Posts

চিন্তা

ঈদ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা: সংস্কৃতির দ্বিচারিতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

March 31, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

44
View

মানুষ আনন্দ ছাড়া বাঁচে না।‌ গভীর বিষাদের মধ্যে কেউ যদি সামান্য খড়কুটোর মতো আনন্দের উপলক্ষ খুঁজে পায় তবে তার জীবনকে সামনে এগিয়ে রাখবার রসদ মিলতে পারে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাইতো দারুণভাবে বলে রেখেছেন, আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।

সুলতানী আমলে (১২০৪-১৫৭৬) ঈদ আনন্দ আয়োজনে রাজা ও প্রজার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকত। মোগল আমলে (১৫৭৬-১৮৫৭) ওই সাংস্কৃতিক প্রবাহ আরও বেগবান হয়। মোগল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সময় ঈদের শোভাযাত্রা ও মেলা বর্ণাঢ্য রূপ নেয়, যেখানে কাব্যপাঠ, সংগীতানুষ্ঠান ও পুতুলনাট্য পরিবেশিত হতো।

সুলতানি আমলে বাংলায় ঈদ উৎসব রাজকীয়ভাবে পালিত হতো। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, সে সময় সুলতানরা ঈদের নামাজের পর বিশেষ শোভাযাত্রার আয়োজন করতেন। এই শোভাযাত্রায় সামরিক মহড়া, রাজকীয় হাতি-ঘোড়ার প্রদর্শনী, বাদ্যযন্ত্রের বাজনা, আরবীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ থাকত। সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে একে বর্ণাঢ্য করে তোলা হতো। তবে তা মূলত ইসলামি সংস্কৃতির পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তেমনিভাবে মোগল আমলেও ঢাকায় সুবেদারদের উদ্যোগে ঈদ শোভাযাত্রা বের হতো। এতে ঢোল-তবলা বাজিয়ে, সুসজ্জিত হাতি-ঘোড়া নিয়ে, ফুলের পসরা সাজিয়ে নগরীর বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করা হতো।

সুলতানি-মোগল আমলের সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে ঢাকার রাজপথে আজ হয়েছে ঈদের আনন্দমিছিল। ঈদকে আরও উৎসবমুখর করতে এ মিছিলের আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ঈদের নামাজ শেষে এ মিছিল আগারগাঁও থেকে শুরু হয়ে সংসদ ভবনের সামনে শেষ হয়।

দ্য ডেইলি স্টার জানাচ্ছে, পুরো আগারগাঁও এলাকা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল "ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক" স্লোগান। শোভাযাত্রায় ছিল ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, সাজানো ঘোড়ার গাড়ি, বলদ টানা গাড়ি এবং নানান রঙিন প্রদর্শনী।

শোভাযাত্রার নেতৃত্বে ছিল একটি ব্যান্ড দল, যারা উৎসবমুখর সুর বাজাচ্ছিল। অংশগ্রহণকারীরা ঈদের শুভেচ্ছা বার্তা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করছিল।

শোভাযাত্রার সামনের সারিতে রাখা হয়েছিল পাঁচটি সুসজ্জিত ঘোড়া, সঙ্গে ছিল ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি। এছাড়া ১০টি পুতুল নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে মোগল ও সুলতানি আমলের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছিল।

ঈদের মিছিলে বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার মতোই লোকজ মোটিফ, টোটেম ও মনুষ্য-প্রাণ-প্রকৃতির বিচিত্র ভাস্কর্য ছিল। ছিল আরব্য রজনীর আলিবাবা ও তস্কর, হস্তি এবং চিরায়ত গরুর গাড়ি।

ব্যাপকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলেও শোভাযাত্রায় সনাতন ধর্মের নারীরাও ছিলেন। ছিল উদ্ভট গাধার পিঠে উল্টো মানুষ। কেউ বলছেন, নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, আবার কেউ বলছেন সমসাময়িক কোনো রাজনৈতিক চরিত্র।

ব্যান্ড পার্টির সুর ও ড্রামের তালে তালে কোনো মানুষ যখন নাচে এরমতো সুন্দর দৃশ্য আর হয়। রোজা শেষে ঈদের প্রার্থনা শেষে টুপি পরিহিত শহুরে নাগরিক যখন নৃত্যে মাতে সেটিকে ট্যাবু ভাঙার প্রতীক হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। আমাদের প্রচলিত ধর্মাচার বাদ্যযন্ত্র ও এর সাথে নৃত্যকে অনুমোদন দেয় না বলে দাবি করেন দেশজ ধর্মগুরুরা। এমন বাস্তবতায় ঈদের দিনে আনন্দ শোভাযাত্রা বর্তমান প্রজন্মের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা বটে। প্রজন্ম তাই সোৎসাহে বলতে পারছে, এই রকম ঈদ আমরা আগে কখন দেখিনি, সেরা ঈদ!'

