দালাই লামা
দালাইলামার উপর প্রতিবেদন উপস্থাপনের প্রারম্ভে সহজাত প্রবৃত্তি ভাবেই কিছু প্রশ্ন
সামনে চলে আসে, দালাইলামা কোন দেশের নাগরিক এবং উনার বাসস্থান কোথায়? দালাইলামা কে এবং এই শব্দের অর্থ কী? তিব্বত কোথায় অবস্থিত? এবং মনের মধ্যে অনেক অজানা আরো অনেক কিছুই চলে আসে, জ্ঞান পিপাসু দের মনে। আমরা সকল প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবো, পাশাপাশি অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সম্পর্কিত বিষয়েও উদঘাটনের চেষ্টা করবো , কিন্তু অবশ্যই ইতিহাস অবলোকনের মাধ্যমে । ইতিহাস এমনি একটি বিষয় যা অতীতের কথা বলে এবং বর্তমানে আমি যে পর্যায়ে অবস্থান করছি তার মূল্যায়ন করে ও ভবিষ্যতে সুন্দর সুস্থ্য ও সঠিক পথে চলার জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। আগামী পথচলাকে আরো সহজ এবং সুগম করে। যে জাতি কিংবা ব্যক্তি তার প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নন, তিনি অনেকটা পরজীবী কিংবা অন্যের উপর নির্ভরশীল বা গাছকে আঁকড়ে ধরে যে সব উদ্ভিদ জীবন ধারণ করে অনেকটা সেই রকম।এই জন্যই বাস্তবিক পক্ষে মানুষ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে ,জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনার সাথে সাথেই, শিকড়ের সন্ধান করে থাকেন, মাটির টানে শিকড়ের সন্ধানে। তাই ইতিহাসের দিকে যখন আমরা ফিরে তাকাই তখন আমাদের প্রকৃত অবস্থা আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। তাছাড়া জীবন চলার পথে অতীত আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, এই কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি কিংবা নিজের ব্যক্তিগত পদচারণা, সফলতা হোক কিংবা বিফল, অনেকটা আয়নার মতো কাজ করে এই ইতিহাস। আর সময় নষ্ট না করে, এখন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করছি। তিব্বতে চীনা অভিযানের মুখে ১৯৫৯ সালে জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে পালিয়েছিলেন তিব্বতী বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা। মার্চ মাস, ১৯৫৯ সাল। লাসায় চীনা সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে পাঁচ দিন ধরে পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে দালাই লামা ভারতে পৌঁছান। এর আগ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে তিব্বতের বাইরের লোকেরা জেনেছিলেন যে, তিব্বতের রাজধানী লাসায় একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা দমন করেছে চীনারা। তবে দালাই লামা কোথায় আছেন - তা জানা যাচ্ছে না। দালাই লামা যে ভারতে চলে গেছেন, সেই খবরটা প্রথম দিয়েছিল রয়টার্স বার্তা সংস্থা। দিল্লিতে রয়টার্সের সংবাদদাতা ছিলেন পিটার জ্যাকসন। দালাই লামার বয়স যখন দুই বছর - তখন থেকেই তাকে দেখা হয় তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতার একজন অবতার হিসেবে। মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তার জনগণের রাজনৈতিক নেতা।
ভারতে আসার সেই দিনটিতে তার সাথে ছিলেন তার মা, তার বড় বোন এবং ছোট ভাই তেনজিন চোগিয়াল। তেনজিন চোগিয়ালকেও তিব্বতের আধ্যাত্মিক গুরুর একজন অবতার বলে মনে করা হয়। তিনিও তার ভাইয়ের মতই তিব্বতী আশ্রমে শিক্ষা গ্রহণ করেন। যখন তাকে সেই আশ্রম ছেড়ে আসতে হলো - তখন তার বয়স ১৩।
চীন তিব্বতে সেনা পাঠায় ১৯৫০ সালে। তিব্বতীয়রা অনিচ্ছাসত্বেও চীনের কাছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করে। ১৯৫৯ সালে চীন যখন সেখানে ভূমি সংস্কার শুরু করতে যায়, তখনই সেখানে উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করে। মার্চ মাসে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় সংঘাতপূর্ণ। চীনারা লাসার ঠিক বাইরে একটি ব্যারাকে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দালাই লামাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং বলেছিল, দালাই লামা যেন সাথে করে কোন সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে না আসেন। তিব্বতীরা আশংকা করছিল যে চীন হয়তো দালাই লামাকে অপহরণ করার চেষ্টা করছে। তিন লক্ষ তিব্বতী দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ঘেরাও করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় অভ্যুত্থান।
সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, দালাই লামা ও তার পরিবারকে অবশ্যই দেশ ছেড়ে যেতে হবে। এই ছিল দালাইলামা যখন ভারতে পালিয়ে যান, ঠিক সেই সময়কার অবস্থা। ‘দালাইলামা’ পৃথিবীর ছাদে থাকা এককালের নিষিদ্ধ রাজ্য তিব্বতের ধর্মগুরুর পদবী। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের যে শাখাটি প্রচলিত আছে, তার প্রধান ধর্মগুরুকে দালাইলামা নামে অভিহিত করা হয়। মোঙ্গলীয় ভাষায় ‘দালাই’ শব্দের অর্থ সমুদ্র আর সংস্কৃত ‘লামা’ শব্দের অর্থ গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দটির পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় এমন এক শিক্ষক যার জ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা সমুদ্রের মতোই গভীর। অন্যদিকে দালাইলামাদের নামের সাথে গিয়াৎসু শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন"( বর্তমান দালাইলামার নাম তেনজিন গিয়াৎসু)'। তিব্বতীয় ভাষায় এই ‘গিয়াৎসু’ শব্দের অর্থও সমুদ্র। যে শব্দটি আসলে দালাইলামার সাথে অনেকটাই সমার্থক। কিন্তু তাহলে দালাইলামা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে? চলুন জেনে নিই কে এই দালাইলামা?দালাইলামার সাথে জড়িয়ে আছে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ইতিহাস,রাজা নামরি সংজেন এর হাত ধরে তিব্বত রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় সপ্তম শতাব্দীতে। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীতে সংজেন এর বংশধরেরা প্রতিবেশী চীন সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আয়তন বাড়াতে থাকে। নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি মধ্য এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এই তিব্বত রাজ্য। প্রতিবেশী চীনের সাথেও বাড়তে থাকে সংঘর্ষ। তাই ৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাত এড়াতে শান্তিচুক্তি করে। পঞ্চম শতাব্দীতে প্রথম তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু হয়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর আগ পর্যন্ত তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের তেমন প্রচার হয়নি। অষ্টম শতাব্দীতে রাজা ত্রাইসং দাস্তেন বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একে রাজধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেন। রাজার আমন্ত্রণে চীন আর ভারত থেকে বৌদ্ধভিক্ষুরা দলে দলে তিব্বতের রাজসভায় এসে যোগ দেন। পাশাপাশি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তখনকার দিনে তিব্বতের অধিবাসীরা ‘বন’ নামক এক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ঐতিহাসিকের মতে ‘বন’ ধর্মের অনুসারীরা আর পুরোহিতরা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের সাথে তাদের সংঘর্ষের জের ধরে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বিদ্রোহ। বিশাল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে একই সাথে শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় তিব্বতজুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে কবলিত তিব্বতের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বিদ্রোহীরা। তবে তিব্বতের চীন এবং ভারত সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মানুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসবিদদের মতে আভালোকিতেসাভ্রা নামক বুদ্ধের এক অনুসারী ছিলেন, যিনি হিমালয়ের পাদদেশের মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবেন বলে বুদ্ধকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তার অনুসারীরাই পরবর্তীতে তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতের লাসায় এসে বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর শিক্ষকেরা ‘লামা’ নামে পরিচিত ছিলেন। লামাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণ তার হাতেই শিক্ষাকেন্দ্রের সকল দায়িত্বভার অর্পিত থাকতো। তিব্বতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে একদিকে অখন্ড তিব্বত রাজ্যের পতন ঘটে, অন্যদিকে তিব্বতজুড়ে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচারের কারণে ধীরে ধীরে প্রধান লামাদের হাতেই তিব্বতের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। ১২৭১ সালে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান চীনে প্রতিষ্ঠা করেন ইউয়ান সাম্রাজ্য। ধীরে ধীরে পরিধি বড় হতে থাকা ইউয়ান সাম্রাজ্যের দখলে আসে তিব্বতও। ১৫৬৯ সালে তৎকালীন ইউয়ান সম্রাট আটলান খান তৎকালীন তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরু লামাদের প্রধান সোনাম গিয়াৎসুকে তার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তবে প্রধান লামা তার বদলে তার কয়েকজন শিষ্যকে আলটান খানের রাজদরবারে পাঠান। তার শিষ্যরা তাকে ফিরে এসে আলটান খান এবং তার রাজ্যসদস্যদের বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানায়। অবশেষে ১৫৭৭ সালে সোনাম গিয়াৎসু আটলান খানের রাজদরবারে আসেন। আটলান খান সোনাম গিয়াৎসুর জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দালাইলামা উপাধি দেন। তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের বিশ্বাসীদের মতে প্রধান লামা ‘গেনদুন দ্রুপ’ এর তৃতীয়বার জন্ম নেন সোনাম গিয়াৎসুর মাধ্যমে। তাই সোনাম গিয়াৎসুকে মূলত আখ্যায়িত করা হয় তৃতীয় দালাইলামা হিসাবে। দালাইলামা উপাধির পাশাপাশি আটলান খান তিব্বতের শাসনক্ষমতার ভারও তাদের হাতেই অর্পণ করেন। ১৬৪২ সালে পঞ্চম দালাইলামা লবসাং গিয়াৎসুর সময়ে দালাইলামাদের ক্ষমতায় কিছু সংস্কার আনা হয়। এরপর থেকে ৩৭৫ বছর ধরে তিব্বতের প্রধান আধ্যাত্মিক আর ধর্মীয় গুরু হিসাবে তিব্বতের ক্ষমতার বিধিবিধান অপরিবর্তিতভাবে ন্যস্ত আছে দালাইলামাদের হাতে। দালাইলামা কি নির্বাচিত হয়ে থাকেন ? কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং একজন দালাইলামার মৃত্যুর পর এক আশ্চর্য প্রথা অনুসরণ করে খুঁজে বের করা হয় আরেকজন দালাইলামাকে। তিব্বতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১৪ জন দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়েছে। তিব্বতের বৌদ্ধ ‘গেলুগ’ শাখার বিশ্বাস অনুসারে দালাইলামা একবার দেহত্যাগ করলেও তাদের বার বার র্জন্ম হয়। পৃথিবীর অনাগত মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতেই তার এই পুনর্জন্ম। তাই একজন দালাইলামার মৃত্যুর সাথে সাথে তিব্বতের প্রধান লামারা একত্র হয়ে খোঁজ শুরু করেন নতুন দালাইলামারূপী শিশুকে। মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করা শিশু দালাইলামাকে। প্রধান লামাদের স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশ: একজন দালাইলামার মৃত্যুর পরেই প্রধান লামাদের কেউ একজন তাদের স্বপ্নে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাবার জন্য কী করতে হবে তার ইঙ্গিত পান। সেই অনুসারে কাজ করে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়।ধোঁয়ার গতিপথ অনুসরণ করা, প্রধান লামাদের কেউ যদি স্বপ্নে কোনো নির্দেশ না পান তাহলে পূর্ববর্তী দালাইলামার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যে ধোঁয়া নির্গত হয়, লামারা তার গতিপথ অনুসরণ করেন। সেই ধোয়ার গতিপথ অনুসরণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে দালাইলামাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তারা।