Posts

চিন্তা

মানবহিতৈষী সনজীদা খাতুন

March 27, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

64
View



এইসময়ের বাংলাদেশের মানুষের চিন্তাসূত্র মূলত দুই ধারায় বিভক্ত —একটি ধর্ম, অপরটি রাজনীতি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য, সমাজকাঠামোর জড়তা, বিকৃত মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রীয় নীতির অনিশ্চয়তা মানুষকে এই দুই ক্ষেত্রের বাইরে চিন্তা করার সুযোগ কমই দেয়। ফলে জাতিগতভাবে আমরা চরম নিন্দুক ও স্থবির হয়ে উঠছি দিন দিন। 

এমন এক বাস্তবতায় শিল্পী ও গবেষক সনজীদা খাতুন ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি নিজেকে কেবল শিল্পচর্চায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং মানবকল্যাণে তা উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সাংস্কৃতিক অবদান যেমন অসামান্য, তেমনি মৃত্যুর পরেও তিনি মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। 

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সনজীদা খাতুনকে নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, কেউবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। তাঁর আচারিক ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যাঁরা তাঁকে নিয়ে তিক্ত বাক্যবাণ ছুড়ছেন, তাঁদের অস্তিত্ব একদিন মাটির নিচে বিলীন হয়ে যাবে। আর অন্যদিকে, সনজীদা খাতুন থেকে যাবেন—মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণাগারে, যেখানে তাঁর দেহ থেকে নতুন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা শারীরস্থানিক ও শারীরবৃত্তীয় জ্ঞান অর্জন করবেন। এই শিক্ষাই মানবসভ্যতার অগ্রগতির জন্য যুগের পর যুগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। 

কোনো ধার্মিক মেডিকেল শিক্ষার্থী যদি সনজীদা খাতুনকে শিক্ষার উপকরণ হিসেবে পেয়ে প্রাণভরে প্রার্থনা করে সেই নিবেদন কি ওই শিল্পীর মহাকালিক কল্যাণে কাজে আসতে পারে? সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। পারলৌকিক জীবন অ্যানাইলাইসিস করবার সক্ষমতা আমাদের মতো অকৃতি অধমের বোধগম্যতার বাইরে। 

প্রথম আলো জানাচ্ছে, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগে সনজীদা খাতুনের মরদেহ দান করা হয়েছে। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ জানিয়েছেন, ১৯৯৮ সালেই সনজীদা খাতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সে সময় তিনি একটি চুক্তিও করেছিলেন। সেই চুক্তির ভিত্তিতেই তাঁর দেহ আজ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যবহৃত হবে। 

কেন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মানবকঙ্কাল প্রয়োজন হয়?
• মানবদেহের গঠন, হাড়ের বিন্যাস, সংযোগ, আকৃতি ও কার্যকারিতা বোঝার জন্য।
• অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার জন্য সঠিক শারীরস্থানিক জ্ঞান অর্জনের জন্য।
• হাড়ের বিভিন্ন রোগ, যেমন: আর্থ্রাইটিস, ফ্র্যাকচার ও জন্মগত বিকৃতি বোঝার জন্য।
• ফরেনসিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য। 

অপ্রতুল মানবকঙ্কাল চাহিদার কারণে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় কৃত্রিম কঙ্কাল ব্যবহার করতে হয়। তবে বাস্তব কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষা নেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। মানবদেহ দানের এই সংস্কৃতি গড়ে উঠলে কঙ্কাল চুরির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডও হ্রাস পাবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কড়ি ও কোমলের ‘প্রাণ’ কবিতার মতোই সনজীদা খাতুন চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও তিনি বেঁচে থাকবেন —মানবতার কল্যাণে, জ্ঞানের ধারক হয়ে।
"মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।" 

আমরা চাইলে তাঁর জীবন ও সিদ্ধান্তের নিন্দা করতে পারি, তাঁর বিশ্বাস ও জীবনদর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি, কিন্তু আমরা কখনোই তাঁর মতো মানবসভ্যতার কল্যাণে এত বড় আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। এটাই সনজীদা খাতুনের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য। তিনি শুধু শিল্পসাধক ছিলেন না, ছিলেন মানবসাধকও। মৃত্যুর পরেও তিনি মানুষকে আলোকিত করে যাবেন, তাঁর জীবনবাদী মরদেহ দানের মহ্তম শিক্ষাই সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি হয়ে থাকবে। 

লেখক: সাংবাদিক
২৭ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login