Posts

গল্প

দূরত্বের দুই পাড়ে বাঁধা এক অটুট ভালোবাসা

April 9, 2025

Afrin Jannat

Original Author Yes

123
View

তাদের প্রথম আলাপ হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর, এক হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে। তখনো জানা ছিল না, এই ভার্চুয়াল কথোপকথন একদিন জীবনকে বদলে দেবে। অনেক দিন কেবল ফোনেই চলল সম্পর্ক—কিন্তু অপেক্ষার অবসান ঘটলো ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন গ্রামের রাস্তার ধারে এক বাইকের পেছনে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখলো সে—ভয়ে কিছু বলতে পারেনি, শুধু লুকিয়ে দিয়েছিলো একটি চিঠি আর তার ভিতরে গুঁজে দেওয়া ১০০ টাকা। এক ছুঁয়া চেয়েছিলো সে সেদিন, কিন্তু মেয়েটি সাহস করেনি। প্রথম দেখা হয় নীরব, কিন্তু আবেগভরা।

এরপর ২ নভেম্বর ২০২০—একটা রেস্টুরেন্টের সকাল, মেয়েটি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলো, ভেবেছিলো চলে যাবে অনাথ আশ্রমে। তখন ছেলেটি এসে তাকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর সেদিনই জীবনের প্রথম বড় চমক—সে এনেছিলো একটি ডায়মন্ড রিং। হঠাৎ করেই হলো তাদের এনগেজমেন্ট। মেয়েটি ভাবেনি যে এমন হবে, কিন্তু ভালোবাসার পরিকল্পনা কি কখনো আগেই করে রাখা যায়?

২০২১ সালের ৫ মার্চ দুপুর ২:৩০ মিনিটে তারা বিয়ে করে ফেলে—লুকিয়ে, নীরবে, কিন্তু পুরো মন দিয়ে। মেয়েটির কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানে, ছেলেটিরও কিছু বন্ধুর জানা। বিয়ের পর শুরু হয় ভবিষ্যতের চিন্তা—মেয়েটি তাকে অনুপ্রাণিত করে কাজ করার জন্য। প্রথমে গরুর খামার শুরু করে সে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে লস খায়। এরপর চাকরির জন্য ১ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়। আবার এক দালাল ৭ লাখ টাকা নিয়ে রোমানিয়া যাওয়ার ভুয়া প্রক্রিয়া করে পালিয়ে যায়। ছেলেটি ভেঙে পড়ে, ঘরে বন্দি হয়ে যায়, কাঁদে। কিন্তু মেয়েটি তাকে ভালোবাসা আর সাহস দিয়ে আবার দাঁড় করায়।

নতুন করে তৈরি হয় পাসপোর্ট। সে লিবিয়া পাড়ি দেয়, এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পেরিয়ে পৌঁছায় ইতালি। আজ সে ভালো আছে—বড় একটা বাড়িতে থাকে, রেস্টুরেন্টে কাজ করে, আর কাজ শেষে প্রতিদিনই মেয়েটিকে সময় দেয়। তাদের জীবনের লক্ষ্য এখন একটাই—ভবিষ্যতে ঘর বাঁধা, আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে একসাথে থাকা।

এদিকে মেয়েটির পরিবার এখনো জানে না এই সম্পর্কে। কিন্তু ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—সে একদিন এসে সবকিছু জানাবে, বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, আর তাকে ঘরের বউ করে তুলবে। ছেলেটির মা-মা তাকে ‘বাবু’ ডাকে, যেমনটা ছেলেটিকেও ডাকে। বাবাও তাকে হেলিকপ্টারে করে বিয়ে করতে নিয়ে যেতে চায়। তাদের পুরো পরিবার মেয়েটিকে ভালোবাসে, মেয়েটিও ভালোবাসে তাদের।

তাদের জীবনে ছিল এক বিশেষ সময়—এক মিথ্যে মামলায় ছেলেটি ২১ দিনের জন্য জেল খাটে। সেই সময়েই ছিল মেয়েটির জন্মদিন। জেলের ভিতর থেকেই ছেলেটি একজনের সাহায্যে সুতা দিয়ে বানানো মেয়েটির নাম খোদাই করা একটি কলম পাঠায় উপহার হিসেবে—মেয়েটির কাছে সেটাই আজও সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি।

এই ছেলেটি তার পরিবারের একমাত্র ছেলে, তার এক বড় বোন আছে। মেয়েটি তার পরিবারে মেঝো, তার বড় ভাই এবং ছোট বোন রয়েছে। তাদের ভালোবাসা বয়সের সীমারেখায় বাঁধা নয়—ছেলেটি ২৯ বছরের, মেয়েটি ১৮। কিন্তু সম্পর্কের গভীরতা সেখানে নয়—থাকে যত্ন আর দায়িত্ববোধে।

মেয়েটি চকলেট খুব ভালোবাসে। ছেলেটি সেটা জানে, তাই ইতালি থেকে ৪ হাজার টাকার চকলেট পার্সেল পাঠায় তার জন্য। আর মেয়েটিও তার ঈদের সেলামি আর সঞ্চয় থেকে তার জন্য গিফট পাঠায়—পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, ঘড়ি।

এখনো তারা দূরে, তবুও প্রতিদিন রুটিনের মতো ভালোবাসায় ডুবে থাকে। রমজানের সেহরি, তাহাজ্জুদের সিজদা কিংবা ইফতারির মোনাজাতে তারা একে অপরকে আল্লাহর কাছে চায়—“তাকে আমার করে দাও” এই প্রার্থনায়।

তাদের সম্পর্কের আসল শক্তি কোথায় জানো?
তা হলো—আল্লাহর ওপর ভরসা আর একে অপরের পাশে থাকা, সব ওঠাপড়ার মধ্যে।

তাদের এই সম্পর্ক দূরত্বের সীমানা পেরিয়ে, সময়ের কাঠামো ভেঙে, আজও দাঁড়িয়ে আছে অটুট, এক ছায়ার মতো—যেখানে অপেক্ষা আছে, কিন্তু কখনো একাকীত্ব নেই।

Comments

    Please login to post comment. Login