গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম রানীগঞ্জ। সেখানেও কতিপয় সংস্কৃতিসেবী মানুষের মধ্যে সুকুমার বৃত্তি চর্চার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন ৫২ বছর ধরে। অথচ এবার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কালে সংস্কৃতি চর্চা হোচট খেয়েছে।
প্রথম আলোর স্থানীয় সাংবাদিক সাদিক মৃধা জানাচ্ছেন, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় স্থানীয় মুসল্লিদের বাধায় একটি নাটকের মঞ্চায়ন বাতিল করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘ মাঠে ‘আপন দুলাল’ নামের নাটকটি মঞ্চায়িত হওয়ার কথা ছিল। আয়োজক রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘ জানিয়েছে, মাসখানেক ধরে ‘আপন দুলাল’ নাটক মঞ্চায়নের জন্য রিহার্সেল চলেছে। রানীগঞ্জ উদয়ন সংঘ মাঠে ৫২ বছর ধরে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের আয়োজনে নাটক, গীতিনাট্য, পালাগানের মঞ্চায়ন হয়ে আসছিল। এটি ছিল ৫২তম আসর। স্থানীয় মুসুল্লিদের বাধায় নাটক মঞ্চায়ন পণ্ড হয়ে গেছে।'
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, 'মুসল্লিরা এও জানিয়ে দিয়েছেন, দুর্গাপুর ইউনিয়নে গান-বাজনা নাটক থিয়েটার পালাসহ কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আর চলতে দেয়া হবে না।'
সংস্কৃতি চর্চা তথা সুকুমার বৃত্তি চর্চা মানুষের জন্য কেন জরুরি? কারণ এটি মানুষের মনন, চিন্তাশক্তি এবং সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে। এটি শুধুমাত্র বিনোদন বা শখ নয়; বরং মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনের একটি অপরিহার্য উপাদান।
নৈতিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া মনুষ্যজীবন পুরোদস্তুর অহিতকর হতে পারে। উগ্রবাদ আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। মানুষের স্বাভাবিক সারল্য কেড়ে নিতে পারে। সুকুমার বৃত্তি যেমন সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক ইত্যাদি মানুষের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। এগুলো মানুষের মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির গুণাবলি বাড়ায়।
সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তির উৎকর্ষতা ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকবার এতটুকু মানে নাই।
সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে নতুন চিন্তার খোরাক দেয় এবং সৃজনশীলতাকে উসকে দেয়। এটি বৈচিত্র্যময় চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।
মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় নিজের আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হয়। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকি। এটি আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা সংরক্ষণ করে।
মানুষের মধ্যে যদি আত্মিক প্রশান্তি না থাকে, মানসিকভাবে সুস্থ না হয়; তবে ওই মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা। সংগীত, শিল্পকলা কিংবা সাহিত্য আমাদের মানসিক শান্তি দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে কম মানসিক চাপ অনুভব করেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে।
মানবসভ্যতার অগ্রগতির জন্য সামাজিক সংহতি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি জরুরি। সংস্কৃতি চর্চা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে বন্ধন তৈরি করে এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করে। এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতা বাড়ায়।
আধুনিক বিশ্বে সবাইকেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। আজকের বিশ্বে শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, সৃজনশীলতা এবং সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বও ক্রমশ বাড়ছে। শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা কর্মক্ষেত্রেও নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। অতএব, সংস্কৃতি চর্চা কেবল বিনোদনের জন্য নয়, এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
ধর্ম মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিককে গড়ে তোলে, আর সংস্কৃতি মানুষের সৃজনশীলতা, আবেগ ও সামাজিক সংহতিকে বিকশিত করে। বাস্তবে, প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ রয়েছে, যা তাকে সমৃদ্ধ করে।
