মেট্রোরেলে রতন-মাহফুজা: এক টুকরো অনাবিল সুখ
- - মোঃ তৌহিদুল আলম খান
ঈদের পরেরদিন সকালবেলা। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। এত সকালে কে? দরজা খুলতেই দেখি গেটের সামনে দাঁড়ানো রতনকে। তার পাশে এক লাজুক মেয়ে - গায়ে লাল রঙের শাড়ি, মাথায় আঁচল টেনে ধরা, চোখে-মুখে বিস্ময় আর ভয়ের মিশেল।
"মিয়া ভাই!" রতনের গলায় সেই চিরচেনা আনন্দের সুর। “আরে রতন, আয়। কেমন আছস, অনেক বছর পর…আর এটা কে? তর বউ নাকি?" রতন হাসতে হাসতে বলল, "হ, মিয়াভাই, এই যে আমার মাহফুজা। বউকে ঢাহা শহর দেহাইতে আনছি।"
মাহফুজা লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল। তার হাতে একটা ছোট পলিথিন ব্যাগ, যেখানে কিছু কাপড়-চোপড় আছে। আর রতনের হাতে আর একটা পলিথিন যাতে একটা মাঝারি সাইজের তরমুজ। আমি বললাম, এটা কি? রতন বলল, “আফনে তরমুজ পছন্দ করেন, তাই আফনের জন্য তরমুজ আনছি।” আমি ঠাট্টা করে বললাম, “দাম দিমু না কিন্তু!” রতন পুরনো সেই হাসি দিয়ে চিরাচরিত কন্ঠে বলল, “মিয়া ভাই যে কি কইন?”
আমার মনে পড়ে সেই আশির দশকের শেষের দিকে। রতন আমাদের বাসায় কাজ করত। তখন তার বয়স ছিল নয় কি দশ। অনেক বছর ছিল। আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি রতনের সাথে।
যাই হোক, দুপুরের খাবারের পর আমি প্রস্তাব দিলাম, "চল আজকে মাহফুজাকে মেট্রোরেল চড়াই।" রতনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মাহফুজা ভয়ে পেছনে সরে গেল, "না ভাইজান, ওসব উঁচু-উচু জিনিসে আমার..."
"কিছু হবে না, আমি সঙ্গে আছি তো!" আমি নিশ্চয়তা দিলাম।
মিরপুর পল্লবী স্টেশনে পৌঁছাতেই মাহফুজার পা যেন জমে গেল। রতনেরও একই অবস্থা। উঠতে ভয় পায় আর এক্সেলেটরত আরও দূরের বিষয়। যেহেতু লম্বা সিঁড়ি বেয়ে আমার পক্ষে উঠা সম্ভব না তাই দুজনকে দুই পাশে নিয়ে এক্সেলেটরে উঠার ঝুঁকি নিলাম।
এক্সেলটরে উঠতে গিয়ে তো দুজনেরই অবস্থা খারাপ। রতন আমার ডান হাত আর মাহফুজা বাম হাত এমনভাবে চেপে ধরল যে মনে হলো আমি কোনো ভারী বোঝা বহন করছি।
ট্রেনে উঠে মাহফুজা জানালা দিয়ে নিচের দৃশ্য দেখতে লাগল। তার চোখে শিশুর মতো বিস্ময়। রতন বলল, "মিয়া ভাই, মনে হইতাছে বিদেশ আইয়া পড়ছি। আর পাখি অইয়া উড়তাছি!" আমি খুব আগ্রহের সাথে দু’জনের অভিব্যক্তি দেখছি।

মতিঝিল স্টেশনে নেমে আমরা তিনজনেই ফুটপাথের এক দোকানে চা খেলাম। মাহফুজা আস্তে আস্তে বলল, "ভাইজান, আমি তো কখনো ভাবিনি..."
রাতে বাড়ি ফিরে রতন আমার পা টিপতে শুরু করল। ছোটবেলার মতোই তার সেই অদক্ষ কিন্তু আন্তরিক মালিশ। এখনও মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় ওকে দিয়ে প্রায়ই গোপনে পা টিপাতাম। কারন আম্মা দেখলে খবর আছিল।
পা টিপতে টিপতে রতন ধীরে ধীরে তার জীবনের গল্প বলতে লাগল - কিভাবে ছোট বেলায় তার বাবা মারা গেল আর এক মাস পূর্বে মা মারা গেল। আর কিভাবে মাহফুজার সঙ্গে বিয়ে হলো, গাঁয়ের সংসারের টানাপোড়েন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিয়ের সাত বছর হল কিন্তু রতনের বউ-এর কোন সন্তান হচ্ছে না। কবিরাজ বলেছে, কারা যেন তার বউকে বান মারছে। তাই তার বউ-এর মুখে কোন হাসি নাই। সবসময় মন-মরা থাকে। কত গল্প রতনের…, আমি আরাম পাচ্ছি আর মনযোগ দিয়ে রতনের জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনছি।
"মিয়া ভাই," রতন হঠাৎ বলল, "আজকে অনেকদিন পর মাহফুজার মুখে হাসি দেখলাম। গেরামেত সে কখনো এত হাসেনা।" মাহফুজা লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। আমি বললাম, "তোরা দুজনেই তো আজ আমাকেও হাসিয়েছিস।"
পরদিন সকালে ওরা চলে যাওয়ার সময় মাহফুজা আমাকে বলল, "ভাইজান, আফনি আমাদের এত আনন্দদিলেন, আল্লাহ আফনার অনেক ভাল করবেন।" আর রতনের চোখে কৃতজ্ঞতার জল। আর আমাকে হাত ধরে খালি বলতে থাকে, “মিয়া ভাই, মিয়া ভাই…”
আমি আমার বউকে বললাম, দেখছ, মেট্রো রেলে চড়ে ওরা কত খুশী। আমার বউ বলল, “ওরা যত না খুশী হইছে মেট্রো রেলে চড়ে, তার চেয়ে বেশী খুশী তুমি নিজে ওদেরকে নিয়া গেছ, তাই।” আমি ভাবলাম, হয়ত বউ ঠিকই বলেছে।
এরা চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি দেখলাম, মাহফুজা এবার রিকশায় উঠতে ভয় পাচ্ছে না। ওদের যাওয়ার পর বারান্দায়দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, এই ছোট্ট মুহূর্তগুলোই জীবনকে কত অর্থপূর্ণ করে তোলে। রতন আর মাহফুজার মেট্রোরেল ভ্রমণশুধু তাদের প্রথম অভিজ্ঞতাই নয়, আমার জন্যও এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। কারণ, প্রকৃত সুখ লুকিয়ে থাকে এসব ছোট ও অতি সাধারণ মুহূর্তের মধ্যে - যখন একজন মানুষের আকাংখা বা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। ভয় দূর করে তাকে হাসানো যায় আর তার চেয়ে বড় হচ্ছে যখন শহরের জাঁকজমকতাকে অতিক্রম করে একজন গাঁয়ের মেয়েকে বিস্ময়ে ভরিয়ে দেওয়া যায়। তাই মাহফুজার সেই বিস্মিত চোখ আর রতনের কৃতজ্ঞতার চোখের পানি এই সাময়িক অবসর জীবনে আমার মনে প্রায়শই গভীর এক প্রশান্তির রেখা টেনে দেয়।
————————————————————