পোস্টস

গল্প

রাজকুমারী লেডিস্ টেইলার্স

২১ মে ২০২৪

নাসরুল ইসলাম

আমার ধারণা পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ বেশি কথা বলে, ড্রাইভার এবং নাপিত। এই ধারণা আমার নিজের নয়, শোনা কথা। যে বলেছে তার কথায় যুক্তিও ছিলো,  কিন্তু সে নিজেই একটা ডেভলপার কম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার, কারন ছাড়াই বকবক করে। তার মতে ড্রাইভার রা গাড়ি চালানোর সময় কথা না বলে থাকতে পারেনা। দূর পাল্লার বাসে যে হেল্পার থাকে তারা ক্রমাগত সামনে কি আছে তা বলতে থাকে,  ড্রাইভার ও কিন্তু সেগুলো দেখে,  তবুও এই যে কথা বলতে বা শুনতে থাকে এটা তাদের জেগে থাকতে এবং ইন্দ্রিয় সচল রাখতে দরকার হয়, প্রাইভেট কারে যেহেতু হেলপার নেই তাই ড্রাইভার নিজেই কথা বলতে থাকে, নাপিতের ব্যাপারটা একটু আলাদা, নাপিত সাধারণত সারাদিন দোকানেই থাকে বাইরে যায়না তেমন, তাই তার কথা বলার মানুষ হলো তার কাস্টমার। মোটামুটি ভালো যুক্তি।
 আমি বসে আছি শাহবাগের জ্যামে। ক্রমাগত বকবক করে যাচ্ছে রকি। রকি আমাদের অফিসের ড্রাইভার, বেশ কাজের লোক, কিন্তু সমস্যা হলো বকবক করে। কথা শুরু করলে কখন থামতে হবে সেটা বুঝতে পারেনা। আজ সকাল থেকে শুরু করেছে গাড়ি বিষয়ক বকবক, গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর শুনে কিভাবে বোঝা যায় গাড়ি কত সিসি, সেডান হ্যাশব্যাকের মধ্যে পার্থক্য, কোন গাড়ির ট্যাক্স কত এসব ব্যাপারে এখন আমি চাইলে ৪৫ মিনিটের একটা লেকচার দিতে পারবো। 
 রকি নাম শুনলেই মনে হতে পারে ইয়াং একটা ছেলে, কিন্তুএই রকি মোটেই তেমন না, লম্বা দাড়ি আর পাঞ্জাবী পরে, মাথায় একটা টুপি পরে যেটা তেল চিটচিটে।  এই টুপিটাও আমার পছন্দ না, কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবেনা ভেবে একটা টুপি কিনে দিয়েছিলাম,  সেটা পেয়ে রকি বেশ খুশি হয়েছে, কিন্তু সেটা ব্যাবহার করে না। তাকে যা-কিছু ভালো দেয়া হয় সেগুলো তুলে রাখে। এ ব্যাপারে কিছু বলতে যাওয়াও ভালো লাগেনা।
আমার বাসা উত্তরায়, ভার্সিটিতে পড়ার সময় নিউ মার্কেটে যেই দর্জির কাছে কাপর-চোপর বানাতাম সেখানে এখনো বানাই, তাই এত ঝামেলা জ্যাম ঠেলে মাসে অন্তত একবার আসতেই হয়। রকি বলছিলো উত্তরা এক দর্জির কথা যে খুব ভালো কাজ করে, কিন্তু বলার ধরনটা এত বাজে ছিলো যে সেখানে যাবার ইচ্ছেটাই আর হয়নি। 
 "ম্যাডাম হুনেন,  সব দর্জির কাছে কাপর-চোপর বানাইয়া আরাম নাই, ব্লাইজ হইলো আরো ছেন্সিটিভ, মাপে একটু উনিশ বিশ হইলে পরা যায়না। "
 : তুমি এত কিছু কিভাবে জানো?
