Posts

চিন্তা

মঙ্গল শোভাযাত্রা: কার সংস্কৃতি, কার নিয়ন্ত্রণ?

April 11, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

114
View

মঙ্গল শোভাযাত্রা এক সময় ছিল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বর্ণিল মিছিল। বৈশাখের প্রথম সকালজুড়ে রঙ, ঢাক, মুখোশ আর প্রতীকের মাধ্যমে উদযাপন করা হতো বাঙালির ঐতিহ্য, প্রতিবাদ, ও প্রতিরোধ। সেই শোভাযাত্রা রূপ নিচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ও অনুমোদিত এক সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠানিকতায়। প্রশ্ন উঠছে—এই আয়োজনটি আর কতটা ‘মঙ্গল’ আর কতটাই বা ‘শোভাযাত্রা’?

সম্প্রতি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক আলোচনায় দাবি করেছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় নাকি খালেদা জিয়াকে পেট্রোল বোমা হাতে দেখানো একটি স্ট্রাকচার চারুকলা থেকে নির্মিত হয়েছিল। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। ঐ প্রতীকটি নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা, যারা ২০১৯ সালে সেটিকে পিকআপ ভ্যানে করে ঢাকায় ঘোরান এবং শেষ মুহূর্তে শোভাযাত্রায় ভিড়িয়ে দেন। চারুকলার সঙ্গে এ ঘটনার কোনো সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। এই তথ্য বিভ্রান্তিমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শিল্পীদের স্বাধীন অবস্থানকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা।

অন্যদিকে, রাজাকারের প্রতীক নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চারুকলার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ১৯৯৬ সালে, বিএনপি সরকারের সময়, প্রথমবারের মতো একটি রা'জাকার প্রতীক বানানো হয়। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের সময়ও আবারো তার পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়—রাজাকার প্রতীক মানেই কি দাড়ি-টুপি? এই প্রতীকায়ন বাঙালি মুসলমান সমাজের একটি বৃহৎ অংশকে অযাচিতভাবে চিত্রিত করছে না তো? এই দৃষ্টিভঙ্গি ও বয়ান নিয়ে ভাবা দরকার।

আরেকটি আলোচিত দাবি ছিল—মঙ্গল শোভাযাত্রায় নাকি বাংলার কৃষকের প্রতিনিধিত্ব নেই। বাস্তবে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে কৃষকের মাথাল, জেলের জাল, গরুর গাড়ি, নৌকা ইত্যাদি গ্রামীণ জীবনের বহু উপাদান স্ট্রাকচারে স্থান পেয়েছে। এই আয়োজনে বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতিফলন বরাবরই ছিল—থাকতে হবে আরও সবিস্তারে।

তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক উঠেছে “ঢাক” বাদ দেওয়া নিয়ে। ঢাক নাকি “হিন্দুয়ানী”, তাই বাদ। এই সিদ্ধান্ত আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় কুঠারাঘাত। ঢাক কেবল ধর্মীয় নয়, বরং এ অঞ্চলের লোকজ ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকি তো এই মাটিরই মানুষ। তারা কি বাঙালি নয়? বাঙালি সংস্কৃতি কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি? বরং, বৈচিত্র্যই বাঙালিয়ানা—এই সত্য ভুলে গেলে বৈশাখও আর বৈশাখ থাকে না।

এবারে আরও একটি অস্বস্তিকর পরিবর্তন এসেছে আয়োজক কাঠামোতে। অতীতে চারুকলার প্রতিটি ব্যাচ বৈশাখের আয়োজনে সরাসরি অংশ নিত, একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এবার সেটি বাতিল করে একে কারিকুলামের আওতায় এনে শিক্ষকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আয়োজক নয়, বরং ‘ক্লাস’ করছে। এই পরিবর্তন চারুকলার সেই স্বাধীনতাসম্পন্ন ঐতিহ্যকে আঘাত করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরাই ছিলেন উৎসবের প্রাণ।

স্বাধীন চিন্তা, শৈল্পিক প্রতিবাদ, ও সংস্কৃতির বহুত্বকে ধারণ না করলে এমন আয়োজন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শোভাযাত্রা কোনো সরকারের PR প্রজেক্ট নয়, এটি একটি প্রজন্মের সাংস্কৃতিক বিবৃতি। সেখানে ‘কি বানানো যাবে, কি যাবে না’, তা মন্ত্রণালয় বা এজেন্সি নির্ধারণ করলে সেটি আর গণমানুষের শিল্প নয়, বরং হয়ে ওঠে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রদর্শনী।

শোভাযাত্রা যেভাবে একসময় রাষ্ট্রক্ষমতারও সমালোচক হতে পেরেছিল, ক্ষমতাকে জবাবদিহি করতে পারছিল; সেই শক্তিকে এখন রীতিমতো দমন করা হচ্ছে। অথচ এই আয়োজনের প্রাণ ছিল ছাত্র, তাদের স্বাধীনতা, তাদের স্বপ্ন।

একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন যখন কেবল সরকারি ছাঁচে নির্মিত হয়, তখন তা জনগণের নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিভূতে পরিণত হয়। “মঙ্গল” শব্দটিকে অস্বস্তিকর আখ্যা দিয়ে নাম পরিবর্তনের কথা বলা বা ঢাক বাদ দেওয়া একধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণনীতি, যার মাধ্যমে বহুসাংস্কৃতিক বাঙালিয়ানাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অতএব, এই বিতর্ক কেবল সংস্কৃতি উপদেষ্টার একক ব্যক্তিগত বিভ্রান্তিকর বয়ানের অভিযোগ নয়; এটি আমাদের সময়ের আর্তনাদ, যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন কোনো দলের প্রচারণামূলক আয়োজন না হয়ে আবারও হয়ে উঠতে পারে সকলের—এইটাই হোক আমাদের সমস্বর নৈতিক দাবি।

বাংলার সংস্কৃতি যেমন সহনশীল, তেমনই প্রতিরোধী। শোভাযাত্রা কেবল আনন্দ নয়, এটি প্রতিবাদের ভাষাও। তাই সেটিকে কৌশলে নির্বিষ করে তোলার প্রয়াসের বিরুদ্ধে এখনই কথা বলা দরকার।
এখন সময়, আয়োজনে ‘শৃঙ্খলা’র নামে লোপাট হওয়া সেই শৈল্পিক স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে আনার। ফিরে আসুক মঙ্গল শোভাযাত্রার সেই প্রাণ—যেখানে বাঙালি হয়ে উঠবে একযোগে কৃষক, জেলে, কবি, প্রতিবাদী, প্রেমিক, বিদ্রোহী—সবই।

লেখক: সাংবাদিক 
৯ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login