম্পর্কিত মৌলিক পূর্বানুমানের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে যার বাস্তবিক ভিত্তি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে অর্থাৎ বিশ্বাস এবং আদর্শ ও মূল্যবোধের সমষ্টি যখন একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক যুক্তির বাইরে গিয়ে ধারণ করেন বা লালন করেন মনের মধ্যে এবং এটিই তাত্ত্বিক মতাদর্শ। পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শিক ভিত্তি ও এই মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ততা আছে মেটাফিজিক্যাল দর্শনসহ নানান ধরনের শিক্ষায়তন সমৃদ্ধ নৈতিক দর্শন ও বিভিন্ন শাখা এবং আদর্শসমৃদ্ধ সামাজিক দর্শন, এই মতাদর্শ বলতে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণভিত্তিক বৈজ্ঞানিক মতাদর্শকেই বোঝাই না বরঞ্চ সেই দার্শনিক মতাদর্শের কথা বলা হয়ে থাকে যেখানে ধর্ম এবং জীবন ও পৃথিবী এবং মানুষ, " জ্ঞান এবং মূল্যবোধের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করে"। Ontology এবং cosmology এই দুইটা নিয়ে গঠিত মেটা ফিজিক্স, অধিবিদ্যা কিংবা মেটাফিজিকস হচ্ছে কোনো বিষয়কে তাত্ত্বিক ও অন্তর্গত দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা ও এই অনুসন্ধান প্রচেষ্টা বৃহত্তর পরিসরে যখনি ঘটে তখন সেটাকে বলা হয়ে থাকে কসমোলজি ও যদি কোনো বিষয়কে যথাসম্ভব ক্ষুদ্রতর কিংবা উৎপত্তিগত দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে,তখন সেটাকে বলা হয় অন্টোলজি। মেটা ফিজিক্স ও এপিস্টেমোলজি দুটোই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠের মতো," Epistemology বুঝতে হবে মেটাফিজিক্যালি, মেটাফিজিকস বুঝতে হবে এপিস্টেমোলজিক্যালি "। আসলে মেটা ফিজিক্স
বা Metaphysics হলো দর্শনের একটি শাখা যেখানে
আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বিশ্বের অস্তিত্ব, সময়
, স্থান, বস্তুর গুণাবলী ইত্যাদির দার্শনিকভাবে আলোচনা করা হয় । মেটাফিজিক্স এর একটি শাখা হচ্ছে সৃষ্টিতত্ত্ব বা Cosmology এবং অপর শাখা হচ্ছে
তত্ত্ববিদ্যা বা Ontology । মেটাফিজিক্স শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ মেটা এবং ফিজিকা থেকে এবং এই ধারার জনক গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল । গ্রীক দর্শন তার সূচনা থেকেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনেক অংশকে প্রভাবিত করেছে । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের উদ্ভব ঘটেছে, দর্শন ব্যবহার করা হয় যুক্তি ব্যবহার করে জগৎকে বোঝার জন্য ও এটি জ্যোতির্বিদ্যা , জ্ঞানতত্ত্ব , গণিত , রাজনৈতিক দর্শন , নীতিশাস্ত্র , অধিবিদ্যা , অন্টোলজি , যুক্তিবিদ্যা , জীববিদ্যা , অলঙ্কারশাস্ত্র এবং নন্দনতত্ত্ব সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে । বুৎপত্তিগতভাবে যক্তিবিদ্যা হলো চিন্তার বিজ্ঞান , কিন্তু যুক্তিবিদ্যা শব্দটা অনুসরণ করলে একে বরং যুক্তির বিজ্ঞানই বলা উচিত এবং সচারচর তাই হয়ে থাকে ।যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে বিচারবুদ্ধির চর্চা এবং এর প্রয়োগপদ্ধতি, এই হিসেবে যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে দর্শনের পদ্ধতি, আবার অনেকে যুক্তিবিদ্যাকে দর্শন বলে মনে করেন, কিন্তু এটি ভুল, এটি যে ভুল তার প্রমাণ হচ্ছে ফিলসফি বা দর্শন বিভাগে এইরকম বিষয় আছে " "philosophical logic কিংবা philosophy of logic"। যুক্তিবিদ্যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো Logic যা এসেছে গ্রীক শব্দ Logosথেকে এবং যার অর্থ চিন্তা বা শব্দ ,যুক্তিবিদ্যা এমন একটি বিষয় যা অনুমানের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য অনুমান এবং তার সহায়ক কতগুলো প্রক্রিয়া নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে আলোচনা করে, তাছাড়া এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো অসত্যকে বর্জন করে সত্যকে অর্জন করা, যুক্তিবিদ্যা সঠিক যুক্তিপদ্ধতির কিছু নিয়ম প্রণয়ন করে যার সাহায্যে যুক্তির বৈধতা এবং অবৈধতা যাচাই করা যায়, যুক্তিবিদ্যায় প্রণীত এইসব নিয়ম ছাড়া জ্ঞানের কোনো শাখাতেই যুক্তির বৈধতা যাচাই করা সম্ভব নয়, তবে বৈধতা বিচারকালে অনুমানের কিছু সহায়ক প্রক্রিয়া নিয়েও যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে। অপরদিকে দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Philosophy এবং শব্দটি গ্রিক শব্দ Philos ও Sophia শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত, Philos শব্দের অর্থ to love এবং Sophia শব্দের অর্থ wisdom , সুতরাং উৎপত্তিগত ভাবে Philosophy বা দর্শন শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা জ্ঞানপ্রীতি, আসল কথা এই সমগ্র বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে একটা সুসংবদ্ধ এবং যৌক্তিক জ্ঞান প্রদান করাই দর্শনের উদ্দেশ্য, তাই দর্শন সূবিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বিশ্বজগৎ এবং জীবন সম্পর্কে একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে। বিচার এবং সমালোচনাই হলো দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, বস্তুত দর্শন আমাদের জীবনের অর্থ, স্বরূপ , পরিণতি ও মূল্য নির্ধারণ করে, প্রকৃতপক্ষে দর্শন জীবন ও জগতের সকল সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং তার সমাধান দিতে চেষ্টা করে। যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শন দুটি ভিন্ন জ্ঞানশাখা হলেও এদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য আছে, তবে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্যও আছে: ১. যুক্তিবিদ্যা হলো দর্শনের একটি শাখা অন্যদিকে, যুক্তিবিদ্যা দর্শনের অন্তর্ভূক্ত।
২. যুক্তিবিদ্যা হলো জ্ঞানের খন্ডিত আলোচনা, অন্যদিকে, দর্শন হলো জ্ঞানের সামগ্রিক আলোচনা।
৩. যুক্তিবিদ্যার পরিধি দর্শনের চেয়ে সংকীর্ণ, দর্শনের পরিসর ব্যাপক ও বিস্তৃত। ৪. যুক্তিবিদ্যা যথার্থ জ্ঞানের শর্তাবলি আলোচনা করলেও কখনো অভিজ্ঞতার জগতের বাইরে যেতে পারে না, অন্যদিকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে দর্শন ইন্দ্রিয় জগত অতিক্রম করে অতীন্দ্রিয় সত্তার জগতে পৌঁছাতে পারে, কারণ দর্শন জড়, প্রাণ, মন, স্রষ্টা, আত্মা ইত্যাদি সব বিষয় নিয়েই আলোচনা।
৫. দর্শন সত্যতার জন্য যুক্তিবিদ্যার উপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে, যৌক্তিক পদ্ধতি দার্শনিক সমাধানের উপর নির্ভরশীল।৬. যুক্তিবিদ্যা প্রক্রিয়ার প্রতি যত্নশীল। অন্যদিকে, দর্শন সিদ্ধান্তের প্রতি যত্নশীল। এইখানে দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যার কথা এসেছে তাই বুঝার সুবিধার্থে এইটুকু তুলে ধরলাম।
গ্রিকএবং গ্রিস শব্দ দুটি যথাক্রমে জাতি ও দেশ। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠে ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে এবং ভৌগােলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে গ্রিক সভ্যতার সাথে দুইটি সংস্কৃতির নাম জড়িয়ে আছে, একটি ‘হেলেনিক' (Hellenic) এবং অন্যটি হেলেনিস্টিক (Hellenistic), গ্রিসকে হেলেনীয় সভ্যতার দেশ বলা হয়। গ্রিসের প্রধান শহর এথেন্সে শুরু থেকেই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে তাকে বলা হয়ে থাকে হেলেনিক সংস্কৃতি, গ্রিস উপদ্বীপ ছিল এই সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ অব্দ পর্যন্ত হেলেনিক সভ্যতা টিকে ছিল, পাশাপাশি এই সময় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিক সংস্কৃতি এবং অগ্রিক সংস্কৃতির মিশ্রণের মাধ্যমে আরেক নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয় এবং ইতিহাসে এই সংস্কৃতির পরিচয় হয় হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি নামে।প্রাচীন গ্রিস হচ্ছে গ্রিস ইতিহাসের অন্তর্গত প্রাচীন সভ্যতা যা প্রাচীন যুগ খ্রিস্টপূর্ব ৮ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে শুরু হয় এবং ধ্রুপদি সভ্যতা আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিরাজ করেছে এবং এরপর পরই কালটি হচ্ছে প্রারম্ভিক মধ্যযুগ ও বাইজেন্টাইন যুগ।
