গল্পটি রহিমা খাতুনের। আবার এটি রহিমা খাতুনের গল্প নাও হতে পারে। গল্পটি সম্ভবত জীবনের তাৎপর্যহীন অসংলগ্ন কোলাহলের।
রহিমা খাতুন একজন পেশাদার গৃহকর্মী। কবে থেকে এই পেশা বেছে নেয়া, রহিমা খাতুনের পক্ষে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভবপর নয়। এর মূল কারন সৎমায়ের সংসারে তার কাটানো জীবনের প্রথম ৯/১০ বছর সে গৃহকর্মী ছিল কিনা, তা রহিমার কাছে অস্পষ্ট। তার বাপের হাত ধরে প্রথম, ঐ বয়সে সে এই শহরে আসে।
একটি নবজাতক সহ তিন সদস্যের ছোট এবং সুখী একটি পরিবারে সে পেশাদার গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়। তার বেতন টি তখন তার বাপের কাছে সরাসরি পাঠানো হতো। নবজাতকটির মা যখন প্রাকৃতিক কর্মে বা গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকবেন, তখন নবজাতকটিকে কোলে পিঠে নেয়া, দেখে রাখা ইত্যাদি ছিল রহিমার প্রথম পেশাগত দায়িত্ব। অবশ্য অচিরেই এই দায়িত্বের পাশাপাশি নবজাতকটির কাঁথা ও বিছানায় লেগে থাকা মলমূত্র পরিষ্কার করা তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছিল।
সুখী পরিবারটিতে রহিমার নির্বিঘ্নে দুটি বছর কেটে যায়। একদিন সে রজঃবতী হয়ে পড়ে। তলপেটে চিনচিনে ব্যথা আর ফ্রকের লেগে থাকা মাসিকের রক্ত নিয়ে রহিমা বাড়ির গৃহিণীটির কাছে যায়। তিনি তরিৎ ব্যবস্থা গ্রহন করেন। যদিও তার চোখের তারায় কৌতুক আর ঘৃনার ঝলক রহিমা বেশ বুঝতে পেরেছিল।
ঐ মাসে কতগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন পর রহিমার বাপ তার কর্মস্থলে আসে। মাসের বেতন নিয়ে সে রহিমাকে ব্যাগ গোছাতে বলে। তাকে নিয়ে তার বাপ গ্রামে রওনা হয়ে যায়। রহিমা বুঝতে পারে সে চাকুরীচ্যূত হয়েছে। জীবনে প্রথম সে লক্ষ করে পুরো সময়টিতে তার বাপ একটি বারও তার কাঁধে হাত রাখে নি, এমনকি বড় রাস্তাগুলো পেরোবার সময়ও ওর হাত ধরেনি।
কিছুদিন পর রহিমার জন্য তার বাপ আরেকটি চাকরির ব্যবস্থা করে। পুনরায় সে শহরে ফিরে আসে। যেহেতু গল্পটি সম্পূর্ণ রহিমা খাতুনের নয়। সম্ভবত গল্পটি জীবনের তাৎপর্যহীন কোলাহলের। সুতরাং, আমরা রহিমার পেশাগত জীবনের আলাপ খুব বেশি ছড়িয়ে পড়তে দিতে চাইনা।
অনেক বছর পর, ৩০ শে জুলাই দিনটিতে রহিমা খাতুন তার দৈনন্দিন কর্মসূচি অনুযায়ী তৃতীয় বাড়িটিতে প্রবেশ করে। এই সময়টিতে বাড়িটি প্রায় ফাকাই থাকে। এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কেবল টেলিভিশনের পর্দায় ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকে। রহিমা তার কালো বোরখাটি খুলে রেখে কাজ শুরু করে। তার মোবাইল ফোনে ঠিক সে সময় অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। রহিমা অপরিচিত নম্বরের কল গুলো বরাবরই খুব ঔৎসুক্যের সাথে গ্রহন করে। নম্বরটি অপরিচিত হলেও ব্যক্তিটি তার পরিচিত। তার স্বামীর সহকর্মী। রহিমা জানতে পারে তার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। রহিমার স্বামী বখতিয়ার একটি দলের সাথে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আজ সকালে কাজে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্মাণাধীন যেই ভবনটি তারা গড়ে তুলছিল, তার সামনে একটি পুলিশের গাড়ি এসে থামে। কিছু সশস্ত্র পুলিশ সদস্য 'বখতিয়ার কে?' জানতে চাইলে, সে সামনে এগিয়ে আসে। তারা তৎক্ষণাৎ বখতিয়ারকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলে। সাহস করে দু এক জন শ্রমিক এগিয়ে গেলে তাদের নিকটস্থ থানায় যোগাযোগ করতে বলে গাড়িটি বখতিয়ারকে নিয়ে চলে যায়। রহিমা খাতুন দ্রুত নিজেকে বোরখায় মুড়িয়ে থানার পথে যাত্রা করে।
