একজন সুপরিচিত বৈজ্ঞানিক (অনেকে বলেন, বাট্রান্ড রাসেল) একবার জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী কি করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, আবার সূর্য কি করে আমাদের নীহারিকা galaxy) অর্থাৎ বিরাট এক তারকা সংগ্রহের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে ঘোরে। বক্তৃতার শেষে ঘরের পিছন থেকে ছোটখাটো এক বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এতক্ষণ আপনি আমাদের যা বলেছেন, সব বাজে কথা। পৃথিবীটা আসলে চ্যাপ্টা, আর রয়েছে বিরাট এক কচ্ছপের পিঠের উপর।” বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন, “কচ্ছপটা কার উপর দাঁড়িয়ে আছে?” বৃদ্ধা বললেন, “ছোকরা, তুমি বেশ চালাক খুব চালাক। তবে তলায় পরপর সবই কচ্ছপ রয়েছে।”
মহাবিশ্ব অসংখ্য কচ্ছপের স্তম্ভ- এ চিত্র অধিকাংশের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু আমরা বেশি জানি এ কথা ভাবব কেন? মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা কি জানি এবং কিভাবে জানি? মহাবিশ্ব এসেছে কোত্থেকে এবং যাচ্ছেই বা কোথায়? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল? যদি থেকে থাকে তাহলে তার আগে কি হয়েছিল? কালের চরিত্র কি? কাল কি কখনো শেষ হবে? পদার্থবিদ্যার ইদানীং কালের আবিষ্কারের সাহায্যে (সে আবিষ্কারগুলো অংশত হয়েছে কিছু অকল্পনীয় প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে) এই সমস্ত বহুদিনের বহু প্রাচীন প্রশ্নগুলোর কিছু কিছু উত্তরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কোন দিন হয়ত এই উত্তরগুলোকে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মত স্বতঃপ্রতীয়মান মনে হবে। কিম্বা হয়ত মনে হবে কচ্ছপের স্তম্ভের মত হাস্যকর। এ সম্পর্কে শুধুমাত্র কালই (সে যাই হোক) বলতে পারবে।
প্রাচীনকালে ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তার অন দি হেভেন্স (On The Heavens–মহাকাশ সম্পর্কে) বইতে পৃথিবী যে একটি বৃত্তাকার গোলক এবং একটা চ্যাপ্টা থালা নয়, এ সম্পর্কে দুটি ভাল যুক্তি দেখাতে পেরেছিলেন। প্রথমত, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চন্দ্রগ্রহণের কারণ সূর্য এবং চন্দ্রের মাঝখানে পৃথিবীর আসা। চন্দ্রের উপর পৃথিবীর ছায়া সব সময়েই গোলাকৃতি। পৃথিবী গোলাকৃতি বলেই এটা সম্ভব। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা থালার মত হত তা হলে সূর্য যখন থালার কেন্দ্রের ঠিক নিচে অবস্থান করছে তখনই গ্রহণ না হলে ছায়াটি হত লম্বাটে এবং উপবৃত্তাকার (ellipti cal)। দ্বিতীয়ত, গ্রীকরা তাদের ভ্রমণের ফলে জানতেন দক্ষিণ দিক থেকে দেখলে উত্তর দিক থেকে দেখার তুলনায় দ্রুবতারাকে (North Star) আকাশের অনেক নিচুতে দেখা যায়। (যেহেতু ধ্রুবতারা উত্তর মেরুর উপরে অবস্থিত, সেজন্য উত্তর মেরুর একজন পর্যবেক্ষকের মনে হয় তারাটি ঠিক তার মাথার উপরে। কিন্তু বিষুররেখা থেকে দেখলে মনে হয় তারাটির অবস্থান দিবালে)। মিশর এবং গ্রীস থেকে ধ্রুবতারার আপাতদৃষ্ট অবস্থানের পার্থক্য পর্যালোচনা করে অ্যারিস্টটল পৃথিবীর পরিধির একটা অনুমান করেছিলেন : চার লক্ষ স্ট্যাডিয়া (stadia)। স্ট্যাডিয়ামের (Stadium) দৈর্ঘ্য ঠিক কতটা সেটা জানা যায় না। তবে প্রায় ২০০ গজ হয়ত ছিল। তা হলে ইদানীং কালের স্বীকৃত মাপের তুলনায় অ্যারিস্টটলের অনুমান প্রায় দ্বিগুণ। বৃত্তাকার এ তথ্যের সপক্ষে গ্রীকদের আরো একটি যুক্তি ছিল। তা না হলে দিকচক্রবাল থেকে জাহাজ আসার সময় প্রথম কোন পাল দেখা যাবে এবং তারপরে কেন দেখা যাবে জাহাজের কাঠামোটা?
