Posts

প্রবন্ধ

বাংলা শব্দের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

April 12, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

980
View

ভূমিকা
ভাষা একটি জাতির পরিচয় ও আত্মার প্রতিফলন। বাংলা ভাষা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত, তার শব্দভাণ্ডার গঠিত হয়েছে নানা ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারায়। এই শব্দভাণ্ডার শুধু ভাষাবৈচিত্র্য নয়, বরং এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার স্মারক। বাংলা শব্দের উৎপত্তি একদিনে ঘটেনি; বরং হাজার বছরের বিবর্তন, ভৌগোলিক বিস্তার, রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তন, ধর্মীয় প্রভাব, সাহিত্যিক চর্চা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে তা বিকশিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব বাংলা শব্দের উৎস, তাদের প্রকারভেদ, ক্রমবিকাশের ধারা এবং আধুনিক প্রভাবের বিশ্লেষণ।


---

১. বাংলা ভাষার উৎপত্তির পটভূমি

বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতের প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ রূপ থেকে। প্রাচীন ভারতে ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষাগুলির একটি শাখা ছিল মাগধী প্রাকৃত, যা থেকেই বাংলা ভাষার বিকাশ। প্রাকৃত ভাষা সরল, কথ্যরূপে ব্যবহৃত এবং সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল। সংস্কৃত ছিল ব্রাহ্মণ্য ও প্রাজ্ঞবর্গের ভাষা, যেখানে প্রাকৃত ছিল জীবনের সহজ স্বর। সময়ের পরিবর্তনে মাগধী প্রাকৃত → অপভ্রংশ → পুরাতন বাংলা → মধ্য বাংলা → আধুনিক বাংলা—এই ধারা বজায় রেখে ভাষার বিকাশ ঘটে।

বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় চর্যাপদে (১০০০ খ্রিঃ থেকে ১২০০ খ্রিঃ), যেখানে বহু তদ্ভব ও দেশি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, শব্দচয়নের ক্ষেত্রে বাংলার নিজস্ব স্বরূপ শুরু থেকেই ছিল দৃঢ় ও স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ।


---

২. বাংলা শব্দভাণ্ডারের উৎস ও শ্রেণিবিন্যাস

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলিকে উৎস ও রূপান্তর অনুসারে সাধারণত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়:

(ক) তৎসম শব্দ

তৎসম শব্দ হল সেই সব শব্দ, যা সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত বা সামান্য পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় এসেছে। সাধারণত ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যিক চর্চায় ব্যবহৃত উচ্চস্তরের শব্দগুলো এই শ্রেণিতে পড়ে। উদাহরণ: অমৃত, জ্ঞান, কর্ম, শান্তি, ধর্ম।

এই শব্দগুলো প্রথমে পাল ও সেন আমলে কিছু পরিমাণে ব্যবহৃত হলেও, প্রধানত মধ্যযুগের পরবর্তী সময়ে এবং নবজাগরণ পর্বে বিশিষ্ট বাঙালি মনীষীদের চেষ্টায় ব্যাপকভাবে সাহিত্যে ব্যবহার শুরু হয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তৎসম শব্দ প্রচলনের অন্যতম পুরোধা।¹

(খ) তদ্ভব শব্দ

তদ্ভব শব্দগুলি মূলত প্রাকৃত ও অপভ্রংশ থেকে আগত। সংস্কৃত শব্দের সরলীকরণ, পরিবর্তন ও লোকভাষার সংস্পর্শে যে রূপে তারা ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোই তদ্ভব। যেমন: জন (জন), মুখ (মুখ), পানি (পানীয়), খাওয়া (খাদ্য)।

বাংলা ভাষার প্রাণ এই তদ্ভব শব্দে নিহিত। কথ্যভাষায় এদের ব্যবহার বেশি, এবং সাধারণত মানুষের আবেগ, অনুভূতি, দৈনন্দিন জীবনের চিত্র এদের মাধ্যমেই সহজভাবে প্রকাশ পায়।²

(গ) দেশি শব্দ

দেশি শব্দ সাধারণত অস্ট্রিক, দ্রাবিড় বা স্থানীয় অনার্য জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে আগত। এই শব্দগুলো অনেক সময় বাংলা ভাষার সঙ্গে ধ্বনিগত বা অর্থগত সাদৃশ্য না রেখেও ব্যবহৃত হয়। যেমন: ডালা, লাঠি, খুঁটি, বাটি, টান, দুলুন।

চর্যাপদ ও মঙ্গলকাব্যে দেশি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এরা বাংলা ভাষার আঞ্চলিক স্বাদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং বাংলার গ্রামীণ সমাজ ও লোকজ সংস্কৃতির নিকট অতিপরিচিত।³

(ঘ) বিদেশি শব্দ

বাংলার দীর্ঘ ইতিহাসে বহু বিদেশি জাতিগোষ্ঠী এসেছে ও শাসন করেছে। এই যোগাযোগের ফলে ফার্সি, আরবি, পর্তুগিজ, তুর্কি ও ইংরেজি ভাষা থেকে বহু শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছে। যেমন:

ফার্সি: দরজা, খাতা, পয়সা, আদালত

আরবি: আল্লাহ, দোয়া, রিজিক, সালাত

তুর্কি: তোপ, চাউস, কুঞ্জি

পর্তুগিজ: আলমারি, আনানাস, সাবান

ইংরেজি: পেন, রেল, স্কুল, টেলিফোন⁴


এসব শব্দ বাংলা ভাষায় শুধু ঢুকে পড়েনি, বরং দীর্ঘ ব্যবহার ও অভিযোজনের ফলে ভাষার শরীরে রক্তের মতো মিশে গেছে।

