Posts

প্রবন্ধ

ইসলামের ইতিহাস প্রথম অংশ

March 28, 2025

Liton Chakma

21
View

১৯/১১/২০২২.
         "(ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রাঃ) এবং সর্বশেষ শেষ স্বাধীন সুলতান খলিফা,হযরত পায়িতাথ আব্দুল হামিদ (রহঃ)"ও ইসলামের ইতিহাস)"
প্রথম অংশ।।
হযরত আবুবকর ( রাঃ) এবং হযরত পায়িতাথ আব্দুল হামিদ (রহঃ) জীবনের কথার শুরুতেই কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে, এই কারণে যে তাতে বুঝতে সুবিধা হয়, পাশাপাশি যে প্রশ্নগুলো সহজ সরল ব্যাখ্যা সাধনের মাধ্যমে আমরা মোটামুটি ভাবে পুরো ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হবো নিঃসন্দেহে। তাছাড়া পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে ইসলামের ইতিহাসের ভূমিকা অগ্ৰগন্য এবং অবিস্মরণীয়। তাই আমি প্রাসঙ্গিক উপস্থাপনার কারণেই এবং সহজতর ও বুঝার সুবিধার্থে প্রশ্নগুলো তুলে ধরছি, ("খোলাফায়ে রাশেদীনের পরিচয় কি? খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবন ও কর্ম এবং সময়কাল কত বছর ছিল? ইসলামের জনক কে? ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জনক কে? )" ইতিহাস হলাে মানবসভ্যতার দর্পণস্বরূপ এবং কোনাে ঘটনার নিরন্তর সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা এবং এর  বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষ, তার পারিপার্শ্বিকতা ও সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ, পরিবর্তন ও পতন,এক কথায় মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানই ইতিহাসের মূল আলােচ্য বিষয়। এ ছাড়া ইতিহাসের মাধ্যমে মানবসভ্যতার প্রধান প্রধান স্তর, সভ্যতার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কথা জানা যায়। পাশাপাশি, ইতিহাস অতীত সম্পর্কে জ্ঞান দান করে, যার অভিজ্ঞতা নিয়ে বর্তমানে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করতে পারি। ‘ইতিহাস' শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ , History, History শব্দটি গ্রীক ও ল্যাটিন শব্দ Historia থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে সত্যানুসন্ধান এবং গবেষণা। ইতিহাসের জনক হেরােডােটাস সর্বপ্রথম তার গবেষণাকর্মের নামকরণে 'Historia' শব্দটি ব্যবহার করেন। সুতরাং ইতিহাস হলাে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিক বিবরণ যা তার অন্তরালের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও অন্তর্ভুক্ত করে।মােটকথা মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকে আজকের এ সুসভ্য জগতে উত্তরণের দীর্ঘপথের সব কর্মকাণ্ডই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। ("ঐতিহাসিক ই এইচ কার তার 'What is History' গ্রন্থে বলেন, “বস্তুত সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে শুরু করে মানুষ এবং তার যাবতীয় চিন্তা, বক্তব্য ও কর্মই হচ্ছে ইতিহাস।”ঐতিহাসিক জনসনের মতে, “যা কিছু ঘটে তাই ইতিহাস, অর্থাৎ অতীতের ঘটনা মাত্রই ইতিহাস।”ঐতিহাসিক আর জি কলিংউডের মতে, “বৈরতত্ত্ব ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় ইতিহাসও এক প্রকার বিশেষ জ্ঞান।” তিনি আরাে বলেন, “ইতিহাস হচ্ছে সফল গবেষণা আর অনুসন্ধান যার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের অতীত কার্যাবলি”)"। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে বলা হয়েছে, ইতিহাস মানবমনের ঐ শাখা যা অতীত ঘটনাবলির চর্চা করে। ঐসব ঘটনাবলি হয় লিখিত থাকে অথবা অন্যভাবে সত্য হিসেবে গৃহীত হয়। এটি অতীতের আনুষ্ঠানিক ঘটনা যা মানুষের কাজ ও বিষয়াবলির সাথে সমপর্যায়যুক্ত এবং বিশেষভাবে বিভিন্ন দেশ ও জাতি গঠিত ও বিকশিত হয়েছে তারই বিবরণ। সুতরাং , অজানা বিষয়কে অনুসন্ধান, গবেষণা ও প্রচেষ্টা দ্বারা আবিষ্কার ও উদঘাটনই হচ্ছে ইতিহাস। ইসলামের ইতিহাস বলতে ইসলাম ধর্মের উদ্ভবের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়কাল পঞ্জী অনুসারে ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী সভ্যতার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে বুঝায়।  অধিকাংশ ঐতিহাসিক, স্বীকার করেন যে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর শুরুতে মক্কা ও মদিনায় ইসলামের সূত্রপাত হয় এবং মুসলিমরা ইসলামকে ঈসা, সুলায়মান, দাউদ, মূসা, ইব্রাহিম, নূহ এবং আদমের মত নবীদের মূল বিশ্বাসের প্রত্যাবর্তন এবং বিশ্বাস করেন যে, আদিকাল থেকেই অর্থাৎ প্রথম মানব আদমের সময় থেকেই ইসলাম ধর্মের প্রচলন । পাশাপাশি এই কথা সর্বজন স্বীকৃত ইসলাম ধর্মের জনক এবং প্রবর্তক, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যিনি মোহাম্মদ এবং মুহম্মদ নামেও পরিচিত , একজন আরবের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামি মতবাদ অনুসারে, তিনি হলেন ঐশ্বরিকভাবে প্রেরিত ইসলামের সর্বশেষ নবী তথা ‘বার্তাবাহক’ ও রাসুল , যার উপর ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আদম, ইব্রাহিম, মূসা, ঈসা (যিশু) এবং অন্যান্য নবিদের মতোই মুহাম্মদ একেশ্বরবাদী শিক্ষা প্রচার করার জন্য প্রেরিত হয়েছেন।  অমুসলিমদের মতে, তিনি ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রবর্তক এবং অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মুহাম্মাদ হলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা এবং তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন, তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল ছিলেন, তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও,সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য, বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সাফল্য মন্ডিত দিক এবং কুরআনের পাশাপাশি তার শিক্ষা এবং অনুশীলনগুলো ইসলামি ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করে।আমরা হেরোডটাসের নাম কমবেশি সকলেই জানি, তাকে বলা হয় ইতিহাসের জনক। তবে ইতিহাসে আরো একজন হেরোডটাস আছেন, তা কি জানা আছে? আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জনক সম্পর্কে, তার নাম হেরোডটাস না হলেও তার কাজ তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘দ্য হেরোডটাস অব দ্য আরব’ খেতাব এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইতিহাস এবং ভূগোল নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে কাজ করেছেন, এবং তাঁকে ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার পুরো নাম আবু আল হাসান আলী ইবনে আল হুসাইন ইবনে আলী আল, মাসুদি যিনি সংক্ষেপে আল মাসুদি নামেই  সুপরিচিত। অনেকেই বলতে পারেন আমি শুধু মাত্র উল্লেখিত দুই জন খলিফার কথা বলে এইসব বিষয় কেন‌ইবা সংযোজিত করছি, ইতিহাস এমন একটি বিষয় আংশিক জানা,তা না জানার সমতুল্য। জানতে হলে পুরোপুরি জানাই শ্রেয়। পাশাপাশি এটি এমন একটি বিষয় এতে লাভ ছাড়া ক্ষতির প্রশ্ন করাই অপ্রাসঙ্গিক এবং অবান্তর। পাশাপাশি আমি উল্লেখিত দুই জন খলিফার জীবনের কথার পাশাপাশি, অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়েও সামনে আনার চেষ্টা করছি।
আল মাসুদি খুব সম্ভবত ৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব, পরিবার ও শিক্ষা- এসব বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যই পাওয়া যায়নি। তবে তার ভ্রমণবিলাসিতার কথা প্রায় সকল ইতিহাসবিদই লিখে গেছেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আল মাসুদি তার যাযাবর জীবনের শুরু করেন এবং মৃত্যুর কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তার এই ভ্রমণ অব্যাহত থাকে। পারস্য, শাম (বর্তমান সিরিয়া), আর্মেনিয়া, আজারবাইজান হয়ে কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ভোলগা অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, ভারত, কানবালু বা বর্তমান মাদাগাস্কার, ওমান, দক্ষিণ আরব, গ্রীক সাম্রাজ্য ও স্পেনে ঘুরে মিশরে গিয়ে শেষ হয় তার এই দীর্ঘ ভ্রমণ। অনেক ইতিহাসবিদ তার ভ্রমণের তালিকায় চীন ও শ্রীলংকাও যোগ করেন। কেননা তাঁর ইতিহাস বিষয়ক লেখায় চীন ও শ্রীলংকা সম্বন্ধে ব্যাপক পরিমাণে তথ্য আছে। আল মাসুদি কেবল একজন অসামান্য ভূগোলবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন চমৎকার লেখকও এবং লেখার আগ্রহও ছিল ভীষণ বৈচিত্র্যময়। বিশেষত বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক লেখায় তিনি একজন পথিকৃৎ হয়ে আছেন। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখা ‘কিতাব আল মুরাজ আল ধাহাব’, যার ইংরেজি অনুবাদ ‘গোল্ডেন মিডোজ’ই একমাত্র অক্ষত অবস্থায় বর্তমানকাল পর্যন্ত টিকে আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই বইটি ছাড়া আল মাসুদির অধিকাংশ লেখাই হারিয়ে গেছে। ভূগোল আর ইতিহাসের বাইরেও তার জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছিল সৃষ্টিতত্ত্ব, আবহাওয়াবিদ্যা, সমুদ্রবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, ইসলামিক শরিয়াহ আর আরব লোকজ সংস্কৃতিকে নিয়ে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, তার জন্মের দেড়শ’ বছর পূর্বে ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া তালাসের যুদ্ধ আল মাসুদি তথা তৎকালীন আরো অনেক পণ্ডিতের জ্ঞানচর্চার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল। সে যুদ্ধে মুসলিমরা চীনা কাগজ প্রস্তুতকারীদের বন্দী করে আরবে নিয়ে এসেছিল এবং কাগজ তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। ফলে আরবে কাগজের প্রচলন শুরু হয় এবং কাগজে ছাপা বইয়ের দাম অনেক কমে যায়। বিশেষ করে বাগদাদে গড়ে ওঠে অসংখ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। আর বইয়ের এমন সহজলভ্যতাই সে সময়ের মুসলিম পণ্ডিতদের জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করে। আল মাসুদির শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে তার জ্ঞানের প্রধান উৎস ছিল, " গ্রীক এবং রোমান ইতিহাস ও বিজ্ঞান এবং তার ভ্রমণ"। তিনি তৎকালীন সমাজে প্রচলিত অনেক কুসংস্কার থেকে নিজেকে সফলভাবে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। প্রচলিত তথ্যের উপর অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন না করে তিনি ভ্রমণের মাধ্যমে প্রামাণিক ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করেন। তখন মুসলিমদের জন্য স্বর্ণযুগ হলেও খ্রিস্টানদের জন্য ছিল ‘ডার্ক এইজ’ বা অন্ধকার যুগ। প্রভাবশালী চার্চই তখন খ্রিস্টানদের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ন্ত্রণ করতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের বিজ্ঞানচর্চা ছিল সম্পূর্ণরূপে চার্চ কেন্দ্রিক। তাদের বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবী একটি বিশাল সমতল প্লেটের মতো যা চারদিক থেকেই জলবেষ্টিত। কিন্তু আল মাসুদি এই ধারণা উড়িয়ে দেন এবং তিনিই পর্যবেক্ষণ দ্বারা পৃথিবী যে গোলাকার সে বিষয়ে নিশ্চিত হন এবং তার মতে পৃথিবী সমতল হলে ভূপৃষ্ঠ সর্বদা জলনিমগ্ন থাকতো। কিন্তু পৃথিবী গোলাকার বলেই সমুদ্রে জাহাজ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়। আল মাসুদি পৃথিবীর সমুদ্র এবং মহাদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণের প্রয়াস চালান।এক্ষেত্রে তিনি গ্রীক প্রথা অনুযায়ী জাপানকে পূর্ব সীমানা এবং পশ্চিমের সীমানা হিসেবে একটি দ্বীপপুঞ্জকে নির্ধারণ করেন এবং সমুদ্রের ব্যাপারে আল মাসুদির ধারণা কিছুটা প্রাচীন ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ , তিনি বিশ্বাস করতেন, পুরো পৃথিবীকে চক্রাকারে ঘিরে আছে একটি মহাসমুদ্র, যা অন্যান্য সকল সাগরের সাথে যুক্ত। তার মতে, আরব সাগর ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম সাগর। তবে আরব ও চীনের মধ্যবর্তী পারস্য সাগর সহ মোট সাতটি সাগরের সীমানা ও দিক নির্ণয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন আল মাসুদি, যা তৎকালীন আরব ব্যবসায়ীদের ভীষণ কাজে আসে।তখনকার ভূগোলবিদদের জন্য একটি বড় সমস্যার নাম ছিল কাস্পিয়ান সাগর। এই কাস্পিয়ান সাগর উত্তর দিকের কোনো সাগরের সাথে যুক্ত নাকি কৃষ্ণ সাগরের সাথে যুক্ত, এ ব্যাপারে তারা দ্বিধান্বিত ছিলেন। ‘দ্য অক্সাস’ বা আমু নদী নিয়েও ছিল সংশয়। এ দু’টি সমস্যার সমাধান করেন আল মাসুদি। তিনি তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, কাস্পিয়ান সাগর কোনোটির সাথেই যুক্ত নয়। অন্যদিকে আমু নদীরও কাস্পিয়ান বা কৃষ্ণ সাগরের সাথে কোনো সংযোগ নেই। বরং আমু পতিত হয়েছে আরব সাগরে। তিনি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ভোলগাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করতেন এবং ভোলগাকে একটি ব্যস্ত ‘ব্যবসায়িক মহাসড়ক’ বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর পরস্পর সংযুক্ত বলে মত প্রকাশ করেন মাসুদি।“পৃথিবীতে এমন কোনো স্থান নেই যা সর্বদা জলনিমগ্ন থাকে, এমন কোনো স্থান নেই সর্বদা ভূমি থাকে। বরং একটি ধ্রুব আবর্তন চক্রাকারে চলতে থাকে যা সদা গতি পরিবর্তনশীল নদীসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভূপৃষ্ঠেরও রয়েছে যৌবন এবং বার্ধক্য, যেমনটি রয়েছে উদ্ভিদ ও জীবের। তবে জীবের বৃদ্ধি একসাথে ঘটতে থাকলেও ভূপৃষ্ঠের যৌবন কিংবা বার্ধক্য চক্র ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চলতে থাকে,”-আল মাসুদি'। একাধিকবার সমুদ্রযাত্রা করা আল মাসুদি সমুদ্রে নাবিকদের প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সমুদ্রের দিক নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং নিরাপদ রুট মানচিত্রে সংযোজন করেন। তিনি নীল নদের প্রকৃত উৎস সম্পর্কিত সমস্যা নিয়েও কাজ করেন। “সিন্ধু উপত্যকার সাথে নীলনদের সংযোগ রয়েছে”-এ সম্বন্ধীয় তত্ত্ব অস্বীকার করেন মাসুদি। তিনি বরং নীল নদের উৎস হিসেবে আবিসিনিয়া উপত্যকার কথা বলেন। অন্যদিকে আল মাসুদি তার সময়ের একজন বিখ্যাত আবহাওয়াবিদও ছিলেন। তিনি ‘হারকেন্দ’ বা বর্তমান বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ুর গমন বিষয়ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। আল মাসুদি পরিবেশ সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি প্রাণ প্রকৃতির সাথে প্রাত্যহিক মানবজীবনের সংযোগ ঘটাবার চেষ্টা করেন এবং নিজের চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনধারা তিনটি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত করে,"পানি, উদ্ভিদ এবং ভূসংস্থান।” এ ব্যাপারে তিনি যুক্তি দেখান যে, কোনো অঞ্চলে পানির পরিমাণ বেশি হলে সেখানে আর্দ্রতা বেশি হয় যা সেখানকার মানুষের মেজাজ হালকা রাখে। অন্যদিকে শুষ্ক অঞ্চলের মানুষ কিছুটা খিটখিটে হয়। আবার জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলের মানুষ কিছুটা হিংস্র প্রকৃতির হতে পারে  এবং মরুভূমির মানুষ বিপরীত প্রকৃতির। তবে মাসুদির মতে, মানুষের বাসস্থান নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় নির্ণায়ক হওয়া উচিত,"পর্বতের নৈকট্য, সাগর বা নদীর উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত উদ্ভিদ"। আরবের যাযাবর বেদুইনদের জীবন সম্পর্কে আল মাসুদির রয়েছে বিচিত্র পর্যবেক্ষণ। তার মতে, শহুরে জীবনের তুলনায় এই যাযাবর জীবনই শ্রেয়। কেননা শহর মানুষের ঘুরে বেড়ানো এবং মুক্ত পরিবেশে বসবাসের ইচ্ছাকে দমন করে ফেলে। পাশাপাশি আরবরা মুক্তভাবে বসবাস করে বলেই তারা শারীরিকভাবে বলবান হয়। তিনি মানুষের আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের উপর আঞ্চলিক প্রভাব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেন এবং তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, উত্তরাঞ্চলে যেখানে সূর্যের তাপমাত্রা কম এবং শীতের আধিক্য বেশি, সেখানকার মানুষজন বদমেজাজি, ঝগড়াটে, ধীর বুদ্ধির, মোটা চামড়া বিশিষ্ট, অধিক মাংসপেশিবহুল, নীল চোখ এবং কোঁকড়ানো লাল চুল বিশিষ্ট হয়। আরো উত্তরে বরফে বসবাসকারী মানুষেরা নিষ্প্রভ এবং বর্বর স্বভাবের হয়। তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন, তা হচ্ছে, এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে বসবাস করলে তার মধ্যে নতুন জাতিসত্ত্বার বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় এবং তিনি তুর্কি থেকে ভারতে গিয়ে বসবাস করা মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করে এ ধারণাটি দেন। "(আল মাসুদি দাবি করেছিলেন, তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জনৈক সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ এর একজন বংশধর। তবে তার এই দাবিতে সমসাময়িক অনেক উচ্চবংশীয় মুসলিম তার উপর ক্ষিপ্ত হন, কেননা আল মাসুদি ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী এবং এজন্যই তার ‘কিতাব আল মুরাজ আল ধাহাভ’ এর মতো অসাধারণ কাজও মুসলিমদের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৮৬১ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ ‘মিডোজ অব গোল্ড’ প্রকাশের পর এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে যে তার অধিকাংশ তথ্যবহুল মূল্যবান কাজই হারিয়ে গেছে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, আল মাসুদি শিয়া ও মুতাজিলি ভাবধারার জীবন ধারণের জন্যই আরবরা তার কাজগুলো গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করেনি।