‘লামও-লা-সো’ নামক এক সরোবরের পারে ধ্যান,যখন অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাওয়া না যাবে, তখন লামও-লা-সো নামক পাহাড়ঘেরা এক সরোবরের পাড়ে ধ্যান শুরু করেন লামারা। ৫,৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ২ বর্গ কিলোমিটারের এই সরোবরের ব্যাপারে তিব্বতে প্রচলিত আছে অনেক রূপকথা। তবে তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের মতে এই সরোবরের দেবী পালদেন লামো প্রথম দালাইলামাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি দালাইলামাদের পুনর্জন্মের ধারাকে অব্যাহত রাখবেন। তাই প্রধান লামারা শিশু দালাইলামার ব্যাপারে কোনোরূপ ইঙ্গিত পাওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন সেই ধ্যান। ১৯৩৫ সালে বর্তমান ১৩ তম দালাইলামার মৃত্যুর পর তার পরবর্তী তেনজিন গিয়াৎসুকে খুঁজে বের করতে ৪ বছর ধ্যানরত ছিলেন প্রধান লামারা। ৪ বছরের মাথায় লামারা তার ব্যাপারে অবহিত হয়ে তাকে খুঁজে বের করেন। শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করার পর তার সামনে অন্যান্য জিনিসের সাথে পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কিছু জিনিস উপস্থাপন করা হয়। যদি সেই শিশু পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কোনো জিনিস বাছাই করে, তবেই তাকে পরবর্তী দালাইলামা হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে দালাইলামার এই অনুসন্ধান শুধুমাত্র তিব্বতেই সীমাবদ্ধ।বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা আর জীবন,প্রধান লামাদের অধীনে রাজধানী লাসায় ৬ বছর বয়সে বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ইতোমধ্যে ১৯৫০ সালে চীন তিব্বতের দখল নেয়। কিন্তু মার্চ ১৯৫৯ এ তিব্বতের জনগণ তাদের স্বায়ত্ত্বশাসন পুনরায় আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে এবং চীনের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন । হাজারখানেক তিব্বতী জনগণ হতাহত হয়। দালাইলামাকে তার বাসস্থান পোতালা প্যালেস থেকে উৎখাত করা হয়। দালাইলামা তিব্বত থেকে ভারতে পাড়ি জমালে তাকে আশ্রয় দেয় ভারত সরকার। সেই থেকে ভারতের ধর্মশালায় অবস্থান করছেন দালাইলামা। চীনের সাথে সংঘাত এড়াতে সবসময়ই সমঝোতা আর অহিংসার কথা বলে আসছেন তিব্বতের এই নেতা। ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকা হাজার হাজার তিব্বতি লামা আর লক্ষাধিক অনুসারীদের শান্তভাবে চীন সরকারের এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহবান জানিয়ে আসছেন এই নেতা। নিজের জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েও জীবনের শেষ দিনগুলোতে এই নেতা বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দিচ্ছেন অহিংসার বাণী। আর এজন্য তাকে ১৯৮৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। যেহেতু নোবেল পুরস্কারের কথা চলে এসেছে, এর সাথে কিছু অংশ যোগ করছি । '(চতুর্দশ দালাই লামার শান্তিতে নোবেল জয় শিরোনামে ,৫/১০/২০২২ইং। সময়:৬:৪৮ মি,প্রথম আলো ,তিব্বতের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদবি হলো দালাই লামা। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বর্তমান দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসু নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। চীন সরকারের কাছ থেকে মাতৃভূমি তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন আদায়ের আশায় তিনি সংঘাতে জড়ানোর পরিবর্তে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন সমঝোতা ও অহিংসার বাণী। ১৯৮৯ সালের এই দিনে তিনি শান্তিতে নোবেল জয় করেন তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের শাখাটির প্রধান ধর্মগুরুকে দালাই লামা নামে অভিহিত করা হয়। দালাই লামা শব্দের অর্থ এমন একজন দীক্ষাদাতা, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা সমুদ্রের মতো গভীর। তিব্বতিদের কাছে তিনি শুধু প্রধান ধর্মগুরুই নন, তাঁদের আধ্যাত্মিক নেতা এবং শাসনতন্ত্রের শীর্ষ পদাধিকারী। তিব্বতি বিশ্বাস অনুসারে দালাই লামা হলেন স্বয়ং বুদ্ধের অবতার। ত্রয়োদশ দালাই লামা মৃত্যুবরণ করলে পরবর্তী দালাই লামার খোঁজে দ্বিতীয় প্রধান আধ্যাত্মিক গুরু পানচেন লামার নেতৃত্বে প্রধান লামারা সাড়ে ১৭ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লামাও লা সো হ্রদের ধারে ধ্যান শুরু করেন। বলা হয়, দীর্ঘ চার বছর ধ্যান করে তাঁরা উত্তর-পূর্ব তিব্বতের একটি গ্রামে শিশু লামো থোনদুপকে খুঁজে পান। আর ওই শিশুকেই ত্রয়োদশ দালাই লামার পুনর্জন্ম অর্থাৎ চতুর্দশ দালাই লামা বলে ঘোষণা করা হয়। দালাই লামা নির্বাচিত হওয়ার পর শিশুটির নাম রাখা হয় তেনজিন গিয়াৎসু। ছয় বছর বয়সে তাঁকে তিব্বতের রাজধানী লাসায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং প্রধান লামাদের অধীনে শুরু হয় শিক্ষাজীবন। ২৪ বছর বয়সে নতুন দালাই লামা বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিব্বতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে চীনারা বেশ কয়েকবার শান্তিপ্রিয় তিব্বতিদের ওপর আক্রমণ করে। চীনারা তিব্বতিদের সম্পদ লুট করে এবং বহুসংখ্যক মঠ ধ্বংস করে। ১৯৫০ সালে চীনা কমিউনিস্ট বাহিনী তিব্বত আক্রমণের মধ্য দিয়ে সমগ্র তিব্বত দখল করে নেয়। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য চীনা শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন এবং চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তখন দালাই লামাকে তাঁর বাসভবন পোতালা প্রাসাদ থেকে উৎখাত করা হলে তিনি তাঁর কিছু অনুগামীসহ ভারতে পাড়ি জমান। ভারত সরকারের একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে হিমালয়ের পাদদেশ ধর্মশালায় বসতি স্থাপন করেন তিনি। ১৯৮৯ সালের আজকের এই দিনে চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসু নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল কমিটির ভাষ্যমতে, তাঁর অনুসারীদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাঁকে এ সম্মান দেওয়া হয়)"। যেহেতু চীন এবং তিব্বতের কথা এসেছে। তাই এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করছি, যদিও পূর্বে এই বিষয়ে কিছুটা ধারণা দিয়েছিলাম আরো বিস্তারিত ভাবে কিছু অংশ সংযোজন করছি। ১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ শুরু হয়েছিল তিব্বতে চীনা দখলদারির বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান। তার পরিণতিতে দালাই লামা এবং হাজার হাজার তিব্বতীকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত পালাতে হয়েছিল। সেই অভ্যুত্থানের সময় লাসায় তিব্বতীদের প্রতিরক্ষার আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন নাওয়াং টংডক নাকেট। ১০ই মার্চ ভোরবেলা। নাওয়াং টংডক নাকেট যাচ্ছেন নবলিংকায় দালাই লামার বাসভবনে, তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ডাক পাঠিয়েছেন তিব্বতীদের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক গুরু। তিনি দেখলেন, নবলিংকার পথে চলেছেন আরো হাজার হাজার লোক। তারা শ্লোগান দিচ্ছেন, "চীনারা চীনে ফিরে যাও।