সবকিছু রাজনীতিকীকরণের একটা বিরাট জ্বালা আছে। অতি কচলানোতে মানুষ বিরক্ত হয়ে রাজনীতি বিমুখ হতে পারে। মানবতাবাদী শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চাও বেহাত হতে পারে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা এবছর হয়ে গেল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। পরের বছর কী হবে, তা জানে মহাকাল! আনন্দ সবসময় হিন্দুদের নামই হয়! উপরন্তু হিন্দু ধর্মে আনন্দের দেবতাকে কামদেব (কাম) বা মন্মথ নামে ডাকা হয়। তিনি কাম, প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ এবং সৌন্দর্যের দেবতা। হিন্দুয়ানি বলে মঙ্গল বাদ গেল, এখন তবে আনন্দ কিভাবে হজম হবে?
আয়োজকরা বলছেন, এবার সবচেয়ে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শোভাযাত্রা হবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, যে শব্দ ৩৫ বছর ধরে সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের সঙ্গী ছিল, সেটিই বাদ দিয়ে যে কারো আবদারে মাথা নিচু করা হচ্ছে। এটা অন্তর্ভুক্তি, নাকি আপসকামিতা?
বাংলা নববর্ষ মানেই নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার অনন্য উৎসব। ঢাকাবাসীর এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধচেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক “Intangible Cultural Heritage” হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ কে সামনে রেখে এবার এই আয়োজনের নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ আজ সংবাদ সম্মেলনে জানান, এবারের শোভাযাত্রা হবে "সর্ববৃহৎ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ"। প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে: “নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান”, যার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘মঙ্গল’ শব্দ নিয়ে বিতর্কের রাজনীতি চলছে অনেকদিন আগে থেকেই। গত কয়েক বছর ধরেই কিছু ইসলামপন্থী দল ও সংগঠন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবি, ‘মঙ্গল’ শব্দটি হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ বাস্তবতা হলো, এখানে 'মঙ্গল' শব্দটি কোনো ধর্মীয় অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হয়নি; বরং এটি অশুভ শক্তির বিপরীতে শুভবোধ, মানবিকতা ও প্রগতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এবারের আয়োজনে সেই ‘মঙ্গল’ শব্দ বাদ পড়ে শুধুই ‘আনন্দ’ টিকে গেছে। এটি কি নিছক কৌশলগত? না কি রাজনৈতিক চাপের কাছে একধরনের আত্মসমর্পণ? এমন প্রশ্ন উঠছে সাংস্কৃতিক মহলে।
এই নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল আগেই। ২৩ মার্চ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছিলেন, “নাম পরিবর্তন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।” ফলে ধরে নেওয়া যায়, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবনা ছিল।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি শুধু একটি সাংস্কৃতিক আয়োজনের পরিচয় নয়, বরং এটি ছিল গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, এবং অতি রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের এক প্রতীক। এখন সেই প্রতিরোধের মর্মবাণীটায় কি জলঘোলা হয়ে গেল?
নামটি এখন 'আনন্দ শোভাযাত্রা' হলেও আয়োজনে রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে, যেমন: “স্বৈরাচারের দৈত্যরূপ” মোটিফ—যা সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে। অনেকে বলছেন, এটির চেহারায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছায়া রয়েছে। যদিও আয়োজকরা তা সরাসরি বলেননি। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ রাখার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সংহতির বার্তাও তুলে ধরা হচ্ছে।
এই নাম পরিবর্তন নিছক একটি শব্দ বদল নয়—এটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক রাজনীতির অংশ। এটি এমন এক সময়ে এলো, যখন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন উৎসব, মূর্তি, সংগীত, এমনকি নারীর শিক্ষা ও চাকরিবাকরি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ‘মঙ্গল’ শব্দের প্রতি আপত্তি সেই ধারাবাহিকতাতেই পড়ে, যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধীরে ধীরে পিছু হটছে।
এমন সময়, যখন পৃথিবীজুড়ে সাংস্কৃতিক অধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তার প্রশ্নগুলো ঝুঁকির মুখে, তখন বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে নাম বদল একপ্রকার আত্মপরিচয়েরও প্রশ্ন তোলে।
‘মঙ্গল’ শব্দটি না থাকলেও যদি এই শোভাযাত্রা প্রগতির বার্তা, বৈচিত্র্যের সম্মান ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থানের সেই রূপ ধরে রাখতে পারে, তবে তাৎপর্য রক্ষা পাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে: চাপের মুখে প্রগতির প্রতীক বদলে ফেলা কি এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়া নয়?
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়তো আনন্দ কমেনি, তবে মঙ্গল কিছুটা মলিন হয়েছে—সাংস্কৃতিক রাজনীতির পাঠে সেটাই আজকের সত্য।
মঙ্গল' গেল, 'আনন্দ' এলো। কাল যদি 'আনন্দ'-এর মধ্যেও কেউ পৌত্তলিকতার গন্ধ পায়, তাহলে সেটাও যাবে। তখন হয়তো শুধু একটা শব্দ থাকবে—‘যাত্রা’। অর্থাৎ, সব কিছুর শেষে আমরা হাঁটছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি—তা জানি না।
লেখক: সাংবাদিক
১০ এপ্রিল ২০২৫