আব্বা, ক্যামন আছেন?
কে?
আব্বা, আমি রনি।
ও রনি....(মুখ জুড়ে অপার্থিব হাসি)
কখন আইছো? ভাল আছো?
সংক্ষিপ্ত কথপোকথন। কিন্তু কি তার অমোঘ আকর্ষন! এই নশ্বর ভুবনে আব্বার কাটানো শেষ দিনগুলোতে আমাদের মধ্যে এইটুকুন কথা ছিল পরম আরাধ্য। শুকিয়ে যাওয়া হাড্ডিসার শরীরের পবিত্র মুখ জুড়ে নামত কি যে নিষ্পাপ মায়াভরা হাসি!! যে হাসি নিমিষেই ভুলিয়ে দিত শতমাইল ভ্রমণের ক্লান্তি! যে হাসি প্রেরণা যোগাত বহুদিন পাশে থাকবার। এই হাসিটুকু দেখব বলে মনপ্রান অস্থির থাকতো পুরো সপ্তাহ জুড়ে, কখন শুক্রবার আসবে আর ঢাকা থেকে বাড়ি যাব, আব্বার কাছে যাব। প্রতিবার বাড়িতে গিয়ে আব্বার সাথে এইটুকুন ভাব বিনিময় কলিজা ঠাণ্ডা করে দিত। আজ আব্বা নেই! কেমনে বিশ্বাস করি! জীবনের এই কঠিনতম সত্য কেনইবা উন্মোচিত হলো। মনে হয় এখনো আব্বা পশ্চিম পাশের রুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন আর অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কোন সন্তানের মায়াভরা "আব্বা" ডাকের। কাছে গিয়ে আব্বা বলে ডাক দিলেই বলবে, কে?
আমাদের সহজ, সরল, অতি সাধারণ আব্বা দুনিয়ার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২। কত ঘটনা, কত স্মৃতি আব্বাকে নিয়ে। আব্বা আমাদের ভাল রাখতে অনেক কষ্ট করেছেন, অনেক কষ্ট সয়েছেন। সৎভাবে, কারো কোনো ক্ষতি না করে, নির্ভেজাল জীবন পার করেছেন। সরকারি চাকরির সীমিত বেতনের টাকায় বড় একটি পরিবার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন কিন্তু কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। মুখ বুজে অনেক কথা হজম করেছেন কিন্তু কখনো কাউকে কটু কথা বলেননি। কর্মক্ষেত্রে তার সততা ছিল সর্বজন বিদিত। উপঢৌকন দিতে চাওয়ায় স্বনামধন্য কলেজের এক অধ্যাপককে বাসা থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা এখনো মনে দাগ কেটে আছে। আব্বাকে কখনো ঘটা করে আমাদের কোন উপদেশ দিতে হয়নি বা দিয়েছেন বলে মনেও পড়ে না। বরং তিনি তার জীবন যাপন দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে গেছেন, কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক। কিভাবে একজন ভাল মানুষ এবং একজন আলোকিত মানুষ হতে হবে।
মাসের শুরুতে বাসায় এসে আব্বা বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বেতনের টাকাগুলো একে একে গুনতে শুরু করতেন। সময় বয়ে যায় টাকা গোনা শেষ হয় না। সামান্য কতগুলো টাকা গুনতে কেন যে এত সময় লাগে তখন বুঝতে পারতাম না। কখনো কখনো টাকা গুনতে গুনতে আব্বা ঘুমিয়ে যেতেন। এখন বুঝতে পারি, সংসারের আয়ব্যয়ের সমীকরণ মিলাতে না পেরে আব্বা হারিয়ে যেতেন ঘুমের রাজ্যে। অথচ আব্বা চাইলেই আমরা সাচ্ছন্দে দিন কাটাতে পারতাম। তার দেয়া সততার শিক্ষা আমাদের জন্য অহংকার আর গর্বের, জীবন চলার পাথেয়।
আব্বাকে হারিয়ে আমাদের জীবন থেকে একটি সুখের পালক খসে পড়েছে। জীবনের সোনালী দিন গুলো আর ফিরে আসবে না! এ শোক শেষ হবার নয়। এ বেদনা অনিঃশেষ। আব্বার ভরসার জায়গা হয়ে তার পাশে আর থাকা হবে না। আর কখনো তার মুখে শুনতে পাবো না, "তুই পাশে থাকলে ভাল লাগে, ভরসা পাই, মনে বল পাই"। আব্বা আপনাকেও কখনো বলা হয়নি, আপনি ছিলেন বলে আমরা পরিপূর্ণ ছিলাম, পরম মমতায় আপনার বাড়িয়ে দেয়া কম্পিত হাতে হাত রাখতে পারা ছিল আমাদের জন্য ছিল অনির্বচনীয় আনন্দদায়ক মুহূর্ত। কেবলমাত্র বিছানায় শুয়ে থাকা আপনার নিথর উপস্থিতিও আমাদের যোগাত পরম ভরসা।
আব্বা, অনন্ত অসীমের পথে আপনার এই একাকী যাত্রা কল্যানময় হউক। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের একজন মেহমান হিসেবে কবুল করুন।