হরিপদের মেয়ে
হরিপদ সকাল থেকে চিৎকার চেচামেচি করছে। শান্ত স্বভাবের মানুষটার হঠাৎ করে কি এমন হলো ভেবে কুল পাচ্ছি না। গতকাল রাতেও দিব্বি বাইরে থেকে এসে গোসল করে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো মিনু।
বাজান কি হইছে জিজ্ঞেস করতেই, হরিপদ বললো আমার একটা দামী জিনিস খুঁইজা পাইতাছি না।
মিনু : কি জিনিস?
বাবা : আছে রে মা, সে তুই বুঝবি নে।
মিনু : বুঝাইয়া কইলেই তো হয়।
বাবা : আবার যাইতে হইব সেই ঠাকুমার কাছে। না জানি এহন সে আমারে বকাঝকা করে। বার বার কইছিল, খুব সাবধানে রাখবি। কাউরে কিছু কইবি না।
মিনু : বাজান, তুমি এহন কনে যাইবা ?
বাবা : বাজারে যামু রে মা । আজ সকালে ৬ কেজি দুধ পাইছি। বিক্রি করতে হইব। তোর কি কিছু লাগবোরে মা ?
মিনু : না বাজান, ঘরে যা আছে তা দিয়ে বাপ বেটির আরও কিছু দিন চইলা যাইব নি।
বাবা : আইচ্ছা মা। অহন আমি যাই।
মিনু : বাজান, কইয়া গেলা না জিনিস টা কি ?
বাবা : না রে মা, তুই বুঝবি না নে ।
এই বলে হরিপদ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল বাজারের দিকে। গায়ের আঁকাবাঁকা পথ। পথের এক ধরে ছোট বড়ো গাছের দল যেন হাত নাড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে হরিপদকে। অন্য ধারে বয়ে চলেছে ক্লান্তহীন নদী । নদীর পারে এক কোনে কিছু ডিঙি নৌকা বাধা আছে। সেখান থেকে এক মাঝি হরিপদকে ডেকে বলল,
মাঝি : ওই হরি এই সক্কাল সক্কাল কলসি হাতে কই চললে?
হরিপদ : বাজারে যাই গো মাঝি।
মাঝি : হ যাও যাও আইজ বাজারে মেলা খদ্দের পাইবা। বেচা বিক্রি ভালা আইজ। তা তোমার মাইয়া কেমন আছে? মেলাদিন দেহি না ওরে।
হরিপদ : আছে ভালাই। তোমার ছাওয়ালডারেও তো মেলাদিন অয় দেহি না। কোনে থাহে অই?
মাঝি : থাহে বাড়িতই। তয় চুপচাপ থাহে। কারো সাথে তেমন কথাটতা কয় না।
হরিপদ : কে হঠাৎ কইরা এমন হইয়া গেলো কে তোমার পোলায় ? আগে তো সবার সাথে মিশতো। সবার খোঁজ খবর লইতো। কি এমন হইলো যে নিজেরে গুটাইয়া নিলো।
মাঝি : জানি না রে হরি, কিচ্ছু বুঝি না। পোলাডা কেন এমন হইলো। যাও মাঝি তোমার বাজারে যাওয়ার পথ আটকাইয়া দিলাম। বাজারে যাও অহন না হলে তোমার কলসির দুধ বাসি হইয়া যাবে নে।
হরিপদ : আইচ্ছা । যাই তাইলে।
হরিপদের এক হাতে ছিল দুধের কলস আরেক হাতে ছিল একটি বড়ো লাঠি আর হারিকেন। এই নিয়ে হেটে চললো বাজারের রাস্তায়। কেন যেন আজ রাস্তা শেষ হচ্ছে না। সুর্য যেন মাথার উপরে চলে এসেছে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে এলো বাজার। মাঝি ঠিই বলেছিলো আজ বাজারে অনেক লোকের সমাগম। হরিপদ ভাবতে লাগলো আইজ খুব তাড়াতাড়ি দুধ বিক্রি কইরা বাড়ি যাইতে পারমু।
বাজারে রাস্তার ধারে এক কোনে হরিপদ তার দুধের কলসি আর সাথে থাকা হারিকেন, লাঠি নিয়ে বসে গেলো। এভাবে বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। সুর্য কিছুটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো,
তা বাপু দুধ কত করে কেজি?
হরিপদ : ১০০ টাকা কেজি দুধ এক্কেরে খাঁটি কোনো ভেজাল নাই। খাইয়ে শান্তি পাইবেন নে।
দুধ ক্রেতা : এই হানে কত টুকু হবে নে?