আমাদের চীনাদের কোন দরকার নেই।" নাকেট ছিলেন দালাই লামার নেতৃত্বাধীন কাউন্সিলের একজন সদস্য। সেদিনই দালাই লামাকে চীনাদের প্রধান ঘাঁটিতে একটি নাটক দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু তাকে বলা হয়েছে দেহরক্ষী নিয়ে না আসতে। তিব্বতীরা সন্দেহ করলেন - হয়তো এটা তাকে আটক করার জন্য পাতা একটা ফাঁদ। দালাই লামা সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন , পাশাপাশি তিনি নাকেটকে লাসায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন, আর বলে দিলেন, চীন যদি কোনভাবে লাসার বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় – তাহলে তা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে। লাসা শহরে দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো চীনাদের দখলে। নাকেট এবং তার সাথীরা চীনা সামরিক অভিযান ঠেকানোর ব্যবস্থা গড়ে তুললেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, আক্রমণ অবধারিত। কয়েকদিন ধরে একটা অচলাবস্থা চলছে। এরই মধ্যে দালাই লামা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেলেন।১৯ তারিখ এ খবর জানার পর চীনারা গুলি চালাতে শুরু করলো এবং তখনই সত্যিকার অর্থে শুরু হয়ে গেল তিব্বতীদের অভ্যুত্থান। চীনা বাহিনীর গুলিবর্ষণে বহু লোক নিহত হলো।নাকেট তার চোখের সামনেই একটি হত্যাকান্ড দেখলেন। পরে তিনি নিজে দীর্ঘদিন ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটালেন। চীনের সবকিছুই তখন নাকেট ঘৃণা করতেন। যদিও পরে ধীরে ধীরে তার সেই মনোভাবের পরিবর্তন হয়। চীনের কমিউনিস্ট সরকার যুক্তি হচ্ছে যে , তিব্বতের পশ্চাৎপদ সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতির কারণে দরিদ্র তিব্বতীরা নিগৃহীত হচ্ছে, এবং তাদেরকে মুক্ত করা দরকার। কিন্তু স্বাধীনচেতা তিব্বতীরা চীনকে দেখতো দখলদার হিসেবে – যারা তিব্বতের সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি হুমকি। প্রফেসর নাওয়াং টংডক নাকেট পরে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন দালাই লামার সরকারি জীবনীকার। যেহেতু তিব্বতের কথা এসেছে আমি এই দেশটি সম্পর্কে কিছু তথ্য সংযোজন করছি। তিব্বতকে বলা হয়ে থাকে, নিষিদ্ধ নগরী , রহস্যময় এক দেশ। যে দেশের মানুষেরা প্রকৃতির মতোই শান্ত! শান্তিপ্রিয় তিব্বতীরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে বেশি কিছু জানাতে পছন্দ করেন না। তিব্বতের রহস্যময়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এর অত্যন্ত দুর্গম প্রকৃতি। হিমালয়ের উত্তরে বরফের চাদরে আবৃত তিব্বত শত শত বছর ধরে নিজেকে বহির্বিশ্ব থেকে আড়াল করে রেখেছে। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে অপার রহস্য লুকিয়ে আছে, তার মধ্যে তিব্বত অন্যতম। নিষিদ্ধ হিসেবে জগৎজোড়া কৌতূহল আছে এই দেশকে নিয়ে। তবে কেন নিষিদ্ধ দেশ তিব্বত? আসলে সমগ্র তিব্বত নিষিদ্ধ নয়। এর রাজধানী লাসা হলো নিষিদ্ধ নগরী। এই নগরীর মানুষেরা নিজেদেরকে আলাদা রাখতে পছন্দ করেন। সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও অনেক ভিন্ন আর রোমাঞ্চকর। তিব্বত মূলত আলাদা কোনো দেশ হিসেবে স্বীকৃত নয়। এটি চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। যদিও অনেকেই তিব্বতিদের চীনের অংশ মানতে রাজি নয়। এ কারণেই ১৯৬৯ সালে তিব্বতিরা দালাইলামার নেতৃত্বে চীনের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলে যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে তিব্বতের পরিচিতির মূলে আছে এর বৈরি প্রাকৃতিক পরিবেশ, নিষিদ্ধতা, অদ্ভূত জীবনযাপন। এসব কারণে তিব্বত বরাবরই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে । প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকায় মানুষ বছরের পর বছর ধরে তাদের এই কৌতূহল নিবারণ করতে সক্ষম হয়নি। আর এ সবকিছু মিলিয়েই তিব্বতের পরিচিতি গড়ে উঠে নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে। বছরে ৮ মাস বরফে ঢাকা থাকে তিব্বত। পৃথিবীর উচ্চতম স্থান তিব্বত, যেখানকার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুট। উচ্চতার কারণে তিব্বতকে পৃথিবীর ছাদ নামেও অভিহিত করা হয়। উচ্চতার কারণে এসব স্থানে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া কষ্টকর। প্রচণ্ড ঠান্ডা আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে এখানে বসবাস করাও কষ্টকর। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও বিপজ্জনক আবহাওয়ার কারণে তিব্বতে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়ে পর্যটকদের বেশি আগ্রহও নেই। ফলে বহুকাল ধরে তিব্বতের রহস্য দুর্ভেদ্যই থেকে যায়। তারপর ১৯৮০ সাল থেকে তিব্বত ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং তিব্বতকে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তিব্বতের বিভিন্ন অদ্ভূত বিষয় বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। তিব্বতের সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে এর রাজধানী লাসা। যাকে বলা হয়ে থাকে নিষিদ্ধ নগরী। লাসা শব্দটির অর্থ হলো ‘ঈশ্বরের স্থান’। তিব্বতিদের জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে এই নগরী। পুরো লাসা জুড়েই ধর্মীয় আচার চর্চা করা হয়ে থাকে। তিব্বতিদের প্রধান ধর্মগুরু দালাইলামার বাসস্থানও লাসার পোতালা প্রাসাদে। শোনা যায়, এই প্রাসাদের চূড়া সোনার তৈরি। এই বিশালাকার প্রাসাদটি প্রথম জনসম্মুখে আসে ১৯০৪ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এর ছবি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই ছবি প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত বাইরের কেউ প্রাসাদটির ছবি দেখতে পায়নি। এ ছাড়াও শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির। এমনকি সেখানে চার হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও আছে। জনসাধারণের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় ধীরে ধীরে এই অঞ্চলটির পরিচিতি হয়ে উঠে নিষিদ্ধ নগরী হিসেবে। শুধু দালাইলামাদের নিষেধাজ্ঞাই নয়, লাসার প্রকৃতিও এই শহরটিকে রহস্যময় করে রেখেছে। লাসা অবস্থানগতভাবে একেবারেই বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল। পৃথিবীর উচ্চতম শহর লাসা, যার উচ্চতা ১১ হাজার ৯৭৫ ফুট।