গ্রিস ইউরোপ এশিয়া এবং আফ্রিকার মিলন স্থলে অবস্থিত, বর্তমানের গ্রিকদের পূর্বপুরুষ হচ্ছেন এক সময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজান্টাইন সম্রাজ্য এবং প্রায় ৪ শতাব্দীর অটোমান সম্রাজ্য। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য অথবা বাইজান্টিয়াম শব্দটি হলো ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মধ্যযুগীয় গ্রিকভাষী রোমানদের মাধ্যমে পরিচালিত সাম্রাজ্যের সাধারণ নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এই সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠে রাজধানী কন্সটান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে, এই সাম্রাজ্যের অপর নাম হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য যদিও পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সম্রাজ্যের পতনের পরবর্তি যুগকে বিবেচনা করলেই কেবল এই নামটি কার্যকারিতা লাভ করে, যখন এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল তখন অনেকেই একে গ্রিকদের সাম্রাজ্য নামেও অভিহিত করতেন, কারণ এই অঞ্চলে গ্রিক আধিপত্যই সবচেয়ে প্রকট রূপ ধারণ করেছিল, একই সাথে সেখানে গ্রিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জনগোষ্ঠী এবং মধ্যযুগীয় গ্রিক প্রথার বিস্তার লাভ করে, এক কথায় সাম্রাজ্যটিকে রোমান সম্রাজ্য নামেও অভিহিত করা যায় এবং এর সম্রাটদেরকে প্রাচীন রোমান সম্রাটদেরই অবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সব কিছু মিলিয়ে গ্রিসের সভ্যতা সমগ্র ইউরোপে এক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা হিসেবে বলা যায়। এই সভ্যতার ইতিহাস অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত ও ছোট খাটো নয় মোটেও, তারপরও দুই লাইনে স্বল্পকথায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি, গ্রিসের ভৌগােলিক পরিবেশ ছিল একটু ভিন্ন ধাঁচের এবং এই অঞ্চলে অনেকগুলাে পাহাড় দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালের মত, ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় দেশটি, এই ছােট দেশগুলাের নামকরণ হয় নগর রাষ্ট্র, তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিল স্পার্টা এবং এথেন্স, স্পার্টা ছিল একটি সামরিক নগর রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনেতারা ছিলেন স্বৈরাচারী, অন্যদিকে প্রতিবেশী এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এথেন্সে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তখন দুইটি সংসদ বিদ্যমান ছিল, গােত্র প্রধানদের নিয়ে গড়া সংসদকে বলা হতো "এরিওপেগাস"ও সাধারণ নাগরিকদের সমিতিকে বলা হতো "একলেসিয়া", এথেন্সে চূড়ান্তভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন পেরিক্লিস এবং পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় আসেন খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে , পাশাপাশি স্পার্টা এবং এথেন্স উভয় দেশ একে অন্যের শত্রু ছিলেন, এথেন্স তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলােকে নিয়ে একটি জোট গঠন করেন, এর নাম হয় ‘ডেলিয়ান লীগ’, অন্যদিকে স্পার্টা তাঁর বন্ধু রাষ্ট্রগুলােকে নিয়ে গঠন করে আরেকটি জোট, এই জোটের নাম হয় পেলােপনেসীয় লীগ, পরবর্তীতে এক সময় এই দুই জোটের মধ্য যুদ্ধ বেঁধে যায়, ইতিহাসে এই যুদ্ধ " পেলােপনেসীয় যুদ্ধ " নামে পরিচিত এবং ৪৬০ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মােট