হরিপদ : ৬ কেজি।
দুধ ক্রেতা : ৬ কেজিই দিয়া দেও তাইলে।
হরিপদ : এই লন।
এই বলে লোকটি তাকে ৬০০ টাকা দিয়ে দুধ নিয়ে বিদায় হলো। হরিপদ খুশি মনে হাতে
দুধের কলস আর হারিকেন আর লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর পায়ে হেটে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
হরিপদ মনে মনে ভাবছে, যাক আজ আর
সন্ধে করে বাড়ি ফেরা লাগলো নে।
দুপুর শেষ হয়ে বিকেল যেনো উঁকি দিচ্ছে। চারিদিকে কিছুটা দমকা হাওয়া বইছে। আকাশে খানিকটা মেঘের আনাগোনা দেখা যায়। বাড়িতে মা মরা মিনু একা একা কি যে করছে সারাক্ষন মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে সে। দিন দিন বড়ো হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা দেখতেও হয়েছে বেশ। ভালো ভালো জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে মেয়ের জন্য কিন্তু একমাত্র মেয়ে হওয়াই বিয়ে দিতে চান না হরিপদ। এই মেয়ে ছাড়া তার তিন কূলে আর কেউ নেই। নদীর কাছে এসে কিছুটা অবাকই হলো সে। সেই সকালে মাঝিকে ডিঙি নৌকার পাশে যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিলো এখনো সেই অবস্থাই বসে আছে সে। মাঝিকে দেখে একটু একটু করে গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো হরিপদ। দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে যেন একটু বিভ্রান্ত মাঝি। হরিপদ মাঝিকেও ডাক দিতেই চমকে গেলো সে।
হরিপদ : কি গো মাঝি বাড়ি যাও নাই এখনো।
মাঝি : কি যামু সেই সক্কাল থিকা একজনরেও নদী পারাপার করতে পারলাম না। হাতে একটা কানা করিও নাই। তা একখান কতা কইবার চাইছিলাম তুমারে।
হরিপদ : কি কিথা কউ দেহি ?
মাঝি : তা মাইয়া তো তোমার বড়ো অইছে। মাইয়া বিয়ে দেওন লাগবো না?
হরিপদ : মা মরা মাইয়া। বাড়িতে ওই ছাড়া কেউ নাই গো। ওরে বিয়া দিলে বাড়িডা আমার খালি হইয়া যায়।
মাঝি : কি যে কউ মিয়া। তাই বইলা কি মাইয়া বিয়ে দেওন লাগবো না ? কইছিলাম কি আমার পুলায় তোমার মাইয়ারে খুব পছন্দ করে। তুমার মাইয়ারে আমি নিজের মাইয়া কইরা রাখুম নে। আমার তো আর কোনো মাইয়া নাই।
এই কথা শুনা মাত্র, হরিপদের চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ চলে এলো। কিছুটা রাগ নিয়ে সে মাঝিকে বলল,মাঝি আজ আমি যাই। মাইয়াটা বাড়িতে একা আমার লাইগা খাওন লইয়া বইসা আছে।
বাড়িতে গিয়ে দেখে তার মেয়ে বাড়ির দুয়ারে পাটি বিছিয়ে খাবার নিয়ে বসে আছে। আর হাতে কি যেন একটা বই খুব মন দিয়ে পড়ছে সে। মাঝি কাছে যেতেই দেখে এটা তো সেই বই যেটা সেই ঠাকুমা তাকে দিয়েছিলো। এই বইটার জন্যই তো মাঝি সকাল বেলা চিৎকার চেঁচামেচি করছিলো। মেয়ের হাত থেকে সঙ্গে সঙ্গে বইটা নিয়ে নিলো মাঝি। তার মেয়ে অবাক হয়ে বাবাকে বলল,
কি হলো বাজান । কহন আইলা ? তুমার বইডা খুঁইজা পাইছি আমি। এইডার লাইগাই তুমি সক্কাল বেলা বাড়ি মাতায় তুলছিলা।
হরিপদ : কনে পাইছোস তুই এই বই?
মিনু : আমাগো বাড়ির পুবদিকে বড়ই গাছের নিচে পইড়া আছিলো। আমি উঠান শুড়তে যাইয়া খুইজ্জা পাইছি। হাত মুখ ধুইয়া আহ খাওন খাইয়া লও।
খাবার খেতে খেতে হরিপদ বলল, মা এইবার তোর একখান বিয়া দেওন লাগবো। মিনু এই কথাটা শুনেও যেনো না শুনার ভান করছিলো।
মিনু খুব আগ্রহ নিয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, আইচ্ছা বাজান তুমি এই বইডা কনে পাইছো ?
