কনফুসিয়াস
প্রাচীন চীনের প্রখ্যাত দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ" (জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর, ৫১১ খ্রিষ্টপূর্ব এবং মৃত্যু ,১১ এপ্রিল, ৪৭৯ খ্রিষ্টপূর্ব) কনফুসিয়াস হলেন চীনের 'কনফুসিয়ান' তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রায়ই দুই হাজার বছর ধরে চীনে কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রভাব শুধু রাজনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নয়, বরং চীনাদের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও তা সমন্বিত আছে। তিনি ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে ২৮ সেপ্টেম্বর, চীনের 'লু' রাষ্ট্রের 'ছুফু' শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর বাবার নাম কং হি ও মায়ের নাম হান ঝেঙ। শৈশবকাল কেটেছে অপরিসীম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে এবং বয়স যখন তিন বছর, তাঁর বাবা মারা যান এবং অল্প বয়সেই জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয় তাকে,
মেষপালক হিসেবে কাজ করেছেন পশু খামারে, কখনো করেছেন লাইব্রেরির চাকরি। অল্প বয়স থেকেই ছাত্র পড়ানো শুরু করেন এবং কনফুসিয়াস মূলত নীতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে নীতিজ্ঞান। কনফুসিয়াস একজন বিদ্বান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি সারা জীবনে কোনো বড় সরকারি অফিসার হতে পারেননি, কারণ তৎকালীন প্রাচীন চীনে পড়াশোনার সুযোগ শুধুমাত্র অভিজাত পরিবারের সন্তানদের অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্ত এই ধরনের অধিকার ভেঙে , তিনি ছাত্রদের সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দেন। যে কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য জিনিস জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন এবং নিজের ছাত্রদের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। যতটুকু জানা যায়, প্রায় তিন হাজার ছাত্রের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরবর্তীতে বড় পন্ডিত হতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। ৫২ বছর বয়সে লু প্রদেশের প্রধান আইনরক্ষকের দায়িত্ব পান তিনি, পাশাপাশি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের মধ্যে যদি নৈতিক চরিত্রের উন্নতি না ঘটে, তবে শুধুমাত্র আইন দিয়ে মানুষকে সংযত রাখা অসম্ভব ব্যাপার এবং দীর্ঘ সময় ধরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাও সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজেই আইন প্রণয়ন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মধ্যে নীতিবোধ জাগাতে নানা উপদেশ দিতে থাকেন। তিনি পাঁচটি সম্পর্কের বিষয়ের উপর কথা উল্লেখ করেছেন "( ১) শাসক-জনগণ, ২) পিতা-পুত্র, ৩) স্বামী-স্ত্রী, ৪) জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ এবং ৫) বন্ধু-বন্ধু)" , এবং এই সম্পর্কগুলোতে তিনি শুধুমাত্র প্রজন্ম, বয়স এবং লিঙ্গের ওপর জোর দেননি, বরং এর পাশাপাশি তিনি উভয়পক্ষের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের উপরেও গুরুত্বারোপ করেছেন। জীবিতবস্থায় একমাত্র চীনের লু রাজ্যে তিনি বেশ কিছুদিন শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাঁর দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞাবলে অল্প দিনেই শান্তির রাজ্যে পরিণত করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীতে আস্তে আস্তে সমগ্র চীনে তার দর্শন ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বুঝতে পারে সমাজে শান্তি আনয়নের জন্য কনফুসিয়াসের দর্শনের কোনো বিকল্প পথ নেই।
("লুন ইয়ু' নামক একটি বইয়ে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণ উপর বর্ণনা করা হয়েছে এবং এই বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে)"। তার মৃত্যুর প্রায় দুই বছর পর লু রাজ্যের রাজা কনফুসিয়াসের বসতবাড়িটিকে একটি মন্দিরে পরিণত করেন এবং এর ভিতরে কনফুসিয়াসের কাপড়-চোপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ করে রাখা হয়।ধারণা করা হয়, এই চীনা দার্শনিক ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বে ১১ এপ্রিল, মৃত্যু বরণ করেন।
চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে চীনের ইতিহাসের একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, তিনি কনফুসিয়াস। গত শতাব্দীর সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন পণ্ডিত মানব জাতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার সময়, চীনের কনফুসিয়াসকে পঞ্চম স্থান দিয়েছেন, এবং কথা বলা যায়, প্রত্যেক চীনার গায়ে কনফুসিয়াসের কম-বেশি প্রভাব আছে। কনফুসিয়াস হলেন চীনের কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। দু’হাজার বছর ধরে চীনে কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রভাব শুধুমাত্র রাজনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নয়, বরং চীনাদের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও এর প্রভাব বিদ্যমান। কোনো কোনো বিদেশি পণ্ডিত কনফুসিয়ান তত্ত্বকে চীনের ধর্মীয় চিন্তাধারা অংশ বলে মনে করেন। আসলে কনফুসিয়ান তত্ত্ব প্রাচীন চীনের মতবাদগুলোর অন্যতম মাত্র। এটি একটি তত্ব কিন্তু ধর্ম নয়, কিংবা এক ধরনের দার্শনিক চিন্তাধারা। চীনে দু’হাজার স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে যথেষ্ঠ মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর চিন্তাধারা শুধুমাত্র , চীনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে তা নয় বরং এর প্রভাব কিছু কিছু এশীয় দেশেও বিস্তৃত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে মধ্যেই প্রবাসী চীনা আছেন, কাজেই কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা চীন ও এশিয়ার সীমা ছাড়িয়েছে। তাঁর জন্ম গ্রীসের বিখ্যাত পণ্ডিত আরিস্টোটলের চেয়েও শতাধিক বছর