রায়হান এখন কথা খুব কম বলে।
এক সময় যে হাসত, আড্ডা দিত, স্বপ্ন আঁকত—
সে আজ এক নিঃশব্দ ছায়া।
তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই
ভেতরে এক ভয়াবহ ঝড় চলেছে,
যে ঝড় কারো চোখে পড়ে না।
পূর্ণিমা চলে গেছে—
হঠাৎ নয়, অনেকদিনের ভেতরঘূর্ণি শেষে।
রায়হান তাকে দোষ দেয় না,
ভালোবেসেছিল ঠিকই, কিন্তু সময়টা ছিল বিপরীত স্রোতের।
পূর্ণিমার চোখে ভবিষ্যতের আলোর অভাব ছিল,
আর রায়হান ছিল এক টুকরো ছায়া—
যে নিজেকে পুড়িয়ে চারপাশে ছায়া দিতে চায়।
চাকরি নেই, টাকাও ফুরিয়ে আসে প্রায়ই,
কিন্তু মুখে কেউ টের পায় না।
বোনের বিয়ে হয়েছে, ভাই ব্যস্ত নিজের জীবনে,
বাবা থেমে গেছেন বহু আগেই,
মা আর তাকিয়েই থাকে—
এই ছেলেটাই কি পারবে সব কিছু ধরে রাখতে?
সে হাল ছাড়ে না।
দরজা বন্ধ করে নিজের সঙ্গে কথা বলে—
“তুই কাঁদবি না। কেউ তোর ব্যথা বুঝবে না।”
তার শরীর কেমন খারাপ, সে জানে না,
ওষুধ কবে শেষ হবে, সেটাও ঠিক মনে থাকে না সবসময়,
কিন্তু ঘরে চাল আছে কি না,
মা’র চোখ কবে কেঁদে লাল হয়েছে—এসব ঠিক মনে রাখে।
সে রান্না করে না, গল্পও বলে না,
তার ভেতরে যা আছে তা হলো
একটা স্থির আগুন—নির্বিকার অথচ পোড়াতে জানে।
দিন আসে, যায়,
তবুও সে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
সে জানে, কেউ পাশে থাকবে না,
কেউ বলবে না "তুই ভালো আছিস তো?"
তবুও সে ভালো থাকার অভিনয় চালিয়ে যায়
কারণ সেই অভিনয়টাই এখন আশ্রয়।
রায়হান নিজেকে হারিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই—
কিন্তু হারায়নি দায়িত্ববোধ।
এই ভাঙা সময়ে,
সে নিজেই হয়ে উঠেছে সময়ের প্রতিষেধক।
কারণ সে জানে,
ঝড় তুফানের পরে যারা বেঁচে থাকে—
তারা আর মানুষ থাকে না,
তারা হয়ে যায় ছায়া, আগুন, পাথর,
আর পরিবার নামক পৃথিবীর
একটি টুকরো দেয়াল।