দুর্ভাগ্যবশত আল মাসুদি সম্পর্কে আমাদের সকলের মধ্যে খুব কমই জানা আছে, অথচ আমরা ইতিহাসের জনক, পদার্থ বিদ্যার জনক থেকে শুরু করে রসায়নের জনক , দর্শনের জনক কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের জনক এবং প্রাসঙ্গিক সকল বিষয়ের জনকের কথা মোটামুটি ভাবে আমাদের জ্ঞানে অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছি। এই থেকে বুঝা যায় এই মহান ইতিহাসবিদ সম্পর্কে খুবই কম চর্চা হয়েছে।   "(আবু আল-হাসান ʿআলী ইবন আল-হুসেন ইবনে ʿআলী আল-মাসʿউদি,জন্ম ৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ, বাগদাদ, মৃত্যু সেপ্টেম্বর ৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ, কায়রো, মিশর), ছিলেন একজন মুসলিম পরিব্রাজক,ইতিহাসবিদ এবং ভূগোলবিদ। তাকে অনেক সময় আরবের হেরোডোটাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়, আল-মাসুদী তার ঐতিহাসিক 'ভূগোল বিশ্বকোষ' -এ তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।  তিনি পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন। পৃথিবীর আকার,আয়তন, গতি ও প্রধান প্রধান বিভাগগুলোর বিবরণ দেন। ভারত মহাসাগর, পারস্য সাগর, আরব সাগরের ঝড়ের অবস্থার কথা তিনি উল্লেখ করেন। ৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভূকম্পন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ ও রচনা করেন, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি মহান এই ব্যক্তিত্বের প্রতি)"। ইসলামের ইতিহাস খুব সহজেই শেষ হবে এটি মনে করা ভ্রান্ত ধারণা হবে, কেননা এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা হচ্ছে, ইসলাম পৃথিবীতে আবির্ভাবের পর থেকে
পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ কিংবা পূর্ব পশ্চিমে যে দেশ‌ই পড়ুক না কেন, পৃথিবীতে এমন কোনো নজির নেই যেখানে ইসলামের সভ্যতা গড়ে উঠেনি। এক সময় এই সভ্যতার আলো পুরো পৃথিবী জুড়ে পৌঁছেছে ও শুধুমাত্র উসমানীয় সাম্রাজ্য পুরো পৃথিবীকে শাসন করেছে দীর্ঘ ৬০০ বছরের‌ও অধিক। আর অন্যান্য সাম্রাজ্যের কথা না হয় বাদই দিলাম। তাই ধৈর্য সহকারে যেমন লিখতে হবে ঠিক তদ্রুপ ধৈর্য সহকারে পড়ার ও আবেদন রইলো। প্রথমেই খোলাফায়ে রাশেদীনের উপর কিছুটা আলোকপাত করছি অতঃপর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় চলে যাবো।খুলাফায়ে রাশেদীন বা সাধারণভাবে রাশেদীন বা রাশিদুন, বলতে ইসলামের প্রথম চারজন খলিফাকে বোঝায়। তাদের খিলাফতকে রাশিদুন খিলাফত বলা হয়। চারজন খলিফা হলেন,"(হযরত আবু বকর (রাঃ) (৬৩২–৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ), হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (৬৩৪–৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ), হযরত উসমান ইবন আফফান (রাঃ)(৬৪৪–৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) ও ʿহযরত আলী ইবন ʾআবী তালিব (রাঃ)(৬৫৬–৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)। এছাড়াও হাসান ইবনে আলীকেও (৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) মাঝেমধ্যে খুলাফায়ে রাশেদীনদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।তাঁরা সকলেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সহচর ও আত্মীয় ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের নেতৃত্ব দেন। তবে মূলত প্রথমেই উল্লেখিত চারজন খলিফার যুগ কিংবা সময়কালকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ বলে অভিহিত করা হয়।এই খোলাফায়ে রাশেদীন যুগের আলোচনাতেই আমরা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর ( রাঃ) কে পেয়ে যাবো।আমি এই যুগকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করবো, কারণ ইসলামের ইতিহাসে এই খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ , কারণ ১১ই  হিজরীর পহেলা রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার দিন ইসলামের নবী মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেন মুহাম্মাদের মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ  ঘটনা যা সংগঠিত হয় ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন তারিখ মদীনায়।এবং উনার মৃত্যুর পরপরই এই যুগের সূচনা পর্ব শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত। বিশ্বনবীর (সা:) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ চার খলিফার শাসনামলকে ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদুনকে বলা হয় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোকিত এবং সুবর্ণ সময়। খোলাফায়ে রাশেদীনের এর শাব্দিক অর্থ  বলতে বোঝায় ,"(ন্যায়পরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সঠিকভাবে পথনির্দেশপ্রাপ্ত খলিফা)" ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক নবী মুহাম্মদের (সা:) পরে ইসলামী বিশ্ব শাসনকারী চারজনকে খোলাফায়ে রাশেদীন বলা হয়। তাঁরা নবী মুহাম্মদের (সা:) সহচর ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর ইসলামের নেতৃত্ব দেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং চার খলিফার সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোকপাত করছি। হযরত আবু বকর (রাঃ), জন্ম ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ এবং মৃত্যু ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ ,নবী মুহাম্মদ (সা) এর একজন প্রধান সাহাবি, ইসলামের প্রথম খলিফা এবং প্রথম মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান তাকে দেয়া হয়। এছাড়া তিনি রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর শ্বশুর ছিলেন রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যুর পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন। নবী মুহাম্মদ (সা:) এর প্রতি অতুলনীয় বিশ্বাসের জন্য তাকে “সিদ্দিক” বা বিশ্বস্ত উপাধি প্রদান করা হয়। তাই তাকে আবু বকর সিদ্দিক নামেও সম্বোধন করা হয়। তরুণ বয়সে আবু বকর একজন বণিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। তিনি আরব ও প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি সম্পদশালী হয়ে উঠেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি তার গোত্রের একজন নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ইয়েমেন থেকে বাণিজ্য শেষে ফেরার পর তিনি নবী মুহাম্মদ (সা:) এর ইসলাম প্রচারের সংবাদ পান। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেকের ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ যুগিয়েছে। আবু বকরের মেয়ে আয়িশার সাথে নবী মুহাম্মদ (সা:) এর বিয়ের ফলে তাদের দুজনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আবু বকর একজন একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নবী মুহাম্মদ (সা:) এর সহযোগিতা করেছেন। তার জীবদ্দশায় আবু বকর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাবুকের যুদ্ধে তিনি তার সমস্ত সম্পদ দান করে দেন। আবু বকরকে বলা হয় ইসলামের ত্রাণকর্তা। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে আবু বকর অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন এই চুক্তির অন্যতম সাক্ষী। নবীজির পরীক্ষিত বন্ধু ছিলেন হজরত আবু বকর। আবু বকর ছিলেন ইসলামের এক জ্বলন্ত নক্ষত্র। আবু বকরের খিলাফত দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। তার খিলাফতকাল দীর্ঘ না হলেও তিনি একজন সফল শাসক ছিলেন। নবী মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যুর পর নবী দাবি করা ব্যক্তিদের তিনি রিদ্দার যুদ্ধে সফলভাবে দমন করেছেন এবং তৎকালীন দুটি পরাশক্তি পারস্য ও বাইজেন্টাইনদের উপর সফল অভিযান পরিচালনা করেছেন, অভিযানের ধারাবাহিকতায় কয়েক দশকে মুসলিম খিলাফত ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের একটিতে পরিণত হয়। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর মারা যান। আয়েশার ঘরে হযরত মুহাম্মদ (স:)এর এর রওজার পাশে তাকে দাফন করা হয়। ইসলামের এই প্রথম খলিফা চির স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায় রয়েছেন।  হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ,জন্ম ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ, ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। তাঁর ব্যক্তিগত নাম ছিল ‘উমর’, ‘ফারুক’ তাঁর উপাধি এবং ইব্ন আল খাত্তাব তাঁর পারিবারিক নাম। তিনি মক্কায় কুরাইশদের এক উচ্চ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি সিরিয়া ও ইরাকে বাণিজ্য প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিতেন।