অ্যারিস্টটল ভাবতেন পৃথিবীটা স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও তারকারা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার কক্ষে চলমান। তিনি এটা বিশ্বাস করতেন তার কারণ অতীন্দ্রিয়বাদী (mystical) যুক্তিতে তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং বৃত্তাকার গতি সবচাইতে নিখুঁত। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টোলেমী (Ptolemy) এই ধারণা বিস্তার করে ব্রহ্মাণ্ডের একটি সম্পূর্ণ প্রতিরূপ (Cosmological model) তৈরি করেছিলেন। পৃথিবী ছিল কেন্দ্রে এবং তাকে ঘিরে ছিল আটটি গোলক। এই গোলকগুলো বহন করত চন্দ্র, সূর্য, তারকা এবং সেই যুগে জানিত পাঁচটি গ্রহ বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি (চিত্র ১.১)। গ্রহগুলো নিজেরা তাদের নিজ নিজ গোলকের সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্রতর বৃত্তে ভ্রমণ করে। এই বিবরণ ব্যাখ্যা করত তাদের আকাশে পর্যবেক্ষণ করা পথের জটিলতা। সবচাইতে বাইরের গোলকে থাকে তথাকথিত স্থির তারকাগুলো, এই তারকাগুলো পরস্পর সাপেক্ষ সব সময়ই একই অবস্থানে থাকে কিন্তু তারা একত্রে আকাশের এপার থেকে ওপারে ঘোরে। শেষ গোলকের বাইরে কি থাকত সেটা কখনোই স্পষ্ট ছিল না। তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের অংশ ছিল না।
টোলেমীর (Ptolemy) প্রতিরূপ থেকে মহাকাশের বস্তুপিণ্ডগুলোর আকাশে অবস্থান সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব ছিল। সেজন্য টোলেমীকে একটা অনুমান করতে হয়েছিল : চন্দ্র এমন একটি পথ পরিভ্রমণ করে, যে পথে অনেক সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের নৈকট্য দ্বিগুণ হয়। এর অর্থ চন্দ্রের আকার অনেক সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দেখানো উচিত। এই ত্রুটি টোলেমী বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তবুও এই প্রতিরূপটি সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য সবাই মেনে নেন নি। খ্রিস্টীয় চার্চ এই প্রতিরূপ গ্রহণ করেছিল। তার কারণ তাদের ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে এই প্রতিরূপের মিল ছিল। এই প্রতিরূপের সুবিধা হল, স্থির তারকাগুলোর গোলকের বাইরে স্বর্গ এবং নরকের জন্য অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়।
নিকোলাস কোপারনিকাস (Nicholas Copernicus) নামক একজন পোলিশ পুরোহিত ১৫১৪ সালে একটি সরলতর প্রতিরূপ উপস্থাপন করেন (প্রথমে হয়ত নিজেদের চার্চ ধর্মবিরোধী বলবে এই ভয়ে কোপারনিকাস নিজের প্রতিরূপটি নিজের নাম না দিয়ে প্রচার করেন)। তার ধারণা ছিল সূর্য কেন্দ্রে স্থিরভাবে অবস্থান করে এবং পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহ বৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই চিন্তাধারাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে প্রায় এক শতাব্দী লাগে। তারপর জার্মান জোহান কেপলার এবং ইতালীয়ান গ্যালিলিও গ্যালিলি এই দুজন জ্যোতির্বিদ প্রকাশ্যভাবে কোপারনিকাসের তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করতে