আগে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তাঁর বাবা মারা যান এবং তিনি মায়ের সঙ্গে বর্তমান পূর্ব চীনের সাংতুং প্রদেশে থাকতেন। তাঁর আসল নাম খুন ছিউ, কনফুসিয়াস হলো তার প্রতি সবার সম্মানসূচক ডাক, প্রাচীন চীনে একজনকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য লোকেরা তার পারিবারিক উপাধীর পিছনে ‘চি’ যোগ করতেন। কনফুসিয়াসের পারিবারিক উপাধী খুন, তাই সবাই তাঁকে খোন চি ডাকেন। কনফুসিয়ান চীনের ইতিহাসের বসন্ত-শরৎ যুগের লোক। এই সময়পর্বে আগের একীভূত রাজ্য ভেঙ্গে অনেক ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়। কনফুসিয়াস তখনকার লু রাজ্যের লোক। সেই আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শাসক শ্রেণী কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন এবং তাঁর কারণ জটিল হলেও সংক্ষেপে বলতে গেলে কনফুসিয়াসের কড়া শ্রেণীবিভাগ চিন্তা আর রাজনৈতিক সংস্কারের চিন্তা শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তার এই সব চিন্তাধারা রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি, সমাজের বিকাশের জন্য অনুকূল। তিনি মনে করেন নীচুস্তরের কর্মকর্তা-- উপরওয়ালার নির্দেশ লংঘন করা আর ছেলে বাবার কথা অনুসারে কাজ না করার মত, এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ। তার মতে, রাজাকে ভালো করে দেশ শাসন করতে হবে এবং সাধারণ অধিবাসীর রাজাকে মান্য করতে হয়। একজন লোক একই সময় মন্ত্রী, বাবা ও ছেলে হতে পারেন। তাকে বিভিন্ন অবস্থায় শ্রেণীবিভাগ ও পারিবারিক অবস্থান অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।কনফুসিয়াসের মতবাদ সৃষ্টির প্রথম দিকে শাসক শ্রেণী তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সময় চীন একটি একীভূত শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। শাসক শ্রেণী মনে করে কনফুসিয়াসের মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে অনুকূল, তাই তার চিন্তাধারাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।'লুন ইয়ু’ নামক একটি বইয়ে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন চীনে এই বই পাশ্চাত্য দেশের বাইবেলের মতো পবিত্র যেহেতু বই সবার প্রয়োজন, তাইএকজন সাধারণ অধিবাসীকেও এই বইয়ের লেখা আচার-আচরণ অনুসারে জীবনযাপন করতে হয়। একজন সরকারি অফিসারের পক্ষে এই বই পড়া আরও প্রয়োজনীয়। এই বই ভালো করে পড়েই শুধু যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা হতে পারেন। চীনের ইতিহাসে একটি কথা আছে, কনফুসিয়াসের মতবাদ সম্বলিত ‘লুন ইয়ু’ নামক বইয়ের অর্ধেক তত্ত্বই দেশ শাসনের জন্য যথেষ্ঠ।আসলে ‘লুন ইয়ু’ একটি একঘেয়ে তাত্ত্বিক বই নয়, বরং তার আলোচ্য বিষয় সমৃদ্ধ, ভাষা প্রাণবন্ত। পাঠকরা এই বই থেকে কনফুসিয়াসের বুদ্ধি স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারবেন। এই বইয়ে পড়া, সংগীত, পর্যটন ও বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশাসহ নানা বিষয়ে কনফুসিয়াসের মন্তব্য আছে। ‘লুন ইয়ু’-তে কনফুসিয়াসের চি কোন নামক এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করেন, সৈন্যবাহিনী, খাদ্যশস্য ও জনগণ– এই তিনটের মধ্যে যদি একটি বাদ দিতে হয়, তাহলে আপনি কোনটি বেছে নেবেন? কনফুসিয়াস কোনো দ্বিধা না করে উত্তর দিলেন, সৈন্যবাহিনীকে বাদ দেব। মানবসভ্যতা প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যেতে যেতে আজকের এই অবস্থানে এসেছে এবং এই বদল চলমান এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কে না জানেন, কনফুসিয়াস শুধু মাত্র কেবল চীনেরই নন, গোটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিষয়ক তাত্ত্বিকদের একজন। বর্তমান যুগে এসেও, চীন এবং পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের সভ্যতা তাঁর দর্শন দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘সমাজ ন্যায়সম্মতভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত।’ তখন এই বাক্যই ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং এই ভাবনা ছিল অভিনব। যা আপনি নিজের জন্য প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের জন্য করবেন না, এই ধরনের অসংখ্য উদ্বৃতি তিনি প্রদান করেছেন, এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে। ইতিহাসে পাতা থেকে কিছু তথ্য সংযোজন করছি, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় কনফুসিয়াস শাসকদের অন্যায় কাজকর্ম দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান এবং একপর্যায়ে তিনি চীন সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন, কিন্তু চাকরিটা ছেড়ে দেন ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কেবল শখের বশেই যে ঘুরতেন, তা কিন্তু নয়। একটানা ১২ বছর চীনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান কনফুসিয়াস। আর এই পথ থেকে পথে হাঁটার সময় তিনি প্রচার করেন সামাজিক সাম্য সম্পর্কে তাঁর ধারণাগুলো এবং দীর্ঘ ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর কনফুসিয়াস তাঁর জীবনের বাকি সময়টা শিক্ষকতা করেই কাটিয়েছেন। সুখী জীবনের জন্য কনফুসিয়াসের ছিল খুব সাধারণ কিছু সূত্র, তিনি মনে করতেন, শাসকেরা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করবে, যাতে সাধারণ জনগণ একে অন্যের প্রতি ভালো আচরণ করতে উৎসাহ বোধ করবে এবং সুখী হওয়ার জন্য তিনি পাঁচটি উপায়ের কথা বলেছেন, এবং যেগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘পাঁচ সদ্গুণ’। চীনা ভাষায় গুণ পাঁচটি হলো ই, লি, রেন, ঝি এবং সিন। তাঁর মতে, সুখী এবং অর্থময় জীবনের জন্য এই পাঁচ গুণের প্রতিটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘ই’ হলো সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা, ‘লি’ হলো সদাচার ও ভদ্রতা, ‘রেন’ হলো দানশীলতা ও মানবতা, ‘ঝি’ হলো জ্ঞান ও শিক্ষা এবং ‘সিন’ হলো বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য। তাঁর জীবদ্দশায় নয়, কনফুসিয়াসের দর্শন ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর পরে। ১৩৬ খ্রিষ্টপূর্বে চীনের রাষ্ট্রীয় নীতিতে কনফুসিয়াসের দর্শন স্থান পায় এবং কনফুসিয়াসিজম নামে পরিচিত এই ধারা পরবর্তীতে দুই হাজার বছর টিকে ছিল, তবে কনফুসিয়াস সম্ভবত নিজে কোনো বই লেখেননি, পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসারীরা তাঁর বাণী সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছে।