হরিপদ : ঐডা জাইনা তোর কাম নাই। আরেকটু ভাত দে দেহি নি। তুই খাবি নে।
মিনু : পরে খামু। আগে তুমি কও, বইডা কনে পাইছো ?
হরিপদ : এই বই আমারে একজন দিছে রে মা। আমারে বলছে এই বই আমাগো বাড়িতে থাকলে কেউ আমাগো কোনো ক্ষতি করবার পারবো না। এই বই থাকলে আমাগো সংসারে অনেক আয় উন্নতি হইবো।
হরিপদ অশিক্ষিত। সে লেখা পড়া জানে না। আর এই জন্যই ঠাকুমা তাকে বইটা দিয়েছিলো তার মেয়েকে বসে আনার জন্য। আর বলেছিল, খুব যত্ন সহকারে বইটা যেন লুকিয়ে রাখে। কিন্তু হরিপদের মেয়ে মিনু আবার পড়ালেখা জানতো। মিনু বইটা পড়ে বুজতে পেরেছিলো এটা কালোযাদুর বই। মিনু খুব চালাক প্রকৃতি একটি মেয়ে। সে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলো, যে এই বইটা তার বাবাকে দিয়েছে সে তার এবং তার বাবার ক্ষতি করতে চায়। কারণ বইটাতে কিছু অদ্ভুত ভয়ঙ্কর কালোযদুর কথা লিখা আছে। আর এমন একটা বই কেনই বা তার বাবার কাছে আসবে, কেই বা দিবে। মিনুর মনে বেশ সন্দেহ দানা বাধতে লাগলো। এখন যদি সে তার বাবার কাছে বইটা চায়। তার বাবা তাকে বইটা দিবে না। তাই সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে যে তার বাবা বইটা কোথায় রাখে।
মিনু : বাজান আরেকটু ভাত দেই ?
হরিপদ : না আর নিমু না। আমি একটু পুবের দিকে যামু। তুই ভাত খাইয়া লইস।
এই বলে হরিপদ। খাওয়া শেষ করে হাতে হারিকেন আর লাঠি নিয়ে পুবের দিকে গেলো। যাওয়ার আগে বইটা বিছানার পাশে বালিশের তলায় রেখে যায়। মিনু লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা খেয়াল করে। যখন হরিপদ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তখন মিনু আবার সেই বই পড়তে শুরু করে। বেশ আগ্রহ সহকারে পড়ছে সে। যতই পড়ছে ততই যেনো সে একটি আসক্ত মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। সে ঠিক করে সম্পূর্ণ বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে থামবে না। বইটা কেন যেন তাকে এক নিষিদ্ধ আনন্দ দিচ্ছে তাকে। ডাকিনি বিদ্যার চর্চা, কুফুরি কালাম সহ নানা রকম কালো জাদুর কথা বলা আছে এতে। হরিপদের পায়ের শব্দ পেতেই বইটা লুকিয়ে ফেললো বালিশের নিচে।
হরিপদ : কনে গেলি রে মা ? আমার ঘরে একটু জল দিয়া যা। ঘুমাই যামু আইজ।
মিনু সুযোগ বুঝে আবার তার বাবার বালিশের নিচ থেকে বইটা নিয়ে তার ঘরে গিয়ে পড়া শুরু করল। বাবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মিনু হারিকেন জ্বালিয়ে তার ঘরে খুব মন দিয়ে বইটি পড়ছে। সে ভাবছে আজকে সম্পূর্ণ বই পড়ে শেষ করবে। কারণ এই বই পড়ার সুযোগ সব সময় তার আসবে না। যদি কোন ভাবে তার বাবা জানতে পারে হয়তো তাকে বকাঝকা করবে। এই ভেবে সে খুব মন দিয়ে বইটি পড়া শুরু করল। এভাবে প্রায় ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত সেই বইটি পড়া চালিয়ে যেতে থাকলো। যখন ফজরের আযান পড়বে তার আগ মুহূর্তে সে বইটি পুনরায় তার বাবার বালিশের নিচে রেখে দিলো। এরপর গুটি গুটি পায়ে তার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
হরিপদ সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার চিৎকার শুরু করল। সে তার বইটি আবারো খুঁজে পাচ্ছে না। এবার মিনু ভাবছে সে তো রাতে বই পড়ে তার বাবার বালিশের নিচেই রেখেছিল। তাহলে বইটি আবার কোথায় উধাও হয়ে গেল। বাবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মিন দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এলো এবং বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
কি হইছে বাজান?
