এটি এখন যুগপৎভাবে অদ্ভুত ও ট্রাজিক এক বাস্তবতা! মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে রক্তাক্ত সংঘাতের একটি হলো ইজরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে বহুবার উড়ে গেছে আশার ছাই, ধ্বংস হয়েছে মানবতা। এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বহুদিন ধরেই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে একটি দল—হামাস। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত, আবার আরব বিশ্বের একাংশে ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তবে এই দ্বৈত ব্যাখ্যার বাইরেও এক জটিল প্রশ্ন বারবার সামনে আসে —হামাস কি প্রকারন্তরে ইজরাইলের স্বার্থই রক্ষা করে?
ইতিহাসে ফিরে তাকালে আমরা আসলে কী দেখতে পাই? হামাসের (Harakat al-Muqawamah al-Islamiyya) জন্ম ১৯৮৭ সালে, প্রথম ইন্তিফাদার সময়। এটি মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের গাজাভিত্তিক শাখা, যার আদর্শিক ভিত্তি ইসলামি প্রতিরোধ। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য, হামাসের উত্থানের সূচনালগ্নে ইজরাইল পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা করেছিল—এই অভিযোগ এখন আর শুধু ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নয়, বরং একাধিক গবেষণা ও প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বক্তব্যে স্বীকৃত তথ্য।
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (UPI)-এর এক প্রতিবেদনে রিচার্ড সেল লিখেন, "Beginning in the late 1970s, Tel Aviv gave indirect financial support to Islamic charities and preachers who would later become Hamas." (১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে ইজরাইল ইসলামি চ্যারিটি ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে আর্থিক ও নীতিগত ছাড় দেয়। এদের অনেকেই পরে হামাসে রূপান্তরিত হয়)।
ইজরাইলি ব্রিগেডিয়ার ইয়িতজাক সেগেভ এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, 'তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কার্যক্রম গাজায় অনুমোদন দেন, যাতে পিএলও ও ফাতাহর মতো ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী সংগঠনের প্রভাব দুর্বল হয়।' Source: Wall Street Journal, 2009.
বরাবর এই আলাপে আমরা সহিংসতা ও সুবিধার অদ্ভুত যোগসূত্র খুঁজে পাই। হামাস বরাবরই ইজরাইলের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং রকেট হামলা ও সশস্ত্র প্রতিরোধে বিশ্বাসী। একদিকে এটি ফিলিস্তিনিদের “প্রতিরোধের অধিকার” হিসেবে বিবেচিত হলেও, অন্যদিকে ঠিক এই সহিংস কার্যকলাপই ইজরাইলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ দেখিয়ে আগ্রাসনের বৈধতা দেয়।
জেরুজালেম পোস্টে ক্যারোলিন গ্লিক লেখেন, "As long as Hamas controls Gaza, the Palestinian statehood project remains paralyzed." (যতদিন হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ততদিন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রশ্ন কার্যত স্থগিত থাকবে)। Source: Jerusalem Post, October 2009.
হামাসের উপস্থিতি পশ্চিম তীরের ফাতাহ-নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন অথরিটিকে দুর্বল করে এবং ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে গভীর বিভাজন সৃষ্টি করে। এই বিভাজন ইজরাইলের জন্য কৌশলগত স্বস্তি। কারণ, ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব মানে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রদাবি—যা ইজরাইলের জন্য উদ্বেগের।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইজরাইলে আকস্মিক হামলা চালায়। ঘটনা নিমিষে নাটকীয় মোড় নিল। এতে প্রায় ১২০০ ইজরাইলি নিহত হয়। ইজরাইল দ্রুত পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়—ইতোমধ্যে নারী ও শিশুসহ ৫০ হাজার মানুষ নিহত হন, আহত হয়েছেন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি, পুরো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে চলেছে। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তোলেন —ইজরাইলের মোসাদ ও শিন বেত-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিভাবে এত বড় হামলার আঁচও পেল না?
নিউ ইয়র্ক টাইমস ও আল জাজিরার অনুসন্ধানে উঠে আসে, ইজরাইল পূর্বাভাস পেয়েছিল; কিন্তু তা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা হয়নি।
এই হামলার পরে ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে নিজেকে রক্ষা করেন এবং জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগান।
এমন বাস্তবতায় কেউ কেউ বলতে শুরু করেন -হামাসের এই ‘সময়ের ভুল হামলা’ প্রকৃতপক্ষে ইজরাইলের রাজনৈতিক কৌশলের অনুকূলে কাজ করেছে।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে দুই রাষ্ট্র সমাধান কি অলীক স্বপ্ন? বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর আশায় তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু হামাসের অবস্থান এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দ্বিখণ্ডিত বাস্তবতা সেই স্বপ্নকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে হামাস বলছে, তারা ইজরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না; অন্যদিকে ইজরাইল বলছে, তারা হামাসের সঙ্গে কোন শান্তি আলোচনায় যাবে না। এই অবিশ্বাস ও সংঘাতের বাতাবরণে এক অদ্ভুত বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে —হামাসের অস্তিত্বই যেন ইজরাইলের দখল নীতিকে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
মোদ্দাকথা হলো এ যেন সংঘাতের ছায়ায় জটিল সহাবস্থান। হামাস ও ইজরাইল —দুজনই যেন পরস্পরের অস্তিত্বের যুক্তি। একজন বলে, "তুমি আছো, তাই আমি অস্তিত্ববান।" এ সম্পর্ক সরল শত্রুতা নয়; বরং একটি জটিল, কৌশলনির্ভর, পারস্পরিকভাবে সুবিধাজনক বাস্তবতা। এটিকে কেউ বলবে "অদৃশ্য আঁতাত", কেউ বলবে "বাস্তবতার নির্মম প্রতিচ্ছবি"। কিন্তু ইতিহাস এবং ভূরাজনীতি আমাদের শেখায় —সংঘাত কখনও সরলরৈখিক নয়। কখনো কখনো শত্রুও আমাদের কৌশলগত মিত্র হয়ে ওঠে —আমরা জানি বা না-ই জানি।
তথ্যসূত্র:
• Richard Sale, "Hamas history tied to Israel," UPI, June 18, 2002
• "How Israel Helped to Spawn Hamas," The Wall Street Journal, 2009
• Caroline Glick, "The Hamas Advantage," The Jerusalem Post, October 2009
• "Israeli Intelligence Missed Warnings Before Hamas Attack," The New York Times, October 2023
• “How Hamas Grew Amid Palestinian Disunity,” Al Jazeera English, October 2023
• Rashid Khalidi, The Hundred Years' War on Palestine, 2020
• Avi Shlaim, The Iron Wall: Israel and the Arab World, 2000
লেখক: সাংবাদিক
৬ এপ্রিল ২০২৫
196
View