হযরত উমর দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন। তার খিলাফতকালে, মুসলমানদেরকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরের বিরুদ্ধে অনেকগুলো যুদ্ধকরতে হয়। যার ফলে এসব দেশের ব্যাপক এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসে। যখন ১৭ হিজরীতে মুসলমানদের দ্বারা জেরুজালেম বিজিত হয় , তখন রোমানদের অনুরোধে তিনি সেই শহর পরিদর্শন করেন এবং মুসলমান ও জেরুজালেমের অধিবাসীদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। হযরত উমর (রাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এক চমৎকার প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন।এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান কিছু কৃতিত্ব হচ্ছে, মজলিশে সুরা প্রতিষ্ঠা, যা খলিফাকে পরামর্শ দানকারী একটি পরিষদ।পুরো ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রশাসনের সুবিধার্থে প্রদেশে বিভক্তিকরণ এবং অর্থ বিভাগের প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে স্কুল এবং মসজিদ নির্মাণ।ইসলামী হিজরী বর্ষপঞ্জীর প্রতিষ্ঠা।এই কথা বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে এবং আমরা প্রায়‌ই সবাই জানি , হযরত উমর ফারুক (রাঃ) তাঁর অধীনস্থ লোকদের মঙ্গলচিন্তায় এত বেশী উদ্বিগ্ন থাকতেন যে, তিনি রাতে ছদ্মবেশে মদীনা শহরে বেরিয়ে পড়তেন।  উনার বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে, তিনি বলেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের সময়, “আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা কুকুর না খেতে পেয়ে মারা যায়, তবে তার জন্য আমি উমার আল্লাহ কাছে দায়ী থাকবো।  তিনি যে সম্মান অর্জন করেছেন ,তা তাঁর চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নয়। তাছাড়া তিনি  আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ও ছিলেন এবং ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করা  হয়। উল্লেখ থাকে যে, আমিরুল মুমিনিন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। '(ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়,নামের মিল থাকার কারণে পরবর্তী কালের উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজকে দ্বিতীয় উমর হিসেবে সম্বোধন করা হয়)',  সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নিদের কাছে আবু বকরের পর উমরের অবস্থান। তাঁর  শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুইতৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং উনার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের খ্রিষ্টান রীতি বদলে ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দেন। ৬৪৪ খ্রীস্টাব্দে হযরত উমর (রাঃ) মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় এক পার্সি ভৃত্য অতর্কিতভাবে তাকে ছুরিকাঘাত করে, এবং এর মাধ্যমেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সাড়ে দশ বছর অর্ধপৃথিবী শাসন করেছেন ,৬৩ বছর বয়সে আখেরাতের পথে পাড়িজমান। মদিনায় রওজাতুন্নবীর পাশে হজরত আবু বকরের কবর, তার পাশেই ঘুমিয়ে আছেন অর্ধপৃথিবীর ন্যায়পরায়ন শাসক হজরত ওমর। 
হযরত উসমান ইবন আফ্ফান ,জন্ম-৫৭৭ খিস্টাব্দ-মৃত্যু-৬৫৬ খিস্টাব্দ, ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। খলিফা হিসেবে তিনি চারজন খোলাফায়ে রাশেদিনের একজন। উসমান আস-সাবিকুনাল আওয়ালুনের হলেন, প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন, এছাড়াও"( তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারা‘র একজন এবং সেই ৬ জন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম যাদের উপর মুহাম্মদ (সা:) আমরণ সন্তুষ্ট ছিলেন)" তাঁকে সাধারণত: হযরত উসমান (রা:) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হজরত ওসমান (রা.)-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মানবতার কল্যাণে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গকারী এ সাহাবি সম্পর্কে রাসুল  (সা:) বলেছেন, "(উসমান হলো তাঁদেরই একজন, যাঁরা আল্লাহ ও রাসুলকে বন্ধু ভাবেন এবং আল্লাহ ও রাসুল তাঁদের বন্ধু ভাবেন)"।  ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথমে নিজের মেয়ে হজরত খাদিজা (রা.) গর্ভজাত সন্তান রুকাইয়াকে ,ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। হজরত রুকাইয়ার ইন্তেকালের পর,  তাঁর সহোদরা উম্মে কুলসুমকে হজরত ওসমান (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় ,"( রাসুল (সা.)-এর দুই মেয়েকে বিয়ের কারণে তাঁকে ‘জিননুরাইন’ বলা হয়)"।   উম্মে কুলসুমের ইন্তেকালের পর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার যদি আরো একটি মেয়ে থাকত, তাহলে তাকেও আমি ওসমানের সঙ্গে বিয়ে দিতাম।’ তিনি রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে পীড়িত স্ত্রী রুকাইয়ার সেবায় মদিনায় অবস্থানের কারণে একমাত্র বদর ছাড়া সব যুদ্ধেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে অংশ নেন। "(রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে ওসমান।’ তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর কাতেবে ওহি দলের অন্যতম)"।
বিপুল ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হযরত ওসমান (রা.) মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। "(হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত ওসমান (রা.) মসজিদে নববিতে মাথার নিচে চাদর দিয়ে শুয়ে থাকতেন‌ এবং মানুষ তাঁর পাশে এসে বসত ও তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। মনে হতো তিনি তাদেরই একজন) "। পাশাপাশি"( জুবাইর ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘হযরত ওসমান সারা বছর রোজা রাখতেন এবং সারা রাত নামাজ পড়তেন। রাতের প্রথমার্ধ্বে একটু ঘুমাতেন)"। হযরত ওসমান (রা.) তাঁর শাসনামলের প্রথমদিকে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। তাঁর জনহিতকর কার্যাবলি সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছিল।  তিনি মদিনা শহর রক্ষাবাঁধ ‘মাহরু‘ নির্মাণ করেন। খাল খনন করে কৃষিতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে জনগণের অত্যন্ত প্রিয় খলিফায় পরিণত হন। মসজিদে নববির আধুনিকায়ন করেন তিনি। তাঁর সময় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা মদিনার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন ন্যায় নীতি এবং নিষ্ঠার সাথে । জান্নাতুল বাকীর পিছনে জিউস কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়। হযরত আলী ইবন আবী তালিব ইসলামের চতুর্থ ও শেষ খলিফা । তিনি ছিলেন আবু তালিবের পুত্র। তাঁর মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ । হয়রত আলী কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু বয়স থেকেই তিনি ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের (সা:) সংস্পর্শে লালিত-পালিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) সাথে নামাজ আদায় করতেন। বালকদের মধ্যে তিনি সর্ব প্রথম বালক যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর বয়স ছিল তখন প্রায় ২২ বছর, আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইয়াছরিবে হিজরত করার শেষ রাতে শত্রুদের চোখের সামনে দিয়ে নিরাপদে গৃহত্যাগ করেন এবং যাওয়ার সময় হজরত আলী (রা.) কে আমানতের গচ্ছিত সম্পদ প্রদানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ।  অন্যদিকে শত্রুপক্ষ দেখল, রসুলুল্লাহ (সা.) এর বিছানায় হজরত আলী (রা.) নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছেন। নবীজি (সা.)-এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হয়েছেন,  নবীজি (সা.)-এর মুখে যিনি কোরআন পাক শ্রবণ করেছেন, নবীজি (সা.) এর কাছেই যিনি কুরআন শিক্ষালাভ করেছেন এবং বুঝেছেন যে, তাঁর জ্ঞান-গরিমা অতুলনীয় হওয়ারই কথা এবং "( নবীজি (সা.)নিজেও বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা)"। হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন একজন অকুতোভয় যোদ্ধা এবং   "( বদর যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের জন্য নবী মুহাম্মদ (সা:) তাঁকে “জুলফিকার” নামক তরবারি উপহার দিয়েছিলেন)" । তাছাড়া"(  খাইবারের সুরক্ষিত কামূস দুর্গ জয় করলে মহানবী (সাঃ) তাঁকে “আসাদুল্লাহ” বা আল্লাহর সিংহ উপাধি দেন)"।  তিনি ছিলেন রাসূল (সা:) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা:) এর স্বামী ।  রাসূল (সা:) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেন তখন হযরত আলীকে রাসূল (সা:) এর বিছানায় রেখে যান এবং তিনি সাহসের সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন। হযরত আলী(রাঃ) একজন দুঃসাহসী এবং দক্ষ কৌশলী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের একজন। মসজিদে যাবার সময় আক্রমণকারীর দ্বারা গুরুতর আহত হন। দু’দিন পর এই অমিত সাহসী এবং ধর্মপ্রাণ খলিফা ৪০ হিজরীর ২০ রমজানে পরলোক গমন করেন। নিঃসন্দেহে, হযরত আলী (রাঃ) খেলাফতের পবিত্রতা এবং মর্যাদা রক্ষার খাতিরে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন।  তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সাঃ),  যাঁদেরকে বেহেস্তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। ইসলামের চতুর্থ ও শেষ খলিফা চির স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায় রয়েছেন। এতো গেলো শুধুমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের খলিফাদের নাম পরিচিত। এখন অন্য প্রসঙ্গে আসবো, সেই সময়কার বিচার ব্যবস্থা আইন কানুন কেমন ছিল এবং কেন‌ইবা উক্ত যুগের তাৎপর্য মন্ডিত দিক ইসলামের ইতিহাসে এতো গুরুত্বপূর্ণ? খোলাফায়ে রাশেদার যুগ ইসলামী ইতিহাসের স্বর্ণালি-বর্ণালি অধ্যায়। উক্ত যুগের "(কর্মপদ্ধতি-আদর্শ ও সামগ্রিক জীবনাখ্যান মানবতার জন্য সর্বোত্তম নমুনা)"। শুধু মাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের জনগণের জন্য  খোলাফায়ে রাশেদীন, খোলাফায়ে রাশেদা কিংবা খোলাফায়ে রাশেদূন যুগ অনন্য নজির নয়, বরঞ্চ যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, উনাদের জন্য ও এটি অনন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত। শুধু মাত্র ইসলামী চিন্তাবিদ গণ এই বিষয়ে মূল্যায়ন করেছেন তাও নয়, বরং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী চিন্তাবিদ যারা আছেন, তাঁরাও এই‌ বিষয়ে গুরুত্ব পূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন।"( মূলত ৬৩২ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে খোলাফায়ে রাশেদার যুগ বলা হয়)"।রাষ্ট্রের মধ্যে আইন, বিচারব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য  বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মূলত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং ধনী-গরিব, দুর্বল-সবল সকলের জন্য বিচার সমান এবং সমতার ভিত্তিতে ফায়সালা করা যেকোনো ধরনের সমস্যা সমাধানের এবং  সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা । উল্লেখ্য থাকে যে," (তৎকালীন ইসলামী বিচারব্যবস্থায় বিচারপ্রাপ্তির জন্য খলিফাকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়,  সেই সময়কার একটি  ঘটনার কথা তুলে ধরি ইতিহাসের পাতা থেকে,  একবার খলিফা আলী (রা.) বর্ম হারিয়ে যাবার পর তা এক ইহুদির কাছে দেখতে পেয়ে বিচারকের দারস্থ হন, তখন বিচারক তাঁকে সাক্ষী পেশ করতে বলেন, তিনি তাঁর পুত্র ও দাসকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করেন,  কিন্তু বিচারক বললেন, পুত্রের সাক্ষী পিতার পক্ষে এবং কৃতদাসের সাক্ষী মনিবের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ফলে বর্মটি অভিযুক্ত ব্যক্তিরই রয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেই ইহুদি এই বলে ইসলাম গ্রহণ করে, যে ধর্মে এমন সুবিচার রয়েছে, তা মিথ্যা ধর্ম হতে পারে না)"।আবু বকরের যুগে বিচারব্যবস্থা, ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকরের যুগে বিচারকের জন্য স্বতন্ত্র ও আলাদা কোনো অবস্থান ছিল না, বরং ফকিহ সাহাবায়ে কেরাম বিচারব্যবস্থার বিষয়টি দেখভাল করতেন এবং মদিনা মুনাওয়ারায় খলিফা নিজেই মানুষের মাঝে বিচার করতেন , আর বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নররাই ছিলেন সেসব অঞ্চলের বিচারক, তাঁরা কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।  উমর (রা.)-এর যুগে বিচারব্যবস্থা, উমর (রা.)-এর যুগে প্রথমবারের মতো মদিনায় কিছু সাহাবিকে বিচারের দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় , তাঁদের মধ্যে জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) ও আবু দারদা (রা.) অন্যতম। এ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চল ও শহরে বিচারক নিয়োগ করা হয়, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), শুরাহবিল ইবনুল হারিস আল-কিনদি ও উবায়দা আল-সালমানিকে কুফার বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়, বিচারব্যবস্থায়  শেষের দুজন দ্যুতিময় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন , পাশাপাশি খোলাফায়ে রাশেদার যুগ ছাড়াও উমাইয়া খেলাফতকালেও তাঁরা মানুষের সেবায় বিচারকাজে নিয়োজিত ছিলেন।
এছাড়া ও  উমর (রা.) সাহাবি উবাদাহ ইবনে উবাদাহ আস-সামিতকে হেমস (আলেপ্পো) ও কনসারাইনের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন এবং এমন কার্যব্যবস্থার মাধ্যমে উমর (রা.) গভর্নরদের থেকে বিচারবিভাগ আলাদা করে নেন, ফলশ্রুতিতে এই কারণে বিচারকের অবস্থান  সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ ছিল এবং তিনি খলিফার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। পাশাপাশি কিছু গভর্নরের জন্য  স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন, তাঁরা নিজস্ব দায়িত্ব পালনের পর বাড়তি সময়ে  এ কাজটুকু করতেন, কিন্তু শত্রুসংলগ্ন প্রদেশগুলোর গভর্নররা সাধারণত এমন করতে পারতেন না,  কারণ তাঁরা সামরিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে সমধিক ব্যস্ত থাকতেন। উমর (রা.) তাঁর গভর্নরদের অসিয়ত করেছিলেন, যেন ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও সৎ-শুদ্ধ লোকদের নির্বাচন করে বিচার বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হয়," (সিয়ারু আলামিন নুবালা, : ১/৪৫৪; রাওদাতুল কুদাত ওয়া তারিকুন নাজাত, পৃষ্ঠা ৮৬)"।ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.) কখনো কখনো বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য আলাদা বিচারক নির্ধারণ করতেন,"(যেমন—কাআব ইবনে সুরকে বসরার বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আবার কখনো গভর্নরদের বিচারের দায়িত্ব দিতেন। আবার যখন কাআব ইবনে সুরকে বিচারকের পদ থেকে বরখাস্ত করেন, তখন বসরার তৎকালীন গভর্নরকে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি বিচার কার্য পরিচালনা করার‌ও আদেশ দেন ঠিক তেমনি,অনুরূপভাবে উসমান (রা.) ইয়ালা ইবনে উমাইয়াকে  সানআর গভর্নর ও বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, (আত-তারিখ, পৃষ্ঠা ১৭৯))"। তবে উসমান (রা.)-এর শাসনকালে বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নররা নিজ দায়িত্বে নিজেদের বিচারক নির্বাচন করতেন এবং তাঁরা তাঁদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন। 
ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) নিজ দায়িত্বে কুফায় বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণত গভর্নরদের পক্ষ থেকে বিচারক নির্ধারণ করা হতো, তবে অনেক বিচারককে আলী (রা.) নিজেই নিয়োগ করেছিলে, (আল-ওলায়া ফিল বুলদান : ০২/৯৩)। খোলাফায়ে রাশেদার যুগে বিচারব্যবস্থার উৎস ,  কোরআন-সুন্নাহ, ইজমা (ঐকমত্য), ইজতিহাদ ও পরামর্শের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, উল্লেখ থাকে যে,"( তাঁদের যুগে সবচেয়ে বেশি ফিকাহতত্ত্ব ও বিধানজ্ঞানসম্পন্ন সাহাবি  ছিলেন আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আয়েশা, মুআজ ইবনে জাবাল, আবু মুসা আশ-আরি, আনাস ইবনে মালিক, আবু হুরাইরা, সালমান আল-ফার্সি, আবু সাইদ খুদরি ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, জায়েদ ইবনে সাবেদ প্রমুখ সাহাবি (রা.), (আলামুল মুআক্কিয়িন : ১/ ১৩))"। খোলাফায়ে রাশেদার যুগে বিচারকরা সব ধরনের বিচারকাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিপূরণ, পারিবারিক বিষয়াদি, আইন-বিধি ও বদলা-প্রতিশোধে ও পারস্পরিক সব রকমের অসুবিধার ও নিষ্পত্তি করতেন এবং বিচারকরা নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিগত মর্যাদাকেন্দ্রিক বিষয়াদির ও বিচার করতেন। কিসাস এবং আইনিবিধি ইত্যাদি খলিফা ও আঞ্চলিক গভর্নররা প্রয়োগ করতেন, তবে এর আগে অবশ্যই অনুমোদন করে নিতে হতো এবং সেই সময়ে হত্যার শাস্তি ব্যতীত অন্যান্য কিসাসের বিচার-বিধান ও বাস্তবায়নের অধিকার পেতেন। পাশাপাশি এটি উল্লেখ করছি, যদি সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে যায়, বিচারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিশেষ কোনো স্থান নির্ধারিত ছিল না ,বরং বিচারক নিজের বাড়িতে কিংবা মসজিদে বিচারকার্য বাস্তবায়ন করতেন , কিন্তু অনেকেই কিংবা শুনলে অবাক হবেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তখন বিচারের কাজ ছিল খুবই কম,  কালেভদ্রে দু-চারটি বিচার করতে হতো। ফলে বিচার ও আইনি ফলাফল বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ করতে হতো না। স্বাভাবিকভাবে স্মৃতিতে গেঁথে যেত সবার। বিচারক অভিযুক্তকে তিরস্কার ও তদন্তের জন্য কারাবরণের দণ্ডাদেশ দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন এবং উমর, উসমান ও আলী (রা.) ও এমনটিই করেছিলেন। তখন ইসলামী সরকার প্রধান শহরগুলোতে কারাগার স্থাপন করা হয়েছিল, পাশাপাশি মসজিদের বাইরে প্রতিশোধ কিসাস বাস্তবায়ন করা হতো,"(আল-ইস্তিয়াব : ২/১০৬; আল-ইসাবা : ২/১৩)"। ইসলামী শিষ্টাচার ও চেতনা-আদর্শের উপর ভিত্তি করে তখনকার মানুষের অবস্থান ছিল,  তারা ব্যক্তিত্ব-মাধুর্যের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে লেনদেন করতেন, ফলে ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও দ্বন্দ্বের পরিমাণ খুবই নগণ্য ছিল এবং বিচারকদের ব্যস্ততা ও দায়িত্ব স্বল্প ছিল। আবারো প্রথম খলিফার কাছে আসি,"( প্রথম খলিফা আবু বকর যখন খিলাফত গ্রহণ করলেন, তখন আবু উবায়দা (রা.) তাঁকে বললেন, ‘আমি বাইতুল মালের দিকটি লক্ষ রাখব।’ উমর (রা.) বললেন, ‘আমি বিচারব্যবস্থা দেখভাল করব।’ পরে দেখা গেল, এক বছর পার হয়ে গেলেও উমর(রাঃ)কাছে কেউ কোনো বিচার কিংবা অভিযোগ নিয়ে আসেনি, আবু ওয়ালে শাকিক ইবনে সালমা বলেন, ‘আমি কুফার বিচারক সালমান ইবনে রাবিআর কাছে চল্লিশ দিন গিয়েছি,  কিন্তু তাঁর কাছে কোনো অভিযোগকারী বা অপরাধীকে দেখিনি।’ একটি বিষয় উল্লেখ করি, সালমান ইবনে রাবিআ ছিলেন ইসলামী শাসনামলে কুফার প্রথম বিচারক। (তারিখে তাবারি : ৩/৪২৬; উসদুল গাবাহ : ২/২২৭))"। উল্লেখ্য থাকে যে,তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্র জনগণকে তাদের পাপ স্বীকার করতে উৎসাহী করত না,  তবে তাদের জন্য তাওবা, পাপ কাজ ছেড়ে দেওয়ার অনুশোচনা ও অনুতাপের তড়প তৈরি করে দিত এবং আল্লাহভীতি ও পরকালের শাস্তির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্ৰহন করতো, এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করি,( শুরাহাবিল ইবনে সামাত (৪০ হি) গভর্নরের দায়িত্ব লাভ করেন, তখন লোকদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘হে লোকেরা, তোমরা যে ভূমিতে রয়েছ, তাতে মদের সয়লাব রয়েছে,  গুনাহের কাজে লিপ্ত হতে অনেক নারী রয়েছে, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো অপরাধ করো, তবে সে যেন আমাদের কাছে আসে (স্বীকার করে) এবং তখন তার ওপর আইন প্রয়োগ করা হবে ও আইনের মাধ্যমেই তাকে পবিত্র করা হবে),এই  খবর যখন উমর (রা.)-এর কাছে পৌঁছে, তখন তিনি শুরাহাবিলের উদ্দেশে লেখেন, ‘মানুষ নিজের অপরাধকে আড়ালে  রাখছে, আর তুমি তা প্রকাশ করে দেবে, আমি তোমাকে সেই অধিকার দিইনি"। তবে  সেই সময়ে মানুষ যখন কোনো বিষয় বিচার বিভাগকে অবহিত করত, তখন রাষ্ট্র কোনো ধরনের পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় না নিয়ে বিচারকার্য বাস্তবায়ন করত।আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি,  "(বর্ণিত আছে যে, ইয়েমেনের হামদানের এক মহিলা অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর চাচা মদিনায় আগমন করেন এবং এরপর বিষয়টি খলিফা উমর (রা.)-এর কাছে তুলে ধরেন, তখন উমর (রা.) তাঁকে বলেছিলেন, ‘তার এ অপরাধ আর বেশি প্রচার করলে আপনাকে আমি শাস্তি দেব। কোনো ভালো পাত্র পেলে, আপনার ভাতিজির বিয়ের ব্যবস্থা করুন।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ৫/১৯৭; আল-মুগনি : ৭/৪৬৮))"। খোলাফায়ে রাশেদার সময়ে বিচার ও আইন-নীতির কার্যক্রম সাধারণ মানুষের মতো ছিলো, এমনকি তাঁরা বিচারকদের মর্যাদা অধিক পরিমাণে জোরদার ও সুসংহত করেছেন, পাশাপাশি তাঁরা শাসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে পুরোপুরি সাম্য-নীতি রক্ষা করে ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের কাজ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে শাসক ও সাধারণের মধ্যে মতানৈক্য ও সাময়িক বৈপরীত্যের বহু উদাহরণ রয়েছে। একবার, বিশিষ্ট সাহাবি উবাই ইবনে কাআব (রা.) খলিফা উমর (রা.)-এর সঙ্গে একটি বাগানের মালিকানা নিয়ে মতানৈক্য র ব্যাপারে প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন, তখন তাঁরা জায়েদ ইবনে সাবেদ (রা.)-কে তাঁদের মধ্যে বিচারক নির্ধারণ করেন, এরপর দুজনই তাঁর বাড়িতে আসেন, অতঃপর উমর (রা.) তাঁকে বলেন, ‘আমরা আপনার কাছে এসেছি, আপনি আমাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেওয়ার জন্য।’ জায়েদ (রা.)-এর বাড়িতেই বিচারকাজ করাশুরু হয়, তখন তিনি উমর (রা.)-কে তাঁর বিছানায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! এখানে বসলে ভালো হয়।’ তখন উমর (রা.) বললেন, ‘প্রথমত আপনার কাছে বিচার চাইতে এলাম, আপনি আমাকে আমার প্রতিপক্ষের সঙ্গে বসতে দিন।’
এরপর দুজনই জায়েদ (রা.)-এর সামনে বসলেন। তখন উবাই ইবনে কাআব (রা.) মালিকানা দাবি করে কথা বললেন, কিন্তু উমর (রা.) অস্বীকার করলেন, তখন জায়েদ ইবনে সাবেদ (রা.) উবাই ইবনে কাআব (রা.)-কে বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিনকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন, আমি আমিরুল মুমিনিন ছাড়া আর কারো জন্য এই অনুগ্রহ চাইনি।’ তখন উমর (রা.) কসম দিয়ে বললেন, ‘জায়েদের বিচার গ্রহণ করা হবে না, যতক্ষণ সে উমর ও একজন সাধারণ মুসলমানের মধ্যে সমানভাবে বিচার না করে।’ উল্লেখিত ঘটনার মতো অনেক ধরনের অসংখ্য উদাহরণ খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে উদাহরণস্বরূপ এবং তথ্য সহকারে বিদ্যমান আছে,  এই জন্যই বাস্তবিক পক্ষে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের‌ ভূমিকা খুবই মহিমান্বিত এবং বিশ্লেষণধর্মী উদাহরণীয়। আলোচনার এই পর্যায়ে এসে আমি ইসলামের ইতিহাসে সর্বশেষ খলিফা উসমানীয় সাম্রাজ্যের বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান পায়িতাথ আব্দুল হামিদ খান (রহঃ), কিংবা সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ খান (রহঃ),  উনার উপর কিছুটা আলোকপাত করছি,  অটোম্যান সম্রাজ্যের শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন আব্দুল হামিদ খান,  তিনি ছিলেন যেমন বিচক্ষণ, তেমন কৌশলী এবং তেমনই আপসহীন এক নেতা। তাঁর সময়ে  উসমানীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রচুর সংস্কারের কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন তুর্কিদের তথা উসমানিয়দের ইউরোপ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্ৰহন করে এবং পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে ও  সমৃদ্ধি অর্জন করা প্রয়োজন, সে লক্ষ্যেই তিনি মেধাবী তুর্কিদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাঠান এবং তাঁর সময়ে সরকারের অনেক বড় বড় আমলা এবং কূটনীতিবিদদের আরও বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় অনুভব করেন, সেই  লক্ষ্যে তিনি সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ইউরোপ পাঠানো শুরু করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে যে  ওই শিক্ষার্থী ,কূটনীতিবিদ‌ এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটা অংশ তখন অটোম্যান সম্রাজ্যকে আধুনিকীকরণ, ওসমানীয়দের অধীনে বসবাসকারী বিদেশী, সংখ্যালঘু এবং বিধর্মীদের আরও বেশি সুযোগ সুবিধা দেয়া এবং গণতন্ত্র নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোপন একটা সংগঠন তৈরি করেন পাশাপাশি তাদের নেতৃত্বে মূলত ছিলেন কুর্দি, আলবেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, আরব এবং বলকান বংশোদ্ভূত লোকজন। তারা গোপনে সালতানাতের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা তো করেন‌ই এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে বড় একটা সংগঠন গড়ে উঠে। অপরদিকে,  ফ্রান্স এবং ব্রিটেন অটোমান সম্রাজ্যকে ভেঙ্গে, নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারার বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্ৰহন করেন, পাশাপাশি অন্যদিকে সরকারের মধ্য থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সালতানাত বিরোধী একটি গ্রুপ। সুলতান এ অবস্থা বুঝতে পারেন  এবং বিদেশে থাকা ‘তরুণ তুর্কি’ নামে এই গোপন সংগঠনটির অনেক সদস্যকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং সরকারের বিভিন্ন পদে তাদেরকে স্থান দেন ও তাঁর নিজের নজরদারিতে রাখেন। কিন্তু তাদের একটা অংশ ধারাবাহিক ভাবে গোপনে সংগঠিত হওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে, পাশাপাশি পূর্বের চেয়ে আরো বেশি সুসংগঠিত হয়। একটি কথা প্রায়‌ই এবং প্রায়শই উচ্চারিত হয়, ইসলামের বিরুদ্ধ শক্তি যতনা ইসলামের ইতিহাসে পতনের প্রেক্ষাপটে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অধিকতর উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে ঘরের শত্রু। এটি বলছি এই কারণে পরবর্তী আলোচনাতে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন আশা করি। সরকারের মধ্যের বড় বড় পাশা, উজির, নাজিরসহ অনেকেই তাদের দলে যোগ দেন এবং সুলতানকে আরও বেশি ডেমক্র্যাসি নিয়ে আসার জন্য চাপ দিতে থাকেন, পাশাপাশি দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় তারা অটোম্যান তুর্কি, ফরাসি, ইতালি, ইংরেজি ভাষায় পত্রিকা চালু শুরু করেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া, ইতালি, গ্রীস, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, আমেরিকা এবং সাইপ্রাস সহ প্রায় ১৩ টি দেশে ১৫২টিরও বেশি সংবাদপত্র বের করেন এই তরুণ তুর্কিরা, তাদের উদ্দেশ্য একটিই,  তাদের পক্ষে দেশে এবং বিদেশে জনমত গড়ে তোলা।  