শুরু করেন। অথচ, এই তত্ত্ব যে রকম কক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছিল তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা কক্ষের সম্পূর্ণ মিল ছিল না। অ্যারিস্টটলীয় টোলেমীয় তত্ত্বের উপর মরণ আঘাত আসে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর গ্যালিলিও সদ্য আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে রাত্রির আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। বৃহস্পতি গ্রহকে দেখার সময় তিনি কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগ্রহ অর্থাৎ চন্দ্র দেখতে পান। সেগুলো বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। এর নিহিত অর্থ হল, অ্যারিস্টটল এবং টোলেমী যা ভাবতেন সেই মতানুসারে যদিও সবারই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা উচিত, তবুও সব জিনিসই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না (অবশ্য তখনও বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল : পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থিরভাবে অবস্থান করছে এবং বৃহস্পতির চন্দ্রগুলো অত্যন্ত জটিল পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। পথটা এমন যে, মনে হয় তারা বৃহস্পতিকে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু কোপারনিকাসের তত্ত্ব ছিল অনেক সরল)। একই সময় জোহান কেপলার কোপারনিকাসের তত্ত্বের পরিবর্তন করেন। তাঁর মতে গ্রহগুলো বৃত্তাকারে চলমান নয়, চলমান উপবৃত্তাকারে (ellipse : উপবৃত্ত লম্বাটে একটা বৃত্ত)। শেষ পর্যন্ত পূর্বাভাস এবং পর্যবেক্ষণে মিল হল।
কেপলারের কাছে কিছু উপবৃত্তাকার কক্ষ ছিল একটি অস্থায়ী প্রকল্প মাত্র বরং এ প্রকল্প ছিল প্রতিকূল। কারণ উপবৃত্ত স্পষ্টতই বৃত্তের চাইতে কম নিখুঁত। কেপলার আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেন : পর্যবেক্ষণের সঙ্গে উপবৃত্ত ভাল মেলে। তার ধারণা ছিল গ্রহগুলোকে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে বাধ্য করে চৌম্বক বল। এই ধারণার সঙ্গে এই আকস্মিক আবিষ্কারকে তিনি মেলাতে পারছিলেন না। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনেক পরে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে। স্যার আইজাক নিউটন তার ফিলোজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া sytecipt (Philosophiae Naturalis Principia Matchematica) 910 প্রকাশ করার পর। এটা বোধ হয়, ভৌত বিজ্ঞান বিষয়ে প্রকাশিত বইগুলোর ভিতরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এ বইটাতে নিউটন শুধুমাত্র স্থান-কালে বস্তুপিণ্ডগুলো কি করে চলাচল করে সে সম্পর্কে তত্ত্বকথাই দেন নি, তিনি এই গতিগুলো বিশ্লেষণ করার জন্য যে জটিল গণিত প্রয়োজন সেটাও সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়া নিউটন একটি প্রকল্পিত সর্বব্যাপী মহাকর্ষীয় বিধি উপস্থাপন করেন। এই বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুপিণ্ডই পরস্পরের প্রতি একটি বল দ্বারা আকৃষ্ট হয়, বস্তুপিণ্ডগুলো পরস্পরের যত নিকটতর হবে, এই