 " আমার পরথম ইসতিরি এই ব্যাপারে ছিলো বিরাট খুতখুইতা, যেম্নে যাইতো মনমত হইতো না। আবার মাইয়া মানুষের বুক ও সব একরকম না, আমার বউয়ের একপাশের টা ছিলো একটু বড় এক পাশের টা একটু ছোট, তা আবার দুইটা মনে হইতো দুই দিকে চাইয়া আছে। সেই লোক একবার তাকাইয়া বানাইয়া দিছে। মাপেও নাই, আর তাতেই খাপেখাপ হইছে।"
 রকি, তোমার বউয়ের বুক বিষয়ক কোন কথা আর কোনদিন আমার সামনে বলবা না। সব চেয়ে ভালো হয় তুমি কথাই না বললে। এত কথা শুনতে ভাল্লাগে না। 
এসবের পরেও একদিন গাড়িতে ওঠার সময় সিটের ওপর দোকানের কার্ডটা দেখতে পেয়ে রাগ করবে কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, বাসার কাছেই, একদিন যাবো কিনা হাটতে হাটতে? এতকাছে যদি ভালো দর্জি পাওয়া যায় তাহলে দূরে যাবার দরকার বা কি?
 ভাবতে ভাবতে ঠিক করি একবার যাবো। ভালো হলে ভালো, মন্দ হলে আর যাবোনা। 
 বিকেল বেলা হাটতে বের হয়ে একদিন চোখে পরলো দোকানটা, গলির মধ্যে যেমন হয় খুব সাদামাটা দোকান, ভেতরে কিছু কাপর হ্যাংগারে ঝুলছে, একদম বিশেষত্বহীন, একটা টেবিল আর দুটো মেশিন এই নিয়ে দোকান। তবে দোকানের নামটা বেশ সুন্দর, "রাজকুমারী লেডিস টেইলার্স"
 ভাবতে ভাবতে দোকানের ভেতরে ঢুকে পরলাম।
নাহ, যা ভাবছিলাম, কেমন না কেমন হয়, মাপ না নিয়ে ব্লাউজ বানাবে, ব্যাপারটা অদ্ভুত না?তবে তেমন কিছুই হয়নি, সিম্পলি যাওয়ার পর কাপর পছন্দ করে দিয়েই চলে এসেছি, মাপের ব্যাপার আমিও কিছু বলিনি সেও না।বলার মধ্যে শুধু কবে নিতে আসবে তা জানতে চাওয়া ছাড়া। শুধু বললেন পরশু।  শুধু শুধুই একটা ইতস্তত বোধ ছিলো ওনার। এটা একটা পরিক্ষা আমার কাছে। যদি সত্যিই ভালো বানায় তাহলে এরপর সব কাজ ওনাকে দিয়েই করাবো। এমনিতে খুব একটা শাড়ি গহনার শখ নেই, কিন্তু হাজব্যান্ডের পিড়াপিড়ির জন্য যেতে হয়। অফিস পার্টি, বিয়ে, জন্মদিন এসব আরো হাবিজাবি প্রোগ্রাম লেগেই থাকে। 
 ***
 নিজের শরীরের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা নেই আমার, ফার্নিচারের মত পরে থাকে, মাঝেমধ্যে ঝারামোছা হয়, লাস্ট কবে নিজেকে খুলে দেখেছি মনে পরেনা।  বাথরুমে বেশ বড় একটা আয়না থাকার পরেও ঠিকঠাক তাকানোই হয়না। অথচ এই ফ্ল্যাটটা কেনার আগে আমার প্রথম আকর্ষণ ছিলো বাথরুম, ১৪*১২ ফিটের একটা রুম পুরোটাই বাথরুম। সেন্ট্রাল এসির একটা উইন্ডো এখানে আনা হয়েছে যাতে গরমের সময় কষ্ট না হয়, উইন্ডোটা চাইলে বন্ধ করেও রাখা যায়। আমাদের বাসায় আমার সব চেয়ে কষ্ট হতো বাথরুমে,  ঘেমে বের হতাম, নিজের কাছেই বিরক্ত লাগতো, কি যেন পরিশ্রম করে বের হইছি! এমন একটা ফিল হতো। আর যে কেউ তাকালে এমন একটা অপরাধ বোধ হতো যেন মাস্টারবেশন করে বের হইছি।
 আজ অনেক বছর পর নিজেকে আয়নার সামনে খুলে বসলাম। রোকেয়া হলে থাকার সময় মাঝেমধ্যে রুমমেটরা গল্প করতে বসতাম, সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা টপিক ছিলো বুক। সাইজ, সেপ, কালার এসব নিয়ে বিস্তর আলাপ হতো। এসব গল্পে আমি মোটেই জয়েন করতাম না, তবে শুনতে ভালো লাগতো, কান লাল হয়ে যেত। ওরা কতসব নাম বলতো! পিরামিড, গম্বুজ, লাউ, আরো হাবিজাবি। বলার সময় হাসির রোল পরতো। আমি খুব সাবধানে এড়িয়ে যেতাম এ সব গল্প। রুমে সবাই রিলাক্স থাকার জন্য শুধু টিশার্ট পরতো, কিন্তু আমি সেটা কখনো পারিনি।