তিব্বতে ভ্রমণ, প্লেনে, ট্রেনে এমনকি বাই রোডেও যাওয়া যায় তিব্বতে। তিব্বতের ভূপ্রকৃতি বা তিব্বতিদের রীতিনীতি রহস্যময় হলেও এগুলো সত্য এবং মানুষ এগুলো স্বচক্ষে দেখে তাদের কৌতূহল নিবারণ করতে পেরেছেন। ভ্রমণপিপাসুরা চাইলে তিব্বতের রাজধানী লাসাকে কেন্দ্র করে পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে ভ্রমণ করতে পারেন। লাসা ও এর উপকণ্ঠে অবস্থিত পোটালা প্রাসাদ, তা চাও মন্দির, জে পাং ও সে লা মন্দিরে- ঘুরতে কয়েকদিন সময় লাগবে। অন্যদিকে তিব্বতের পূর্বাঞ্চলে আছে- লিন শি, পা সোং ছুও, ইয়ারলাং চাংপু গ্রান্ড ক্যানিয়ন, লু লাং ও মো থুও। এ ছাড়াও তিব্বতের দক্ষিণাঞ্চলে আছে- সাং ইয়ে মন্দির, ইয়ো বু লাখাং, ছাং চু মন্দির ও জে কু মন্দির। আর পশ্চিমাঞ্চলে আছে- শীগেস্ট সিটি, এভারেস্টের ঘাঁটি, চাশিলুনবু মন্দির, চি লং। উত্তরাঞ্চলে দর্শণীয় স্থানের মধ্যে আছে- নামটসো ও ইয়াং পা চিং। একটি দেশ এবং এর ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। খুবই সহজভাবে একটি দেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে শত শত বছরের ইতিহাস , কিংবা হাজার বছরের ইতিহাস বললেও ভুল বলা হবে না। তিব্বতের ইতিহাস মূলত তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও বিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই ধর্ম শুধুমাত্র তিব্বতী সংস্কৃতি নয়, মঙ্গোল ও মাঞ্চু জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়ে ওঠে। ভারত ও চীনের মতো দুইটি সুপ্রাচীন সভ্যতার মধ্যবর্তী স্থানে তিব্বতী সভ্যতার বিস্তার ঘটে। তিব্বত মালভূমির পূর্বে অবস্থিত পর্বতশ্রেণী তিব্বত ও চীনের মধ্যেকার সীমান্ত হিসেবে দীর্ঘকাল অবস্থান করছে। অপরদিকে হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী ভারত ও নেপালের রাজ্যগুলি থেকে তিব্বতকে পৃথক করে রেখেছে। এই দুই সভ্যতার মধ্যে মূলতঃ ভারত থেকে শান্তরক্ষিত, কমলশীল, বিমলমিত্র, অতীশ দীপঙ্করের মতো বহু বিখ্যাত মহাযানী বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং পদ্মসম্ভবের মতো বিখ্যাত তান্ত্রিক তিব্বতের দুর্গম পথে যাত্রা করে তিব্বতী শাসককদের পৃষ্ঠপোষকতায় তন্ত্রসমৃদ্ধ তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের সূচনা ও প্রসার ঘটান এবং তিব্বতে একটি ধর্ম ও তন্ত্রকেন্দ্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। ১৪ তম দালাই লামা তেনজ়িন গিয়াৎসো , ১৭ নভেম্বর ১৯৫০ এখনো পর্যন্ত বর্তমান। উনার পূর্বসূরী,থুবতেন গিয়াৎসো।৬ জুলাই ১৯৩৫ সালে জন্ম এবং বর্তমানে ৮৭ বছর অতিক্রম করছেন। উনার জন্মের নাম , লামো থোঁডুপ ।"দালাই লামা" নামটি হল মঙ্গোলিক শব্দ দালাই এর সংমিশ্রণ যার অর্থ "সমুদ্র" বা "বড়",এটি একটি উপাধি।মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ দেশগুলিতে, সহস্রাব্দ ধরে এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে অবলোকিতেশ্বর, করুণার বোধিসত্ত্ব, তিব্বতের জনগণের সাথে একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং দালাই লামাদের মতো পরোপকারী শাসক এবং শিক্ষক হিসাবে অবতারণা করেন এবং তাদের ভাগ্য হস্তক্ষেপ করেন। এটি কদাম্পা স্কুলের প্রধান পাঠ্য বই কদম অনুসারে, যেখানে প্রথম দালাই লামা, গেন্ডুন ড্রুপ প্রথম ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এই পাঠ্যটি তিব্বতিদের পরবর্তীকালে দালাই লামাদের অবলোকিতেশ্বরের অবতার হিসেবে চিহ্নিত করার ভিত্তি স্থাপন করেছে। এটি বোধিসত্ত্বের অবতারের কিংবদন্তীকে তিব্বতের প্রথম দিকের রাজা এবং সম্রাট যেমন সোংটসেন গাম্পো এবং পরে দ্রোমটোনপা (১০০৪-১০৬৪) হিসাবে চিহ্নিত করে।তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামাকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। নির্বাসিত এ ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত জীবন আসলে কেমন ? ভারতীয় ফটোসাংবাদিক রাঘু রাই-এর একটি নতুন বই এসেছে বাজারে যেখনে তিনি অনেকটা নজিরবিহীন ভাবে তুলে ধরেছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন আধ্যাত্মিক নেতার জীবন
লোকচক্ষুর অন্তরালে কিভাবে কাটে দালাইলামার সময় কিংবা ঘরে বাইরে কি করে সময় কাটান তিনি তার সবকিছুই উঠে এসেছে এ বইতে।("অ্যা গড ইন এক্সাইল- বা নির্বাসনে একজন ঈশ্বর নামক ")এই বইতে আসলে ফটোসংবাদিকের অন্তদৃষ্টিতে দেখা দালাইলামার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা হয়। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন, "কিভাবে যেন আমি তাঁর (দালাইলামা) সাথে দৃষ্টি বিনিময়ের সুযোগ করে ফেললাম এবং তাকে বললাম যে তাঁর কিছু ছবি তুলতে পারি কি-না। তিনি হাসলেন এবং বললেন, হ্যাঁ।" এরপর তিনি দালাইলামার ছবি তুলেছেন বহুবার এবং গড়ে তুলেছেন এক 'গভীর বন্ধুত্ব'। ১৯৫৯ সালের মার্চে চীনা সেনাবাহিনীর হামলার মুখে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন দালাইলামা, তখন তিনি বিশের কোঠায় থাকা এক তরুণ।পরে ভারত সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় এবং তিনি আবাস গড়েন উত্তরাঞ্চলীয় শহর ধর্মশালায়। তাকে অনুসরণ করে নির্বাসনে আসে তিব্বতের প্রায় ৮০,০০০ মানুষ এবং তারা একই শহরে বসবাস শুরু করে। আরো উল্লেখিত স্মৃতিচারণে ,মি. রাই বলছেন, "যখন তিনি তিব্বতের কারও দিকে তাকান। তখন তাঁর চোখ দেখা উচিত। মনে হবে দাদু তার নাতি বা নাতনীকে আদর করছেন।"২০১৪ সালে মি. রাই নিজের তোলা দালাইলামার ছবি নিয়ে একটি বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।"তিনি প্রাণীর সাথে খেলতে ভালোবাসেন। একদিন আমি তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন হঠাৎ তার সাথে একটি বিড়াল দেখতে পাই"।প্রাণী ভালোবাসেন দালাইলামা। একবার ধর্মশালায় ২০১৫ সালে দালাইলামার ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ছবিও তোলেন মি. রাই। সেখানে দালাইলামার বড় ভাইও এসেছিলেন এবং তাকে কৌতুক করে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন 'ট্রাবলমেকার বা সমস্যাসৃষ্টিকারী' হিসেবে। রাঘু রাইয়ের তোলা কিছু ছবিতে দালাইলামা নিজের টেলিভিশন ঠিক করছেন কিংবা বাড়িতে বাগানের কাজ করছেন, আর এসব তিনি নিজের হাতে করতেই পছন্দ করেন।"আসলে তিনি আমাকে বহু ভাবে ছবি তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন"।বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন।