বল ততই শক্তিশালী হবে। তাছাড়া সে বলের শক্তি বৃদ্ধি হবে বস্তুপিরে ভর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। এই বলই বস্তুপিণ্ডগুলোর মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণ। (প্রচলিত কাহিনী হল: নিউটনের মাথায় একটা আপেল পড়াতে নিউটন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ কাহিনী প্রায় নিশ্চিতভাবে অপ্রমাণিত। নিউটন নিজে যা বলেছেন, তা হল, তিনি চিন্তা করার মেজাজে’ বসেছিলেন, তখন একটা আপেল পড়তে দেখে তাঁর মাথায় মহাকর্ষ সম্পর্কে ধারণা এসেছে)। নিউটন আরো দেখিয়েছিলেন, তার বিধি অনুসারে মহাকর্ষ চন্দ্রকে উপবৃত্তাকার কক্ষে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করায় এবং সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণের কারণও এই মহাকর্ষ।
কোপারনিকাসের প্রতিরূপ টোলেমীর মহাকাশের নানা গোলক celestical spheres) সম্পর্কে ধারণা দূরীভূত করে এবং তার সঙ্গে দূরীভূত হয় মহাকাশের একটি স্বাভাবিক সীমানা রয়েছে সেই ধারণা। পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনে দরুন স্থির তারকাগুলোর আকাশে আড়াআড়ি ঘূর্ণন (accross the sky) ছাড়া ‘সেগুলোর’ অবস্থানের কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এইজন্য স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা হয়েছিল যে ওগুলো আমাদের সূর্যের মতই বস্তু, তবে তাদের অবস্থান আরো দূরে।
নিউটন বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর মহাকর্ষীয় তত্ত্ব অনুসারে তারকাগুলোর পরস্পরকে আকর্ষণ করা উচিত। সুতরাং মনে হয়েছিল তারা মূলত গতিহীন থাকতে পারে না। কোন একটি বিন্দুতে কি তাদের একসঙ্গে পতন হবে না? সে যুগের আর একজন চিন্তানায়ক রিচার্ড বেন্টলীকে (Richard Bentley ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দে একটি পত্রে নিউটন যুক্তি দেখিয়েছিলেন, এ রকম হতে পারত শুধুমাত্র যদি তারকাগুলোর সংখ্যা সীমিত হত এবং তারা যদি স্থানের একটি সীমতি অঞ্চলে বিতরণ (distributed) থাকত। কিন্তু তার যুক্তি ছিল : অন্য দিক থেকে বলা যায় যদি তারকার সংখ্যা অসীম হয়, তারা যদি সীমাহীন স্থানে কমবেশি সমরূপে বিতরণ (distributed) থাকে, তা হলে এ রকম হবে না। কারণ, পতিত হওয়ার মত কোন কেন্দ্রবিন্দু থাকবে না।
অসীমত্ব নিয়ে বলতে গেলে কি রকম ভুল হতে পারে এই যুক্তি তার একটা দৃষ্টান্ত। একটি অসীম মহাবিশ্বে প্রতিটি বিন্দুকেই একটি কেন্দ্র বলা যেতে পারে। তার কারণ প্রতিটি বিন্দুরই সর্বদিকে অসীম সংখ্যক তারকা থাকবে। অনেক পরে বোঝা গিয়েছিল নির্ভুল দৃষ্টিভঙ্গি হবে শুধু সীমিত পরিস্থিতির বিচার করা। সেই পরিস্থিতিতে তারকাগুলোর পরস্পরের উপর পতিত হবে। তারপর প্রশ্ন করা উচিত এই অঞ্চলের বাইরে যদি মোটামুটি সমরূপে বিতরণ আরো অনেক তারকাকে যোগ করা যায়, তা হলে কি পরিবর্তন হতে পারে। নিউটনের বিধি অনুসারে বাড়তি তারকাগুলো মূল তারকাগুলো ব্যাপারে গড়ে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে না। সুতরাং তারকাগুলো একই দ্রুতিতে পতিত হবে। আমরা যত খুশি তারকা যোগ করতে পারি। তবুও তারা সর্বদা নিজেদের উপর (but they will always collapse is on themselves) পতিত হয়ে চুপসে যাবে। এখন আমরা জানি মহাবিশ্বের এমন একটি স্থির প্রতিরূপ অসম্ভব যে প্রতিরূপে মহাকর্ষ সব সময়ই আকর্ষণ করে।