কিছু দিন যাবৎ শহরের মানুষদের মাঝে অস্থিরতা ও ক্রোধ সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষেরা বুঝতে পারছিল তাদের অধিকারগুলো পর্বত শৃঙ্গে বরফ হয়ে জমে আছে। অথবা তারা আগে থেকেই জানত, মানুষের অধিকার সমূহ সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই পর্বত শৃঙ্গে বরফ হয়ে জমে থাকে। তারা কেবল বিস্মৃতি ও নিষ্ক্রিয়তা নামক সংক্রামক ব্যাধিতে দীর্ঘদিন আক্রান্ত ছিল। মানুষেরা তার অধিকার ফেরৎ চাইতে লাগলো। অথবা তারা তাদের অনেক অধিকার, যা অতিব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে সেসব পুড়িয়ে ফেলতে চাইছিল। নতুন একটি পর্বতশৃঙ্গে জমা হওয়া অনাস্বাদিত সুশীতল প্রলোভন তাদের অস্থিরতার কারন হয়ে উঠছিলো। এমনও হতে পারে, যেহেতু বৃত্তাকার পরিভ্রমণ প্রাকৃতিক ধর্ম, সেহেতু মানুষেরা একটি চক্র সম্পন্ন করার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। এটা নতুন চক্র শুরু হবার অস্থিরতা। হয়ত এক দীর্ঘ বিস্মৃতির কালের আগমনে এই অস্থিরতার অবসান হবে।
রহিমা খাতুন যখন থানায় পৌছেছে, সেসময় সূর্য মধ্য আকাশে জ্বল জ্বল করে পুড়ছিল। সূর্যের তাপে পাথরে ঢালাই করা পথ ক্রমশ নরম হতে থাকে। পথের পাশে দোকান ঘর গুলোর টিনের ছাউনিতে চোখ ঝলসে যায়। তবুও মানুষেরা রাস্তায় জড়ো হয়ে কোলাহল করতে থাকে। কয়েকটি লাশ পুড়িয়ে ফেলার গল্পকে ঘিরে কোলহলটি মুখর হয়ে ওঠে। লাশের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক জমে ওঠে। একজন বলে সে ভ্যানের ওপর তিনটি মৃতদেহ দেখেছে। অপর কন্ঠে শোনা যায় তিনটির নীচে আরও লাশ চাপা পড়ে ছিল। লাশের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। একটি কন্ঠে শোনা যায় তার দুই সহকর্মী, যারা পেশায় পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করত, গত কাল থেকে লাপাত্তা। শেষবার তাদের থানার দিকে এগোতে থাকা মিছিলে দেখা গেছে। একজন সাক্ষ্য দেয় তার এক নির্মাণ শ্রমিক বন্ধু মিছিলটিকে প্রতিরোধ করতে যে দলটি জড়ো হয়েছিল সেখানে তার সাথে এসেছিল। যখন আগুন জ্বলে ওঠে, গুলি শুরু হয় কথক ছুটে পালিয়ে আসে কিন্তু তার বন্ধুকে এরপর সে আর দেখেনি। একজন বলে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র কাল থেকে নিখোঁজ। একটি কন্ঠে জানা যায়, দুপুর থেকে পুলিশের পোশাক পড়া যে দুটি রক্তাক্ত মৃতদেহ বড় রাস্তার ওভার ব্রীজে ঝুলছিল, সেগুলো সন্ধ্যার পর আর দেখা যায়নি। আলোচনাটি একমত হয় রাতে থানার পেছনের গলিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে যে অগ্নিকুন্ডটি জ্বলছিল তা মানুষের মৃতদেহ পুড়িয়ে তৈরি করা হয়েছিল। আর এমন অপরিচিত পোড়া গন্ধটি সম্ভবত মানুষের মাংস পুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। রহিমা খাতুন কোলাহল মুখর ভীড়টিকে পাশ কাটিয়ে থানায় প্রবেশ করে।