হরিপদ : আমি আবার আমার বইডা খুইজা পাইতাছিনা।
মিনু : খাড়াও বাজান, আমার মনে অয় বইডা পুবদিকের ঐ বড়ই গাছটার নিচে পড়ে আছে।
এই কথা বলে মিনু দ্রুত ছুটে গেল পূব দিকে। ঠিক সেদিনের মতো বইটা আজও বড়ই গাছটার নিচে পড়ে আছে। সত্যিই অদ্ভুত প্রতিদিন বইটা এখানে কিভাবে আসে মিনু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। হরিপদও বেশ চিন্তিত এই বিষয়টি নিয়ে কিন্তু হরিপদ তো আর জানে না যে, মিনু এই বইটির ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে। মিনু ঠিকই বইটা সেখান থেকে এনে তার বাবার হাতে তুলে দেয়। মিনু ভাবছে, আজ রাতে বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে আবার বইটি পড়া শুরু করবে। ততক্ষণ পর্যন্ত পড়বে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ঘুম চলে আসে।
তার বাবা ঘুমানোর পর গুটিগুটি পায়ে তার বাবার ঘরে গেল এবং বইটি নিজের ঘরে নিয়ে আসলো। বইটি যতই পড়ছে ততই মিনুর ভয়ে
গা শিউরে উঠছে। একটা বই কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটাই ভাবছে মিনু। ভয় পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু বইটি পড়ার সাথে সাথে তার মনে বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি আগ্রহের জন্ম নিছে। এভাবেই প্রতি রাতে তার বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে একা একা বইটি পড়া শুরু করে।
মিনু বুঝতে পারে, তার বাবার সরলতার সুযোগ নিয়ে তার এবং তার বাবার কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। মিনু সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে ডেকে তোলে।
মিনু : আইচ্ছা, বাজান সত্যি একটা কথা কও তো। তুমি এই বইডা কনে পাইছো ?
হরিপদ : কেনরে মা ? তুই আচমকা এই কতা জিগাইলি যে ?
মিনু : বাজান তুমি কি জানো এটা কিসের বই?
হরিপদ: না রে মা।
মিনু : এইডা কালা জাদুর বই বাজান। তোমার আর আমার ক্ষতি করবার লাইগা এই বইডা তোমারে কেউ দিছে। পয়লা দুইদিন যহন তুমি শীতানে রাইখা ঘুমায় ছিলা তহন এই বইডা বড়ই গাছের নিচে পইরা আছিলো। কিন্তু তুমি ঘুমাই যাওনের পর আমি এই বইডা একা একাই পড়ি। তুমি ঘুম থিকা উঠার আগে তোমার শীতানে বইডা রাইখা আহি। তাই এখন আর বইডা বড়ই গাছতলার নিচে পইড়া থাহে না। তার মানে রাইতের বেলা কেউ এহানে আইয়া বইডা ঐখানে রাইখা যায়। তুমি কি কিছু বুঝতাছো বাজান ?
হরিপদ : ঠিকই কইসোস মা। আসলে আমারে এক ঠাকুমা এই বইখানা দিয়া কইছিল, এই বই আমার কাছে থাকলে আমরা মেলা ধনী হমু।
মিনু : শুনো বাজান, তুমি আইজ দুপুরে আমাগো মসজিদের হুজুররে লইয়া আইবা আমগো বাড়িতে। বাকি কতা আমি তুমারে হুজুরের সামনেই কমু।
হরিপদ : আমরা তো হিন্দু রে মা। হুজুর কি আমাগো ডাকে অইবো?