এমন কি যারা বুঝতে পেরেছিলেন যে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না, তারাও মহাবিশ্ব প্রসারমান এ রকম প্রস্তাবনা করেন নি। বরং তারা মহাকর্ষীয় তত্ত্বের পরিবর্তন করতে পেয়েছিলেন। তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন, অত্যন্ত বেশি দূরত্বে মহাকর্ষ বিকর্ষণ করে। এর ফলে গ্রহগতি সম্পর্কে তাঁদের পূর্বাভাসে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয় নি। বরং অসীমভাবে বিতরণ তারকাগুলোর ভারসাম্যের অবস্থা অনুমোদন করেছেন। তার কারণ, নিকটবর্তী। তারকাগুলো আকর্ষণবল এবং দূরের তারকাগুলোর বিকর্ষণবল ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু এখন আমরা বিশ্বাস করি এ রকম ভারসাম্য হবে অস্থির। কোন একটি অঞ্চলে তারকাগুলো যদি পরস্পরের সামান্য নিকটবর্তী হয় তা হলে তাদের অন্তর্বর্তী আকর্ষণী বলগুলো শক্তিশালী হবে এবং বিকর্ষণী বলের উপর প্রভুত্ব করবে। সুতরাং তারকাগুলো পরস্পরের প্রতি পড়তেই থাকবে। আবার অন্যদিকে তারকাগুলো যদি সামান্য দূরে হয় তা হলে বিকর্ষণবল প্রভুত্ব করবে এবং তারা পরস্পর থেকে দূরে হতেই থাকবে।
অসীম স্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে আর একটি আপত্তি সাধারণত আরোপ করা হয় জার্মান দার্শনিক হাইনরিখ ওবারসের (Heinrich Olbers) উপরে। তিনি এই তত্ত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন ১৮২৩ সালে। আসলে নিউটনের সমসাময়িক অনেকেই এই সমস্যা উত্থাপন করেছিলেন। এমন কি ওলবারসের প্রবন্ধটি এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুক্তিপূর্ণ প্রথম প্রবন্ধ নয় কিন্তু এটাই প্রথমে বহুলোকের নজরে এসেছিল। মুশকিল হল, একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বে দৃষ্টির প্রতিটি রেখাই একটি তারকার পৃষ্ঠে গিয়ে শেষ হবে। সুতরাং আশা করা যাবে রাত্রিতেও সমস্ত আকাশ সূর্যের মত উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এর বিরুদ্ধে ওলবারসের যুক্তি ছিল দূরের তারকা থেকে নির্গত আলোক অন্তর্বর্তী পদার্থের শোষণের ফলে ক্ষীণতর হবে। কিন্তু এরকম যদি ঘটে তা হলে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী পদার্থও এমন উত্তপ্ত হবে যে সেগুলো তারকার মত তাপোদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে রাতের আকাশের সম্পূর্ণটাই সূর্যপৃষ্ঠের মত উজ্জ্বল হবে। এই সিদ্ধান্ত এড়াবার একমাত্র উপায় এই অনুমান করা যে তারকাগুলো চিরকালই ভাস্বর নয়, তার ভাস্বরতা অতীতের কোন সীমিত কালে শুরু হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশোষণকারী পদার্থ হয়ত এখনো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেনি, কিম্বা হয়ত সুদূরের তারকাগুলো থেকে আলোক এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় নি। এর ফলে আর একটি প্রশ্ন আমাদের কাছে উপস্থিত হয়, সেটা হল তারকাগুলো প্রথম জ্বলল কি করে?
