Posts

চিন্তা

ঈদ মোবারক: খুশীর পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক

March 31, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

13
View

আধুনিক যান্ত্রিকযুগের কর্মযজ্ঞতায় পিষ্ট যাপিতজীবনে অন্যের দিকে চোখ তুলে চাইবার সময় কোথায়? নিজেদের ব্যস্ততার কাছে সময়ের সবটুকু ঢেলে দেয়ার পরও জীবনযুদ্ধের যেন পুরোটা সংকুলান হয় না। অপরের কথা বাদ থাকুক, নিজের দিকে তাকানোরও সময় যেন নেই কারো। এমন এক বৃত্তবন্দি জীবনে বছরে দু’চারবার সর্বজনীন উৎসবে মাতে বাঙালি। ঈদুল ফিতর সেই উৎসবের অন্যতন বড় অনুষঙ্গ। আজ রাগ-বিরাগ বা অন্তর্কলহ ভুলে ভালোবাসার কাছে নিজেকে পুরোমাত্রায় সঁপে দেয়ার দিন। শুধু পরিবার পরিজন আত্মীয় নয় অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার দিন আজ। দোস্ত দুশমন ভুলে গিয়ে সবার সাথে হাত মিলানোর দিন। হাজার আঘাতে মন ভেঙ্গে দেয়ার কারিগর যারা, ভালোবেসে তাদেরকেই জাদুকরী শিল্পী তকমা দিয়ে নিজেদের ত্যাগী জাত চিনিয়ে দেয়ার সময় এইতো। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কী যথার্থই না বলেছেন-
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।

কেবল ঐশী আদেশের বাতাবরণে আবদ্ধ করে নয়, বরং নানা লৌকিক উপাচারের সন্নিবেশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে আমরা ঈদকে বিশাল জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছি। ইহজাগতিক সাংস্কৃতিক মাত্রিকতায় ঋদ্ধ করে নিয়েছি। ঈদের পোশাক, ঈদের বই, ঈদের মুভি, ঈদের বেড়ানো ইত্যাকার শত উদযাপনের আলোয় আলোকিত ঈদীয় পার্বণ। আত্মশুদ্ধিতে পূর্ণ একমাসের সিয়াম সাধনা শেষে ঈদ আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব। আর এই পার্বণের অংশীদার এখন কেবলমাত্র একটি ধর্মের মানুষ বা জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা নয়, বরং বিশ্বমানুষেরই সমান ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ঈদ উৎসব পূর্ণতা পাচ্ছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের পুণ্যে পুতঃপবিত্র হচ্ছে আনুষ্ঠানিকতার সকল শুভ অন্তরাল। আমরা তাই সবাইকে আলিঙ্গন করে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে নজরুলের অমোঘ বাণী উচ্চারণ করতে পারি-
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।

খাইলাম দাইলাম ঘুরলাম ফিরলামটাই প্রকৃতার্থে ঈদ নয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক জীবনবোধ কিংবা জীবনজিজ্ঞাসার মিশেল না ঘটলে পার্বণ যথার্থতা পায় না। আজীবন শিখবার বা জ্ঞানার্জনের অভিলাষ সৃষ্টি না হলে কেবল নামকাওয়াস্তে ঈদ আসলে গেলে তাতে কারো কিছু এসে যাবে না। গণমানুষের অধিকারহীনতার অসাধু আর্গল ভেঙ্গে দুর্বৃত্তায়নের কড়ালগ্রাসে জর্জরিত একটি জাতিরাষ্ট্রকে উদ্ধার করবার তরিকা না খুঁজলে উৎসবে অন্ধকার হাতড়ানোই সার হবে, আর কিছু না। মানুষ এখন স্মার্টফোনের ভিতর দিয়ে নেটের দুনিয়ার মেকি চাকচিক্যে মেতে আছে। ফেসবুকে নিজেদের আত্মপ্রচার ছাড়া তারাতো আর কিছুই শিখছে না। ভার্চুয়াল ফুল, খাবার, হাসি, পছন্দ বা ভালোবাসা নামের মিথ্যা ছড়িয়ে দিয়ে ভুলে ভরা মায়া কাড়তে চাইছে। একালে আমরা ক’জন জানি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’র সেই বেদবাক্য-
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।
নিজেরে করিতে গৌরব দান...
আমারে না যেন করি প্রচার
আমার আপন কাজে ;
তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ
আমার জীবন-মাঝে ।