পরিশেষে শেষ সম্পাদনায় বলবো,তিব্বত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের একটি আঞ্চলিক পৰ্যায়ের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। তিব্বত অঞ্চলকে প্রতিস্থাপিত করে এই অঞ্চলকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। জনসংখ্যা ৩১,৮০,০০০,(ডিসেম্বর,২০১৪)এই অঞ্চলের বর্তমান সীমারেখা ১৮ শতকে নির্ধারিত করা হয়।এবংজাতিগত-সাংস্কৃতিক তিব্বতের অৰ্ধাংশসহ। আয়তনে ১২,২৮,৪০০ বর্গকিলোমিটার (৪,৭৪,৩০০ বর্গ মাইল) অঞ্চল নিয়ে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চীনের জিংজিয়াং অঞ্চলের পর দ্বিতীয় সৰ্ববৃহৎ অঞ্চল, এমনকি পার্বত্য এবং দুর্গম পরিবেশের অঞ্চল হওয়ার জন্য চীনের সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৯৫০ সালে চীনের গণ মুক্তি সেনা তিব্বতী সেনাবাহিনীক চামডো শহরের নিকট এক যুদ্ধে পরাজিত করে। ১৯৫১ সালে তিব্বতের প্ৰতিনিধিরা চীনা কেন্দ্ৰীয় গণ সরকারের সাথে একটা ১৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ফলস্বরূপ তিব্বত চীনের সাৰ্বভৌম দখলদারিত্ব লাভ করার সাথে সাথে তিব্বত চীনের অঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। চুক্তিপত্রটি কয়েক মাস পর লাছা'তে অনুমোদন করা হয়।যদিও ১৭ দফা এই চুক্তিপত্রটিতে দালাই লামাকে স্বায়ত্তশাসনের ভার প্ৰদান করা হয়েছিল, ১৯৫৫ সালে সাম্যবাদী কায়দায় "তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের প্ৰস্তুতি সমিতি" গঠন করা হয় এক সমপৰ্যায়ের শাসন বব্যস্থা চালানোর জন্য। ১৯৫৯ সালে দালাই লামা ভারত পালিয়ে আসেন এবং ১৭ দফা চুক্তিপত্রটি বর্জন করা হয়। ১৯৬৫ সালে এইভাবে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠিত হল, যার মৰ্যাদা অন্যান্য চীনা অঞ্চলের সমান।তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পৃথিবীর সর্বোচ্ছ স্থান তিব্বতীয় মালভূমিতেতে অবস্থিত। উত্তর তিব্বতীয় ঢালু গড়ে ৪,৫৭২ মিটার (১৫,০০০ ফু) এর ও বেশি। নেপালের সাথে তিব্বত সীমান্তে মাউন্ট এভারেস্ট অবস্থিত
স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি সাতটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত: পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং দুইটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এই প্রশাসনিক অঞ্চলনসমূহ মোট ৬৮টি প্রদেশ পর্যায়ের প্রশাসনিক উপবিভাগে এবং পাঁচটি জেলাঃ (লাসা, দইলুংডেগেন, সামযুবযে, কারুব, বায়ি, এবং নেডং।তিব্বতের অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তিব্বতি জনগোষ্ঠী মহাযান মতে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম চর্চা করে থাকে। জীবন জীবিকার জন্য তিব্বতীয়রা ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। চীনা অর্থনৈতিক সংস্কার এর প্রভাবে ১৯৮০ সালে,তিব্বতে ট্যাক্সি চালনা এবং হোটেল ব্যবসা সহজলভ্যতা লাভ করে। তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লাসায় পোতালা প্রসাদ।বিদেশি পর্যটকরা তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রথম ভ্রমনের সুযোগ পায় ১৯৮০ সালে। তখন প্রধান আকর্ষণ ছিল লাসায় অবস্থিত পোতালা প্রসাদ, এছাড়াও আরো অনেক আকর্ষণীয় স্থানের মধ্যে রয়েছেঃজোখাং মন্দির, নামতসু হ্রদ, এবং তাশিলহুনপ আশ্রম। পাশাপাশি ,তিব্বতের মুসলমান ও তাদের ধর্মকর্ম এই শিরোনামে তা সংযুক্ত করছি "(১৩/৭/২০১৮ইং, দৈনিক কালের কণ্ঠ,তিব্বতের ঐতিহাসিক লাসা মসজিদ,তিব্বত মহাচীনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। পশ্চিম চীনে অবস্থিত এই অঞ্চলের উত্তরে চীনের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ঝিনঝিয়াং ও কিংহাই প্রদেশ, পূর্বে সিচুয়ান প্রদেশ, দক্ষিণ-পূর্বে চীনের ইউয়ান ও বার্মা এবং দক্ষিণে ভারত, ভুটান ও নেপাল। এর আয়তন ২.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। শত শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত তিব্বতের জনগণের রয়েছে পৃথক ভাষা, ধর্মবিশ্বাস ও আচারপ্রথা। তিব্বতি জনসংখ্যা ৭৮ লাখের মতো ধরা হয়। এরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা গানসু, কিংহাই ও সিচুয়ান অঞ্চলে বসবাস করে ২২ লাখের মতো। তা ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটানে বাস করে যথাক্রমে এক লাখ ৮৯ হাজার, ১৬ হাজার ও চার হাজার ৮০০ তিব্বতি। বহির্বিশ্বে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশেও তিব্বতি মানুষ রয়েছে। তিব্বতের জনগণ বহু বছর যাবৎ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করলেও পরিশেষে তারা চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। চীনের স্বায়ত্তশাসনের আড়ালে তিব্বতি জনগণের ওপর চলেছে নানা প্রকার নিপীড়ন। ফলে নির্যাতিত মানুষ দেশ ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ দুনিয়ার নানা দেশে। তিব্বতি মানুষের বেশির ভাগই বিশেষ ধরনের বৌদ্ধ ধর্মমতের অনুসারী। সপ্তম শতকে তিব্বতে এই ধর্ম পৌঁছেছিল। দালাই লামা হলেন তিব্বতি বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক ও দুনিয়াবি প্রধান। মধ্যযুগের মুসলিম ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিশারদের মধ্যে ইবনে খালদুন, আল-বিরুনি, তাবারি, ইয়াকুবি, রশিদুদ্দিন, ইয়াকুত আল-হামাভি প্রমুখের লেখায় তিব্বতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা তিব্বতকে ‘তেহরাত’ বা ‘খেতাব’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজের খেলাফতকালে (৭১৭-৭২০) চীন ও তিব্বতে ধর্ম প্রচারের জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর অনুরোধ পান। তাই তিনি সালিত বিন আবদুল্লাহ আল হানাফিকে তিব্বতে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানকার মানুষের মধ্যে দ্বিনের দাওয়াত প্রচার করেন। তাই সেই সময় কিছু না কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে অষ্টম শতকের দিকে তিব্বতে ইসলামের আগমন ঘটে। মুসলিম শাসক মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ সালে সিন্ধু বিজয় করলে তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত হয়। আর এই সম্পর্ক ভারত, চীন ও মালয় উপদ্বীপ পেরিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়। আব্বাসীয় মুসলিম শাসনামলে তিব্বত ও ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহাল ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতের রাজা মুসলিম শাসক খলিফা আল মাহদির (৭৭৫-৭৮৫) কর্তত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে অষ্টম শতাব্দী থেকে তিব্বতের স্বর্ণ মুসলিম বিশ্বে রপ্তানি হয়। এই স্বর্ণ দিয়েই মুসলিম শাসকরা দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করতেন। দশম শতাব্দীতে ফারসিতে লিখিত ‘হুদুদ আল-আলম’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিব্বতের কেন্দ্রীয় শহর ‘লাসাতে’ একটি মসজিদ ছিল। যদিও এই শহরে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল খুবই কম। একাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দিকে বাংলার শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি (মৃত্যু ১২০৫ সাল) তিব্বতসহ ওই অঞ্চলের কিছু অংশ অধিকার করেন। বাদাখশান ও কাশ্মীরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাল্টিস্তানসহ তিব্বতের কিছু অংশ পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এবং ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম সেনাদল জয় করেছিল। এরপর সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিব্বত ছিল মঙ্গোল-তুর্কি বংশোদ্ভূত কালমাক শাসকদের অধীনে। বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি ও বিশাল ভৌগোলিক অংশের দাবিদার চীন ও ক্ষুদ্র তিব্বত পাশাপাশি দুটি অঞ্চল। এ কারণেই হয়তো অঞ্চল দুটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়েছে। অন্যদিকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ইসলামের আগমনের অনেক আগে থেকেই বহাল ছিল। চীনা সওদাগররা তাঁদের পণ্য বেচাকেনার জন্য আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে সমুদ্রপথে নিয়ে যেতেন। চীনের এক সূত্র মতে জানা যায়, ৬৫১ সালে আরবের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল চীনের ক্যান্টন (বর্তমানে গুয়াংজু) নগরী সফর করেছিল। তখন ইসলামী খেলাফতের কর্ণধার ছিলেন হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.)। মুসলিম ইতিহাসবিদরা বলেন, মুসলমানদের ওই বাণিজ্য কাফেলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহানবী (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)। তিনি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে এসে চীনে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পান। তাঁর সংস্পর্শে এসে চীনাদের অনেকে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা লাভ করে। মুসলমানের ইবাদতের জন্য সাদ (রা.) ক্যান্টনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, চীন ও তিব্বতের প্রথম দিকের মুসলমানরা আরব, পারস্যবাসী, মধ্য এশিয়া ও মঙ্গোলীয় মুসলিম ব্যবসায়ী ও সৈনিকদের বংশধর। এরা সপ্তম ও দশম শতাব্দীতে চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এসব মুসলমানের অনেকে চীন ও তিব্বতের নারীদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বাভাবিকভাবেই ওই সব নারী ইসলামে দীক্ষিত হন। মহাচীনের সমাজে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য ব্যাপক। ‘হানরা’ চীনের বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। দেশটির বর্তমান জনসংখা ১৩৫ কোটি। এর ৯১.৫৯ শতাংশই হান জনগোষ্ঠীর লোক। চীনা সরকার ৫৫টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারিভাবে এরা ‘মিনজু’ বা সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত। তাদের সংখ্যা ১২ কোটি, যা মোট চীনা জনসংখ্যার মাত্র ৮.৪৯ শতাংশ। চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ ইসলামের অনুসারী। এদের মধ্যে রয়েছে উই, উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ, সালার, বাওয়ান (বোনান), দংজিয়াং, উজবেক, তাজিক ও তাতার। তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ গোষ্ঠীগুলো হলো হুই, উইঘুর ও কিরগিজ। এরা সংখ্যায় যথাক্রমে এক কোটি পাঁচ লাখ, এক কোটি ও দুই লাখ। বেশির ভাগ হুই জনগোষ্ঠীর বাস চীনের উত্তর ও পশ্চিম অংশের প্রদেশগুলোতে। এসব জনগোষ্ঠীর পেশা কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কারুকাজ। এসব জনগোষ্ঠীর লোকেরা আরব, মধ্য এশিয়া ও পারস্যের ব্যবসায়ীদের বংশধর। এরা সপ্তম শতাব্দী থেকে চীনে আগমন করে এবং এখানে বসতি স্থাপন করে। হুই সম্প্রদায়ের লোকেরা অনেকে স্থানীয় চীনা নারীদের বিয়ে করার ফলে ক্রমেই তারা চীনা সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে। এখন তারা ম্যান্ডারিন বা অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে। হুই মুসলমানরা যে চীনের মূলধারার সঙ্গে মিশে গেছে, তার প্রমাণ হলো তাদের সবাই চীনা নাম ধারণ করেছে। চীনাদের হুই সমাজে মুহাম্মদকে ‘মা’ বা ‘মু’ বলা হয়। একইভাবে হুইদের নামে ‘হুসাইন’ হয়ে ‘হু’, ‘সাঈদ’ হয়ে গেছে ‘সাঈ’, ‘শামস’ হয়ে গেছে ‘ঝেং’ এবং ‘উসমান’ হয়ে গেছে ‘কারি’। তিব্বতি মুসলমানদের বংশধারা মিশ্রিত। তাদের পূর্বপুরুষরা কাশ্মীর, লাখাদ ও মধ্য এশিয়া থেকে তিব্বতে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তারা সেখানকার তিব্বতি মহিলাদের বিয়ে করে। এভাবে মুসলমানরা তিব্বতের সমাজের অংশে পরিণত হয়। তিব্বতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ। ইতিহাসের পর্যায় অবলোকন