সাজঘরে তৃষা একদৃষ্টিতে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছিল। আজ তার বিয়ে—আর মাত্র দশ মিনিট পরেই। গায়ে শাড়ি, কপালে টিপ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক—সব ঠিকঠাক। কিন্তু ভেতরের উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা একসাথে কাজ করছিল। তখনই দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
আরিয়ান ঢুকল, চোখেমুখে তাড়াহুড়ার ছাপ।
তৃষা একটু অবাক হয়ে উঠল, "তুমি এখানে? এখন?"
আরিয়ান গম্ভীর গলায় বলল,
"আমি যাচ্ছি... একটা জরুরি কাজ পড়েছে, খুবই ইম্পর্ট্যান্ট—বিজনেস রিলেটেড।"
তৃষার গলা কেঁপে উঠল, "কিন্তু… আর মাত্র দশ মিনিট পরেই তো আমাদের বিয়ে… তুমি কি জানো সেটা?"
আরিয়ান রেগে গিয়ে বলল,
"জানি! আবার মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই! বলেছি তো জরুরি কাজ। আমাকে যেতেই হবে।"
তৃষার চোখ ভিজে উঠল, কাঁপা গলায় বলল,
"তুমি তো সবসময় বলো আমি তোমার সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট… আজও?"
আরিয়ান চোখ ফিরিয়ে নিলো, যেন নিজের ভিতরের লড়াইটা চাপা দিচ্ছে,
"তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি ফিরে এসে সব ঠিক করে নেবো।"
এইটুকু বলেই আরিয়ান সরে গেল। পেছনে পড়ে রইল কাঁপতে থাকা তৃষা, চোখের কোনা বেয়ে ঝরে পড়ল নীরব অশ্রু। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ভেঙে যাচ্ছে… ঠিক যেন সে নিজে ভেঙে যাচ্ছে।
সাজঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তৃষাকে মায়ের হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে আসা হলো। গানের সুর, অতিথিদের হাসি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ—সবই চলছে, কিন্তু তৃষার ভিতরে যেন সব নিস্তব্ধ।
সে চুপচাপ বসল বিয়ের মঞ্চে, লাল রঙা ঘোমটার আড়ালে মুখটা ঢাকা, কিন্তু চোখদুটো শুকিয়ে কাঠ। মনটা বলছে—আরিয়ান আসবে না।
কাজী সাহেব এসে দাঁড়ালেন, কনের পরিচয় জানতে চাইলেন, সময়ের সীমানা টপকে যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা যেন বিষ ঢালছে।
তৃষার বাবার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল।
তিনি আরিয়ান এর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"ভাইজান, আরিয়ান কোথায়? বিয়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, ও এখনো আসেনি।"
আরিয়ান এর বাবা ভ্রু কুঁচকে মোবাইল বের করলেন, একের পর এক ফোন করতে লাগলেন ছেলেকে।
—"আরিয়ান… কোথায় তুই?"
বারবার ডায়াল করেও কোনো সাড়া নেই।
একসময় ফোনটা কেটে গেল, পর্দায় ভেসে উঠল—"Switched Off"
তৃষার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চারপাশের ফিসফাস যেন তলোয়ারের মতো বিঁধে যাচ্ছে।
"কি বলো! বরই আসছে না!"
"এত সুন্দরী মেয়ে! কি দুর্ভাগ্য তার!"
তৃষা সব শুনছে—কিন্তু কোনো উত্তর নেই তার কাছে। ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, চোখ ভিজে গেছে, কিন্তু সে কিছুতেই কাঁদছে না। ঠোঁট কামড়ে বসে আছে।
এই মুহূর্তে—অপমান, ক্ষোভ, বেদনা—সব মিশে একটা কঠিন অভিমান গড়ে তুলছে তৃষার মনে।
আর হৃদয়ের গহীনে গেঁথে যাচ্ছে একটাই প্রশ্ন—
"যে আজকের দিনে আমার হাত ছাড়ল, সে কি কখনওই আমাকে ভালোবেসেছিল?"
মঞ্চের চারপাশে চাপা গুঞ্জন যেন বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
"এই মেয়েরা না, অতিরিক্ত স্বাধীনতা পেলে এমনই হয়..."
"সেই যে, দেখিনি ওর কলেজে কত ছেলের সঙ্গে দেখা করত!"
"বর তো পালিয়েছে—অবশ্য দোষ তো মেয়েটারই!"
প্রতিটি কথা যেন ছুরি হয়ে বিঁধছে তৃষার বুকের মধ্যে। সে চুপচাপ বসে আছে, মাথা নিচু করে, যেন নিজেকেই দোষী ভাবছে এখন। অথচ জানে—এই অপমান তার প্রাপ্য নয়।
এই মুহূর্তে মিস্টার আমান একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কোনো কথা তার কানে ঢুকছিল না। সেও যেন হতবাক।
তার চোখ তৃষার দিকে গেল—এই মেয়েটিই কিছুক্ষণ আগে তার দাদির হাতে সোনার চেইন নিয়েছিল, মাথা নিচু করে সম্মান দেখিয়েছিল, যার চেহারায় ছিল অনাবিল সৌন্দর্য আর বিনয়। এখন সেই মেয়েটি অপমানিত, নিঃশব্দ, কাঁপছে—কিন্তু এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি।
মিস্টার আমান ফোনটা বের করল—আরিয়ানকে আবার কল দিল।
Ring… Ring… No Answer.
পাশ থেকে আমানের পিএ এগিয়ে এসে বলল, "Sir… ফোন বন্ধ, এখন কিছু করা যাবে না।"
কিছুক্ষণের নীরবতার পর আমান দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
"Enough!"
তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, চারপাশ থমকে গেল।
"এই মেয়েটিকে কেউ দোষারোপ করার আগে, একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন—বর কেন পালালো? যদি পালাতে হয়, তবে আগেই বলতে পারত। মেয়েটির তো কোনো দোষ নেই। বরং এভাবে অপমানিত করে যাওয়াটাই সবচেয়ে কাপুরুষতা।"
এই কথাগুলো তৃষার বাবাও শুনছিলেন, তার মুখটা ভেঙে পড়েছে, কিন্তু চোখে কৃতজ্ঞতা।
তখন আমানের দাদি পাশে এসে বললেন,
"এই মেয়েটি আমার পছন্দ হয়েছে। আমি ওকে আমার ঘরে আনতে চাই… আরিয়ান যদি না আসে।"
চলবে.......