কনফুসিয়াসের জন্মের আগের কথা কিছুটা তুলে ধরছি , চীনা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো লেখার প্রতিলিপি পাওয়া যায় ষাঁড়ের হাড় বা কচ্ছপের খোলসে (ওরাকল বোন) খোদাই করা অবস্থায় এবং সেটি শ্যাং রাজত্বকালের (খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০–১০৪৬) বলে জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা শ্যাংদের অস্তিত্বকে ‘মিথ’ ভাবলেও ওই সমস্ত লেখাগুলো কিন্তু উল্টো কথা বলে, এ তো গেল লেখার কথা। চীনের প্রথম দার্শনিক হলেন লাও জু। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে তিনি জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি তাওইজম নামের একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। এই ধর্মের মূল নীতি ছিল সততা এবং সম্প্রীতি।কনফুসিয়াসের আবির্ভাবের পরবর্তীতে,চীনা দার্শনিক মেনসিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭২–২৮৯) কনফুসিয়াসের দর্শনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন , এবং তিনি জনগণকে একতাবদ্ধ হয়ে অত্যাচারী শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য আহ্বান জানাতেন।যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) কনফুসিয়াসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।কনফুসিয়াস: চীনে ‘মাস্টার কং’ নামে পরিচিত । কয়েক হাজার বছর আগে কোনো একজনের জন্ম ও মৃত্যুর দিন-তারিখ লিপিবদ্ধ রাখা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার, চীনাদের কাছে ‘মাস্টার কং’ নামে পরিচিত এই মহান দার্শনিকের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুর দিনক্ষণ শুধু মাত্র লেখা কিংবা লিপিবদ্ধ মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং দিন দু'টি অদ্যাবধি পালিতও হয়।
কেবল মাত্র চীনে নয়, বিশ্ব বরেণ্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকের তালিকায় জ্বলজ্বল করে কনফুসিয়াসের নাম, সেই আদি যুগে এমনই মহত্তম কথা বলেছেন আর নীতিমালার নির্দেশ প্রদান করে গেছেন , যা আজো চিন্তার জগতকে আলোড়িত করে। একটি বার চিন্তা করুন আড়াই হাজার আগে, যখন অক্ষরজ্ঞান বা বইপুস্তকের ভালো করে সমৃদ্ধি কিংবা বিকাশই ঘটেনি, তখন তিনি বলছেন," (চিন্তা না করে কেবল অধ্যয়ন করা অনর্থক, এবং অধ্যয়ন না করে কেবল মাত্র চিন্তা করা বিপজ্জনক।") পাশাপাশি"( আরো বলেছেন, 'যখন তুমি কোন ভালো মানুষকে দেখ, তার মত হওয়ার চেষ্টা কর। আর যখন কোন খারাপ মানুষকে দেখবে, তখন তোমার নিজের দুর্বলতাগুলোর দিকে নজর দিবে)"। প্রতিবেদনের শেষ পর্যায়ে আমি গুরু কনফুসিয়াসের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। আমাদের জীবন, জীবনে চলার পথে আমাদের আচার আচরণ, ব্যবহার এবং তার বহিঃপ্রকাশ খুবই কম ব্যক্তি আছেন, কনফুসিয়াসের মতো এতো স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন , "(তিনি বলেছেন, 'যদি তুমি কোন কিছু সঠিক মনে কর, কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করতে না পারো, তবে তোমার সাহসিকাতার অভাব আছে।' এবং'তুমি নিজে যা করতে চাও না, অন্যকে তা করতে দিও না)"। তাই বুঝতেই পারছেন তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, প্রজ্ঞার প্রসারতা ও দূরদৃষ্টির বহুমাত্রিকতা যে হাজার বছর পরেও পৃথিবীর মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক? তাঁর নীতি ও আদর্শের দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে দেখতে পাবো তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপ্তি ও উজ্জ্বলতা এবং চিন্তা ভাবনা ও দর্শন। তাঁর কিছু উদ্ধৃতি এখনই কিছু তুলে ধরতে চেষ্টা করছিঃ ১. সকলের সঙ্গে ভালো আচরণ করুন, এবং তাই শ্রেষ্ঠ ও নিরাপদ। ২. সু অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং দৈনন্দিন কার্যপদ্ধতি মেনে চলুন, তাহলে সফল হবেন। ৩. একজন ব্যক্তির উত্তম মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থাকা উচিত। ৪. পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, শিক্ষক-ছাত্র, দাস-মালিক ইত্যাদি প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। ৫. প্রত্যেকের উচিত সবকিছুতে নতুনত্ব নিয়ে আসা। ৬. একজন ব্যক্তির যে গুণাবলী থাকা আবশ্যক, তা হলো সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরার্থপরতা, ধার্মিকতা ও আনুগত্য।
প্রাচীন এই মহান শিক্ষাগুরুর রাজনৈতিক ও দার্শনিক এমন বহু কথা ও নির্দেশনার উল্লেখ করা সম্ভব, যা বর্তমানকালেও সবাইকে বিস্মিত করে এবং তিনি বিশ্বসেরাদেরই একজন , যিনি দর্শনকে মহত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করে যুগ যুগ ধরে মানব জীবনের নীতিনিষ্ঠপন্থায় চলার পাশাপাশি, একটি সহজ, সরল,সাবলীল এবং সুন্দর পথ দেখিয়ে চলেছেন।