বাঙালি মানুষ পড়তে ভুলে গেছে। শিল্প, চলচ্চিত্র, কবিতা, গল্প বা সাহিত্য ত্যাগ করেছে। বই কেনা আর তার হয়ে ওঠে না। বিজ্ঞানচর্চাও শিকেয় তুলেছে। যুক্তির চেয়ে ঐশীবাণীই তাদের কাছে একমাত্র সত্যের আকর। তারাশঙ্কর, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, শেক্সপীয়র তারা চেনে না। এমনটা চলতে থাকলে জ্ঞান সমুদ্র পারি দেবার অনতিক্রম্যতা কীভাবে সে জয় করবে? পাঠাভ্যাস ও বিদ্যাচর্চার ভালোবাসায় মানুষের রুচি ফেরানোটা এই ঈদে আমাদের ব্রত হোক।

আজকের দিনে আমাদের বিদ্যা বিত্ত রুচি বিকৃত হয়ে গেছে। আমাদের মনে সামান্যতম সংবেদনশীলতা বলে কিছু আর অবশিষ্ট নাই। আমরা এখন আর জীবনানন্দ দাশের মতো করে বলতে পারি না -এ সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাক কাচপোকা মাছরাঙা পানকৌড়ি দোয়েল চড়াই। মানুষের জন্য ন্যূনতম সহমর্মিতা যেখানে অবশিষ্ট নাই, সেখানে কবির মতো করে ঝরে পরা পাখির পালকের জন্য কান্না আর আমাদের সাজে না। আমরা এখন নরম তুলতুলে প্রজাপতি দেখে আপ্লুত হই না। দুর্বা ঘাসের ডগায় শিশির কণা আমাদের চোখে লাগে না। কারো দুঃখে কাঁদতে ভুলে গেছি। অন্যের আনন্দ আর আমাদেরকে আনন্দিত করে না। আমরা চিন্তায় আড়ষ্ট আর বুদ্ধিতে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছি। আমরা এতটাই স্বার্থনিমগ্ন যে, এক আপনাকে ছাড়া আমরা আর কাউকে চিনিই না। কিন্তু এটাতো মানুষের জীবন নয়। আমরা যন্ত্রদানবের কাছে মাথা বিক্রি করে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে সুন্দর পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারি না। আমাদেরকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের মতো জীবনবাদী সাহিত্যিকদের কাছে ফিরতে হবে। জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ কবিতার রসাস্বাদন করতে জানতে হবে-
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে, কত বালুচরে কত আঁখি ধারা ঝরায়ে বর্ষ শেষে আজ আবার ঈদ এসেছে। কেবলমাত্র নিজের সুখ বিলাসে আজ সকল সঞ্চয় কুক্ষিগত করবার দিন নয়। চোখের জলে কারো ঘরে দীপ না জ্বলুক। আমরা সবাই যেন বাঁচি সবার জন্য। সবার সুখ দুঃখ যেন সমান করে ভাগ করে নেই। লোক দেখানো ধর্মাচারি নয়, জ্ঞানে ও গুণে মানুষ হয়ে ওঠবার সাধনাটা যেন আমরা চালিয়ে যাই। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঈদ মোবারক’ কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবধারায় ভক্তিস্নান করলে ঈদ হতে পারে প্রিয়াস্পদের অনিন্দ্য ভালোবাসার মতো অনাবিল ও মহিমাময়।   
খুশীর পাপিয়া পিউ পিউ গাহে দিগ্বিদিক,
বধু-জাগে আজ নিশীথ-বাসরে নির্নিমিখ্।
কোথা ফুলদানী, কাঁদিছে ফুল!
সুদূর প্রবাসে ঘুম নাহি আসে কার সখার,
মনে পড়ে শুধু সোঁদা সোঁদা বাস এলো খোঁপার,
আকুল কবরী উলঝলুল্!!

লেখক: সাংবাদিক 
রচনাকাল: ৫ জুন ২০১৯

Comments

    Please login to post comment. Login