সেই দিনটার পর থেকে সব বদলে গেল।
তৃষ্ণা আর আরিয়ান কেউই আর একে অপরের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলছে না। ফোন বাজলেও কেউ ধরছে না, চোখে চোখ পড়লেও কিছু না বলে চলে যাচ্ছে। সম্পর্কের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, যেটা কেউ স্বীকার করছে না, কিন্তু দুজনেই অনুভব করছে গভীরভাবে।
তৃষ্ণা বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন আরিয়ান একবার অন্তত ফোন করে। কিন্তু না, সে ফোন করেনি।
আরিয়ানও প্রতিদিন ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকত, নাম্বার ডায়াল করত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কেটে দিত। তার মনে হচ্ছিল, "আমি কেন সবসময় ওকে আগে খুঁজব? এবার তৃষ্ণা নিজে এসে কথা বলুক!"
কিন্তু তৃষ্ণাও তো একই কথা ভাবছিল…
অভিমান জমতে জমতে…
এভাবে কেটে গেল পাঁচটা দিন।
কিন্তু একটা সময় আসলো, যখন আরিয়ান আর সহ্য করতে পারল না। তৃষ্ণার অভিমান, তার নিরবতা, সব মিলিয়ে যেন এক ভয়ানক শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার ভেতরে।
তাই, শেষ পর্যন্ত, সে একটা মেসেজ পাঠাল—
"লেকে আসো। যেদিন প্রথমবার ভালোবাসার অনুভূতি এসেছিল, সেই জায়গায়। প্লিজ।"
তৃষ্ণার হাত কাঁপছিল মেসেজটা দেখে।
সে জানত, না বলা অনেক প্রশ্ন জমেছে তাদের মধ্যে। কিন্তু আরিয়ান আজও তাকে সেই জায়গায় ডাকছে, যেখানে তাদের ভালোবাসার প্রথম শুরু হয়েছিল…
তৃষ্ণা জানত, সে যেখানেই থাকুক না কেন, আরিয়ানের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে না। যতই অভিমান থাকুক, যতই দূরত্ব তৈরি হোক—আরিয়ানের ডাক তার হৃদয়ের সব বাধা ভেঙে দেয়।
তাই সে গিয়েছিল, ঠিক সেই লেকের ধারে।
সন্ধ্যার নরম আলো তখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, হাওয়ার মৃদু ছোঁয়ায় জলের ঢেউ এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে। আরিয়ান দাঁড়িয়ে ছিল সেই পুরোনো জায়গায়, যেখানে একদিন দুজনের হৃদয় একসাথে কেঁপে উঠেছিল, যেখানে প্রথমবার তারা বুঝতে পেরেছিল, তাদের মাঝে শুধু বন্ধুত্ব নেই—তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু আছে।
তৃষ্ণা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
আরিয়ান তাকিয়ে রইল তার দিকে। এতদিন পর কাছ থেকে দেখতে পেয়ে তার ভেতরের সব অনুভূতি যেন একসাথে জেগে উঠল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে শুধু বাতাসের শব্দ, জলের মৃদু ঢেউ আর হৃদয়ের অস্থির স্পন্দন।
"তৃষ্ণা…" আরিয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, কণ্ঠে এক ধরনের গভীরতা।
তৃষ্ণা চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। সে দেখতে পাচ্ছিল, আরিয়ান কতটা কষ্ট পেয়েছে, কতটা অভিমান জমেছে তার ভেতরে।
"তুই আসবি জানতাম," আরিয়ান ফিসফিস করে বলল, তার গলায় প্রশান্তির স্পর্শ।
তৃষ্ণা কিছু বলল না, শুধু ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলল।
কিন্তু পরের মুহূর্তেই সব যেন বদলে গেল।
আরিয়ান হঠাৎ করেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে এক ঝটকায় তৃষ্ণাকে কাছে টেনে নিল, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
তৃষ্ণা হতবাক হয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই অনুভব করল, তার হৃদয়ও তো এতদিন ধরে এই স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল।
আরিয়ান গভীরভাবে ফিসফিস করে বলল, "আমি আর পারছি না, তৃষ্ণা… তোমার থেকে দূরে থাকতে পারছি না। কেন আমাদের মাঝে এত দূরত্ব? কেন আমরা একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছি?"
তৃষ্ণার নিশ্বাস গতি হারিয়ে ফেলল। এতদিনের অভিমান, কষ্ট, না বলা কথা—সব মিলিয়ে তারও আর নিজেকে আটকানোর শক্তি রইল না।
সে আস্তে করে চোখ বন্ধ করল, আর তারপর…
তাদের ঠোঁট একসাথে মিলিত হলো।
প্রথমে ধীরে, কাঁপতে কাঁপতে… তারপর যেন আবেগের বিস্ফোরণ ঘটল।
আরিয়ান তৃষ্ণাকে আরও গভীরভাবে নিজের মাঝে টেনে নিল, তার হাত শক্ত করে ধরে রাখল, যেন আর কখনো ছেড়ে দেবে না।
তৃষ্ণা প্রথমে অবাক হলেও, তারপর সেও নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে জড়িয়ে ধরল আরিয়ানকে। এতদিনের সব অভিমান, কষ্ট, ব্যথা যেন এই এক মুহূর্তেই উড়ে গেল।
সন্ধ্যার বাতাস বয়ে চলল, চারপাশে নীরবতা, আর সেই নীরবতার মাঝে শুধু ছিল দুটো হৃদয়ের নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি—
"আমি তোমায় ভালোবাসি… আমি তোমার ছিলাম, আছি, আর থাকব…"
চলবে........