যদি তাঁর জীবন যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো , ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে চীনের লু’ স্টেটে জন্ম, তাঁর বাবা ‘কং’ ছিলেন একজন শুধুমাত্র সৈনিক, তিন বছর বয়সেই তাঁর বাবা মারা যান, মায়ের কাছে অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি, তাঁর পরিবার ছিল চীনের ‘শাই’ নামে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবার, কিন্ত অভিজাত পরিবার নয় মোটেও কৃষকদের থেকে কিছুটা উপরে । এই রুপ অবস্থার মধ্যে থেকে ও শ্রেণি সম্পর্কে শৈশব থেকেই চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেন এবং সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে ভিন্নতর পন্থার চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অভিজাত শ্রেণীর নয় বলে পড়াশোনা করার ও সুযোগ পাননি কিংবা সেই সৌভাগ্য নিয়ে তিনি পৃথিবীতে আসেননি। সেই পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে ওঠে, ("তিনি মনে করতেন, 'মানুষকে মর্যাদা দেয়া ও পুরস্কৃত করা উচিত তার মেধা দিয়ে, সে কোন পরিবারে জন্ম নিয়েছে তা দিয়ে নয়)"। তবে বাস্তবিক পক্ষে গুরু কনফুসিয়াসের শৈশবের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব পর হয়নি, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন মেষ পালক হিসেবে, অবশ্য পরবর্তীতে বুক কিপার ও ক্লার্কের কাজ করেছেন ও ত্রিশ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন, "(একমাত্র তিনিই ছিলেন চীনের প্রথম কোন শিক্ষক যার লক্ষ্য ছিল সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা)" । চল্লিশ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং তৎকালীন চীনা সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন ও লু’ স্টেট শহরের গভর্নর পদ লাভ করেন, এইভাবে ধীরে ধীরে সরকারের উপদেষ্টা র পদ লাভ করেন। সেই সময় লু' স্টেটের নেতৃত্বে ছিলেন একজন ডিউক, যার অধীনে ছিল তিনটি অভিজাত পরিবার, যারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি এই ব্যবস্থার সংস্কার করে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিছুটা সফলও হয়েছিলেন, তবে পুরোপুরি সংস্কার করতে সমর্থ্য হননি। এরপর থেকে তার বেশ কিছু শত্রু তৈরি হয় এবং তিনি লু স্টেট ছেড়ে চলে যান।
এ প্রসঙ্গে অবশ্য আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায়, তা হলো, সে সময় পার্শ্ববর্তী রাজ্যের এক রাজা লু’ স্টেটের রাজাকে ১০০টি ঘোড়া ও ৮০ জন সুন্দরী রমণী উপহার পাঠান এটা পেয়ে রাজা চরম আনন্দ-উল্লাস ও বিলাসিতায় মত্ত হয়ে পড়েন, এর প্রতিবাদে স্বরুপ গুরু কনফুসিয়াস রাজ্য ছেড়ে চলে যান এবং চীনের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়াতে থাকেন এবং তার রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন প্রচার করতে থাকেন। তার প্রচারিত দর্শন 'কনফুসিয়ানিজম' হিসেবে পরিচিত। অনেকেই এটিকে একটি ধর্মীয় আবার কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন, তবে তার দর্শনে পরকাল ও স্বর্গের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার মতবাদ ,ধর্মীয় বিভিন্ন বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে সম্পূরক নয়। তবে তিনি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল ব্যক্তি ও সরকারের নৈতিকতা, সামজিক সম্পর্কের সংশোধন, ন্যায়বিচার ও আন্তরিকতার পাশাপাশি ভদ্রতা, পরিকল্পনা, শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি তিনি এই শিক্ষাও দিয়েছেন যে, মুল্যবোধই একটি সুখী জীবন গড়ে তুলতে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে । তাঁর মতে সুপরিকল্পিত কাজ এবং অন্যদের সহযোগিতার মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ লুকিয়ে আছে বা নিবিষ্ট আছে। তাঁর দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল কতিপয় লোককে সুযোগ সুবিধা না দিয়ে রাষ্ট্রের উচিত সবাইকে উপকৃত করা, কেউই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন না।সকলেই এর সমান অংশীদার। ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান মহান এই দার্শনিক। পরবর্তীতে কনফুসিয়াসের অনুসারীরা তাঁর আদর্শকে ‘দ্য অ্যানালেক্টস অব কনফুসিয়াস’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। চীনে হান রাজাদের শাসনামলে কনফুসিয়াসের শিক্ষা রাষ্ট্রীয় দর্শন ও দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তার দেয়া 'কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা' আদর্শ হিসেবে এখনও পর্যন্ত চীনের সংস্কৃতি ও সরকার ব্যবস্থায় অনুসরণ করা হয়ে থাকে।এই প্রসঙ্গে আমার আরো একটি অভিমত ব্যক্ত করছি, শুধু মাত্র চীনে নয় বরং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও গুরু কনফুসিয়াসের দর্শন মূল্যবোধের এখনো পর্যন্ত প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই তাঁর আদর্শ এখনো পর্যন্ত অনুসরণ করে যাচ্ছেন, তা না হলে অনেক কিছুই আজ ইতিহাসের পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু গুরু কনফুসিয়াসের দর্শন আদর্শ মূল্যবোধ এখনো আলোকিত এবং প্রতিনিয়ত আলোই বিকশিত করছেন। বাস্তবিক অর্থে তাঁর আলো ছড়িয়ে পড়ছে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। তাই গুরু কনফুসিয়াস এখনো আলোর মতোই কাজ করছেন।
গুরু কনফুসিয়াসের কিছু বিখ্যাত উক্তি তুলে ধরছিঃ
১.তেমার চেয়ে ভালো নয়, এমন মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করো না।
২.নিরবতা হলো সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, যে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
৩.অতীত থেকে শিক্ষা নাও, যদি ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে চাও।
৪.সাবধানীরা কদাচিৎ ভুল করে।
৫.নিখুঁত নুড়ির চেয়ে ত্রুটিযুক্ত হীরে বেশি ভালো।
৬.অত্যাচরী শাসক বাঘের চেয়েও ভয়ংকর।
৭.প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার আগে, অন্তত দুটি কবর খুঁড়ে রেখো।
৮.আঘাত ভুলে যেও,কিন্তু করুনা ভুলো না।
৯.তিন উপায়ে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি ; প্রথমত প্রতিফলন দ্বারা, যা সর্বোত্তম; দ্বিতীয়ত, নকল করে, যা সব থেকে সহজ; তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতা দ্বারা, যা কিনা সব থেকে তেতো।
১০.মৃত্যু ও জীবনের নিজস্ব নির্দিষ্ট মুহূর্ত স্থির করা আছে; ধন এবং সম্মান নির্ভর করে সৃষ্টিকর্তার ওপর।
১১.যে কাজ ভালো লাগে সেটাই বেছে নাও, জীবনে কখনও তোমাকে সারা দিন ধরে কাজ করতে হবে না।
১২.যা নিজে পছন্দ করো তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিও না।
১৩.সঠিক কাজ জেনেও তা মাঝপথে ছেড়ে গেলে সাহসের অভাব বোঝায়।
১৪.সবকিছুর ভেতরই সৌন্দর্য আছে, কিন্তু সকলের সেই সৌন্দর্য দেখতে পাওয়ার চোখ নেই!