তিনবার যুদ্ধ হয়, শেষ পর্যায়ে এসে এই যুদ্ধে চূড়ান্ত পতন ঘটে এথেন্সের, ৩৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে আসে স্পার্টার অধীনে। এরপর নগররাষ্ট্র থিবস দখল করে নেয় এথেন্স, ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপস থিবস অধিকার করে নেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে দ্বিতীয় ফিলিপসের মৃত্যু হলে আলেকজান্ডার দি গ্ৰেট ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরােহণ করেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যাবিলনে তাঁর মৃত্যু ঘটে ।
"হেলেনিক এবং হেলেনিস্টিক সভ্যতা" ,যদি প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসের দিকে তাকান তাহলে "হেলেনিক" মানুষ এবং " হেলেনিস্টিক " সময়ের
কথা উল্লেখ আছে দেখতে পাবেন, গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে" হেলেন" হলেন জিউস এবং লেডার কন্যা ও স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী। তাঁর ভাইবোনদের নাম হলোঃক্যাস্টর, পলিডিউসিস এবং ক্লিটেমনেসট্রা। পাশাপাশি হেলেন ট্রয়ের হেলেন নামে বিশেষভাবে পরিচিত বা হেলেন অফ ট্রয় নামেও সুপরিচিত, গ্রীক কিংবদন্তীতে গ্রীসের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা এবং ট্রোজান যুদ্ধের বা ট্রয় যুদ্ধের কারণ, সুতরাং আবারো ট্রয়ের যুদ্ধ এবং বুঝতেই পারছেন হেলেনিক সভ্যতার নামটির উৎপত্তির ইতিহাস। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস হেলেনকে নিয়ে স্পার্টা থেকে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই মেনেলাউস যুদ্ধযাত্রা করেন ও ট্রোজান যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে । ট্রোজান যুদ্ধ বা ট্রয়ের যুদ্ধ , তিন হাজার বছরেরও আগেকার কথা, একজন নারীকে উদ্ধার করতে এজিয়ান সাগর পাড়ি দেয় এক হাজার জাহাজ এবং তখনও দুনিয়ার সেরা সুন্দরী হিসেবে তাঁকেই মনে করা হতো, যদিও এই সৌন্দর্যের কারণেই সুখী হতে পারেননি তিনি ও তাঁর জন্যই ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন হাজার হাজার যোদ্ধা, পাশাপাশি ধুলোয় মিশে যায় সুখী এবং সমৃ্দ্ধিশালী একটি জনপদ ট্রয় নগরী এবং সেই তিনিটাই হলেন সবার থেকে আলাদা বিশ্বসুন্দরী হেলেন, মূলত হেলেন শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ "টর্চ" থেকে, তবে গ্রিক ভাষায় হেলেন শব্দের মূল অর্থ "জ্বলন্ত কিছু " । যদিও গ্রীকরা তাঁকে ডাকতেন হেলেন বলে। হেলেন শব্দটি পুরুষবাচক, আবার অনেকে মনে করেন হেলেন নামে কেউ ছিলেনই না, দেবী আফ্রোদিতিই হেলেন নাম নিয়ে মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন, তারপর আশ্রয় নেন স্পার্টার রাজা টিন্ডারাসের প্রাসাদে। স্পার্টার দক্ষিণ পূর্বের থেরেপনিতে হেলেনের মন্দির পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৮৩৩ এবং ১৮৪১ সালে , কারো মন্দির পাওয়া মানে একসময় তাঁকে পূজা করা হতো নিশ্বিত। স্পার্টার মানুষ হেলেনকে দেবী হিসেবেই পুজো করতেন ও দেবতা জিউসকন্যা হিসেবেও হেলেনের একটা আলাদা পরিচয় আছে। হেলেনের মন্দির নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা এই হেলেন ছিলেন উর্বরতা এবং নিরামিষের দেবী, হেলেনের মন্দির যখন আবিষ্কৃত হয়েছে তাহলে ট্রয়ও আছে নিশ্চয়ই, তাহলে ট্রয় নগরীটা কোথায় বিদ্যমান ছিল? গ্রিক ভাষায় ট্রয়কে বলা হয়ে থাকে "ত্রাইয়া বা ইলিয়ন ", এমনকি প্রাচীন গ্রিসের অনেক মহাকাব্যেই ট্রয়ের উপস্থিতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়, মহাকবি হোমারের লিখিত দুই মহাকাব্যের একটি হচ্ছে ইলিয়াড, এই ইলিয়াডের অনেক খানি অংশ জুড়ে আছে এই ট্রয়, তবে হোমারের কাহিনীতে কল্পকাহিনীর পরিমাণ এতো বেশি দেখা মিলে অনেকেই মনে করেন বাস্তবে ট্রয় নামে কোনো নগরের অস্তিত্ব ছিলই না, বরং সম্পূর্ণটা কাল্পনিক । আসলে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই নগরীকে খুঁজে বের করেন " হাইনরিখ স্লাইম্যান " নামে এক জার্মান ব্যবসায়ী। ট্রয়ের তুর্কি নাম ত্রুভা, তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চলের হিসারলিক নামক জায়গায় এর অবস্থান এবং এখানকার হিসারলিক শহরটাই হলো প্রাচীন ট্রয় নগরী, তুরস্কের কানাক্কাল প্রদেশের সমুদ্র সৈকতের কাছে ও আইডা পর্বতের নিচে দার্দানেলিসের দক্ষিণ পশ্চিমেই হিসারলিক শহর, ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের জায়গায় যুক্ত হয় ট্রয়। ইউরোপীয় সাহিত্যের দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র মহান লেখক হোমার, গ্রিক সভ্যতার মূল্যবোধগুলো বই দুটিতে প্রতিফলিত হয়েছে , অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনি এবং লোকউপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে হোমার বীরত্ব, ভাগ্য, সম্মান, আনুগত্য ও ন্যায়বিচারের মতো বিষয়গুলোকে উপজীব্য করেছেন, মহাকাব্য দুটির শৈল্পিক মান এতই উঁচু যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রন্থ দুটি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ও সমাদৃত ।
মহাকবি হোমার খুবই সম্ভবত একজন আইওনিয়ান গ্রিক , আনুমানিক অষ্টম খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনর বা আধুনিক তুরস্ক উপকূলে অথবা সংলগ্ন দ্বীপগুলোর কোনো একটিতে বসবাস করতেন, তবে কিংবদন্তি অনুসারে তিনি অন্ধ ছিলেন এবং নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে চারণ কবি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, মনে করা হয়ে থাকে তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন সেই বিষয়টিকে আড়াল করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে অন্ধ বলা হয়েছে অথবা এও হতে পারে জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
বাস্তবিক অর্থে হোমারের জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই বিশদ ভাবে জানা যায়নি , তাঁর সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই বলে প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, শিল্প এবং তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তাঁকে জানার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন, প্রতিটি শতাব্দীর দর্শন, কবিতা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, উপন্যাস এবং আরো অনেক কিছুতেই বিষয়বস্তু এবং কাঠামো উভয় দিক থেকেই তাঁর রচিত মহাকাব্যের অসাধারণ সাংস্কৃতিক প্রতিফলন ঘটেছে, ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’র বিষয়আশয় ও কাঠামোর প্রতিধ্বনি মিলবে পাশ্চাত্যের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যে, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে বিবরণ মেলে না বা দেখা যায় না।হোমারের উভয় মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ট্রোজান যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধের বীরদের গল্প, কিংবদন্তি অনুসারে এটি হচ্ছে এশিয়া মাইনরের উপকূলে অবস্থিত ট্রয় আর গ্রিসের মানুষের মধ্যকার যুদ্ধ , যদিও গ্রিকরা যুদ্ধটিকে প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা বলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ যথেষ্ট ভাবে পাওয়া যায়নি, হোমারের অস্তিত্বের কয়েক শতাব্দী আগে যুদ্ধটি যদি সত্যিই সংঘটিত হতো তাহলে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণসহ সেই যুদ্ধের কথাও অন্যদের বিবরণ থেকে জানা সম্ভব হতো, মিলত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, এর পরও ট্রোজান যুদ্ধটি ঐতিহাসিক ঘটনা না হলেও এই যুদ্ধের সূত্রে ট্রোজান ও গ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্বন্দ্বসংঘাত লেগেই থাকতো অবশ্যই সেটি কেউ অস্বীকার করেননি। অনুগ্রহ করে পরবর্তী পাতায় দেখুন ।
15
View