করলে দেখা যায়, তিব্বতের বৌদ্ধ নেতারা সাধারণত সহিষ্ণু। সেখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির প্রতি বৌদ্ধ নেতারা উদার মনোভাব পোষণ করেন। পঞ্চম দালাই লামার (১৬১৭-১৬৮২) শাসনামলে মুসলমানরা ধর্মীয়, আইনগত, শিক্ষা, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অধিকার ভোগ করতেন। ধর্মকর্ম পালন, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানরা ব্যাপক স্বাধীনতা লাভ করেছিলেন। পঞ্চম দালাই লামা একটি মসজিদ ও গোরস্থানের জন্য মুসলমানদের কিছু জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয়, আইনগত ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয় ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে পারত। মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-কলহ বা বিরোধ মীমাংসার জন্য তারা নিজস্ব ইসলামী আইনের প্রয়োগ করতে পারত। তারা সরকারের পক্ষ থেকে কর অবকাশও লাভ করেছিল। প্রথম যুগে বৌদ্ধদের পবিত্র মাস ‘সাকাদাওয়ার’ সময় তিব্বতে গোশত বিক্রি ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ থাকলেও মুসলমানদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। সরকারের সব অনুষ্ঠানে মুসলিম নেতারা আমন্ত্রিত হতেন। সম্প্রতি চীনা সমাজে মুসলমানদের অধিকার কিছুটা হলেও সীমিত করা হয়েছে। তাদের নানাভাবে পীড়িত করছে সমাজ ও রাষ্ট্র। ধর্মীয় অধিকারের বিষয়টি সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেই মনে হয়। তার পরও মুসলমানরা যতটা সম্ভব নিজেদের ধর্মকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে)"।
তাছাড়া তিব্বতীয়দের আছে শত শত কিংবা হাজার বছরের সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বিভক্তিকরণ যুগ, গুজ রাজ্যের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি, ইউয়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি, মধ্য তিব্বতের (তিন) রাজবংশের ইতিহাস থেকে শুরু করে মঙ্গোলিয়ানদের শাসন এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ অভিযান প্রভৃতি।আর দীর্ঘায়িত করবো না, এটিই বলবো দালাই লামার উক্তি যা আপনাকে বিশ্বকে দেখার ,বিবেক বিবেচনা পরিবর্তন, ঘোরাঘুরিকে আলোকিত এবং আপনাকে আরও সহানুভূতিশীল
করতে সাহায্য করবে কিংবা চলার পথে সম্পূরক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।
যদিও বয়স এবং ক্লান্তির কারণে তার ভ্রমণের সময়সূচী উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে , দালাই লামা ১৯৫০ সাল থেকে আধ্যাত্মিক পরামর্শ প্রদান করে বিশ্ব ভ্রমণ করছেন। তার বিশাল আধ্যাত্মিক জ্ঞান মূলত বিদেশী জায়গায় নতুন সংস্কৃতির সাথে কাটানো সময় দ্বারা অতিবাহিত করেছেন। সম্ভবত এই কারণেই দালাই লামার জীবনের উদ্ধৃতিগুলি ভ্রমণকারী হিসাবে আমাদের শেখানোর মতো অনেক কিছু রয়েছে। সমবেদনা সম্পর্কে দালাই লামার উদ্ধৃতিগুলি আমাদের আরও বিবেকবান ভ্রমণকারী হতে সাহায্য করতে পারে, যখন দালাই লামার ভ্রমণের উদ্ধৃতিগুলি আমাদের নতুন জায়গাগুলি দেখতে এবং চিন্তার অপরিচিত উপায়ে নিজেদেরকে প্রকাশ করতে আরও অনুপ্রাণিত করতে পারে। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মার্জনার আবেদন রইলো এবং তথ্য গত কোনো ত্রুটি থাকলে দয়া করে অবহিত করবেন। অনেক শুভ কামনা রইলো সকলের প্রতি। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন এবং নিরাপদে ও আনন্দের মাঝে থাকুন এটিই কামনা। অনুপ্রেরণামূলক দালাই লামার উক্তিঃ
১)."আপনি ভ্রমণের সময় চিন্তা করার জন্য দালাই লামার উক্তি
"আসুন আমরা প্রতিটি দিনের মূল্যবান প্রকৃতি চিনতে চেষ্টা করি।"
২)"প্রতিদিন, ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে চিন্তা করুন: আজ আমি বেঁচে থাকার সৌভাগ্য পেয়েছি, আমার একটি মূল্যবান মানব জীবন আছে, আমি এটি নষ্ট করতে যাচ্ছি না।"
৩)"লক্ষ্য হল অন্য মানুষের চেয়ে ভালো হওয়া নয়, বরং আপনার আগের স্বত্ব।"
৪)"সতর্কতার সাথে বিবেচনা করুন, আপনি যেভাবে জীবনযাপন করতে চান সেভাবে বাঁচতে আপনাকে কী বাধা দেয়?"
৫)"আপনি শ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে নিজেকে লালন করুন। আপনি যেমন শ্বাস ছাড়বেন, সমস্ত প্রাণীকে লালন করুন।"
৬)"ভালবাসা এবং সহানুভূতি প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। এগুলি ছাড়া মানবতা বাঁচতে পারে না।"
৭)"এই জীবনে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল অন্যদের সাহায্য করা। এবং যদি আপনি তাদের সাহায্য করতে না পারেন, অন্তত তাদের আঘাত করবেন না।"
৮)"শান্তি মানে সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়; পার্থক্য সবসময়ই থাকবে। শান্তি মানে এই পার্থক্যগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা; সংলাপ, শিক্ষা, জ্ঞান এবং মানবিক উপায়ে।"
৯)"ধর্মের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য হল প্রেম এবং সহানুভূতি, ধৈর্য, সহনশীলতা, নম্রতা এবং ক্ষমা করা।"
১০)"শুধুমাত্র অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং বোঝাপড়ার বিকাশই আমাদের সেই প্রশান্তি এবং সুখ আনতে পারে যা আমরা সবাই খুঁজি।"
১১)"সহানুভূতি আমাদের সময়ের উগ্রবাদ।"
১২)"সহানুভূতি স্বাভাবিকভাবেই একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে, এবং ফলস্বরূপ, আপনি শান্ত এবং সন্তুষ্ট বোধ করেন।"
১৩)"ভালোবাসা এবং সহানুভূতি আমার কাছে সত্যিকারের ধর্ম। কিন্তু এটিকে বিকাশ করতে আমাদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করার দরকার নেই।"
১৪)"সহানুভূতির বিষয়টি মোটেও ধর্মীয় ব্যবসা নয়; এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে এটি মানব ব্যবসা, এটি মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন।"
১৫)"কখনও কখনও কেউ কিছু বলে একটি গতিশীল ছাপ তৈরি করে, এবং কখনও কখনও কেউ নীরব থাকার মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য ছাপ তৈরি করে।"
১৬)"যেখানে অজ্ঞতা আমাদের প্রভু, সেখানে প্রকৃত শান্তির কোন সম্ভাবনা নেই।"
১৭)"অন্যের মন পরিবর্তন করার উপায় স্নেহ দিয়ে, রাগ নয়।"
১৮)"মনে রাখবেন যে কখনও কখনও আপনি যা চান তা না পাওয়া ভাগ্যের একটি দুর্দান্ত স্ট্রোক।"।।