১৫.যিনি তার নিজের গুণে সরকার চালান তাকে উত্তর মেরুর নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায় যে নিজস্থানে থাকে এবং সকল নক্ষত্রেরা তার দিকে ফেরে।
১৬.যদি আমরা জীবন কে না চিনি, মৃত্যুকে চিনব কি করে?
১৭.যদি আমি দুজন মানুষের সঙ্গে পথ হাঁটি, তাদের প্রত্যেকেই আমাকে শিক্ষক হিসাবে সেবা করবেন। ভালো বিষয়গুলি আমি বেছে নেব এবং নকল করব তাদের। আর তাদের খারাপ বিষয়গুলি সংশোধন করে রেখে দেব নিজের মধ্যে।
১৮.নিজের হৃদয়ে উঁকি মেরে দেখো, যদি সেখানে খারাপ কিছু না পাও, তাহলে দুশ্চিন্তার কী আছে? কী নিয়ে এত ভয়?
১৯.অজ্ঞতা হল মনের রাত, সেই রাত যখন আকাশে চাঁদ কিংবা নক্ষত্রেরা অনুপস্থিত।
২০.যদি এক বছরের কথা ভাব, একটা বীজ পেতো ; দশ বছরের কথা ভাবলে লাগাও গাছ ; আর যদি একশো বছরের কথা চিন্তা করো, মানুষকে শিক্ষা দাও।
২১.যে কোনো সুশাসিত দেশে দারিদ্র্য এমন একটা বিষয় যা লজ্জার। যে দেশে সুশাসন অনুপস্থিত সেখানে সম্পদ এমন একটা বিষয় যা লজ্জার।
২২.পুণ্য কি খুব দূরের জিনিস ? আমি পুণ্যবান হতে চাই, আরে দ্যাখো! পুণ্য হাতের মুঠোয়।
২৩.যে শেখে কিন্তু ভাবে না, সে গোল্লায় যায়। যে ভাবে কিন্তু কিছুই শেখে না সে বিপদে পড়ে।
২৩.যে অমিতব্যয়ী তাকে অনুশোচনা করতে হয়।
২৪.যে শালীনতা ব্যতিরেকে কথা বলে তার পক্ষে নিজের বক্তব্যকে সুন্দর করে তোলা কঠিন।
২৫.স্বর্গ মানে ঈশ্বরের সঙ্গে এক হওয়া ।
২৬.বিশ্বস্ততা এবং আন্তরিকতা কে প্রথম নীতি হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।
২৭.আমি চাই তোমার সত্তার গভীরে যে প্রকৃত তুমি বর্তমান তার পরিপূর্ণ বিকাশ।
২৮.যে সব উত্তর জানে তাকে সব প্রশ্ন করা হয়নি।
২৯.যদি তুমি প্রশ্ন করো, তাহলে তুমি ১ মিনিটের জন্য বোকা থাকবে। আর যদি প্রশ্ন না করো তাহলে সারাজীবনের জন্য বোকা হয়ে থাকবে।
৩০.জীবন সত্যিই সহজ, কিন্তু আমরাই সেটিকে জোর দিয়ে জটিল করে তুলি।
৩১.আপনি যদি ভুল করেন এবং এটি সংশোধন না করেন তবেই সেটা ভুল হিসেবে গণ্য হবে।
৩২.সবচেয়ে মজার মানুষটি সবচেয়ে দুঃখী!
৩৩.অন্যায় করা কঠিন কিছুই নয়, যদি না আপনি সেই অন্যায়ের কথা ভুলে যেতে পারেন।
৩৪.নিজেকে সম্মান করুন, তাহলে অন্যরাও আপনাকে সম্মান করবে।
৩৫.আপনি যখন একজন ভাল মানুষ দেখেন, তখন তার/তার মতো হওয়ার কথা ভাবুন। আপনি যখন কারো মাঝে ভালো দেখতে না পান, তখন নিজের দুর্বল দিকগুলো চিন্তা করুন।
৩৬.আপনি কোনোকিছু না শিখে একটি বই খুলতে পারবেন না।
৩৭.অন্যের মধ্যে থাকা মন্দকে আক্রমণ না করে নিজের মধ্যে যে মন্দ আছে তাকে আক্রমণ করুন।
৩৮.বড় মানুষ যা চান তা নিজের মনের মধ্যে রাখেন, আর ছোট মানুষ যা চায় তা অন্যদের মধ্যে থাকে।
৩৯.সবথেকে কঠিন কাজ হল একটি অন্ধকার ঘরে একটি কালো বিড়াল খুঁজে পাওয়া, বিশেষ করে যদি বিড়াল না থাকে।
৪০.সঙ্গীত এক ধরনের আনন্দ তৈরি করে যা মানব প্রকৃতি ছাড়া করতে পারে না।
৪১.রত্নকে ঘর্ষণ ছাড়া পালিশ করা যায় না, আর মানুষকে পরীক্ষা ছাড়া নিখুঁত করা সম্ভব না।
৪২.আমাদের দুটি জীবন আছে, এবং দ্বিতীয়টি শুরু হয় যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের শুধুমাত্র একটি আছে।
৪৩.জ্ঞানী মানুষ কখনো দুই মনের হয় না; পরোপকারী মানুষ কখনই চিন্তা করে না; আর সাহসী মানুষ কখনো ভয় পায় না।
৪৪.আমাদের বন্ধুদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার চেয়ে অবিশ্বাস করা আরও বেশি লজ্জাজনক।
৪৫.প্রকৃত জ্ঞান হলো নিজের অজ্ঞতার পরিধি জানা।
৪৬.মনে রাখবেন, আপনি যত দূরেই যান না কেন, আপনি সেখানে আছেন।
৪৭.অন্যায় সমাজে ধনী ও সম্মানিত হওয়া একটি অপমানজনক।
৪৮.বিশ্বকে সুশৃঙ্খল করতে হলে আমাদের প্রথমে জাতিকে সুশৃঙ্খল করতে হবে; জাতিকে সুশৃঙ্খল করতে হলে, আমাদের প্রথমে পরিবারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে; পরিবারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হলে, আমাদের প্রথমে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে ঠিক করতে হবে; আমাদের নিজেদেরকে ঠিক করতে হলে, নিজের হৃদয়কে ঠিক করতে হবে।
৪৯.একটি সিংহ আমাকে একটি গাছের দিকে তাড়া করেছিল এবং আমি উপর থেকে দৃশ্যটি উপভোগ করেছি।
৫০.যে পিতা তার সন্তান কে কর্তব্য কি তা শেখান না, তিনি সেই সন্তানের সমান দোষে দোষী যে কর্তব্যে অবহেলা করে।