অবশ্য এর অনেক আগেই মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কয়েকটি আদিম সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ইহুদি, ক্রীশ্চান ও মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে মহাবিশ্বের শুরু একটি সীমিত অতীত কালে এবং সে কাল খুব সুদূর অতীত নয়। এই রকম একটা শুরুর সপক্ষে ছিল এই বোধ যে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একটি “প্রথম কারণ (first cause)” প্রয়োজন। (মহাবিশ্বের ভিতরে আপনি সব সময়ই একটি ঘটনার ব্যাখ্যা হিসেবে অন্য একটি পূর্বতন ঘটনাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু মহাবিশ্বের নিজের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার একমাত্র উপায় হল তারও একটা শুরু আছে এই অনুমান)। সেন্ট অগাস্টিন তাঁর বই ‘দি সিটি অব গড’ (The City of God–ঈশ্বরের নগর) এ আর একটি যুক্তি উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখালেন, সভ্যতার প্রগতি হচ্ছে এবং কোন কাজ কে করেছিলেন এবং কোন প্রযুক্তি কার দ্বারা বিকাশ লাভ করেছিল সেটা আমাদের । মনে থাকে। সুতরাং মানুষ এবং হয়ত মহাবিশ্বেরও অস্তিত্ব খুব বেশি দিনের নয়। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কীয় পুস্তক (Book of Genesis) অনুসারে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে। সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine) এ তথ্য মেনে নিয়েছেন। (আকর্ষণীয় ব্যাপার হল এই তারিখ এবং দশ হাজার বছর আগেকার শেষ তুষার যুগের সমাপ্তি খুব বেশি দূরবর্তী নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, সভ্যতার সত্যিকারের শুরু সে সময় থেকেই।)
অন্যদিকে অ্যারিস্টটল এবং গ্রীক দার্শনিকদের অধিকাংশই সৃষ্টি সম্পকীয় ধারণা পছন্দ করতেন না। কারণ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাগবত হস্তক্ষেপ বড় বেশি রয়েছে। সেইজন্য তারা বিশ্বাস করতেন, মানবজাতি এবং তার চারপাশের বিশ্ব চিরকাল ছিল এবং থাকবে। প্রাচীনরা প্রগতি সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত যুক্তিগুলো আগেই বিচার করেছেন। তাদের উত্তর ছিল মাঝে মাঝেই বন্যা কি ঐ রকম কোন বিপর্যয় ঘটেছে এবং মানবজাতিকে বারবার পিছনে ঠেলে সভ্যতার একেবারে শুরুতে নিয়ে গিয়েছে।
কালে মহাবিশ্বের কোনও শুরু ছিল কিনা এবং মহাবিশ্ব স্থানে সীমিত কিনা এ বিষয়ে পরবর্তীকালে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ১৭৮১ সালে প্রকাশিত তার মহান (এবং অতি দুর্বোধ্য) গ্রন্থ ‘ক্রিটিক অব্ পিওর রিজ’-এ (Critique of Pure Reason বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। প্রশ্নগুলোকে তিনি বিশুদ্ধ যুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ (অর্থাৎ বিরোধাভাস) বলেছেন। তার কারণ মহাবিশ্বের একটা আরম্ভ রয়েছে এ তত্ত্ব বিশ্বাস করার সপক্ষে যেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে তেমন দৃঢ় যুক্তি রয়েছে মহাবিশ্ব চিরকালই ছিল এই তত্ত্বের সপক্ষে। তত্ত্বের সপক্ষে তার যুক্তি ছিল মহাবিশ্বের যদি কোন আরম্ভ না থেকে থাকে, তাহলে যে কোন ঘটনার পূর্বেই একটা অসীম কাল থাকা উচিত। তাঁর মতে এটা অসম্ভব। বিরোধী যুক্তির সপক্ষে যুক্তি; মহাবিশ্বের যদি শুরু থেকে থাকে, তাহলে তার পূর্বে একটা অসীম কাল ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে একটি বিশেষ সময়ে মহাবিশ্বের আরম্ভ কেন হবে? তত্ত্বের সপক্ষে এবং তার বিরোধী তত্ত্বের সপক্ষে যুক্তিগুলো আসলে একই। দুটোরই ভিত্তি তার অব্যক্ত অনুমান : মহাবিশ্ব চিরকাল থাকুক কিম্বা না থাকুক কাল চিরন্তনভাবে অতীতে রয়েছে। এরপর আমরা দেখব, মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কাল সম্পর্কীয় কল্পনা অর্থহীন। এটা প্রথম দেখিয়েছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কি করছিলেন, অগাস্টিন তখন উত্তর দেন নি। এই ধরনের প্রশ্ন যারা করেন তিনি তাদের জন্য তৈরি করছিলেন নরক। তার বদলে তার উত্তর ছিল মহাবিশ্বের কাল ঈশ্বরসৃষ্ট। মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কালের অস্তিত্ব ছিল না।
চলবে…