গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংস দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তখন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মৃদু প্রতিক্রিয়া বা নিস্পৃহ অবস্থান গ্রহণ করে। মানবিক ও নৈতিকভাবে মুসলিম বিশ্ব এই সংকটে বড় ভূমিকা রাখতে পারত, অথচ তারা যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়ে গেছে। কেন তারা সরাসরি প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেয় না? নিপীড়িত ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেয় না? এই অক্ষমতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রকৃত কারণ কী?
রাজনৈতিক বিভাজন ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আলাপ প্রথমেই আসে। মুসলিম বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে চরমভাবে বিভক্ত। সৌদি আরব ও ইরানের ভূরাজনৈতিক বৈরিতা, কাতার ও বাহরাইনের টানাপোড়েন, কিংবা তুরস্ক ও মিশরের প্রতিযোগিতা এই ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে। ২০১৭ সালে কাতারের ওপর আরব দেশগুলোর অবরোধ তার বড় উদাহরণ। এই বিভক্তি মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে এমনভাবে জিইয়ে রেখেছে যে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এরপর আসে পশ্চিমা শক্তির প্রতি নির্ভরতার চিরায়ত আখ্যান। সৌদি আরব, আমিরাত, মিশরসহ বহু দেশ অস্ত্র, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন সামরিক সহায়তা এবং বিনিয়োগের ভয়েই তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হয়। এই নির্ভরতা শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে নয়, বিদেশনীতি নির্ধারণেও একধরনের বন্ধন সৃষ্টি করেছে।
সৌদি আরব ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে (SIPRI Data)। একইভাবে, মিশর প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য পায়। এ ধরণের সহায়তা ইসরায়েল-বিরোধী অবস্থানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
আরও আছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতা। গণতন্ত্রবিমুখ শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার হরণের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বৈধতা সংকটে থাকা বহু মুসলিম দেশের শাসকগোষ্ঠী টিকে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ এতে পশ্চিমা দেশগুলোর বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসন বা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সরকারগুলো পশ্চিমা স্বীকৃতি পেতে মরিয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আরব বসন্তের পর মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসা সেনাপ্রধান সিসি পশ্চিমা সমর্থনেই টিকে রয়েছেন।
অনেক দেশ অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক চাপ নিয়ে তীব্রতর সংকটে নিপতিত। লেবানন, পাকিস্তান, মিশর, ইরাকসহ অনেক মুসলিম দেশ বর্তমানে IMF সহ আন্তর্জাতিক নানামুখী ঋণে জর্জরিত। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত, বাণিজ্যিক চাপ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা এই দেশগুলিকে দুর্বল করে তুলেছে। গাজা ইস্যুতে কড়া অবস্থান নিলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা তাদের নিরুৎসাহিত করে। পাকিস্তান বর্তমানে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের ঋণে জর্জরিত, এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ভয়েই এরা ইসরায়েল-বিরোধী কার্যকর অবস্থান নিতে পারে না।
৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসি (OIC) প্রায় প্রতিবারই গাজা পরিস্থিতি নিয়ে নিন্দা জানায়, তবে কার্যত কোনো কার্যকর কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে না। এসব বিবৃতি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবভিত্তিক কোনো কৌশল, যেমন নিষেধাজ্ঞা, বর্জন বা সামরিক সহায়তা গ্রহণ করা হয় না। কার্যত ওই শক্তিই সংস্থাটির নেই।
ইসরায়েলি লবির প্রভাব ও স্বীকৃতির রাজনীতিকে অনেক মুসলিম দেশ খুব বড় করে দেখতে বাধ্য হয়। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Abraham Accords তথা আব্রাহাম চুক্তি’র আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর মতো মুসলিম দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই স্বীকৃতির পেছনে অর্থনৈতিক সুবিধা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং মার্কিন চাপ কাজ করেছে। এর ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়।
সমাজ ও ধর্মীয় নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা মুসলিম দেশগুলোর গুরুতর সমস্যা। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ধর্মীয় নেতারা রাষ্ট্রনির্ভর অথবা নিস্পৃহ। মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। জোরজবরদস্তির ধর্মাচার কিংবা মোরাল পুলিশিং নিয়ে নিজেরাই বিভাজনে ব্যতিব্যস্ত। জনমত ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠার সুযোগও তাই সীমিত। ফলে সাধারণ জনগণের আবেগ থাকলেও তা রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রতিফলিত হয় না।
মুসলিম বিশ্বে গাজা ইস্যুতে বিরাট সংবেদনশীলতা থাকলেও তার প্রতিফলন দেখা যায় না রাষ্ট্রীয় নীতিতে। গাজা প্রশ্নে মুসলিমদের দুর্বলতা কেবল কূটনৈতিক নয়, তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিকও বটে। একটি ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন ও আত্মনির্ভর মুসলিম নেতৃত্ব ছাড়া গাজা কিংবা ফিলিস্তিনের মুক্তি অসম্ভব। সময় এসেছে—শুধু বিবৃতি নয়, সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বকে বুঝতে হবে—ইতিহাস সবসময় নীরবতার মূল্য চোকাতে চায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার সময় কিন্তু খুবই সীমিত। মুসলিম বিশ্ব যদি নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, ভাঙা ঐক্যের সেতুবন্ধন না গড়ে; তাহলে তার যথোচিত কিংকর্তব্যের সুসময় আরও ক্ষীণ হয়ে আসবে।
তথ্যসূত্র:
• “Why Arab States Turned Against Qatar”, BBC News, June 2017
• Stockholm International Peace Research Institute (SIPRI) Arms Transfer Database
• “U.S. Foreign Aid to Egypt”, Congressional Research Service, 2023
• “Egypt’s Sisi and the West’s Embrace of Authoritarianism”, The Guardian, 2019
• “Pakistan’s Economic Crisis”, Al Jazeera, January 2024
• OIC Joint Statement on Gaza, November 2023
• “The Toothless Roar of the OIC”, Foreign Policy, 2023
• U.S. State Department on Abraham Accords, 2020
• “Normalization Deals and the Future of Palestinian Diplomacy”, Brookings Institution, 2021
লেখক: সাংবাদিক
৭ এপ্রিল ২০২৫