অনেক বুদ্ধিজীবীর লেখা তখন এসব পত্রিকায় ছাপানো হয় এবং সেই সব লেখা এই "তরুণ তুর্কি"দের পক্ষে জনমত গড়তে প্রচুর প্রোপাগান্ডা চালায়, জন তুর্ক বা ইয়ং তুর্ক নামে পরিচিত এই গ্রুপটি পরবর্তীতে ইত্তিহাদ এবং তেরাক্কি নামে একটু নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে।  আর এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি নামক দলটিতে সালতানাতের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজন যোগ দেয়ার পাশাপাশি , ইসলামিক চিন্তাধারার লোকজন,  তুর্কি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, এবং অটোম্যানিজমে বিশ্বাসী লোকজনও যোগ দান করেন। মোট কথা  ইসলামি, তুর্কি, এবং অটোম্যান মতবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন এরকম অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও যোগ দেন এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি দলে। তাছাড়া সুলতানের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য একটি সংসদ গঠনের প্রস্তাব দেন, তাদেরকে তখন সরাসরি সাপোর্ট দেয় সরকারের মধ্য থেকে অনেক বড় বড় পদের ব্যক্তিবর্গ এবং সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুলতান তাদের চাহিদা মোতাবেক একটি পার্লামেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং পার্লামেন্টের সদ্যসদ্যের কিছু ক্ষমতাও দেন, এইভাবে চালু হয় সংসদীয় সালতানাত ব্যাবস্থা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অকেজো হয়ে পরে, এই পার্লামেন্ট। কারণ, পার্লামেন্ট সদ্যসদ্যের মধ্যে যে যেই জাতি এবং মতাদর্শের সে তার নিজস্ব জাতি এবং মতাদর্শের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন , এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে কোনো আইন পাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।  এমতাবস্থায়, সুলতান পার্লামেন্টকে স্থগিত করেন। তখন এই ইত্তেহাদ তেরাক্কি গ্রুপটি সেনাবাহিনীর একটি অংশকে ব্যবহার করে বহুবার সুলতান আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে সামরিক এবং গণ অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা শুরু করেন, শেষ পর্যন্ত ১৯০৯ সালের ২৭শে এপ্রিল অটোম্যানদের শেষ স্বাধীন সুলতান আব্দুল হামিদ খাঁনকে জোড় করে ক্ষমতাচ্যুত করেন,  এই ইত্তিহাদ তেরাক্কি নামক সংগঠনটি। 
প্রকৃতপক্ষে তখনই সমাধি ঘটে সেই বিশাল ওসমানীয় সম্রাজ্যের ,অস্ত যায় দুনিয়ার বুকের সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটির।  এমতাবস্থা দাঁড়ায় মুসলমানদের রক্ষার জন্য এবং তাদের পক্ষে হুঙ্কার ছাড়ার সেই শক্তিশালী বাঘটিকে খাঁচার মধ্যে বন্দি করা হয় শেষমেষ। পাশাপাশি শেষ হয়ে যায় ৬০০ বছরের সেই দাপুটে সম্রাজ,  যা দাঁড়িয়ে ছিল, '(আদালত, ন্যাবিচার, এবং সহমর্মিতার উপর ভিত্তি করে। যার ভয়ে ইউরোপে বাঘে মহিষে এক ঘাঁটে জল খেত,যেই উসমানীয় সম্রাজ্যের হুঙ্কারে ইউরোপে রাতে গানের আসর, রঙ্গলিলা বন্ধ করে দেয়া হতো।  যেই উসমানীয় সম্রাজের নাম নিলে ইন্দোনেশিয়া থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত মুসলমানদের শত্রুরা থরথর করে কাঁপতো, সেই উসমানীয় সম্রাজ্য ধসে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই।  সুলতান আব্দুল হামিদকে ইস্তান্বুল থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় সেলানিকে।এই সেলানিকেই ছিল ইত্তেহাদ-তেরাক্কির মূল অফিস। ক্ষমতাচ্যুত সুলতান আব্দুল হামিদ তাদের সাথে আপস না করলে এই সেলানিক শহরে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয় এবং সালতানাতে বসানো হয় আব্দুল হামিদের ভাই সুলতান মেহমেত রেশাত বা পঞ্চম মেহমেতকে। সুলতান রেশাত ছিলেন মূলত এই ইত্তিহাদ-তেরাক্কিদের হাতের পুতুল।ইত্তিহাদ-তেরাক্কিরা তাদের যেকোনো স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য এই নামকাওয়াস্তের সুলতানকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। আব্দুল হামিদের খমতাচ্যুতির পরে উসমানীয় সৈন্য এবং সালতানাতের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক দ্বিধা বিভক্তি দেখা দেয়, ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রীস, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং মন্টেনিগ্রো অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ চলে ৮ই অক্টোবর ১৯১২ থেকে ৩০শে মে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার অটোম্যান সৈন্য নিহত হয় এবং বলকান অঞ্চলের প্রায় সবটুকুই ওসমানিয়দের হাতছাড়া হয়ে যায়। অপরদিকে, সুলতানের পদচ্যুতি ও গৃহবন্দি, অন্যদিকে বিশাল এক অঞ্চল হাতছাড়া হওয়া এবং বিপুল পরিমাণে সৈন্যের মৃত্যু উসমানীয়দেরকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। আব্দুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুতির খুশিতে আত্মহারা ইত্তিহাদ তেরাক্কির নেতারা তখনও বুঝতে পারেননি,তাদের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। এই সংগঠনটির মূল নেতাদের মধ্যে ছিলেন অনেক পরিচিত মুখ। যেমন  মোস্তফা কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা, ইসমেত ইনোনু, জালাল বায়ার এবং কাযিম কারাবেকিরসহ আরও প্রমুখ। এছাড়াও তুরস্কের জাতীয় কবি মেহমেত আকিফ এরসোয়ও ছিলেন তাদের মধ্যে,  যিনি লিখেছেন বর্তমান তুরস্কের জাতীয় সঙ্গীত। আধুনিক তুরস্কে ইসলামি পুনর্জাগরনের পথিকৃৎ হিসেবে যাকে দেখা হয় সেই বদিউজ্জামান সাইদ নুরসিও ছিলেন ইত্তেহাদ তেরাক্কিদের পক্ষে, আরও ছিলেন আধুনিক তুরস্কের বিখ্যাত লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী জিয়া গোকআল্প।  এই ইত্তিহাদ তেরাক্কিরাই সুলতানকে না জানিয়ে জার্মানির সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের চুক্তি করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয়েভাবে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ৮ অক্টোবর ১৯১৮ সালে এই দলটি নিজেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এবং ক্ষমতাধর পাশাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কিন্তু ততদিনে যে ক্ষতি উসমানীয় সম্রাজ্যের তথা সারা মুসলিম বিশ্বের হয়েছে তা  কাটিয়ে ওঠা আর সম্ভবপর  হয়নি। সংক্ষিপ্ত ভাবে দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ তথা,উসমানীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ স্বাধীন ক্ষমতাধর সুলতান এবং মুসলিম বিশ্বের খলিফা সম্পর্কে আলোকপাত করছি। সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ হলেন ( ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৪২ – ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮)  উসমানীয় সাম্রাজ্যের ৩৪তম সুলতান এবং এমন‌ই একজন উম্মাহর দরদি মুসলিম বিশ্বের খলিফা ,যাকে ইহুদিরা বায়তুল মুকাদ্দাস হস্তান্তরের জন্য ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি মুসলিম বিশ্বের একচুল মাটি ছাড়তেও রাজি হননি।রাজত্বকাল, ৩১ আগস্ট ১৮৭৬ - ২৭ এপ্রিল ১৯০৯ পর্যন্ত এবং রাজ্যাভিষেক,৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ সালে। তাঁর পূর্বসূরি ছিলেন ,পঞ্চম মুরাদ। তাঁর পিতা
সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ এবং মাতা,  জন্মদায়িনী মাঃতিরিমুজগান কাদিন ও