(ঙ) চলিত ও প্রচলিত শব্দ

বাংলা ভাষার আধুনিক পর্বে বহু শব্দের দৈনন্দিন রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তিত শব্দগুলোকে চলিত বা প্রচলিত বলা হয়। যেমন, কহিলেন → বললেন, গেলেন → গেলেন। এই শ্রেণিভুক্ত শব্দ গঠনের ধারা নতুন প্রজন্মের ভাষাভ্যাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে।


---

৩. বাংলা শব্দের ধাপে ধাপে ক্রমবিকাশ

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারের বিবর্তন তিনটি প্রধান পর্বে বিভক্ত করা যায়:

(ক) প্রাচীন বাংলা (৯৫০–১২০০ খ্রিঃ)

এই সময়কালেই বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ রচিত হয়। এতে দেশি ও তদ্ভব শব্দের প্রাধান্য দেখা যায়। সাধক কবিরা তাঁদের সহজিয়ান ধ্যান, প্রেম ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে গূঢ়ভাবে প্রকাশ করলেও ভাষাটি ছিল জনসাধারণের নিকট উপযোগী।⁵

(খ) মধ্যযুগ (১২০০–১৮০০ খ্রিঃ)

এই সময়ে ফারসি ও আরবি শব্দের প্রবেশ ঘটে। তৎসম শব্দের ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও দেশি ও তদ্ভব ছিল প্রধান। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, মক্তবের গদ্য ও ইসলামি উপদেশমূলক সাহিত্যে আরবি-ফারসি শব্দের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এই যুগের শব্দভাণ্ডারে বৈচিত্র্য, আঞ্চলিকতা এবং ধ্বনিগত অভিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

(গ) আধুনিক বাংলা (১৮০০–বর্তমান)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের লেখনিতে তৎসম শব্দের আধিক্য দেখা যায়। এরপরে কাজী নজরুল ইসলাম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক তৎসম-তদ্ভব-দেশি শব্দের মিশ্রণে এক নতুন রীতির জন্ম দেন। আর স্বাধীনতার পরে বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের আধিক্য বৃদ্ধি পায়।


---

৪. আধুনিক যুগে নতুন শব্দ ও প্রযুক্তির অভিঘাত

আজকের বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে বাংলা ভাষায় নিত্যনতুন শব্দ ঢুকছে। অধিকাংশই ইংরেজি থেকে নেওয়া, আবার কিছু শব্দ বাংলা অর্থান্তরে রূপান্তরিত। যেমন:

কম্পিউটার, ইমেল, ফোল্ডার, ফাইল, লগইন, আপলোড, ডাউনলোড ইত্যাদি প্রযুক্তিভিত্তিক শব্দ

গুগল করা, সেলফি তোলা—যেখানে ইংরেজি ক্রিয়ার বাংলা রূপ তৈরি হচ্ছে


এই শব্দগুলো এখন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, শিক্ষাক্ষেত্র এমনকি সাহিত্যেও জায়গা করে নিচ্ছে। এতে করে বাংলা ভাষা যেমন আধুনিক হচ্ছে, তেমনি প্রশ্ন উঠছে ভাষার মৌলিক চরিত্র রক্ষার দায় নিয়ে।


---

৫. শব্দের বিবর্তনে প্রভাবক কিছু উপাদান

বাংলা শব্দের ক্রমবিকাশে যেসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি:

রাজনৈতিক শাসন পরিবর্তন: মুসলিম শাসন, ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তানি শাসন প্রভৃতি ভাষায় বহিরাগত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটায়।

ধর্মীয় আন্দোলন ও সংস্কার: বৈষ্ণব আন্দোলন, সুফি-সাধক প্রভাব, ব্রাহ্ম আন্দোলন ইত্যাদি ভাষার শব্দচয়নে বৈচিত্র্য এনে দেয়।

শিক্ষা ও সাহিত্য: সংস্কৃত, ইংরেজি ও পাশ্চাত্য সাহিত্যচর্চা তৎসম এবং বিদেশি শব্দের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তোলে।

বিজ্ঞাপন, গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি: এগুলোর কারণে ভাষার শব্দভাণ্ডার দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে।

---

উপসংহার

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার তার অতীত ও বর্তমানের এক অপূর্ব মিলনস্থল। এর প্রতিটি শব্দ শুধু একটি অর্থবহন করে না, বরং একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি এবং একটি মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। শব্দচয়নের এই দীর্ঘ অভিযাত্রা বাংলা ভাষাকে করেছে বহুস্তরীয় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। একদিকে সংস্কৃতের গাম্ভীর্য, অন্যদিকে প্রাকৃতের প্রাণবন্ততা, ফারসি-আরবির রঙিন প্রভাব আর ইংরেজি-প্রযুক্তির আধুনিক স্পর্শ—সব মিলিয়ে বাংলা শব্দভাণ্ডার বিশ্বভাষার দৃষ্টিকোণে এক অনন্য নিদর্শন।

ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার এই স্বরূপ রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সচেতন শব্দচয়ন, মৌলিক শব্দ গঠনে উৎসাহ এবং একবিংশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ভাষার সৃজনশীল অভিযোজন।


---

পাদটীকা

¹ Suniti Kumar Chatterji, The Origin and Development of the Bengali Language, Vol. I, Calcutta University Press, 1926, p. 129
² Sukumar Sen, Bangala Bhashar Itibritta, Ananda Publishers, 2000, p. 88
³ Haraprasad Shastri, Deshi O Tadbhav Shabder Itihas, Asiatic Society Journal, 1902, p. 41
⁴ Gauri Maity, Persian and Arabic Influences on Bengali Language, Visva-Bharati, 1995, p. 52
⁵ Dinesh Chandra Sen, History of Bengali Language and Literature, Calcutta University, 1911, pp. 94

Comments

    Please login to post comment. Login