বাংলাদেশের সংস্কৃতি বহুমাত্রিক ও বহুস্তরীয়। একদিকে আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কৃতি —এই দুইয়ের সহাবস্থান বহু যুগ ধরে চলে আসছে। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, একই ধরনের সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গি এক প্রেক্ষাপটে হালাল আর অন্য প্রেক্ষাপটে হারাম বলে চিহ্নিত হচ্ছে। বিশেষ করে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে যারা ধর্মীয় যুক্তিতে সোচ্চার, তারা ঈদের শোভাযাত্রায় সেই একই লোকজ মোটিফ ব্যবহার করলেও কোনো আপত্তি  তুলছে না। প্রশ্ন হলো, কেন এই দ্বিচারিতা? সংস্কৃতির এই উল্টো ঘোড়া চালানোর রহস্য কী?

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে প্রথম পহেলা‌ বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়। পরবর্তী সময়ে এটি দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয় এবং ইউনেস্কো এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। লোকজ মোটিফ, পশুপ্রাণীর মুখোশ, গ্রামবাংলার প্রতীক ইত্যাদি নিয়ে এই শোভাযাত্রা বাংলা নববর্ষের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। তবে এক শ্রেণির মানুষের মতে, এই শোভাযাত্রা তাদের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আজকে আমরা লক্ষ্য করলাম, ঈদের আনন্দ শোভাযাত্রায় বৈশাখের মতো কাছাকাছি ধরনের লোকজ মোটিফ ও টোটেম ব্যবহার করা হলো। পুতুলনাট্যের মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ঈদ উৎসবের সাথে মিশিয়ে পরিবেশন করা হলো। অথচ যারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন, তারা এই ঈদ শোভাযাত্রায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। তাহলে কি লোকজ মোটিফ কেবল নির্দিষ্ট উৎসবের জন্যই ইসলামবিরোধী?

প্রশ্ন হলো সংস্কৃতির এমনতর দ্বিচারিতা কেন? সংস্কৃতি কখনো স্থির থাকে না, বরং তা নিরন্তর বিবর্তনের মধ্যে থাকে। কিন্তু এই দ্বিচারিতার কারণ কী? মূলত এটি একটি রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ। যারা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙালিত্বের প্রতীক মনে করে বিরোধিতা করেন, তারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য এই দ্বৈত নীতি অনুসরণ করেন। ঈদের আনন্দ র‌্যালিতে লোকজ উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে তারা মূলত নিজেদের সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।

আজকের ঈদের আনন্দ আয়োজনকে আমরা সর্বোতভাবে সমর্থন করি। ভাবীকালে এই উৎসব আরো জাঁকজমকপূর্ণ ও ইনক্লুসিভ হবে, জনহিতে মেসেজনির্ভর থিয়েট্রিক্যাল অনুষঙ্গ থাকবে, নির্দিষ্ট ধর্মীয় বাতাবরণ ঘুচে গিয়ে বহুত্ববাদী সাম্য কায়েম হবে; আমরা এমনটা প্রত্যাশা করি। কিন্তু ঈদ শোভাযাত্রা যদি বৈশাখী শোভাযাত্রাকে বাতিল করবার প্রবণতা তৈরি করে, নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে; তবে ওই আয়োজনের সমর্থক আমরা কিছুতেই হবো না।

মনে রাখা দরকার ঈদ উৎসবে সুলতানি ও মোগল ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করছি মানে আমরা বৃহত্তর ভারতবর্ষীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদকে একপাশে রেখে আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রাধান্য দিচ্ছি। সুলতান ও মোগলের ভাবাদর্শ টেনে আনায় শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য ভারতবিরোধিতা দ্বিচারিতা দোষে দুষ্ট হতে পারে।

সংস্কৃতি সর্বজনীন। তা ধর্ম, জাতি, মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত। তাই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য একরকম এবং অন্যদের জন্য আরেকরকম মানদণ্ড নির্ধারণ করার প্রবণতা সংস্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের অন্তরায়। ঈদ শোভাযাত্রায় লোকজ মোটিফ ব্যবহারের ফলে বোঝা যাচ্ছে, লোকজ সংস্কৃতি কোনো ধর্মের জন্য সমস্যা নয়, বরং কিছু গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রয়োজনে একে কখনো গ্রহণ করা হয়, কখনো প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাই সংস্কৃতিকে রাজনীতির হাতিয়ার না বানিয়ে, তাকে সবার জন্য সমানভাবে উপভোগ্য করে তোলা উচিত।

লেখক: সাংবাদিক 
৩১ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login