পালিতা মাঃ রাহিমে পেরেস্তু কাদিন। একটি কথা খুবই প্রচলিত “ যখন দেখবে শত্রুরা তোমার কোনো কর্মের প্রশংসা করছে, হোকনা তা মন্দ, বুঝবে তোমার কাজে তাদের কোন স্বার্থরক্ষা আছে,  আর যখন তোমার কোন ভাল কাজেরও নিন্দা করবে, বুঝবে এতে তাদের কোন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।” সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে শত্রুদের আপবাদ ও মিথ্যাচারের যে তাণ্ডব, তা থেকেই বুঝা যায়, তাঁর পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে ‘আপনজনেরা’ না বুঝলেও শত্রুরা ঠিকিই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।  প্রখ্যাত ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী আর্লন্ড টয়েনবি লিখেন,“ সুলতান আব্দুল হামিদের ইসলামি রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের মুসলমানদের এক পতাকার নিচে একত্রিত করা এবং নিঃসন্দেহে যা ছিল মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ঐপনিবেশিক শক্তিগুলোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক পাল্টা শক্তিশালী প্রতিরোধী পদক্ষেপ।” তাকে নিয়ে ইউরোপিয়রা এত বেশি পরিমাণে লিখেছেন যে, সমকালীন ইতিহাসে তো বটেই, সুদীর্ঘ সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে অন্য কোন মুসলিম শাসককে নিয়ে তারা ততটা লেখা হয়নি। শুরু থেকে কারো ধারণা ছিল না, সম্ভবত তিনিও ভাবেননি যে তিনি কখনো খলিফা হবেন। কারণ পিতার জীবদ্দশায় প্রায় ১৮ বছর তিনি ছিলেন মসনদের তৃতীয় উত্তরাধিকারী। কিন্তু ১৮৬১ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে পিতা সুলতান আব্দুল মাজিদ মৃত্যুবরণ করেন,  খলিফা হন ৩১ বছর বয়সি চাচা আব্দুল আজিজ। কিন্তু ১৮৭৬ সালে ৪৬ বছর বয়সে তিনিও নিহত হন। এরপর মসনদে বসেন তারই বড় ভাই ৫ম মুরাদ, যিনি তার থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন। উল্লেখ থাকে যে,  চাচাকে হত্যাকারীদের সঙ্গে ৫ম মুরাদেরও যোগসূত্র ছিল, এবং তিনি ছিলেন কুচক্রী ইহুদিদের বিশ্ব সংগঠন ফ্রিমেসনস্ এর সদস্য। আসলে মূলত ৫ম মুরাদকে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ছিল এবং তা হলো কানুনে আসাসি বা বুনিয়াদি সংবিধান ঘোষণার মাধ্যমে খিলাফতকে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা। যাতে খলিফা হবে একটি আলংকারিক পদ। নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে পাশা ও উজিরদের হাতে। কিন্তু মসনদে আরোহণের পরপরই তার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ ফুটে উঠে ও সব ধরণের প্রচেষ্টা ও চিকিৎসা সত্ত্বেও যখন তিনি পুরোপুরিভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন, এরপর ডাক আসে ৩৪ বছর বয়সী যুবরাজ আব্দুল হামিদের।মসনদে খিলাফতের চারপাশে তখন ইহুদিবাদী ফ্রি-মেসন ও নব্য তুর্কিদের একক প্রাধান্য। বাধ্য হয়ে সেই কুচক্রীদের শর্ত মেনেই তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং খেলাফত বিরোধীচক্রের মূল হোতা ইংরেজ এবং ইহুদিদের দালাল মিদহাত পাশাকে প্রধান উজির বানাতে বাধ্য হন। তাঁদের শর্তমতে তিনি কানুনে আসাসী বা বুনিয়াদি সংবিধান ঘোষণা করেন  , এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খিলাফত ব্যবস্থা তখন মূলত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়।।  তিনি ছিলেন সুলতান আব্দুল মাজিদের ত্রিশজন সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ও ৩৪তম উসমানি সুলতান ।দশ বছর বয়সে মাকে হারান এবং  সৎ মায়ের কাছেই লালিত পালিত হন, অবশ্য তিনিও নিঃসন্তান ছিলেন এবং অত্যন্ত স্নেহ মমতায় তাকে লালন পালন করেন। সৎ মাতার ধর্মীয় জীবনাচার ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ অবস্থান তার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে, খলিফা হওয়ার পর তিনি তাঁকে রাজমাতা ঘোষণা করেন। ছোট থেকেই তিনি অত্যন্ত গম্ভীর ও স্পর্শকাতর প্রকৃতির বলে পরিচিতি। রাজপ্রাসাদের অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর হাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তাদের নিকট তিনি আরবি ফারসি ও ইতিহাসের পাঠগ্রহণ করেন এবং পাশাপাশি সাহিত্যও অধ্যয়ন করেন। এসময় তিনি অশ্বারোহণ, তলোয়ার চালনা ও অন্যান্য অস্ত্রচালনায় দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি কথা কম বলতেন এবং অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও চারপাশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। শৈশব থেকেই নিয়মিত পত্রিকা ও বিশ্বরাজনীতির খবরাখবর রাখা তার অভ্যাস ছিল। তিনি বিশ্ব রাজনীতিতে খেলাফতে উসমানিয়ার অবস্থান বুঝার চেষ্টা করতেন। শৈশব থেকেই আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে রেখেছিল। তা হলো তার সুপরিমিত অর্থনৈতিক বোধ ও অপচয় একদম পছন্দ করতেন না, উক্তসময়ে তিনি ছিলেন তৎকালীন উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী যুবরাজ, তাঁর এই অর্থব্যবস্থাপনাগুণ খেলাফতে জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর প্রমাণিত হয় পরবর্তীতে।  এমন একটা সময় ছিল, মুসলিম বিশ্বের খিলাফত ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। রাসুল (সঃ)-এর ইন্তেকালের পর সর্বসম্মতিক্রমে মুসলিমদের সর্বপ্রথম খলিফা হন , হযরত আবুবক (রাঃ),শুরু হয় খিলাফতের যাত্রা, পাশাপাশি এটি একটি বংশগত অবস্থান হয়ে ওঠে, প্রথমে উমাইয়া পরিবার এবং পরে আব্বাসীয়রা খেলাফতে অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, উসমানীয় সাম্রাজ্য ১৪শ শতাব্দী থেকে শুরু করে ২০শ শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেন, এই সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজীর পিতা আরতুগ্রুল গাজী। ১২৯৯ সালে অঘুজ তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান এর পিতা আরতুগ্রুল গাজী উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার দ্বায়িত্ব পান সেলযুক সাম্রাজ্য কর্তৃক, প্রথম দিকে রোমের সেলযুক সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও রোমের সেলজুক সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন  এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ  সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন, পাশাপাশি তিনি সেলজুক রাজবংশের জামাতাও ছিলেন , এবং প্রথম উসমানের মাতা হালিমে সুলতান ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের শাহজাদী। প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জয়ের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য বহুমহাদেশীয় সাম্রাজ্য হয়ে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয় করার মাধ্যমে উসমানীয়রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে, পরবর্তীতে১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চল সমূহ নিয়ে বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও আফ্রিকার শৃঙ্গ জুড়ে , মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলসহবিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক‌ এবং বহুভাষিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।  ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে উসমানীয় সাম্রাজ্যে ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি অনুগত রাজ্য ছিল, পাশাপাশি, এসবের কিছু পরে সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেয়া হয় এবং বাকিগুলোকে কিছুমাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্য সুদীর্ঘ ছয়শত বছরেরও বেশি ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়, এরপর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের উদ্ভব হয়, পাশাপাশি বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪৯টি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।উসমানীয় সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের নাম অনুসারে উসমানীয় সাম্রাজ্য, একইভাবে রাজবংশকে উসমানীয় রাজবংশ বলা হয়, যা তুর্কি ভাষায় সাম্রাজ্যকে বলা হত দেভলেতি আলিয়া উসমানিয়া  বা উসমানলি দেভলেতি।আধুনিক তুর্কি ভাষায় উসমানলি ইম্পারাতুরলুগু বা উসমানলি দেভলেতি বলা হয়।
পাশ্চাত্যে "উসমানীয় সাম্রাজ্য" ও "টার্কি" তথা তুরস্ক নাম দুইটির একটি অন্যটির বদলে ব্যবহার হত। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে "টার্কি" শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। প্রজাতন্ত্র গঠিত হওয়ার পর আঙ্কারা ভিত্তিক নতুন সরকার টার্কি শব্দকে সরকারি নাম হিসেবে ব্যবহার শুরু করলে এই দ্বৈতপ্রথার অবসান হয়।প্রবল পরাক্রমশালী উসমানীয় সাম্রাজ্য তথা অটোমান শাসকদের পতন হয়েছিল যেভাবে,
তুরস্কের একজন গোত্রপতির হাত ধরে বহু বছর ধরে যে বিশাল সাম্রাজ্যের জন্ম হয়েছিল, তার পতন হতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক বছর। একের পর এক যুদ্ধ দিয়ে যারা ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ দখল করে নিয়েছিল, একটি মহাযুদ্ধ সেই সাম্রাজ্যকে কয়েক বছরের মধ্যেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিদেশি ভাষায় বা ইংরেজিতে অটোমান সাম্রাজ্য বলে বর্ণনা করা হলেও, তুরস্কের ভাষায় সেই সাম্রাজ্যের নাম উসমানীয় বা ওসমানী সাম্রাজ্য। তার দলের সদস্যদের বলা হতো ওসমানী, তুরস্কের ভাষায় ওথমান। বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার ছোট একটি এলাকা থেকে এই রাজত্বের শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে তা লাখ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ছয়শ বছর ধরে তৈরি হওয়া সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। পরবর্তী দ্বিতীয় অংশ।

Comments

    Please login to post comment. Login