Posts

প্রবন্ধ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস(পর্ব-১০)

April 6, 2025

Yousuf Haque Chowdhury

227
View

চতুর্থ ক্রুসেড 

পোপ ৩য় ইনোসেন্ট চতুর্থ ক্রুসেডের ঘোষণা দেন। এই ক্রুসেডটি মূলত সাজানো হয়েছিল মিশরে হামলা চালিয়ে জেরুজালেম দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ক্রুসেডারদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তখন একজন ক্ষমতাচ্যুত বাইজেন্টাইন সম্রাট ক্রুসেডারদের কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করার প্রস্তাব দেয়। তিনি বলেছিলেন যে তিনি খ্রিস্টধর্মের আসল সংস্করণে ধর্মান্তরিত হবেন, তার সমস্ত প্রজাকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করবেন এবং তারপর জেরুজালেম আক্রমণে সহায়তা করবেন। ক্রুসেডাররা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ১২০৪ সালের এপ্রিল মাসে কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করে যা ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করার পর জানা যায় যে ক্ষমতাচ্যুত সম্রাট আসলে ভুয়া ছিলেন। ভুয়া সম্রাটকে হত্যা করা হয়। ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপল শহর লুট করে। লুণ্ঠনের মাল এত বেশি ছিল যে তারা জেরুজালেমের কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের বাড়ি চলে যায়।

পঞ্চম ক্রুসেড 

১২১৬ সালে পোপ ইনোসেন্ট মারা যান। কিন্তু নতুন পোপ তৃতীয় অনারিয়াস তার পরিকল্পনা অব্যাহত রাখেন। ক্রুসেডাররা ১২১৮ সালের ২৪ মে আক্রা ত্যাগ করে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রথমে তারা ১২১৮ সালের জুন মাসে নীল নদের উপর দিয়ে কায়রো যাওয়ার প্রধান পথ পাহারা দেওয়া মিশরীয় বসতি দামিয়েত্তার উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। দামিয়েত্তার নেতা সুলতান আল-আদিল ক্রুসেডারদের বিশাল সেনাবাহিনীকে কায়রোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তাদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তারা বেশ কয়েক মাস ধরে ক্রুসেডারদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে মিশরীয়রা ক্রুসেড সেনাবাহিনীর আকার দেখে কায়রোর দিকে পালিয়ে যায় এবং নীল নদের পাশে অবস্থান নেয়। ১২১৯ সালের ৫ নভেম্বর দামিয়েত্তা দখল করা হয়। ক্রুসেডাররা বেশ কয়েকদিন ধরে শহরটিতে লুটপাট চালায়। এরপর তারা কায়রোর দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু ক্রুসেডাররা নীল নদের বন্যাকে বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়। তাই কায়রোতে পৌঁছানোর পর তারা একটি খালের পিছনে আটকা পড়ে যা পরে বন্যায় প্লাবিত হয়। তখন মিশরীয়রা তাদের আক্রমণ শুরু করার সাথে সাথে খ্রিস্টানরা পিছু হটে। খ্রিস্টান সেনাবাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং অবশিষ্ট সৈন্যদের সুলতান বন্দী করেন। এভাবেই পঞ্চম ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটে।

ষষ্ঠ ক্রুসেড

ষষ্ঠ ক্রুসেড ছিল জেরুজালেম এবং পবিত্র ভূমির বাকি অংশ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সামরিক অভিযান। পঞ্চম ক্রুসেডের ব্যর্থতার সাত বছর পর এটি শুরু হয়েছিল। রোমান সম্রাট এবং সিসিলির রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের কূটনৈতিক কৌশলের ফলে এতে খুব কমই লড়াই হয়েছিল। আল মালিকুল কামেল এবং তার ভাইদের মধ্যে বিরোধেরকারণে বায়তুল মুকাদ্দাস শহর ক্রুসেডারদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী পনেরো বছরের বেশিরভাগ সময় ধরে জেরুজালেম এবং পবিত্র ভূমির অন্যান্য অঞ্চলের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় খৃষ্টানরা।

সপ্তম ক্রুসেড

সপ্তম ক্রুসেড ফ্রান্সের সম্রাট নবম লুই দ্বারা পরিচালিত ক্রুসেড ১২৪৮ হতে ১২৫৪ পর্যন্ত সংঘটিত হয়। যুদ্ধে রাজা নবম লুই পরাজিত ও বন্দী হন। আইয়ুবীয় রাজবংশের শাসক মুয়াযযাম তুরানশাহের নেতৃত্বে মিশরীয় বাহিনী রাজা নবম লুইকে বন্দী করে। যুদ্ধ শেষে লুইয়ের মুক্তির জন্য ৫০,০০০ স্বর্ণমূদ্রা (ফ্রান্সের তখনকার বাৎসরিক আয়ের সমান অর্থ) মুক্তিপণ হিসাবে দেয়া হয়। এই ক্রুসেডে মিশরীয় বাহিনীকে বাহরি, মামলুক, বাইবার্স, কুতুয, আইবাক ও কুলওয়ান গোষ্ঠী সহায়তা করে।