আসলে উপরোক্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় উনার উপর আলোচনা এবং বিশ্লেষণ। তারপর ও ইতিহাস পর্যালোচনা, আমার লব্ধ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা ভিত্তিতে চেষ্টা করবো আরো কিছু সংযোজন করা সম্ভব কিনা। কিংবা পাশাপাশি উপরোক্ত প্রতিবেদনের উপর আলোকে ভিন্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরতে তাও চেষ্টা করবো। এযেন প্রকৃত পক্ষে এমন একটা বিষয় গুরু কনফুসিয়াস কে পেয়ে আমি তার ছাত্র, গুরু এবং ছাত্রের মধ্যে আলোচনা এবং পর্যালোচনা। আমি ছাত্র হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করছি ঠিক এইভাবে যা উপরোক্ত আলোচনার সাথেই সংগতিপূর্ণ, কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে। চীনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং চীনা সভ্যতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যে ব্যক্তি, চীনের অধিকাংশ মানুষ আজো যার দর্শন ও মতবাদকে এখনো জীবনের পথচলার প্রধান অঙ্গ হিসেবে মেনে চলেন তিনি হচ্ছেন মানবতাবাদী দার্শনিক কনফুসিয়াস, পাশাপাশি একজন প্রভাবশালী চীনা দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এবং কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। প্রায় ২,৫০০ বছর আগে প্রচারিত হয়েছেল তার এই তাত্ত্বিক মতবাদ। কিন্তু তা আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সমাদৃত। প্রাচীন এই দর্শনকে আবহমান চীনের সভ্যতা-সংস্কৃতির মূল নিয়ামক বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক গণ। অনেকে আবার এই মতবাদকে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন হিসেবে ভাবতে চাইলেও বেশিরভাগ পন্ডিতই তার এই মতবাদকে দার্শনিক চিন্তাধারার ধারক ও বাহক হিসেবেই মনে করেন। চীনাদের চিন্তাধারা ও তাদের সামাজিক আচার-আচরণেও এর ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান। চীনের মানুষ এখনও তাঁদের সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার আদর্শ ও শিক্ষা। তার এই মতবাদ শুধু চীনা রাজনীতি বা সাংস্কৃতির গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় মোটেও, বরং আশেপাশের অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর মধ্যেও কনফুসিয়াসের দার্শনিক তত্ত্বের প্রভাব বিদ্যমান।
জন্ম ও শৈশব সম্পাদনাঃ কনফুসিয়াস জন্মেছিলেন আনুমানিক ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং বাবার নাম কং হি ও মায়ের নাম হান ঝেঙ। পরবর্তীতে কনফুসিয়াস নামে পরিচিত লাভ করেন। আসল নাম ছিল কঙ ফু তজু এবং লু নামে একটি ছোট প্রদেশের সরকারী কর্মচারী ছিলেন তার বাবা, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একজন সৈনিক ছিলেন। শৈশব সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় যায় না, তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, তার শৈশবকাল কেটেছে অপরিসীম দারিদ্র্যের মাঝে।
গুরু কনফুসিয়াসের সময় চীন অনেকগুলো ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং প্রায়ই এক রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো, এসব জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সহায় সম্পত্তি হারাতে হয়েছিল কনফুসিয়াসের পরিবারকে। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান। অনেক ইতিহাসবিদবিভিন্নভাবে তাঁর মূল্যায়ন করেছেন অনেকের মতে, স্কুলে যাবার বয়স হতেই কনফুসিয়াসের মা ছেলেকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন, আবারো অনেকের মতে তিনি শিক্ষা গ্ৰহনের খুবই একটা সুযোগ পাননি, কারণ সেই সময়কার ইতিহাস বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , তাঁর সময়ে শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল শুধু মাত্র অভিজাত শ্রেণীর সম্রদায়ের মধ্যে। আচ্ছা ধরেই নিলাম তিনি কিঞ্চিত শিক্ষা গ্ৰহনের সুযোগ পেয়েছেন, তবে তা পরিপূর্ণ নয়, যতটুকু দরকার তা তিনি পাননি।যদিও পেয়েছেন তা হতে পারে স্থানীয় স্কুলে, সেই সময়কার বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনো স্কুলে তো নয়ই , বর্তমানে আমাদের দেশের মধ্যে স্বনামধন্য স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায়,তাতে অন্তত নয়। হয়তোবা জন্মস্থানের সংযুক্ত কিংবা সংলগ্ন আশেপাশের মধ্যে অবস্থিত স্থানীয় কোনো স্কুল। কিছুদিনের মধ্যেই কনফুসিয়াস শিক্ষক-ছাত্র সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। অসাধারণ মেধা এবং জ্ঞান অর্জনে তার প্রবল আগ্রহের কারণে তার সমসাময়িক ছাত্রদের থেকে তিনি ছিলেন অনেক অগ্ৰগামী , স্কুলের পাঠ্য পুস্তকের বাইরে নানা বিষয়ে ছিল তার অগাধ জ্ঞান এবং ধর্ম-দর্শনে তার পান্ডিত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু দারিদ্র্য তার কারণে জীবিকার সন্ধানে
কৈশোর পেরোতে-না-পেরোতেই জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয় ।কখনো মেষপালক হিসেবে কাজ করেছেন পশু খামারে, কখনো কেরানিগিরি বা লাইব্রেরির চাকরি, আবার কখনো বা শহরের উদ্যানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার দায়িত্বের কাজও করেছেন । কিন্তু একেবারেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলেননি কখনোই। অল্প বয়স থেকেই ছাত্রদের পড়াতে শুরু করেন , এর মধ্যে বিবাহ হয় কনফুসিয়াসের এবং ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন কিগুয়ান নামের এক নারীকে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান কঙ লি। মাত্র ২৩ বছর বয়সে কনফুসিয়াস মাতৃহারা হন।