শুধুমাত্র ধর্মচর্চা মানুষকে একরকমের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঠেলে দিতে পারে, যেখানে সৃজনশীলতা, মননশীলতা ও সৌন্দর্যচর্চার জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়। ধর্ম মানুষের আত্মার প্রশান্তি দিতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতি তাকে রঙিন ও অর্থবহ করে তোলে।
সংস্কৃতি ছাড়া ধর্মও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ধর্মেরও নিজস্ব সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে। ইসলামে কবিতা, ক্যালিগ্রাফি, সংগীত (যেমন হামদ-নাত), স্থাপত্যকলার গুরুত্ব রয়েছে। খ্রিস্টানদের গসপেল সংগীত, বৌদ্ধদের মন্দির শিল্প কিংবা হিন্দুদের মন্দিরের ভাস্কর্য—সবই সংস্কৃতির অংশ।
ইতিহাস কি বলে? ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো সমাজ সংস্কৃতি চর্চাকে উপেক্ষা করেছে, তখনই সেই সমাজে সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা ও গোঁড়ামি বিস্তার লাভ করেছে। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। আবার নবজাগরণের সময় ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে ইউরোপ একটি সমৃদ্ধ যুগে প্রবেশ করেছিল।
সভ্যতা টিকিয়ে রাখতেই ব্যক্তি ও সমাজের ভারসাম্য প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি শুধু ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে তার মানবিক ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাকে সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চিত্রকলা ইত্যাদির মাধ্যমে মানবিক ও রুচিশীল করে তুলতে হয়। সমাজও একইভাবে সংস্কৃতির মাধ্যমে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে।
যারা সংস্কৃতি চর্চাকে বাদ দিয়ে কেবল ধর্মচর্চার ওপর জোর দেন, তারা মানবজীবনের পূর্ণতা ও ভারসাম্যের বিষয়টি এড়িয়ে যান। ধর্ম যেমন প্রয়োজন, তেমনি সংস্কৃতিও। তাই, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে একমাত্র সত্য হিসেবে দেখলে সমাজ একরৈখিক ও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে ধর্ম ও সংস্কৃতির সুসমন্বয় অপরিহার্য।
'রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গানটি যিনি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি একাধারে ইসলামী ও হিন্দু সংস্কৃতি চর্চার ধারক ছিলেন। গজল, হামদ, নাত যেমন, তেমনি শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, কীর্তনও লিখেছেন। তিনি বারবার বলেছেন, "মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান!" এই বক্তব্যটিতে ধর্মীয় বিভেদ নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐক্যের জয়গান আছে। কবি সাহিত্য ও সংগীতকে সংস্কৃতির বাহক হিসেবে দেখেছেন। নজরুলের মতে, সংগীত ও কবিতা মানুষের অন্তর্লোককে জাগ্রত করে, মনুষ্যত্ব গঠনে সহায়তা করে। তিনি বলেছেন—"সংগীত হ’ল আত্মার আর্তি, হৃদয়ের কথা।" বস্তুত সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছেন নজরুল। তাঁর সাহিত্য রচনার মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষের মানসিক দাসত্ব দূর করা এবং একটি উদার, মানবিক সমাজ গঠন। বরাবর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতাকারী নজরুলের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি চর্চার মানে ছিল মানবতার জয়গান। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ, যেখানে ধর্ম, ভাষা, জাতি, সংস্কৃতির ভেদাভেদ না থেকে মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসা যাবে।
দেশটা ক্রমশ ভালোবাসাহীন হয়ে পড়ছে তা কি আমরা খেয়াল করছি? নাটক, থিয়েটার, বাউল গান হতে দেয়া হচ্ছে না। নারীর ফুটবল খেলায় বাধা দেয়া হচ্ছে। নারীকে অসম্মানকারীর গলায় ফুলের মালা তুলে দিচ্ছে তৌহিদি আমজনতা। এসবে সরকারি ব্যর্থতার দায় চিহ্নিত করে 'দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে'র মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর পরিবেশিত হচ্ছে।
উপযুক্ত রাহবারের দেখা না পাওয়া মুসল্লিরা অবুঝদার হতে পারেন। তাদের পাঠাভ্যাস কম থাকতে পারে। চিন্তায় তারা সংকীর্ণ, একরৈখিক ও একদেশদর্শী হতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রতো চালাচ্ছেন বিশ্বসভ্যতার পাঠ নেয়া এবং ঔদার্যের শিক্ষা পাওয়া জ্ঞানীগুণীরাই। তারা কি জনগণকে নজরুল পাঠে মনোনিবেশ করাবেন? বুঝিয়ে বলবেন, কেবল ধর্মাচার নয় মানবজীবন আলোকিত করতে সংস্কৃতি চর্চার ভূমিকা কতখানি?
লেখক: সাংবাদিক
৪ এপ্রিল ২০২৫