একটি কক্ষে কয়েকজন পুলিশের উত্তপ্ত আলোচনা চলছিল। রহিমা খাতুনের প্রবেশ সেখানে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনা। সে নিজেই একটি টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। 'স্যার আমি রহিমা'। পুলিশটি কন্ঠে তার বিরক্তি আর অস্থিরতা আড়াল করার কোন চেষ্টা না করে তার আগমনের কারন জানতে চায়। রহিমা তার স্বামী বখতিয়ারকে ধরে আনার ঘটনাটি জানায়। পুলিশ সদস্যকে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে। তার দারিদ্র্য ও একটি সন্তান নিয়ে কষ্ট করে এই শহরে টিকে থাকার বয়ানটি সে বর্ণনা করে। পুলিশটি রহিমাকে জানায়, বখতিয়ার মিছিলে গিয়েছিলো এবং তার বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ও ভাংচুরের অভিযোগ আছে। সুনির্দিষ্ট মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রহিমার কান্নার বেগ বেড়ে যায়, সে জানায় গতকাল সংঘর্ষের সময় বখতিয়ার বাড়িতে ছিলো, তার মেয়ে ও প্রতিবেশীরা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। সে পুলিশ সদস্যটির পা ধরে ক্ষমা চাইতে উদ্যত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যটি বলে তার কিছুই করনীয় নেই, রহিমা চাইলে থানার ওসির সাথে কথা বলতে পারে।
রহিমা ওসির কক্ষে প্রবেশ করলে তার পরিচয় ও সমস্যাটি শোনার পর ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অধীনস্থকে ডেকে জানতে চান ব্রোথেল থেকে কোন বেশ্যা থানায় আসলে তার সাথেও তিনি দেখা করবেন কিনা। রহিমা পূর্বের পুলিশ সদস্যের টেবিলের সামনে গিয়ে কাঁদতে থাকে। পুলিশটি জানিয়ে দেয় এখন পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে, কালকে বখতিয়ার সহ গ্রেফতারকৃতদের কোর্টে নেয়া হবে। রহিমাকে সে উকিল ধরার পরামর্শ দিয়ে থানা ত্যাগ করতে বলে।
থানার বাইরে, একটি ল্যাম্পপোস্টের আলো যেখানে অন্ধকারে মিশে গেছে, রহিমা একটি মূর্তির মত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। 'ঐ মাতারি, এদিকে আও', আহ্বানটির উৎসের দিকে অন্ধকার যেখানে জমাট বেধে আছে রহিমা এগিয়ে যায়। 'কাইলকা মিছিল থিকা দোকানপাট ভাঙছে, আগুন দিছে। পুলিশের লগে মারামারি হইছে, পুলিশও মরছে। অখন মামলা হইছে, বেনামী আসামি দেড় হাজার।' রহিমা শুনতে থাকে। পুলিশ যারে পাইছে ধরতাছে। কাইল কোর্টে চালান দিব।' এটুকু বলার পর ছায়ামূর্তিটি একটি কাগজের টুকরো রহিমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। '৫০ হাজার। রাইতের মইধ্যে জোগাড় করতে পারলে কাগজের নম্বরে একটা ফোন দিও। স্বামীরে আইসা লইয়া যাইতে পারবা।' ছায়ামূর্তিটি এরপর দূরে সরে যায়।
রহিমা চন্দ্রাহতের মত হাঁটতে শুরু করে। গল্পের এই পর্যায়ে রহিমার পেশাগত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমরা আলোকপাত করব।
