রাজনৈতিক প্রবাদ বলে, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার নাই। অপরদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ‘বন্ধু শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়’।
এই খারাপটার সবচেয়ে বেশি ঘটল বাংলাদেশের সাথেই। আমাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর ১৫ ভাগ থেকে লাফিয়ে শুল্ক ধার্য করা হলো ৩৭ ভাগ। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা বিরাট অশনিসংকেত। গার্মেন্টস শিল্প টিকবে কিনা -এমন আশঙ্কায় এক ধরনের দোদুল্যমান পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। লাখো মানুষকে পেশা বদলে ফেলতে হতে পারে। কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে হাজারো মানুষ। সামাজিক অস্থিরতায় পড়তে পারে দেশ।
দেখার বিষয় প্রফেসর ইউনূস সরকার এই কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেয়। আমাদের সাথেই কেন এমন হলো? অন্তর্বর্তী সরকার অথবা সরকার প্রধানকে মিস্টার ট্রাম্প আস্থায় নিতে পারছেন না? কোনোভাবে শিক্ষা দিতে চান? কোণঠাসা করতে চান? আমরা এখনো ঠিক জানিনা রাজনৈতিক সেই অন্তরাল। তবে ইতিহাসের অতীত ঘেঁটে প্রফেসর ইউনূসের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো লেভেলেই এতটুকু সখ্যতার নজির আমরা পাইনি।
প্রথম আলো রয়টার্সের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন, যাকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।
বাংলাদেশের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে।
নতুন করে উচ্চ মাত্রায় এই শুল্ক আরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ অভিহিত করেন ট্রাম্প। নতুন শুল্ক আরোপকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, এই দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষা করছে।
ট্রাম্পের পাল্টা এই শুল্ক আরোপে ভারতের পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৪ শতাংশ।
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ, তাইওয়ানের পণ্যে ৩২ শতাংশ, জাপানের পণ্যে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের পণ্যে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের পণ্যে ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের পণ্যে ১০ শতাংশ, ইসরায়েলের পণ্যে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের পণ্যে ১৭ শতাংশ, চিলির পণ্যে ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্কের পণ্যে ১০ শতাংশ, কলম্বিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে।
অন্যান্য যেসব দেশের পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ এবং মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
পাল্টা এই শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে থাকা ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ‘বন্ধু শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়’।
শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, আজকের দিনকে আমেরিকান শিল্পের ‘পুনর্জন্ম’ এবং আমেরিকাকে ‘আবার সম্পদশালী’ করার দিন হিসেবে স্মরণ করা হবে।
কথা হলো এই বিপর্যয় কি বাংলাদেশ মোকাবেলা করতে পারবে? আমরা মনে করি অসম্ভব কিছু না। হয়ত বাংলাদেশে পোশাক শিল্প থাকবে না। বেশ কয়েকবছর অর্থনৈতিক টানাপোড়েন চলবে। মানুষে মানুষে হানাহানি বাড়বে। কিন্তু একবার যদি মানুষ অভ্যস্ত হয়ে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে পুনরায় ফিরে যায়, মানুষ যদি নিজের ফসল নিজেই ফলায় পরিস্থিতি হয়ত সামাল দিতে পারবে।
সরকারকে এবার মানুষের জন্মহার হ্রাস করবার দিকে মনোযোগী হতে হবে। জনমিতিকে আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চার অংশ করতে হবে। কোনো বহুবিবাহের ঝাণ্ডাধারী ধর্মগুরুদের আর আগাতে দেয়া যাবে না। আর যদি তা না পারে সরকার, প্রকৃতি নিজেই তার ব্যবস্থা করে নেবে।
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিক থমাস রবার্ট ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus) ১৭৯৮ সালে তার "An Essay on the Principle of Population" গ্রন্থে দেখিয়েছেন: পৃথিবীতে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় (১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২...)। অপরদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬...)। এর ফলে জনসংখ্যা খাদ্য সরবরাহের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা দারিদ্র্য, অভাব ও দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে।
ম্যালথাসের মতে, প্রাকৃতিক বাধা (Positive Checks): দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবে জনসংখ্যা হ্রাস করে।
প্রতিরোধমূলক বাধা (Preventive Checks): বিলম্বিত বিয়ে, পরিবার পরিকল্পনা, নৈতিক সংযম ইত্যাদির মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
আধুনিক কৃষি ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে। যা ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের অনুমানকে কোথাও ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করতে পারে। সৌখিন জীবনধারণ না হোক, অন্তত দূমুঠো ভাত কাঁচামরিচ ও পিঁয়াজ মেখে খেয়ে বাঁচতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে আমাদেরকে রেখেছেন মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, মাদাগাস্কারের দলে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নাম্বার ওয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী চায়নাকেও আমাদের চেয়ে ভালো পজিশনে রাখা হয়েছে। একদিন হয়ত পৃথিবীটা ট্রাম্পের থাকবে সেদিন আমাদের ন্যায্য অধিকার আমরা ফিরে পাবো। তার আগে নিজেদের পথ নিজেদেরকেই দেখতে হবে বৈকি।
লেখক: সাংবাদিক
৩ এপ্রিল ২০২৫