কর্মজীবন সম্পাদনাঃ আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সেই সময় চীনের সমাজ ব্যবস্থায় জনগণের অবস্থান অনুযায়ী তাদের পেশার শ্রেণীবিন্যাস করা হতো। কনফুসিয়াসের সামাজিক অবস্থান এবং জ্ঞানের কারণে তিনি ছিলেন শী শ্রেণীভুক্ত, যারা ভদ্র-মধ্যবিত্ত-বিদ্বান হিসেবে সমাজের সম্ভ্রান্ত ও শাসক শ্রেণীর সাথে মেলামেশার সুযোগ পেতেন। এই সময় লু প্রদেশের শাসক ছিলেন চি চি। কসফুশিয়াসের জ্ঞান ও পান্ডিত্যের কথা জানতে পেরে রাজা কনফুসিয়াসকে তার সভায় আমন্ত্রন জানান। প্রথম পরিচয়েই কনফুসিয়াসের পান্ডিত্যে মুগ্ধ হন রাজা। দারিদ্রের কথা শুনে তিনি কনফুসিয়াসকে হিসাবরক্ষকের কাজে নিযুক্ত করলেন। কনফুসিয়াসের কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে রাজা তাকে আরো উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত করেন। কনফুসিয়াস আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী না হলেও তার দৈহিক অপূর্ণতা তিনি তার মধুর ব্যবহার আর তার জ্ঞানের আলোকবর্তিকায় মুগ্ধ করেন তাঁর কাছে আসা সকলকে। আর উৎসুক মানুষও নিজেকে জ্ঞানের প্রদীপ্ত শিখায় আলোকিত করার জন্য তার কাছে আসতো এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করতো। কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, নীতিজ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষা দান করতে পারলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে সবচেয়ে বেশি। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের ছয়টি বিদ্যার ওপর জোর দিতেন বিশেষ ভাবে, ধনুর্বিদ্যা, হস্তলিপি, হিসাববিদ্যা, সঙ্গীত, রথ চালনা এবং সমাজের রীতিনীতি জ্ঞান শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে উপযুক্ত ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা । শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ক্রমশ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমদিকে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা তার কাছে শিক্ষা নিতে আসলেও পরে অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েরাও জ্ঞান লাভের জন্যে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে উঠেন। একটা পর্যায়ে ধীরে ধীরে অভিজাত শ্রেণীতে তিনি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং তার প্রভাব আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। এর মাঝেও কনফুসিয়াসের জ্ঞান অর্জনে কোনো খামতি ছিল না, প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহের পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনের নের জন্য বিভিন্ন জায়গার গমন করেন।যেখানেই দুষ্প্রাপ্য কোনো পুঁথির সন্ধান পেতেন, তা সংগ্রহের জন্য ছুটে যেতেন। সেসব পুঁথি শুধু সংগ্রহই করতেন না, গভীর আগ্রহে নিয়ে খুব মনযোগ সহকারে সেই পুঁথিগুলো পড়তেন এবং তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন। যখর ত্রিশ বছর বয়স, তিনি উপলব্ধি করলেন প্রকৃত জ্ঞান অর্জন কেবল গ্রন্থ বা পুঁথিতে সীমাবদ্ধ হতে পারে না, বরং চারপাশের জগতেই ছড়িয়ে রয়েছে জ্ঞান অর্জনের সমস্ত উপকরণ। এই ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই তিনি চীনের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে সক্ষম হন, তাঁর সময়ে অর্থনীতির কেন্দ্রে ছিলেন শাসক শ্রেণী ও বণিক সম্প্রদায়। দরিদ্রদের নানাভাবে ঠকিয়ে দেওয়ায় ছিল তাদের কাজ। দেশের আইন-কানুনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না সেই সব শ্রেনীর ব্যক্তিরা , পাশাপাশি দেশ জুড়ে কেবল অভাব-অনটন, রাজা এবং রাজ পুরুষদের নৈতিক অধঃপতন, দেশে-দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের দামামা এবং কোথাও কোনো শান্তি-শৃঙ্খলার লেশমাত্র নেই, এইসব বিষয় তিনি খুবই নিবিড়ভাবে অবলোকন করেন ও এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের সচেতন করে তোলার পাশাপাশি,তা নিয়ে কনফুসিয়াস শুরু করেন তাঁর যুদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন , কোনো আইন বা দন্ডের দ্বারা সামাজিক এই বিশৃঙ্খলাকে দমন করা যাবে না, বরঞ্চ আইন যতই কঠিন হবে, ততই মানুষের আইন অমান্য করার স্পৃহা তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। একমাত্র মানুষের বিবেকবোধ, নীতিবোধই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে এবং এই বিবেকবোধ ও নীতিবোধ মানুষের মাঝে জাগ্রত করতে হবেও ঘটাতে হবে ধর্মীয় চেতনাবোধের অভ্যুদয়। তাঁর এই চেতনাবোধ তিনি ছড়িয়ে দিতে লাগলেন তার একান্ত ছাত্রদের মধ্যে। আর ছাত্রদের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে।
আইন প্রশাসক সম্পাদনাঃ ৫২ বছর বয়সে লু প্রদেশের প্রধান আইনরক্ষকের দায়িত্ব পান কনফুসিয়াস। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মাঝে যদি নৈতিক চরিত্রের উন্নতি না ঘটে, শুধুমাত্র আইন দিয়ে মানুষকে সংযত রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাও সম্ভব নয়। তাই কনফুসিয়াস নিজেই আইন প্রণয়ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে নীতিবোধ জাগাতে নানা উপদেশ দিতে থাকেন।