বেশ কয়েক বছর পূর্বে রহিমা একটি বাড়িতে আবাসিক গৃহপরিচারিকা হিসেবে কর্মরত ছিল। তখনো তার বিয়ে হয়নি। পরিবারটি ছিল চার সদস্যের। এক চিকৎসক দম্পতি তাদের ২৪ বছর বয়সের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পুত্র ও স্কুল পড়ুয়া একটি কন্যা সন্তান নিয়ে শহরের এক অভিজাত এলাকায় বসবাস করত। ধনাঢ্য পরিবারটিতে রহিমা খাতুন বেশ ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা সহ বেশ কিছু বছর চাকরি করে। তরুন ছেলেটির নাম মোস্তাফিজুর রহমান। অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল যুবক। বর্তমান সময়ে সরকারি আমলা। রহিমা দীর্ঘকাল পরিবারটিতে সুনামের সাথে কাজ করার দরুন ও পরিবারটির আদি নিবাস রহিমার একই গ্রামের হবার কারনে পরিবারটির সাথে তার সম্পর্ক আজও টিকে আছে। বিশেষ করে রোজার ঈদে যাকাতের কাপড় ও কোরবানির ঈদে পবিত্র গোস্তের একটি অংশ মোস্তাফিজুর রহমানের মা রহিমার জন্য বরাদ্দ রাখেন। ঈদের দিনগুলোতে রহিমা ঐ বাড়িতে তার শিশু সন্তানটিকে নিয়ে হাজির হয়। প্রতিবছর রহিমা তার সন্তানের স্কুলের বাৎসরিক ভর্তি ফি বাবদ কিছু সাহায্যও পেয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রহিমা ঐ বাড়িতে কাজ করবার সময় মোস্তাফিজুর রহমান একবার খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। কয়েক সপ্তাহ তাকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। রোগগ্রস্ত মোস্তাফিজের সেবা করার দায়িত্ব রহিমাকে অর্পণ করা হলো। রোগীর পথ্য রান্না করা, নিয়মিত খাওয়ানো, মাথায় পানি দিয়ে গা মুছে দেয়া, ঔষধ খাওয়ানো ইত্যাদি কাজে রহিমা খাতুনের বেশ ব্যস্ত সময় কাটে। রহিমা মোস্তাফিজুর রহমানের প্রতি মায়া বোধ করে, অর্পিত কর্তব্য গুলো সে গভীর নিষ্ঠার সাথে পালন করতে থাকে। যুবকটি ক্রমশ সুস্থ্য হয়ে ওঠে।
প্রাসঙ্গিক দিনটিতে। রহিমা রোজকার মত যখন মোস্তাফিজের খাটের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিছানাটি ঝাঁট দেবার জন্য তাকে উঠে দাঁড়াতে বলে, সে মন্ত্রমুগ্ধের মত বিছানা ছেড়ে সরে যায়। হঠাৎ মোস্তাফিজ রহিমাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে। প্রচন্ড ভয় আর আতংকে রহিমা কুঁচকে যায়। একতাল শীতল মাংসপিন্ডের ভেতর মোস্তাফিজ জোড় করে প্রবেশ করে। পুরো সময়টি রহিমা খাতুনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। অপমান আর তীব্র যন্ত্রণার এই স্মৃতি তাকে আজীবন তাড়া করবে। সেদিন রহিমা খাতুন অসংখ্যবারের মত আরও একবার অনুধাবন করে, মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে সক্ষম, স্বপ্ন বেঁচে থাকার রসদ যোগায়, কিন্তু জীবন একনায়কের স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষকে পরিনতির দিকে নিয়ে যায়।
মোস্তাফিজের মা অত্যন্ত বিচক্ষন নারী। কিছু অস্বাভাবিকতা তার চোখ এড়াতে পারে না। রহিমার গলায় আঁচড়ের দাগ ও তার অন্যমনস্কতা নারীটিকে সন্দিহান করে তোলে। নিজের সন্তানের আচরণগত কিছু পরিবর্তনও তার চোখ এড়ায় না। একদিন সকালে রহিমার বাপকে পুনরায় রহিমার কর্মস্থলে আসতে হয়। রহিমাকে নিয়ে তিনি সেদিন গ্রামে ফিরে যান। তাকে বেশ মোটা অংকের টাকা দিয়ে দ্রুত রহিমার বিয়ে দিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হলো। পুরো খরচ তারাই বহন করবেন। গ্রামে রহিমার জন্য পাত্র খুঁজতে বেগ পেতে হয়না। শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর দিনে বখতিয়ারের সংগে রহিমার বিয়ে হয়ে যায়।