 আমার স্বামীও কখনো আমার খোলা বুক দেখেনি৷ নট ফর এ সিংগেল টাইম। আমি দেখতে দেইনি। ও প্রথমে খুব চেষ্টা করতো, ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কথাই বলেছে কিন্তু আমার না কে হ্যা করতে পারেনি। আমার ধারণা মানুষ ছাড়া আর কোন প্রানীর বুকের প্রতি এত তীব্র আকর্ষণ নেই। কখনো কোন গরু বা ছাগল মিলিত হবার সময় স্তন রাব করে? কে জানে? তার উপর ও কর্পোরেট মানুষ! সপ্তাহে দুইদিনের বেশি কখনো আমাদের মেলামেশা হয়না, যেদিন হবে সেদিন আগেই তার প্রিপারেশন থাকে, আর আমাকেও ইশারায় বুঝিয়ে দেয় আজ তার আমাকে চাই। চুলোয় কফির পানি বসিয়ে বেলকনিতে চেয়ার পেতে বেডে আসে, মিনিট পাচেক পর নিজেই গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে আসে, তারপর সিগারেট আর কফি খেতে খেতে হালকা সাউন্ডে মিউজিক শোনে। আমি চাদরটা গায়ে টেনে পরে থাকি।
 আজ এসব কেন মনে আসছে! বুঝতে পারছিনা।
 ওই গোবেচারা ধরনের দর্জিটার চোখে কি কিছু ছিলো? 
 এখনো শরীরের গঠন বেশ পোক্তই আছে বলা যায়। লকেটটার জন্য আরো ভালো লাগে। খুব লোকাট ব্লাউজ কখনো পরিনা আমি। গহনার মধ্যে একটা চেইন আর ওই লকেটটা।
 ****
 রাজকুমারী লেডিস্ টেইলার্সের   বয়স ১০ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু উন্নয়ন তেমন হয়নি, আগের মতই একটা কাটিং টেবিল তিনটি মেশিন, আহামরি ইনকাম হয় তাও না। তবুও এটা মনে হতেই পারে আমি এটা কেন চালাচ্ছি? উত্তরটা সহজ, আমি এর বাইরে কিছুই করতে পারিনি। মাঝখানে যখন উবারের নতুন প্রচলন হয় তখন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড প্রোবক্স গাড়ি কিনেছিলাম।   তাতে লাভ হয়নি, ড্রাইভারের বেতন, গ্যাস, সার্ভিসিং, পেপার আপডেটের খরচা সব মিলিয়ে লাভ তো হয়না। আর এই স্টেশন ওয়াগনে কেউ উঠতেও চায়না, এর চেয়ে সুন্দর সুন্দর সেডান কারে ঢাকা ভর্তি, বাধ্য হতে ড্রাইভারের কাছেই বেচে দিয়েছি। সব ব্যাবসা সবাইকে দিয়ে হয়না। সংসার না থাকার এই একটা সুবিধা বেশি ইনকামের দরকার থাকে না।  সংসার নেই বলা কি ঠিক হলো? বউ এর সাথে থাকিনা, ডিভোর্স ও হয়নি, ওরা আমাকে ছাড়া ভালো আছে আর আমিও মন্দ নেই। প্রথমে গুলশানের পিংক সিটিতে কিছুদিন এক বড়ভাই এর দোকানে বসছিলাম,  টেইলার্স দেবার চিন্তাটাও সেখান থেকে এসেছে, দোকানটা ছিলো ইন্ডিয়ান থ্রিপিসের। কিছুদিন দোকানে বসেই বুঝতে পারলাম দোকানে কি কাপর আছে সেটার চেয়ে জরুরী হলো সেলসম্যান কতটা এক্সপার্ট,  আমার শিখতে সময় লাগেনি। 
 ব্যাপারটা হলো কাস্টমার এর চোখ খেয়াল করা, সাধারণত কাস্টমার রা সারা দোকানে চোখ বোলায়, এই সময়টাতেই আপনাকে বুঝতে হবে সে কোন কাপরটার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, সেটার প্রথমে সুনাম করে বাকি সব গুলোর দাম কম বলা, তখন আরেকটা ব্যাপার আসে যে যেটা সে পছন্দ করলো সেটা ওনার সাইজের হবে কিনা। এই দুটা জিনিস মেলাতে পারলেই ভালো দামে সেল করা সম্ভব।  এবার আসে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, গুলশানে এলিট শ্রেনীর কাস্টমারদের বসবাস,  সেখানে হুট করে আপনি কোন মেয়ের বুকের সাইজ জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। করলেও সেটা ওনারা ভালোভাবে নেবে না। আবার কারো বুকের দিকে তাকিয়ে থাকাও অসম্ভব,  থাপ্পর দিয়ে বসতে পারে যখনতখন,  আপনার কাস্টমারের চোখের দিকে তাকিয়েই বুকের মাপ নির্ভুল ভাবে অনুমান করতে হবে। বুকের দিকেও তাকাবেন তবে সেটা হবে চোখের পলকে!