(“অপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে বিচারকরা যেন মানবিকতার কথা না ভোলেন কখনও,”),বিচারবিভাগীয় কর্মচারীদের প্রতি এই ছিল তার প্রধান উপদেশ।(“উদার ও ন্যায়পরায়ণ না হলে বিচারক হওয়া যায় না, মানুষকে ভাল না বাসলে তুমি তাকে সংশোধন করবে কী করে”) , এই ছিল গুরু কনফুসিয়াসের মূল তত্ত্ব। অল্প কিছুদিনেই এর সুফল দেখা দিল রাজ্যে। সমগ্র চীন দেশেই লু রাজ্য ছিল একমাত্র রাজ্য যেখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন হতো না এবং সকলেই নির্ভয়ে, নিরাপদে নিজের দ্রব্য রাখতে পারতো। গভীর রাতেও পর্যটকরা নিরাপদে চলতে পারতো। আইনরক্ষকের দায়িত্ব এত ভালভাবে সম্পাদন করার পুরষ্কার হিসেবে কয়েক বছরের মধ্যেই তাকে ভার দেওয়া হয় লু প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীত্বের।
কনফুসিয়াসের পর্যটক জীবন সম্পাদনাঃ মহাজনদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের বাঁচাতে বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন তিনি, এতে বেজায় চটে যান লু প্রদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, শেষপর্যন্ত তাদেরই বিরোধীতায় তাকে ছাড়তে হয় প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ। তারপর থেকেই কনফুসিয়াসের শুরু হয় পর্যটকের জীবন। উত্তর চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে মানুষের দুর্দশা দেখে বুঝতে পারেন যে, দেশবাসীর এই দুঃখ-দুর্শার মূলে রয়েছে দেশ শাসনের ব্যর্থতা। এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার ব্যাপারে তিনি কাজ শুরু করেন। জনসাধরণের মাঝে তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন তাঁর উপদেশ, এ কাজে তাকে সহায়তা করেন তার কয়েকজন ছাত্র ও অনুগামী। উপরোক্ত আলোচনা এবং বর্তমান পর্যালোচনার মাধ্যমে গুরু কনফুসিয়াসের মূল তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা আসবেই প্রিয় পাঠক গণ আপনাদের মাঝে।ছেলেবেলা থেকেই কনফুসিয়াস ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল, মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় কেঁদে উঠতো তার মন, তাছাড়া তিনি সবসময় বলতেন,(“জীবন দিয়ে মানুষকে অর্জন করতে হবে সততা ও সারল্য, তাছাড়া ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার অন্য কোনো পথ নেই।”)। এই ছিল কনফুসিয়াসের শিক্ষার মূল কথা। ধর্মগুরু বলতে সাধারণত যা বোঝায়, কনফুসিয়াস আদৌ তা ছিলেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষকে যে উপদেশগুলো তিনি দিতেন তারই মধ্যে নিহিত থাকতো সমস্ত ধর্মের মূল কথা। মানুষকে ভালবাসো, মানুষকে বিশ্বাস করো, অসৎ হয়ো না, হিংসা করো না কাউকে, এই শিক্ষা কি আমাদের দেয় না পৃথিবীর সব ধর্মই?
মহাজ্ঞানীর প্রয়াণ সম্পাদনাঃ “শুধু কর্মজীবনেই নয়, পারিবারিক জীবনেও সবাইকে হয়ে উঠতে হবে আদর্শ মানুষ, হয়ে উঠতে হবে আদর্শ পিতা-মাতা, পালন করতে হবে আদর্শ পুত্রকন্যার ভূমিকা, কারণ পরিবারই হচ্ছে সে জায়গা যেখানে মানুষের আত্মিক বিকাশের সূত্রপাত,”কিংবা কেন্দ্র বিন্দু। সমস্ত মানুষের প্রতি এই ছিল তার উপদেশ। ধারণা করা হয় এই চীনা দার্শনিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ সালে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কুফু নগরীর কাং লি সিমেট্রিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয় কনফুসিয়াস তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে ঈশ্বরের চিন্তা করেননি, কিংবা আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারেও তাঁর আগ্রহ ছিল না। তিনি সবাইকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে মানুষের দুঃখ দূর করে তাদের জন্য শান্তি-সমৃদ্ধির জীবনযাপনের জন্যই মূলত কাজ করেছেন। তাঁর মতো আর কারো পক্ষে এত সহজভাবে নীতিবোধের ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি , তাই এতো হাজার বছর পরেও তিনি আলোর মতোই । তিনি বলেছিলেন,
“জীবন সত্যিই সহজ, কিন্তু আমরা একে জটিল করে তুলি।” এর জন্য তিনি মানুষের মাঝে তার আদর্শ, উপলব্ধি ও নীতিজ্ঞান প্রচার করে গেছেন। তার মধ্য দিয়ে মানুষকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন।চীনের মানুষের অস্তিত্বের সাথে সাথে মিশে রয়েছে, কনফুসিয়াসের নীতি ও আদর্শের বাণী, আধুনিক চীনের মানুষ এখনও তার এই শিক্ষা পালন করে চলেছেন। ‘অ্যানালেক্টস’ বইয়ে সঙ্কলিত আছে তার সমস্ত উপদেশ। চীনের মানুষের কাছে আজও সেই বইয়ের মর্যাদা এতটুকু কমেনি। আলোচনাই বলুন আর পর্যালোচনাই বলুন আর দীর্ঘায়িত করবো না। গুরু কনফুসিয়াসের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং প্রণাম। অনেক শুভ কামনা রইলো সকলের প্রতি। ভুল ত্রুটি এবং অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মার্জনার আবেদন রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন এবং নিরাপদে ও আনন্দের মাঝে থাকুন এটিই কামনা। ধন্যবাদ।