Posts

চিন্তা

মার্কিন গণমাধ্যম ও বাংলাদেশের রাজনীতি

April 2, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

37
View

বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে। এই প্রক্রিয়ায় গোয়েন্দা তৎপরতা, সাহায্য সংস্থার কার্যক্রম, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং গণমাধ্যমের সংবাদ প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের দিকে সব দেশই সতর্ক দৃষ্টি রাখে। একইভাবে, মার্কিন প্রশাসনও বৈশ্বিক রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে নির্দিষ্ট সংবাদ তৈরি বা প্রচারের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটায়।

১ এপ্রিল দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত বাংলাদেশের ওপর প্রতিবেদনটি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিবেদনটিতে উত্থাপিত অভিযোগগুলো পুরোপুরি সত্য হলেও, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যথারীতি এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে ইতিহাস বলে, অস্বীকার করলেই বাস্তবতা বদলে যায় না।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল: "As Bangladesh Reinvents Itself, Islamist Hard-Liners See an Opening." প্রতিবেদনের মূল কথা, বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসক উৎখাতের পর দেশটিতে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যার সুযোগ নিচ্ছে ইসলামী কট্টরপন্থীরা।

তারাগঞ্জ ও ঢাকা থেকে দ্য টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যূরো চিফ মুজিব মশাল ও প্রতিবেদক সাইফ হাসনাতের করা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়, নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে উগ্রবাদীরা বিষয়টি শুরু করেছিল।

বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী নেতাকে উৎখাতের পর একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতার মধ্যে একটি শহরের ধর্মীয় মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, তরুণীরা আর ফুটবল খেলতে পারবে না। আরেকটি শহরে এই মৌলবাদীরা এমন এক ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে পুলিশকে বাধ্য করেছে, যিনি হিজাব না পরায় প্রকাশ্যে এক নারীকে হেনস্তা করেছিলেন। পরে তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়।

এরপর আরও নির্লজ্জ আহ্বান জানানো হয়েছে। ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সরকার যদি ইসলাম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ড না দেয়, তাহলে তাঁরাই তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবেন। এর কয়েক দিন পর একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠী ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে বড় মিছিল করেছে।

ওই প্রতিবেদনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট সুস্পষ্ট করা হয়েছে। প্রতিবেদন মতে, দেশের নিপীড়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যেসব নারী শিক্ষার্থী পথে নেমেছিলেন, তাঁদের জন্য মৌলবাদীদের এই উত্থান বিশেষভাবে বেদনাদায়ক।

নারী শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের এখন ধর্মীয় লোকজনের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। তাদের লড়াই করতে হচ্ছে এমন এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, যারা হিন্দু ও ইসলামের ছোট ছোট সম্প্রদায়ের অনুসারীসহ নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো, সমালোচকেরা বলছেন, ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁরা অভিযোগ করছেন, অধ্যাপক ইউনূস অপেক্ষাকৃত নমনীয়, গণতান্ত্রিক সংস্কারের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া ও সংঘাতবিমুখ। তিনি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেননি, ফলে চরমপন্থীরা আরও বেশি জনসাধারণের স্থান দখল করে নিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের সহকারীরা একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন জারি ছিল। এখন অবশ্যই বাক্‌স্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। কিন্তু এটি করলে মূলত চরমপন্থী দাবির জন্য একটি দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনর্নির্মাণ ও সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য নতুন এক ভবিষ্যৎ তৈরির চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘ দিন ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইসলামি উগ্রপন্থীরা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।

হাসিনা সরকার এই লুকিয়ে থাকাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে নিজের পক্ষে রাখতে চেয়েছিলেন সেটি প্রতিবেদনে তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে স্পষ্ট করা হয়েছে। কার্যত আজকের উগ্রপন্থার দায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরই বহুলাংশে বর্তায়। গেল ১৫ বছর নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একচ্ছত্র রুলিং পার্টি ছিল তারাই।

এছাড়া বাংলাদেশের উদীয়মান উগ্রপন্থার সাথে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের উদাহরণ টানা হয়েছে প্রতিবেদনে। যেটি বিশ্বের সভ্য সমাজে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো কোনো বার্তা দেয় না।

প্রতিবেদনটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো:
১. বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী নেতাকে সরানোর পর মৌলবাদীরা সমাজে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নিচ্ছে। এক শহরে তারা ঘোষণা দিয়েছে, তরুণীরা ফুটবল খেলতে পারবে না। অন্য শহরে হিজাব না পরায় এক নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তাকারীকে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, এমনকি তাকে ফুল দিয়ে বরণও করা হয়েছে।

২. যারা শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনের অবসান চেয়েছিলেন, তারা এখন এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন। তাদের আশা ছিল, বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরবে, কিন্তু এখন তাদের লড়াই করতে হচ্ছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, যারা নারী, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষদের জন্য নতুন সংকট তৈরি করছে।

৩. প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার উগ্রপন্থীদের দমন করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে অনেকেই নমনীয় মনে করছেন। তার এই নীতির কারণে মৌলবাদীরা আরও প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পেয়েছে।

৪. হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের গোপনে লালন-পালন করেছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন সেই গোষ্ঠী প্রকাশ্যে এসেছে এবং রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে।

এই প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তীব্র প্রতিবাদ জানালেও, বাস্তবতা হলো, অভিযোগগুলোর একটি ক্ষেত্রেও তারা কার্যকরভাবে পাল্টা তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং, মার্কিন গণমাধ্যমের এমন প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকারি দায়িত্ববোধ, করণীয় ও জবাবদিহিতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে সদ্য বিদায় হওয়া শাসকগোষ্ঠীকে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতির প্রতি আঙুল তুলবার সমূহ সুযোগ তৈরি করছে।

মার্কিন গণমাধ্যমের কাঠামো বেশ শক্তিশালী এবং এটি কয়েকটি প্রধান প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়, যেমন CNN, The New York Times, The Washington Post, The Wall Street Journal এবং Fox News। এসব গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করলেও অনেক সময় কর্পোরেট স্বার্থ ও মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের কারণে মার্কিন মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র , মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়া, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, অর্থনীতি, শ্রম অধিকার, পোশাক শিল্প, বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম প্রায়ই বিশেষ নজর নিয়ে  সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমের এসব প্রতিবেদন কোনোভাবেই উপেক্ষা করা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের এ ধরনের প্রতিবেদন কেবল বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেই প্রভাবিত করে না, বরং বৈশ্বিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গিকেও নিয়ন্ত্রণ করে।

সরকারের উচিত যুক্তিযুক্ত ও তথ্যভিত্তিক পাল্টা প্রতিবেদন প্রকাশ করা, যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একপেশে বয়ানে প্রভাবিত না হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং পেশাদার কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা প্রয়োজন। সর্বোপরি সরকারকে অবশ্যই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ইতিবাচক হয়।

মোদ্দাকথা, মার্কিন গণমাধ্যম কেবল বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই প্রভাব বিস্তার করে। যদিও এই প্রভাব সবসময় হয়ত বাস্তবতা ও নিরপেক্ষতার প্রতিফলন ঘটায় না। তারপরও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে ঢালাওভাবে বাতিল না করে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করাই হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।

লেখক: সাংবাদিক
২ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login