আমাদের স্কুল, নূরজাহান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়তাম। ঈদের ছুটির পর প্রথম দিনটায় সবার মনেই একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—“মিকু কোথায়?” মিহাদ, যাকে সবাই ভালোবেসে মিকু বলে ডাকে, সে ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা আর সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্র। পড়াশোনায় সে তেমন ভালো ছিল না, কিন্তু তার লম্বা গড়ন আর উদ্ভট কান্ডকারখানার জন্য সে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত। কিন্তু আজ সে অনুপস্থিত! ছুটির পরে স্কুলে ফিরলে যে পরীক্ষার ধাক্কা সামলাতে হবে, সেটা সবার জানা ছিল, কিন্তু মিকু কি এই ভয়েই স্কুলে আসেনি?
কিছুক্ষণ পর আমাদের ক্লাস টিচার, অঞ্জনা ম্যাম, ক্লাসে ঢুকে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “মিহাদ (মিকু) পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না, কারণ সে অসুস্থ।”
এই কথা শুনে আমরা সবাই হতভম্ব! ঈদের ছুটির আগে তো সে দিব্যি ছিল। তাহলে হঠাৎ কী হলো?
কেউ কেউ মজা করে বলল, “টেনশন না, ও পরীক্ষা থেকে পালানোর নতুন স্ট্র্যাটেজি বের করছে!” কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
ঈদের ছুটি মানেই আমাদের জন্য ছিল স্বর্গসুখের মতো সময়। সকালবেলা নতুন জামা পরে মসজিদে যাওয়া, তারপর পোলাও-কোরমার গন্ধে ভরা দুপুর, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি—সব মিলিয়ে জীবন তখন রঙিন ছিল। কিন্তু এই স্বর্গবাস বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ঈদের ছুটি শেষ মানেই স্কুলের কঠিন বাস্তবতা, আর তার সঙ্গে পরীক্ষার ভয়ঙ্কর থাবা!
ছুটির পর স্কুল খুলতেই পরীক্ষার সময়সূচি আমাদের মাথার ওপর বজ্রপাতের মতো এলো! সবাই বইখাতা খুলে পড়ার ভান করলেও, মনের ভেতর তখনো ঈদের রেশ কাটেনি। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক করা বিষয় ছিল মিকুর অনুপস্থিতি।
আমরা যখন পরীক্ষার প্রথম দিন সকালে স্কুলে এলাম, তখনও মিকু নেই। দ্বিতীয় দিনেও অনুপস্থিত! ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকছিল। এমন না যে মিকু পড়াশোনার জন্য খুব দায়বদ্ধ ছিল, তবে পরীক্ষার সময় সে কিছু না কিছু মুখস্থ করে এসে উত্তরপত্রে ঝাড়ত। কিন্তু এবার পুরো উধাও!
পরীক্ষা শেষে একদিন হঠাৎই সে স্কুলে এসে হাজির!
সবাই তাকে দেখে অবাক! মিকু তো এত লম্বা, অথচ আজ সে যেন কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটছে। তার মুখে অদ্ভুত এক বিব্রত হাসি।
“ওই মিকু! কিরে তুই? তোর কী হইছে?” কেউ একজন জিজ্ঞেস করল।
মিকু মাথা চুলকিয়ে বলল, “আরে ভাই, ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গেছিলাম, তাই এই অবস্থা।”
দুই-তিন দিন পর ক্লাসে একদল ‘বিশ্বাসঘাতক’ বন্ধু হাসতে হাসতে ফাঁস করে দিলো আসল ঘটনা!
ঘটনাটা ঘটে ঈদের ছুটির আগের দিন। টিফিন টাইম প্রায় শেষের পথে, আর ক্যান্টিনের সামনে লাইন কমে আসছে। মিকু তখন সিদ্ধান্ত নেয়, লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি কাজ সেরে ফেলবে! সে আস্তে আস্তে ক্যান্টিনের পাশে গিয়ে দেখে, ক্যান্টিনের মামা তখন ব্যস্ত অন্য ছাত্রদের খাবার পরিবেশন করতে।
মিকু দ্রুত সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক হাতে সমোচা, অন্য হাতে সিঙ্গারার প্যাকেট তুলে নেয়। কিন্তু তখনই ক্যান্টিনের মামা তার দিকে তাকায়!
বাঁচার একটাই রাস্তা—পালানো!
কিন্তু মেইন গেটে ছিল তালা লাগানো, তাই সে দেয়াল টপকানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
এখানেই তার সবচেয়ে বড় ভুল!
মিকুর উচ্চতা অন্যদের চেয়ে বেশি, তাই সে দেয়াল পার হওয়ার সময় একটু বেশি জোরে লাফ দেয়। কিন্তু ল্যান্ডিংটা এতটাই খারাপ হয় যে, সে কোমরের ওপর ধপ করে পড়ে যায়! ব্যথায় ছটফট করতে করতে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের টিফিন ফেলে ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে।
বাসায় গিয়েও তো মা-বাবাকে বলা যাবে না, “আমি স্কুলে টিফিন চুরি করতে গিয়ে পড়ে গেছি।” তাই সে অভিনয় শুরু করল!
“মা, ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গেছি! খুব ব্যথা পেয়েছি!”
তার মা দৌড়ে এসে তাকে দেখলেন, সত্যিই সে কাতরাচ্ছে। সাথে সাথেই ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার বললেন, কোমরের মাংসপেশিতে চোট লেগেছে, কিছুদিন বিছানায় বিশ্রাম নিতে হবে।
এদিকে তার মা যখন স্কুলে ফোন দিয়ে অঞ্জনা ম্যাডামকে জানালেন, তিনিও দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তখনো কেউ জানত না, মিকুর ফুটবল খেলার গল্পটা পুরোপুরি বানানো!
কিন্তু ক্লাসের সেই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বন্ধুরা যখন এই আসল ঘটনা সবাইকে জানাল, পুরো ক্লাস হেসে কুটিকুটি! অঞ্জনা ম্যাডাম তো রেগে আগুন!
“দেখলে তো, স্কুল বাঙ্ক করতে গিয়ে কী অবস্থা হলো! এখন থেকে কেউ যদি এমন কান্ড করে, শুধু শাস্তি না, তার কোমরের চিকিৎসার খরচও দিতে হবে!”
পুরো ক্লাস তখন মজায় ফেটে পড়ল, আর মিকু তখন মাথা নিচু করে নিজের হাসি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।
এই ঘটনা জানার পর মিকুর মা তো রেগে গেলেন!
“এই ছেলে! এত বড় মিথ্যা বললি? ফুটবল খেলতে গিয়ে চোট লাগেনি, বরং টিফিন চুরি করতে গিয়ে এই অবস্থা? একদম তোর বাবাকে বলব!”
মিকু তখন মিনমিন করে বলল, “মা, প্লিজ বাবাকে বলো না...আর কখনও এমন করব না!”
কিন্তু বাবা শুনে ফেললেন, আর হাসতে হাসতে বললেন, “এই ছেলে, পড়াশোনা না করলেও মিথ্যা বলার প্রতিভা আছে!”
এটাই মিকু! যার হাস্যকর কান্ডকারখানা ছাড়া আমাদের স্কুল জীবন একদম পানসে হয়ে যেত। আর আমরা তখন বুঝলাম, টিফিন চুরি করা শুধু অন্যায় নয়, শারীরিকভাবেও কতটা বিপজ্জনক হতে পারে!