 একটু দেড়ি হলেই শেষ।
 তিনদিনের মাথায় আমি ব্যাপারটা আয়াত্ব করে ফেললাম।  তবে ঠিক কিভাবে বুঝলাম সেটা আমিও জানিনা,  তবে কনফিডেন্স লেভেল এত হাই হয়ে গেল আমার যে কাস্টমার ভুল করলেও আমার ভুল হতোনা। 
 আচ্ছা মানুষের চোখে কি এক্সরে মেশিনের মত কিছু থাকতে পারে? আমি ব্যাপারটা কাউকে কখনো বলিনি, আমার ধারণা আমার চোখে এমন কিছু একটা আছে। এটা কোন সসমস্যা কিনা তাও জানিনা।  আমার এক বন্ধু রেটিনা স্পেশালিষ্ট, ওকে বলেছিলাম তাতে উলটো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে।  ভুল আমার যে ছিলোনা তাও না, সেদিন ওর বাসায় গিয়েছিলাম,  কথায় কথায় এটাও জিজ্ঞেস করেছি যে এমন কোন ব্যাপার হতে পারে কিনা। ও হেসেই উড়িয়ে দিলো, এরমধ্যে ওর স্ত্রী চা দিয়ে গেলো, আমি ওকে বললাম তোর বউয়ের বুকে দুইটা তিল, একটা লাল একটা কালো, একদম পাশাপাশি।  ও একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না। একটু পর ও ভেতর থেকে যখন এলো ওর চোখমুখ লাল!  আমি বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। আমি চলে এলাম, এরপর আর কখনো ওর সাথে কথা হয়নি, সামনে পরলেও না দেখার ভান করেছে। এই খারাপ অভিজ্ঞতার পর এটা নিয়ে আলোচনা করা যায় না। 
 আজকের ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকলো, যে ভদ্র মহিলা দুপুর বেলায় দোকানে আসলেন ওনার দিকে তাকিয়ে আমি শুধু অবাক হইছি তা নয়, আমার এত বছর টেইলারিং জীবনে এমন হোচট আমি কখনো খাইনি।
 এই প্রথম আমার কনফিডেন্সের ব্যাপারে আমি কনফিউজড।  এটা কিভাবে সম্ভব? 
 একটা মানুষের তিনটা চোখ দেখলেও আমি এত অবাক হতাম না। আমার ধারণা ইনি ব্লাউজ নিয়ে আসবেন। ঠিকঠাক হলেও আসবেন, না হলেও আসবেন।
 ****
 আশ্চর্য ব্যাপার হলে একদম ঠিকঠাক মাপ হবার পর ও আমি ব্যাপারটা মানতে পারলাম না। ১৬ বছরের একটা মেয়েকে কেউ বিনা কাপড়ে দেখে ফেললে যেমন একটা ভয় মিশ্রিত রাগ কাজ করে আমার ঠিক তেমন মনে হচ্ছিলো। আবার একটা ভালো লাগাও কাজ করছিলো, গোপন থাকা আর অস্তিত্বহীন থাকা এক নয়।
 দুপুরবেলা ওই বানানো ব্লাউজ টা নিয়ে দোকানে চলে গেলাম। ১ টার দিকে মহিলা কর্মচারিরা খেতে যায়। আমিও এই সময়েই গেলাম। বললাম মাপ ঠিক হয়নি, বেশ বিব্রত আর কাচুমাচু মুখ নিয়ে বললো কি বলেন ম্যাম? ঠিক না হবার কথা না। ওরাও কেউ নেই, আচ্ছা আমি মাপ নিয়ে নিচ্ছি বলেই ইঞ্চি টেপ খুজতে শুরু করলো। আমি অস্ফুটে বিরবির করে বললাম টেপ ছাড়া বুঝি মাপ নেয়া যায় না?