পুনরায় আমরা আমাদের গল্পে ফিরে এসে দেখি, চন্দ্রাহত রহিমা খাতুনকে রাতের শহরের ফুটপাথের আলো অন্ধকারে হাঁটতে। রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের সপরিবারে বসবাসের কোয়ার্টারটিতে সে খুব দৃঢ় পায়ে প্রবেশ করে। আমাদের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে মোস্তাফিজুর রহমানের বাসা এই মুহূর্তে রহিমা খাতুনের গন্তব্য।
এই বাসায় এটাই তার প্রথম আসা। ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল চেপে, সে অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পরে একটি কিশোরী দরজা খুললে রহিমাকে চিনতে পারে। ড্রইংরুম জুড়ে মৃদু আলো নরম হয়ে ছড়িয়ে আছে। কার্পেটে রহিমার পা গোড়ালি পর্যন্ত দেবে যায়। একটি ঝাড়বাতি মাথার উপর তার শাখা প্রশাখা নিয়ে ধীর লয়ে ঘুরতে থাকে। রহিমার দৃষ্টি রুমের আসবাবপত্র, সৌখিন সব মিনিয়েচার ভর্তি শোকেস ইত্যাদি ঘুরে একটি বড় ফটোগ্রাফে নিবদ্ধ হয়। সেখানে মোস্তাফিজুর রহমান, তার পরীর মত স্ত্রী, পুতুলের মত দুটি কন্যা একটি ফ্রেমকে আলোকিত করে রাখে। মোস্তাফিজুর রহমানের ফ্রেমবন্দী সফল জীবনটির দিকে রহিমা সমীহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এই বাড়িতে সে প্রথম এসেছে। যদিও সবাইকে সে চেনে। মোস্তাফিজুর রহমানের মায়ের বাসায় কয়েকবার এদের সাথে তার দেখা হয়েছে।
মোস্তাফিজের স্ত্রী রহিমাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। আজ রাতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় রহিমার জীবনে নেমে এসেছে, সে তা বর্ণনা করে। জানায় মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে সে অনেক আশা নিয়ে এসেছে। মোস্তাফিজকে তার স্ত্রী ডেকে নিয়ে আসে। ঘটনাটি সে নিজেই তাকে বলে যায়, রহিমা মাথা নীচু করে থাকে। এই পর্যায়ে মোস্তাফিজের স্ত্রী রহিমাকে কিছু খাবার এনে দিতে রান্না ঘরের দিকে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন মোস্তাফিজ রহিমাকে ধর্ষণ করত তার পর থেকে এই দিনটি পর্যন্ত কোনদিন রহিমার মোস্তাফিজের সাথে কথা হয়নি।
রহিমা সরাসরি মোস্তাফিজের চোখে তাকায়। 'আপনি তারে ছাড়াইয়া আনার ব্যবস্থা করেন। আমি চাইলে আপনার নামে বিচার দিতে পারতাম। আপনার মায় জানে আপনে কি করছেন।'
রহিমা খাতুনের চোখের তারায় জ্বলতে থাকা ঘৃণা, দৃঢ় কন্ঠস্বর মোস্তাফিজকে নাড়িয়ে দেয়। সম্ভবত সে কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে। এমনও হতে পারে সে বোধ করে গভীর অনুতাপ। অথবা সে রহিমার সাহস দেখে, মনে মনে কৌতুক বোধ করে। তীব্র রাগ তার শরীরে ছড়িয়ে পরতে থাকে। সে জানে চাইলেই সে আগামী কয়েকঘন্টায় রহিমা খাতুনকে অদৃশ্য করে দিতে পারে। মোস্তাফিজুর রহমানকে এর চেয়ে অনেক জটিল পরিস্থিতি তার পেশাগত জীবনে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সে শীতল কন্ঠে থানার নাম জানতে চায়। রহিমা চিরকুটটি তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। 'থানায় যা। এই বাসায় আর কখনো আসবি না।' মোস্তাফিজ রহিমাকে বিদায় দেয়।
এরপর আমরা উদ্বিগ্ন রহিমাকে থানার সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। একপর্যায়ে থানার গেট দিয়ে ক্লান্ত পায়ে বখতিয়ার হেঁটে আসে। রাত্রির শেষ প্রহরে তারা যখন একটি রিকশায় করে বাড়ি ফিরছিল, রহিমা খাতুন শক্ত করে বখতিয়ারের বাহু আঁকড়ে ধরে থাকে।