অষ্টম ক্রুসেড

অষ্টম ক্রুসেড ছিল ফ্রান্সের রাজা নবম লুই কর্তৃক পরিচালিত দ্বিতীয় ক্রুসেড। এটি ১২৭০ সালে তিউনিসিয়ার হাফসি রাজবংশের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। তিউনিসিয়ার তীরে পৌঁছানোর পরপরই লুই আমাশয়ে মারা যান। এই ক্রুসেডে কোনও উল্লেখযোগ্য লড়াই দেখা যায়নি। ক্রুসেডার এবং হাফসিদের মধ্যে তিউনিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে ভূখণ্ডের কোনও পরিবর্তন হয়নি, যদিও খ্রিস্টানদের বাণিজ্যিক এবং কিছু রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয়েছিল। ক্রুসেডাররা শীঘ্রই ইউরোপে ফিরে যায়।

নবম ক্রুসেড

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড এবং ফ্রান্সের রাজন্য যৌথভাবে সিরিয়াতে হামলা চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এসময় মুসলমানদের পূর্ণ শক্তি থাকার কারণে ইংরেজ-ফরাসী যৌথবাহিনী নাস্তানাবুদ হয়। এ যুদ্ধের ফলে সিরিয়া-ফিলিস্তিন থেকে ক্রুসেডারদের অস্তিত্ব নিশ্চিন্ন হয়ে যায়।ক্রুসেডারদের মধ্যে আর যুদ্ধের সাহস জাগেনি।এদিকে মুসলমানরা নিজেদের এলাকা রক্ষায় সচেতন হয়ে যায়। ক্রুসেড যুদ্ধসমূহের অবসান ঘটে।

নাইট টেম্পলারদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো? 

১২৯২ সালের যুদ্ধে মতান্তরে ১২৯১ সালে তারা পরাজিত হয়। নাইটদের শেষ লর্ড জ্যাক ডি মলোয়সহ তারা সাগর পাড়ি দিয়ে সাইপ্রাসে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের বাদশাহর কাছে সামরিক সাহায্যের আহবান পাঠান। কিন্তু কোনো সাহায্য আসেনি।বকারন ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ দ্যা ফেয়ার (Phillip the Fair) তখন নাইট টেম্পলারদের কাছ থেকে নেয়া ধারের ভারে ডুবু ডুবু অবস্থায়। 

টেম্পলাররা তাদের টাকা রাজাকে সুদে ধার দিত, কিন্তু যুদ্ধের খরচের জন্য নিজেদের টাকা ব্যয় করতোনা। কারন যাতে রাজা পরিশেষে সেই টাকা ট্যাক্সের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে তুলে নেন। পশ্চিমাদের এই কারসাজি কিন্তু আজকের দিনেও লক্ষণীয়। বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর চাপে পশ্চিমা সরকারগুলো যুদ্ধে করে এবং ট্যাক্স পেয়ারের কাছ থেকে টাকা ওঠায়। তারপর কর্পোরেশনগুলো যুদ্ধ পরবর্তী সুবিধা নেয়।

যাইহোক, দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা ফ্রান্সের রাজার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ইংল্যান্ডের সাথে তখন তার যুদ্ধ চলছিল। ডি মলোয় নিরাশ হয়ে ১৩০৭ সালে ফ্রান্সে আসেন।কিন্তু এরই মধ্যে অনেক ষড়যন্ত্র হয়ে যায়।পোপের সম্মতি নিয়ে রাজা ফিলিপ, জ্যাক ডি মলোয় ও তার অনুচরদেরকে গ্রেফতার করেন। ১৩১৪ সালের ১৩ই মার্চ, শুক্রবার জ্যাক ডি মলোয় ও তার সহপার্টি ৬০ জন নাইট টেম্পলারকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরপর থেকে Friday the 13th ইউরোপিয়ানদের কাছে একটি কুলক্ষণ হয়ে পড়ে। তাদের হত্যার মাধ্যমে ফিলিপ ঋণমুক্ত হন। এসব কাজ পশ্চিমা দেশগুলো এখন আরব লিডারদের সাথে করে থাকে।

টেমপ্লারদের উপর অভিযোগ আনা হয় যে-- তারা ধর্মচ্যুত বা বিপথগামী হয়েছিল, তারা প্রচলিত ধর্মীয় বাহ্যিক আনুষঙ্গিকতার প্রয়োজনীয়তা মনে করত না, এমন কি মুসলিম জগতের সংস্পর্শে সূফী দার্শনিক কিছু সংযোজন ঘটানোর অভিযোগও ছিল। রিমান্ডের মারপিটে সবাই অভিযোগ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো।

কিন্তু বাকী নাইট টেম্পলাদের কী হল? তাদের বিরাট সম্পত্তির কী হল? তারা কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করলো? এসবের কোন হদিস সেদিন পাওয়া যায় নি, বা সর্বসাধারণ জানে নি। অনেকের ধারণা যে এই নাইট টেম্পলাররাই বিভিন্ন গোপন সোসাইটির আড়ালে থেকে কাজ করে যেতে থাকে, যেমন ফ্রিম্যাসন, ইলুমিনাটি ইত্যাদি।

Comments

    Please login to post comment. Login