মিনু : অইবো। হে জাত ধর্ম দেহে না। মাইনষের মেলা উপকার করে। মানুষ তো মানুষের জন্যই বাজান।
হরিপদ : আইচ্ছা।
এই বলে হরিপদ কিছুটা চিন্তিত মনে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। বাপ বেটির ছোট্ট একটি সংসার। কেইবা তাদের ক্ষতি করতে চাইবে। পথ চলতে চলতে সেই হরেন মাঝির সঙ্গে দেখা। না জানি আজ আবার আমার মেয়ের বেপারে কি জিজ্ঞেস করে। তার ছেলের জন্য আমার মেয়েকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে সে। এসব ভাবতে ভাবতে পথ চলছে সে। সামনেও এসে দাঁড়ালো হরেন মাঝি।
মাঝি : কি হরিপদ। কনে যাইতাছো এই দুপুর বেলা ? আর তো কিছু কইলা না মিনুর বেপারে।
হরিপদ : আসলে মাইয়া এহন বিয়া দিবার চাইতাছি না মাঝি।
এই বলে কথা না বাড়িয়ে মাঝিকে বিদায় দিয়ে আবার পথ চললো হরিপদ। মাঝি কিছুটা রাগান্নিত হয়েই তার বাড়ির দিকেও রওনা হলো।
সামনেই মসজিদ। জোহরের নামাজ শেষ হওয়ার পর হুজুর যখন মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলো তখন পাশে থেকে কিছুটা ভীতু কণ্ঠে হুজুর কে ডাক দিলো হরিপদ।
হুজুর : কি বেপার হরি? তুমি এখানে কি করো।
হরিপদ : হুজুর যদি কিছু মনে না করেন একটা আবদার করতাম।
হুজুর : আচ্ছা বলো শুনি তোমার আবদার।
হরিপদ : জানি আপনে হুজুর মানুষ এই রকম আবদার করা ঠিক হইবো কিনা আমি জানি না । কিন্তু আপনে তো মেলা মানুষের মেলা উপকার করেন। কইতেছিলাম কি, হুজুর আইজ আমাগো বাড়িতে একটু যাইবেন? আমার মাইয়া আপনারে খুব কইরা যাইতে কইছে।
হুজুর : ঠিক আছে। আমি বাদ আসর তোমার বাড়িতে যাব।
হরিপদ খুব খুশি মনে হুজুর কে সালাম দিয়ে বিদায় হলো।
বাদ আসর হুজুর এলো হরিপদের বাড়িতে। বাড়িতে পা রাখা মাত্র হুজুরের মুখটা কেমন যেনো মলিন হয়ে উঠলো। হুজুর কে দেখে মিনু ঘর থেকে বের হয়ে এলো। মিনু কথা বলার আগেই হুজুর মিনুকে সেই বইটা আনতে বলল। মিনু কিছুটা অবাক হলো এবং বইটা হুজুরের হাতে তুলে দিলো। মিনুর হাত থেকে বইটি নেওয়ার সময় হুজুর বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বইটি নেয়। হুজুর মানুষ সাধারণত কোন কিছু নেয়ার আগে ডান হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো ঘটলো। হরিপদও ছিল সেখানে। মিনু হুজুরকে কিছু বলার আগেই হুজুর মিনুক থামিয়ে দিল এবং সে বলতে শুরু করল।
হুজুর : মিনু আমি খুব ভাল করেই জানি তুমি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছো। দেখো হয়তো তোমার বাবা বিষয়টি বুঝতে পারেনি কিন্তু তুমি বিষয়টি বুঝতে পেরেছ। আমি জানি কে বা কারা তোমার এবং তোমার বাবার ক্ষতি করতে চায়। আমি খুব ভালো করেই জানি কিন্তু আমি এখন তার নাম প্রকাশ করতে পারবো না কারণ এতে করে হয়তো তোমাদের সাথে তার একটা শত্রুতা তৈরি হবে। মিনুর বাবা হরিপদ হুজুরকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, কে ঐ ব্যক্তি যে তাদের ক্ষতি করতে চায়। হরিপদ হুজুরকে কথাও দিয়েছিল যে, সে কখনোই তাকে কোন কিছু বলবে না এই বিষয় নিয়ে। শুধু ঐ ব্যাক্তির থেকে নিজেকে সাবধান রাখার জন্যই হুজুরের কাছ থেকে তার নাম জানতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হুজুর তার নামটা বলেন। সে আর কেউ না সে ছিল সেই হরেন মাঝি যার ছেলের সাথে মিনুর বিয়ের কথা বলা হয়েছিল। হরিপদ শুরু থেকেই এ বিষয়ে নারাজ ছিল বিধায় হরেন মাঝি ঠাকুমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে হরিপদ এবং হরিপদের মেয়েকে বসে আনার চেষ্টা করেছিল। হুজুর হরিপদ এবং মিনুকে কথা দিতে বলে, যেন তারা হরেন মাঝি বা ঠাকুরকে এ ব্যাপারে কোন কিছু না জানায়। এবার তারা নিরাপদে থাকতে পারবে কারণ বইটি হুজুর নষ্ট করে ফেলে। মিনু বেশ চালাক এবং শিক্ষিত একটি মেয়ে। যার কারণে সে তাদের কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই বইটি পড়ে অনেক কিছু জেনে যায়। এরপর হুজুর হরিপদের বাড়ি থেকে চলে আসে।
128
View
Comments
-
Pinku Chandra Paul
8 months ago
সুন্দর হয়েছে