ফিলিস্তিনে বর্তমান সংঘাতের বীজ মূলত উনিশ শতকের শেষ দিকে বপন হয়, যখন জায়নবাদ নামে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ইউরোপে শুরু হয়। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যা ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের ancestral homeland হিসেবে বিবেচিত।
* জায়নবাদী অভিবাসন: বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন বাড়তে থাকে। এই অভিবাসন স্থানীয় আরব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উদ্বেগ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে, কারণ তারা তাদের ভূমিতে বহিরাগতদের আগমন হিসেবে দেখছিল।
* জাতিগত ও জাতীয়তাবাদী সংঘাত: ফিলিস্তিনে দুটি ভিন্ন জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা সংঘাতের জন্ম দেয় - একদিকে ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যদিকে ফিলিস্তিনি আরবদের তাদের ভূমিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা।
* জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (১৯৪৭): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে চাইলে জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্র - একটি আরব এবং একটি ইহুদি - এর মধ্যে ভাগ করার প্রস্তাব করে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও আরব পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে।
* প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (১৯৪৮): জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনার পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পরদিনই আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল জয়লাভ করে এবং ফলস্বরূপ আরও বেশি ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা নাকবা (Nakba) নামে পরিচিত, যার অর্থ "বিপর্যয়"।
কি কারণে:
ফিলিস্তিন সংকটের মূল কারণগুলো বহুবিধ ও জটিল। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
* ভূমির অধিকার: ভূমি এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। উভয় পক্ষই এই ভূমিকে ঐতিহাসিকভাবে তাদের বলে দাবি করে। ইসরায়েল এটিকে ইহুদিদের ঐতিহাসিক জন্মভূমি হিসেবে দেখে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা এটিকে তাদের ancestral homeland হিসেবে মনে করে।
* আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার: ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে। ইসরায়েল তাদের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ দিতে দ্বিধা বোধ করে।
* জেরুজালেমের মর্যাদা: জেরুজালেম উভয় ধর্মের (ইহুদি ও মুসলিম) কাছেই পবিত্র স্থান। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে এবং এটি সংঘাতের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়।
* ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন: ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং পরবর্তী সংঘাতগুলোর কারণে বহু ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার একটি অমীমাংসিত বিষয় এবং এটি সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
* ইসরায়েলি বসতি স্থাপন: ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল কর্তৃক অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে (পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম) ইহুদি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।
* নিরাপত্তা উদ্বেগ: ইসরায়েল তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে আসা হামলাকে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ও অবরোধের শিকার।
* রাজনৈতিক বিভাজন: ফিলিস্তিনিদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন (যেমন ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে) তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে বাধা দেয়।
প্রত্যেকটি ধারণা:
* জায়নবাদ (Zionism): উনিশ শতকের শেষদিকে ইউরোপে সৃষ্ট একটি ইহুদি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
* ব্রিটিশ ম্যান্ডেট (British Mandate): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ। এই সময়েই ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
* জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (UN Partition Plan): ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি অংশে ভাগ করার প্রস্তাব করে - একটি আরব রাষ্ট্র ও একটি ইহুদি রাষ্ট্র।
* নাকবা (Nakba): ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় শত শত ফিলিস্তিনি গ্রামের ধ্বংস এবং প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুতি। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি একটি জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হয়।
* আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (Arab-Israeli Wars): ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় যুদ্ধ হয়েছে (১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩)। এই যুদ্ধগুলোর ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ এবং শরণার্থীদের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
* অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড (Occupied Palestinian Territories): ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম।
* ইসরায়েলি বসতি (Israeli Settlements): অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য নির্মিত বসতি, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ।
* ফিলিস্তিনি শরণার্থী (Palestinian Refugees): ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং পরবর্তী সংঘাতগুলোর কারণে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ও তাদের বংশধর। তাদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
* হামাস (Hamas): গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী একটি ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন, যা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে।
* ফাতাহ (Fatah): পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণকারী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (PLO) প্রধান দল, যা ইসরায়েলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
ফিলিস্তিনের এই দীর্ঘদিনের সংঘাত অত্যন্ত জটিল এবং এর কোনো সহজ সমাধান নেই। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন পক্ষের দাবি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব এই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
475
View